সহজ-সরল-অজানা গন্ধের আশঙ্কায় আমি ও আমরা by কনকচাঁপা

গন্ধের প্রতি আকর্ষণ মানুষের প্রায় আদিম কাল থেকেই। যখন তারা জানল যে তারা মোটামুটি একটা সত্তা, তখন থেকে নিজেকে বাকল-ছালপাতা দ্বারা আবৃত করার প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গেই তারা গাছগাছালি, ফুল-ফল থেকে প্রাকৃতিক সুগন্ধি দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে সচেষ্ট হলো।


সুর-চিত্রাঙ্কনের মতোই এই সুগন্ধি মানবজাতির একটি মৌলিক উপসঙ্গ। আর আমি মনে করি যে একটা মানুষের স্বভাব, ধরন, পছন্দ, রুচি- সব বোঝা যায় তার থেকে নিঃসৃত গন্ধ থেকে। সেটা ব্যক্তিগত ও ব্যবহারকৃত সুগন্ধির সমন্বয়ে নির্গত 'বায়বীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য' হয়ে দাঁড়ায়। সংক্ষেপে বললে গন্ধেই তার পরিচয়- এমনটাই দাঁড়ায়। বিশাল পরিধির এই সুগন্ধিকে (পারফিউম) মোটামুটি সাত ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- ফ্লোরাল, ওরিয়েন্টাল, সাইট্রাস, সাইপ্রে, ফুজাইর, ফ্রুটি, অ্যাকোয়া। নামেই মোটামুটি বোঝা যায় তাদের গন্ধের ভিন্নতা সম্পর্কে। গোলাপ, বেলি, ল্যাভেন্ডার, কার্নেশান- এমন বহু ফুলের নির্যাস থেকে 'ফ্লোরাল' বংশীয় সুগন্ধি তৈরি হয়। নারীদেরই একচেটিয়া পছন্দের তালিকায় আছে এই সুগন্ধিগুলো। শীতের উষ্ণতা, বন্যতা, স্পর্শকাতর অনভূতি পছন্দের তালিকায় যাঁরা ধরা দেন, তাঁরা ব্যবহার করেন ওরিয়েন্টাল বংশীয় সুগন্ধি। সতেজতায় উজ্জীবিত থাকতে, কোনো আরোপিত কড়া নির্দিষ্ট গন্ধে আবদ্ধ থাকতে চান না যাঁরা, তাঁদের প্রথম পছন্দ সাইট্রাস বংশীয় সুগন্ধি। মাটির সঙ্গে ঝোপঝাড়, শৈবাল, ঘন নিবিড় বনের উষ্ণ ঝাঁঝালো গন্ধ আকৃষ্ট করে যাদের, সেই অজানাকে জানতে চাওয়া মানুষ পছন্দ করে সিপ্রে বা সাইপ্রাস বংশীয় সুগন্ধি। এটাকে স্পাইসিও বলা যায়। শান্তশিষ্ট, নম্র কিন্তু স্পষ্ট চরিত্রের নারীরা পছন্দ করেন তরতাজা ভেষজ শৈবাল আচ্ছাদিত ফার্নের উদ্দাম কিন্তু সূক্ষ্ম গন্ধের অধিকারী ফুজাইরের আকর্ষণ অমোঘ। ফ্রুটি বংশীয় সুগন্ধি বলাই বাহুল্য যে ফলের গন্ধের সংমিশ্রণ। লেবু, কমলা, তরমুজ, পিচ ছাড়াও ভ্যানিলা, চকোলেট, কফি ইত্যাদি গন্ধেরও সুগন্ধি এতে সংযুক্ত। প্রধানত তরুণরাই এটা বেশি ব্যবহার করে। একে ফ্রুটি ফুডিও বলা যায়। সাগরের তাজা ও ভেজা বাতাস, দুরন্ত ঢেউ, শৈবাল, কিছু জলজ ফুলের উদ্দাম গন্ধকে একত্র করে অ্যাকোয়া সুগন্ধির ধারা তৈরি করা হয়। