চারদিক-বই, না ভিডিও গেমস? by শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
মহানগরের গণ্ডিবদ্ধ জীবনে বেশির ভাগ শিশুর অবসর কাটে একঘেয়েমির ভেতর। এখানে এত বড় মাঠ নেই যে একটি শিশু দিগন্ত ছোঁয়ার প্রলোভনে মিছেমিছি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটবে। সরষে খেতের পাশে সবুজ ঘাসে শুয়ে বুনো ঘ্রাণে বুঁদ হওয়ার সুযোগ নেই তাদের।
নেই দূর আকাশে ডানা মেলা চিলের অলস উড়ে বেড়ানো দেখতে দেখতে কল্পনার আকাশ বাড়ানোর উপায়।
রাজধানীতে ঘরের বাইরে বেশির ভাগ শিশুর খেলার মাঠ হচ্ছে বাড়ির পাশের গলিপথ। অবসরে সেখানে ফুটবল বা ক্রিকেট নিয়ে মাতে তারা। এতে একদিকে পথচারীরা যেমন বিড়ম্বনায় পড়েন, তেমনি বড়দের বকুনি-দাবড়ানি হজম করতে হয় শিশুদের।
এ ছাড়া ঘরের ভেতর বেশির ভাগ শিশুর অবসর কাটে টিভি দেখে বা কম্পিউটারে গেমস খেলে। সচ্ছল পরিবারে শিশুদের বড় একটা অংশ এই গেমস নিয়ে পড়ে থাকে।
ইংল্যান্ডের ডেভনের বাইডফোর্ডের দাতব্য প্রতিষ্ঠান উইংস সাউথ ওয়েস্ট গেমসে মত্ত শিশুদের নিয়ে উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছে। তারা বলেছে, গেমসের নেশা ঘুম কেড়ে নিচ্ছে শিশুদের। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে আবেগহীন জড় পদার্থে পরিণত হচ্ছে তারা।
উইংস সাউথ ওয়েস্টের সমীক্ষায় জড়িত কর্মকর্তা পল বাউজার বলেছেন, ‘যেসব শিশু গেমস নিয়ে পড়ে থাকে, তাদের মধ্যে ঘোর লাগা অসাড় ভাব লক্ষ করা গেছে। না ঘুমিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলার কারণেই এটা হচ্ছে। এটাকে ভাবালুতা না আসক্তি, কী বলব?
অপর দাতব্য সংস্থা কিডস অ্যান্ড মিডিয়ার কর্মকর্তা রবার্ট হার্ট ফ্লেচার বলেন, ‘যেসব শিশু গেমস নিয়ে পড়ে থাকে, তাদের আচরণগত পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি।’ তাঁর মতে, এসব শিশুর প্রকৃত সহানুভূতি ও সমবেদনা কমে গেছে। অনেক অভিভাবক এ ক্ষেত্রে যুক্তি দেখাতে পারেন, কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকবে না তো কী করবে? শিশুপার্কসহ হাতেগোনা কয়েকটি জায়গা ছাড়া আর কী আছে যে ওরা গিয়ে একটু নতুনত্বের স্বাদ নেবে?
