শেকড়ের ডাক-তীব্র ভূমিকম্পে ঢাকায় 'কেয়ামত' নেমে আসবে by ফরহাদ মাহমুদ

ভূমিকম্প নয়। এমনকি টর্নেডো বা কালবৈশাখীও নয়। তবুও রাজধানীতে একের পর এক ভবন ধসের ঘটনা ঘটছে। কিছুদিন আগে বেগুনবাড়ীতে একটি পাঁচতলা ভবন একদিকে কাত হয়ে পড়ে গেল। ভবনের নিচে চাপা পড়ল আরো কয়েকটি কাঁচা ঘর। মারা গেল আটজন, আহত হলো ২২ জন।


ভবনের ভেতরে কয়েক দিন আটকে থাকল অর্ধশতাধিক লোক। ঠিকমতো উদ্ধার তৎপরতা চালানো যাচ্ছিল না। কারণ গলিটির এমন অবস্থা যে সেখানে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঢুকতে পারছিল না। এটি শুধুু বেগুনবাড়ী নয়, ঢাকা মহানগরীর বেশির ভাগ এলাকারই একটি অতি পরিচিত চিত্র। অথচ এ রকম গলির ভেতরেও রয়েছে বহু 'হাইরাইজ' ভবন। এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের পর অবস্থা কী হতে পারে_কল্পনায় তা একটু দেখার চেষ্টা করুন।
বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হঠাৎ ভবন ধসে পড়ার ঘটনা আগেও অনেক ঘটেছে। বেগুনবাড়ীতেই বছর কয়েক আগে ফিনিঙ্রে একটি ভবন ধসে পড়েছিল। সাভারের স্পেকট্রাম ভবন ধসে বহু লোক হতাহত হয়েছিল। শান্তিনগর, নারিন্দা, কল্যাণপুরসহ বেশ কিছু স্থানে বহুতল ভবন একদিকে কাত হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প ছাড়াই ভবনে ফাটল তৈরি হতে দেখা গেছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এসব ভবন সবার আগে ধসে পড়বে। এ ক্ষেত্রে নির্মাণ প্রকৌশলীদের উত্তর একটিই_নির্মাণত্রুটি। যথাযথভাবে মাটি পরীক্ষার পর প্রয়োজন অনুযায়ী ভিত্তি গড়ে তোলা হয়নি। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা তো নয়ই, এমনকি ভবন নির্মাণের নূ্যনতম নিয়মকানুনও মানা হয় না। অনেকের মতে, রাজধানীতে এ রকম ভবনের সংখ্যাই বেশি। খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী সংসদে বলেছেন, রাজধানীতে ৭ মাত্রার কাছাকাছি ভূমিকম্প হলেও ৭০ হাজারের বেশি বাড়িঘর ধসে পড়বে। তিনি অবশ্য বলেননি, সে ধরনের ভূমিকম্পের পর উদ্ধার তৎপরতা চালানোর জন্য বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত অথবা কত দিন লাগবে। তবে বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, সে রকম পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি এখন পর্যন্ত নেই বললেই চলে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত 'ভূমিকম্প মোকাবিলায় সচেতনতা ও করণীয়' শীর্ষক এক সেমিনারেও বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, ঢাকার প্রায় সব ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৬ বা ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের ৭২ হাজার বাড়িঘর বিধ্বস্ত হবে।
২০০৮ সালের ১২ মে চীনের সিচুয়ান প্রদেশে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। বলতে গেলে, মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই তারা মূল উদ্ধার তৎপরতা সম্পন্ন করেছিল। ভূমিকম্পবিধ্বস্ত এলাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল ঢাকার তুলনায় অনেক কম। সেখানকার অবকাঠামোও ছিল অনেক বেশি টেকসই। তার পরও সেখানে প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় এক লাখে পেঁৗছেছিল। আর ঢাকায় একই মাত্রার ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা সাত বছরেও সম্পন্ন করা যেত কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাৎক্ষণিক মারা যাওয়া লোকের সংখ্যাই হবে অনেক বেশি। ভেতরে আটকে পড়া লোকজন খাদ্য, পানি ও চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে।