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, মানুষ তার মনের অজান্তেই এসব বিভিন্ন গন্ধের-ধর্মের সুগন্ধি ক্রয় করে। তাতে তার পছন্দ, শ্রেণী, চরিত্র, মোটামুটি ফুটে ওঠে। আমার কাছে সুগন্ধি হলো অতীত। জীবনের অনেক অতীত স্মৃতিচারণার সময়ে আমি গন্ধগুলো নাকে পাই, আবার অনেক গন্ধ নাকে পেলে সেই সম্পর্কীয় অতীত মনে পড়ে। বুদ্ধির বয়স থেকেই দেখেছি আমার মা 'কান্তা' সুগন্ধি মাখেন। এ ছাড়া নিত্য ব্যবহার্য প্রসাধনীতে ছিল পন্ডস স্নো, ক্রিম আর তিব্বত পমেড। দুপুর বেলা গোসল সেরে বিশাল দৈর্ঘ্যের চুল শুকানোর জন্য রোদে যখন বসতেন, তখন তাঁর দৈনিক প্রসাধনীর গন্ধ ও তাঁর সার্বিক সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম নাহ্ এ আমার মা হলেও কাল রাতে ননীবুজি যে পরীর গল্প বলেছেন আসলে আমার এই মা-ই সেই পরী। এখনো আমার মাকে আমার সেই পরীর মতোই লাগে। কিছু দিন আগে একটা সুগন্ধি কিনে এনে মায়ের নাকে দিয়ে বললাম বলেন তো এটা কিসের গন্ধ? আম্মা কেঁদে ফেললেন- বললেন এটা আমার মায়ের চুলের গন্ধ। আমি তাজ্জব। এভাবে মনে থাকে? থাকে- মানুষের অতীতের ওপরই তার জীবন দাঁড়িয়ে থাকে, জীবনকে খুঁজে পেতে গন্ধের আশ্রয় নিতে হয়। সুগন্ধিপ্রিয় আমার বাবা চলে যাওয়ার সময় কিছু কর্পূর, আতর মেখে শক্ত খাটিয়ায় চুপটি করে শুয়েছিলেন। তাঁকে ভাবতেই কর্পূরের মন খারাপ করা গন্ধ আমার চোখ ভাসিয়ে দেয়। সারা জীবন কড়া সুগন্ধি আতর মেখে বাবা শেষে আমার নাকে কর্পূর ছিটিয়ে দিয়ে একটা নতুন বিভাজন আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন! কিন্তু যে আত্মীয়স্বজন, মা-বাবাকে তাঁর বস্তাবন্দি ছেলের লাশ মুখে কাপড় গুঁজে দেখতে, বমি আটকে দেখতে হয়, তাঁরা তাঁর ছেলেকে কিভাবে মনে করবেন? মনে করতেই তো ওই গলিত লাশের গন্ধ তাঁদের আক্রমণ করবে! লাশের গন্ধে আতঙ্কিত হতে থাকা এই আমরা ফুলের গন্ধে কখনো উদ্বেলিত হতে পারব তো? আমার নাক খুব সূক্ষ্ম গন্ধ পায়। নরসিংদী বৃষ্টি হলে ঢাকায় বসে আমি টের পাই মাটির সোঁদা গন্ধ এবং বৃষ্টি হবে কিছুক্ষণ পরেই। সত্যি! সেই আমি, আমরা সবাই কি কোনো নতুন গন্ধ পাচ্ছি? এই ফাগুনে মাতাল শিমুল অথবা আসছে বর্ষার বেলী ফুলের আতর গন্ধের বদলে কি আমরা গলিত লাশ ও বারুদের সংমিশ্রণে নতুন কোনো বংশীয় গন্ধের সন্ধান পাব? এমনটা আমরা চাই না।
লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.