সমাধান যে নেই, তা নয়। বই-ই শিশুদের জন্য অবসর কাটানোর ভালো উপায় হতে পারে। হতে পারে সীমাবদ্ধতার মধ্যে নতুনত্বের অফুরান ভান্ডার। এতে তাদের আবেগ-অনুভূতি ভোঁতা না হয়ে বরং তীক্ষ হবে। শিশুতোষ নানা বিষয়ে ভরা একটি মানসম্পন্ন পত্রিকা শিশুকে দিতে পারে এমন প্রাণসঞ্চারী খোরাক, যা পড়ে শিশু গেমসের উদ্ভট চরিত্রগুলো নিয়ে অবাস্তব কিছু না ভেবে বুনতে পারে এমন স্বপ্নের জাল, যা জাতিকে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ উপহার দেবে।
তবে এখানেও প্রশ্ন। পথ দেখাবে কে? শিশুরা বড়দের অনুকরণ বা অনুসরণ করে শেখে। আর শেখে চোখের সামনে যা ঘটছে, তা দেখে। তাদের হাতে বই তুলে না দিলে বা বইয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি না করলে তারা তো পড়বে না।
শিশুদের মানসিক বিকাশে পাঠ্যবইয়ের বাইরে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের ভূমিকা অসামান্য। এ ক্ষেত্রে বাধা কিন্তু কম শক্ত নয়।
শিশুদের মোহাবিষ্ট করতে আরও প্রস্তুত স্যাটেলাইট টিভির একগাদা অনুষ্ঠান। এক সন্ধ্যায় একুশের গ্রন্থমেলায় দেখেছিলাম, বইয়ের স্টলের সামনে বাবার কোলে বসা এক শিশু জিজ্ঞেস করছে, ‘ডরিমনের (জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র) বই আছে?’ মেলায় শিশুতোষ বইয়ের মধ্যে এ ধরনের বই অনেক ছিল। শিশুরাও ঘুরেফিরে এসব বইয়ের দিকে ঝুঁকেছে। বোঝা যায়, স্যাটেলাইট টিভির প্রভাব কোথায় পৌঁছেছে!
রাজধানীতে গত বছরের মার্চে ছোটদের বই নিয়ে মেলার আয়োজন করে শিশু একাডেমী। একদিন সেখানে ঘণ্টা দুয়েক ছিলাম। এই সময়ের মধ্যে এমন একজন শিশুর দেখা মেলেনি, যে মেলা দেখতে বা বই কিনতে এসেছে। বাবা-মা নিয়ে এলে তবেই না ওরা আসবে।
ছোটদের বই বা পত্রিকার ব্যাপারে এসব ঘটনা নতুন নয়। আমাদের দেশে ছোটদের কোনো পত্রিকা টিকতে পারে না। পৃষ্ঠপোষকতা, ক্রেতা ও বিজ্ঞাপনের অভাবে হারিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর ঢাকঢোল পিটিয়ে শিশু-কিশোরদের জন্য অনেক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগই কিছুদূর দৌড়ে হারিয়ে গেছে। হাতেগোনা কয়েকটি যাও বা টিকে আছে, ধুকপুকি অবস্থা।
মনে পড়ে, শৈশবে কিশোর বাংলা নামের একটি ট্যাবলয়েড অনেক শিশু-কিশোরের মন জয় করে নিয়েছিল। এখনকার স্বনামখ্যাত অনেক কবি-সাহিত্যিক এই পত্রিকায় লিখেছেন। গুণেমানে কমতি ছিল না পত্রিকাটি। প্রতি সপ্তাহে উন্মুখ থাকতাম পত্রিকাটির জন্য। এই ভেবে গর্ববোধ করতাম—আমাদেরও পত্রিকা আছে! হঠাৎ একদিন হারিয়ে গেল সেই পত্রিকা।
এরপর ছোটদের কত পত্রিকা সাড়ম্বরে বের হয়ে চুপিসারে বন্ধ হয়েছে, এর কোনো হিসাব নেই। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ঘটা করে দুটি মাসিক পত্রিকা বের হলো। সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হলো কিশোর পত্রিকা, পাক্ষিক তারকালোক-এর তৎকালীন প্রতিষ্ঠান থেকে বের হলো কিশোর তারকালোক। দুটি পত্রিকায়ই নবীন-প্রবীণ অনেক কবি-সাহিত্যিকের লেখা প্রকাশিত হতো। গল্প, কবিতা, ছড়ার পাশাপাশি ছাপা হতো মনকাড়া কার্টুন, কমিক, ফিচার। পত্রিকা দুটির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ছিল। তখন জেনেছি, পত্রিকা বিক্রি এবং বিজ্ঞাপন পাওয়া নিয়ে কী হিমশিম অবস্থা। অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে পত্রিকা দুটির প্রকাশনা।