এর আগে সাভারের স্পেকট্রাম ভবন, বেগুনবাড়ীর ফিনিঙ্ ভবন, র‌্যাংগস ভবনের হঠাৎ ধসে পড়া কয়েক তলার ধ্বংসস্তূপ অপসারণের সময়ই এর প্রমাণ পেয়েছি। একেকটি ভবনে উদ্ধারকাজ সম্পন্ন করতে মাসাধিককাল লেগে গিয়েছিল। দুর্যোগমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী যদি ৭২ হাজার ভবনও ধসে পড়ে, তাহলে বর্তমান ক্ষমতায় তাতে ৭২ হাজার মাস লাগবে। কয়েক প্রজন্ম পার হয়ে যাবে। আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় উদ্ধার কাজে কিছুটা গতি আসতে পারে। কিন্তু যেখানে উদ্ধারকাজের যন্ত্রপাতিই পেঁৗছানো যাবে না, সেখানে উদ্ধারকাজ চলবে কিভাবে? চীনে তো দ্রুত আহতদের হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমাদের হাসপাতাল ভবনগুলো টিকবে কি না_তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় আছে। তদুপরি নিমতলীর অগি্নকাণ্ডের পরই তো দেখেছি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কী ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। আর যেখানে লাখ লাখ লোক আহত হবে, সেখানে বিপুলসংখ্যক আহত মানুষের চিকিৎসার সামান্যতম ব্যবস্থাও কি আমাদের আছে?
ঢাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ ভূতাত্তি্বকভাবেই ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। ঢাকাও ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের মধ্যেই রয়েছে। আর আমাদের অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ড ঢাকাকে অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। আগেই বলেছি, নির্মাণ বিধিমালা না মেনে দুর্বল অবকাঠামো তৈরি, অপরিসর রাস্তা, খালবিল ভরাট করে বাড়িঘর নির্মাণ ইত্যাদি ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দেবে। আরেকটি বিষয় ঢাকার জনজীবনের জন্য আত্মঘাতী হচ্ছে। তা হলো, অতিরিক্ত পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন। রাজধানীতে এখন প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে ওয়াসা। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশই হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি। অন্যদিকে খালবিল সব ভরাট হয়ে যাওয়ায় ভূগর্ভে পানি প্রবেশ করতে পারে না। ফলে প্রতিবছর পানির স্তর তিন থেকে পাঁচ মিটার পর্যন্ত নেমে যাচ্ছে। তিন মিটার করে ধরলেও গত ১০ বছরে পানির স্তর নেমেছে ৩০ মিটার। তার অর্থ, ভূগর্ভের এই ৩০ মিটার স্তরে পানি থাকার স্থানগুলো শূন্য রয়েছে। ভূমিকম্পের প্রচণ্ড ঝাঁকুনির সময় মাটিতে শূন্যস্থান থাকবে না। আশপাশের মাটি ভেঙে সেই শূন্যস্থান পূরণ করবে। এতে ঢাকার বহু অংশে ব্যাপক ধস নামতে পারে। আর সেসব এলাকার বাড়িঘর, রাস্তা, অবকাঠামো কিছুই অক্ষত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। এতে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বেড়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা অনবরত ভূগর্ভের পানির বদলে ভূপৃষ্ঠের বা আশপাশের নদীর পানি বেশি ব্যবহারের তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কোনো সরকারই সেদিকে খুব একটা কর্ণপাত করছে না। রাজধানীবাসীর বর্ধিত পানির চাহিদা মেটাতে এখনো নতুন নতুন গভীর নলকূপই স্থাপন করা হচ্ছে।
রাজধানীতে নিয়মনীতি না মেনে দুর্বল ভবন তৈরি হয় কিভাবে? ভবন তৈরির নকশা অনুমোদন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বাস্তবায়ন এবং নির্মাণকাজ ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা দেখার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউকের। সমস্যাটা এখানেই। অভিযোগ আছে, এখানে ঘুষ বা টাকার বিনিময়ে দিনকে রাত করা যায়। টাকায় নকশা পাস হয়। টাকায় নকশা পাসের দিনক্ষণ চলে যায় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা প্রণয়নের আগে। আর নির্মাণ তদারকির দায়িত্ব পালন করা হয় পকেট ভারী করার মাধ্যমে। ফলে খোদ রাজধানীতে অহরহ এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন তৈরি হচ্ছে।
