গন্তব্য ঢাকা-‘আর ঢাকায় থাকতে চাই না’ by শর্মিলা সিনড্রেলা

মাথার ওপর সূর্যটা যেন আরও বেয়াড়া হয়ে উঠছে দিনে দিনে। কিছুতেই বারণ শোনে না। দিনকে দিন হয়ে উঠছে আরও বেশি উত্তপ্ত; যেন জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড। পথচারীর তো তৃষ্ণায় প্রাণ যাওয়ার জোগাড়! তবে এই তপ্ত রোদই হাসি ফোটায় কিছু কিছু মানুষের মুখে। এই যেমন হাসিম উদ্দিনের কথাই বলা যাক; রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বিক্রি করেন


শরবত। পেঁপে, কলা, বেল, আপেল, কমলা—সব ধরনের ফল একসঙ্গে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করেন। সঙ্গে মিশিয়ে দেন কয়েক টুকরো ঠান্ডা বরফ। এক গ্লাস শরবত খেলে এই তীব্র রোদে পথচারীর তৃপ্তি আসে। তাই গনগনে রোদে কিছুটা জটলা দেখা যায় শরবত বিক্রেতার আশপাশে। কিন্তু যদি প্রকৃতি হয় ঠান্ডা, তাহলে হাসিম উদ্দিনকে পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ক্রেতার জন্য।
গ্রাম ছেড়েছেন অনেক বছর। তাই বলে ঢাকাকেও ঠিক মেনে নেওয়া হয়নি। তাই এক মাস, দুই মাস পর; আবার কখনো কখনো সুযোগ হলেই চলে যান গ্রামে। গ্রামেই তো সবাই থাকে। তাই ঢাকা আরও বেশি অসহ্য হয়ে পড়ে কয়েক দিন গেলেই। হাসিম উদ্দিন বলেন, ‘গ্যারামে অনেক ভালো লাগে। ধরেন, ওখানে ঘুরতে-ফিরতেও ভালো লাগে। তয় আয়-ইনকাম হয় না তো, তাই ঢাকায় থাকতে হয়। আমার এই শরবত বিক্রি হয় কেবল গরমের সিজনে। শীত আইলে কেউ খাইতে চায় না। তখন অন্য কিছু করন লাগে। কহনো গ্রামে চলে যাই। খেতে কামকাজ করি। আবার প্যাটে টান পড়লে ঢাকায় আহি। রিশকা চালাই।’
হাসিম উদ্দিনের বয়স তখন ১০। পড়াশোনা তাঁকে দিয়ে হয়ে ওঠেনি। তাই একদিন ভাতিজা সালামের সঙ্গে চলে এলেন ঢাকায়। তার পরই লিপ্ত হওয়া জীবনসংগ্রামে। ‘মনে হয় পড়াশুনা করলে ভালোই হতো। ভালো কোনো চাকরি করতে পারতাম। মা, বউ, বাচ্চা—ওগো জন্যে অনেক কিছু করতে মন কয়; পারি না টাকার অভাবে। এহন ছেলেমেয়েগুলারে পড়াশুনা করাব। তাইলে আমি খুশি।’
হাসিম উদ্দিনের বাবা কসুম উদ্দিন মারা গেছেন ১০ বছর আগে। মা নূরজাহান থাকেন সেই গ্রামে। আছে ছোট ছোট ভাইবোন। ‘ওগো কথা খুব মনে হয়। ওরা কেউ ঢাকা পছন্দ করে না। আমিও চাই না, ওরা ঢাকায় আসুক। আমি নিজেই আর ঢাকায় থাকতে চাই না।’ গ্রামটা অনেক বেশি প্রিয় হাসিম উদ্দিনের কাছে। এক মাস পর বাড়ি গেলে মা আর বউয়ের নতুন নতুন খাবার খাওয়ানোর ধুম পড়ে যায়। ‘বাড়িত গেলেই পারুল (স্ত্রী) আর মা দুজনে মিলে অনেক মজার মজার খাবার তৈয়ার করে। জোর করে করে খাওয়ায়।’
গ্রাম শব্দটি বললেই চোখের সামনে ভেসে আসে একটি ছবি; যেখানে ছোট ছোট কয়েকটি বাড়ি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। অনেকগুলো গাছ এখানে-সেখানে। সামনে একটা বড় খেত, যেখানে ফলে আছে কোনো মৌসুমি ফসল। আর একপাশে একটু দূর দিয়ে বয়ে গেছে একটা খরস্রোতা নদী। হাসিম উদ্দিনের গ্রামের বর্ণনাও অনেকটা এই রকম। পাশ দিয়ে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্র নদও অনেক টানে হাসিম উদ্দিনকে। আরেকটা জিনিস হাসিম উদ্দিনকে গ্রামের দিকে টানে, সেটি হলো ক্লাব। ‘আমরা অনেক দিন আগে গ্রামে একটা ক্লাব করছিলাম। অন্য কোনো কামে না, কেবল সবাই সেহানে একসাথে আড্ডা দেবার জন্য। এখনো সেই ক্লাবটা আছে। আমরা মাসে মাসে ৫০ টাকা করে চাঁদা দিই ঘরভাড়া আর বিদ্যুৎ-বিল দেবার জন্য। যখনই গ্যারামে যাই, তহন ওই খানে আমার বন্ধু লোকমান, আমানুল্লাহ, শিপলুদের সাথে আড্ডা দিই। এইটা অনেক ভালো লাগে।’
তেজগাঁও শিল্প এলাকার তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনাল বায়তুন নূর জামে মসজিদের পাশে প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত শরবত বিক্রি করেন হাসিম উদ্দিন। অবশ্য বৃষ্টি হলে সেদিনের মতো বেচা-বিক্রি বন্ধ থাকে। তিন মাস থেকে এখানে ব্যবসা করেন তিনি। আগে ব্যবসা করতেন সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে, অন্য এক লোকের সঙ্গে। পরে ভাইয়ের মেয়ের জামাইয়ের সঙ্গে এই কাজ শুরু করলেন। প্রতিদিন এক হাজার টাকার ফল এনে আজকাল দিনের শেষে দুজনের লাভ থাকে প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। এই নিয়েই চলতে হয় তাঁকে। বাড়ির বড় ছেলে, তাই দায়িত্ব অনেক বেশি। মাসের শেষে বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাতে হয়। আর বাড়িতে গেলে স্ত্রী, মা ও তিন ছেলেমেয়ের জন্য কিছু নিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। এদিকে ঢাকায় থাকতে নিজের কিছু খরচ তো লাগেই। আর প্রতিনিয়ত চোখে ভাসে প্রিয়জনের মুখ। তাই আর ঢাকায় থাকতে ইচ্ছে করে না। কিছু টাকা জমাতে পারলেই গ্রামে চলে যাওয়ার ইচ্ছা হয়। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের সেই ঘাঘরা গোপালপুর নামের গ্রামটিতেই নিজের ছোট্ট-সুখের নীড়ে সবাইকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে থাকতে চান হাসিম উদ্দিন।
শর্মিলা সিনড্রেলা

No comments

Powered by Blogger.