আমরা কথায় কথায় বলি, শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। সে অনুযায়ী, বড়দের চেয়ে বরং ওদেরই মানসম্পন্ন পত্রিকা ও বইয়ের প্রয়োজন বেশি। শিশুরা যত জানবে, যত শিখবে, তা ভবিষ্যতে জাতির উন্নয়নে কাজে লাগবে। কাজেই শিশুকে দামি খাবার ও খেলনা কিনে দেওয়ার চেয়ে তাদের উপযোগী বই ও পত্রিকা কিনে দেওয়া বেশি প্রয়োজন। অথচ এখানেই অনেকের গড়িমসি। কেন? তা তাঁরাই জানেন।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
রাজধানীতে ঘরের বাইরে বেশির ভাগ শিশুর খেলার মাঠ হচ্ছে বাড়ির পাশের গলিপথ। অবসরে সেখানে ফুটবল বা ক্রিকেট নিয়ে মাতে তারা। এতে একদিকে পথচারীরা যেমন বিড়ম্বনায় পড়েন, তেমনি বড়দের বকুনি-দাবড়ানি হজম করতে হয় শিশুদের।
এ ছাড়া ঘরের ভেতর বেশির ভাগ শিশুর অবসর কাটে টিভি দেখে বা কম্পিউটারে গেমস খেলে। সচ্ছল পরিবারে শিশুদের বড় একটা অংশ এই গেমস নিয়ে পড়ে থাকে।
ইংল্যান্ডের ডেভনের বাইডফোর্ডের দাতব্য প্রতিষ্ঠান উইংস সাউথ ওয়েস্ট গেমসে মত্ত শিশুদের নিয়ে উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছে। তারা বলেছে, গেমসের নেশা ঘুম কেড়ে নিচ্ছে শিশুদের। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে আবেগহীন জড় পদার্থে পরিণত হচ্ছে তারা।
উইংস সাউথ ওয়েস্টের সমীক্ষায় জড়িত কর্মকর্তা পল বাউজার বলেছেন, ‘যেসব শিশু গেমস নিয়ে পড়ে থাকে, তাদের মধ্যে ঘোর লাগা অসাড় ভাব লক্ষ করা গেছে। না ঘুমিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলার কারণেই এটা হচ্ছে। এটাকে ভাবালুতা না আসক্তি, কী বলব?
অপর দাতব্য সংস্থা কিডস অ্যান্ড মিডিয়ার কর্মকর্তা রবার্ট হার্ট ফ্লেচার বলেন, ‘যেসব শিশু গেমস নিয়ে পড়ে থাকে, তাদের আচরণগত পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি।’ তাঁর মতে, এসব শিশুর প্রকৃত সহানুভূতি ও সমবেদনা কমে গেছে। অনেক অভিভাবক এ ক্ষেত্রে যুক্তি দেখাতে পারেন, কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকবে না তো কী করবে? শিশুপার্কসহ হাতেগোনা কয়েকটি জায়গা ছাড়া আর কী আছে যে ওরা গিয়ে একটু নতুনত্বের স্বাদ নেবে?
সমাধান যে নেই, তা নয়। বই-ই শিশুদের জন্য অবসর কাটানোর ভালো উপায় হতে পারে। হতে পারে সীমাবদ্ধতার মধ্যে নতুনত্বের অফুরান ভান্ডার। এতে তাদের আবেগ-অনুভূতি ভোঁতা না হয়ে বরং তীক্ষ হবে। শিশুতোষ নানা বিষয়ে ভরা একটি মানসম্পন্ন পত্রিকা শিশুকে দিতে পারে এমন প্রাণসঞ্চারী খোরাক, যা পড়ে শিশু গেমসের উদ্ভট চরিত্রগুলো নিয়ে অবাস্তব কিছু না ভেবে বুনতে পারে এমন স্বপ্নের জাল, যা জাতিকে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ উপহার দেবে।
তবে এখানেও প্রশ্ন। পথ দেখাবে কে? শিশুরা বড়দের অনুকরণ বা অনুসরণ করে শেখে। আর শেখে চোখের সামনে যা ঘটছে, তা দেখে। তাদের হাতে বই তুলে না দিলে বা বইয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি না করলে তারা তো পড়বে না।
শিশুদের মানসিক বিকাশে পাঠ্যবইয়ের বাইরে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের ভূমিকা অসামান্য। এ ক্ষেত্রে বাধা কিন্তু কম শক্ত নয়।
শিশুদের মোহাবিষ্ট করতে আরও প্রস্তুত স্যাটেলাইট টিভির একগাদা অনুষ্ঠান। এক সন্ধ্যায় একুশের গ্রন্থমেলায় দেখেছিলাম, বইয়ের স্টলের সামনে বাবার কোলে বসা এক শিশু জিজ্ঞেস করছে, ‘ডরিমনের (জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র) বই আছে?’ মেলায় শিশুতোষ বইয়ের মধ্যে এ ধরনের বই অনেক ছিল। শিশুরাও ঘুরেফিরে এসব বইয়ের দিকে ঝুঁকেছে। বোঝা যায়, স্যাটেলাইট টিভির প্রভাব কোথায় পৌঁছেছে!