এ দেশে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পটি হয়েছিল ১৮৯৭ সালে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ১। সিলেটের ডাউকি ফল্ট সিস্টেমে উৎপত্তি হওয়া এ ভূমিকম্পে ময়মনসিংহ, রংপুর, ঢাকাসহ অনেক স্থানেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ঢাকায় সে সময় যত ইটের তৈরি ভবন ছিল, প্রায় সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৫০ সালে আসামে ৮ দশমিক ৬ মাত্রার আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। তার প্রভাবও আমাদের দেশে পড়েছিল। ১৯১৮ সালে সিলেটের শাহজীবাজারে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার একটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল, যাকে শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এটির উৎপত্তি হয়েছিল শাহজীবাজার ফল্ট থেকে। এ ছাড়া ১৯৩০ সালে কুচবিহারের ধুবরি ফল্টে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পটি ছিল ৭ দশমিক ১ মাত্রার। এই ফল্টের প্রভাববলয়ের মধ্যে রয়েছে আমাদের রংপুর-কুড়িগ্রাম অঞ্চল। ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল বগুড়া অঞ্চলে। এটি 'বেঙ্গল আর্থকোয়েক' হিসেবে খ্যাত। এ ছাড়া ১৮৬৯ সালে 'কাছার ভূমিকম্প' নামে খ্যাত আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল ভারতের ত্রিপুরায়। এটির উৎপত্তি ত্রিপুরা ফল্ট সিস্টেমে, যার দ্বারা আমরাও প্রভাবিত হই। এ ছাড়াও আমাদের কয়েকটি ফল্ট সিস্টেম রয়েছে, সেগুলো হলো : চট্টগ্রাম ফল্ট সিস্টেম, রাজশাহীর তানোর ফল্ট সিস্টেম, সীতাকুণ্ড-টেকনাফ ফল্ট সিস্টেম এবং ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ফল্ট সিস্টেম। কাজেই যেকোনো ফল্ট সিস্টেমে যেকোনো সময় অধিক মাত্রার ভূমিকম্প বা বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। উৎপত্তিস্থলের কাছাকাছি ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বেশি থাকলেও মাটির গঠনগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত দূরেও ভূমিকম্পের তীব্রতা বা ক্ষয়ক্ষতি অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি হতে পারে। আগেই বলেছি, ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতে পারে অতিরিক্ত ঘনবসতি এবং আমাদের নানা অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের কারণে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৩৫ শতাংশ এবং ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৪৩ শতাংশ বাড়িঘর ধসে পড়বে।
অন্য এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরীর ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বাড়ি খারাপ মাটিতে তৈরি হয়েছে। উপযুক্তভাবে অর্থাৎ থরে থরে দুরমুজ করে বা মাটি বসিয়ে ভরাট করা হয়নি। অনেক হাউজিং এলাকায় কোনো রকমে মাটি ভরাট করে প্লট বানিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আর যিনি কেনেন, তিনি এসেই বাড়িঘর বানাতে শুরু করে দেন। নিয়মমতো পাইলিংয়ের মাধ্যমে মজবুত ভিত্তি করা হলেও ঝুঁকি অনেক কমানো যেত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা করা হয় না। ব্যক্তিগতভাবে যাঁরা বাড়ি করেন, দেখা গেছে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের মতো করে বাড়ি তৈরি করেন।
ভূমিকম্প প্রতিরোধী ডিজাইন বা নকশার ধারই ধারেন না। আবার অনেকে নকশা করালেও বানানোর সময় তা মানেন না। ভূমিকম্পের ভয়াবহ পরিণতি থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের নিয়ম মানতেই হবে। সরকারকে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর স্বার্থ চিন্তা করে অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে হবে। পাশাপাশি, ভূমিকম্প ও পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.