রাজধানীতে গত বছরের মার্চে ছোটদের বই নিয়ে মেলার আয়োজন করে শিশু একাডেমী। একদিন সেখানে ঘণ্টা দুয়েক ছিলাম। এই সময়ের মধ্যে এমন একজন শিশুর দেখা মেলেনি, যে মেলা দেখতে বা বই কিনতে এসেছে। বাবা-মা নিয়ে এলে তবেই না ওরা আসবে।
ছোটদের বই বা পত্রিকার ব্যাপারে এসব ঘটনা নতুন নয়। আমাদের দেশে ছোটদের কোনো পত্রিকা টিকতে পারে না। পৃষ্ঠপোষকতা, ক্রেতা ও বিজ্ঞাপনের অভাবে হারিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর ঢাকঢোল পিটিয়ে শিশু-কিশোরদের জন্য অনেক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগই কিছুদূর দৌড়ে হারিয়ে গেছে। হাতেগোনা কয়েকটি যাও বা টিকে আছে, ধুকপুকি অবস্থা।
মনে পড়ে, শৈশবে কিশোর বাংলা নামের একটি ট্যাবলয়েড অনেক শিশু-কিশোরের মন জয় করে নিয়েছিল। এখনকার স্বনামখ্যাত অনেক কবি-সাহিত্যিক এই পত্রিকায় লিখেছেন। গুণেমানে কমতি ছিল না পত্রিকাটি। প্রতি সপ্তাহে উন্মুখ থাকতাম পত্রিকাটির জন্য। এই ভেবে গর্ববোধ করতাম—আমাদেরও পত্রিকা আছে! হঠাৎ একদিন হারিয়ে গেল সেই পত্রিকা।
এরপর ছোটদের কত পত্রিকা সাড়ম্বরে বের হয়ে চুপিসারে বন্ধ হয়েছে, এর কোনো হিসাব নেই। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ঘটা করে দুটি মাসিক পত্রিকা বের হলো। সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হলো কিশোর পত্রিকা, পাক্ষিক তারকালোক-এর তৎকালীন প্রতিষ্ঠান থেকে বের হলো কিশোর তারকালোক। দুটি পত্রিকায়ই নবীন-প্রবীণ অনেক কবি-সাহিত্যিকের লেখা প্রকাশিত হতো। গল্প, কবিতা, ছড়ার পাশাপাশি ছাপা হতো মনকাড়া কার্টুন, কমিক, ফিচার। পত্রিকা দুটির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ছিল। তখন জেনেছি, পত্রিকা বিক্রি এবং বিজ্ঞাপন পাওয়া নিয়ে কী হিমশিম অবস্থা। অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে পত্রিকা দুটির প্রকাশনা।
আমরা কথায় কথায় বলি, শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। সে অনুযায়ী, বড়দের চেয়ে বরং ওদেরই মানসম্পন্ন পত্রিকা ও বইয়ের প্রয়োজন বেশি। শিশুরা যত জানবে, যত শিখবে, তা ভবিষ্যতে জাতির উন্নয়নে কাজে লাগবে। কাজেই শিশুকে দামি খাবার ও খেলনা কিনে দেওয়ার চেয়ে তাদের উপযোগী বই ও পত্রিকা কিনে দেওয়া বেশি প্রয়োজন। অথচ এখানেই অনেকের গড়িমসি। কেন? তা তাঁরাই জানেন।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
No comments