ইস্টার-খ্রিষ্টের ক্রুশ, তাঁর পুনরুত্থান by মার্টিন অধিকারী

বছর ঘুরে আবার এসেছে ইস্টার, যিশুখ্রিষ্টের পুনরুত্থানের দিন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের খ্রিষ্টসমাজের লোকেরাও আনন্দের সঙ্গে এ দিনটি উদ্যাপন করছে উপাসনা, কীর্তন-গান প্রভৃতির মাধ্যমে। আজকের গান, ‘কী মহানন্দ উপস্থিত, কী জয় যিশুর উত্থানে! পাপ অন্ধকার হয় অন্তর্হিত কালনিশি অবসানে।’


খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মানুষের জন্য ঈশ্বরের প্রেম। ক্রুশে হত খ্রিষ্টে সেই পবিত্র প্রেম চূড়ান্তরূপে প্রকাশিত হয়েছে। ঈশমানব খ্রিষ্ট তাঁর নিষ্পাপ জীবন ক্রুশে সমর্পণ করে মানুষকে পাপ থেকে উদ্ধারের পথ খুলে দেন। বাইবেলের নতুন নিয়মে চারটি সুসমাচারেই অন্য সব বিষয়ের চেয়ে যিশুখ্রিষ্টের মৃত্যুর বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। সে সময় রোমীয়রা ক্রুশে দিয়ে জঘন্য অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করত। ইহুদি ধর্মীয় নেতাদের চক্রান্তে রোমীয় কর্তৃপক্ষ প্রহসনমূলক বিচারের পর যিশুকে ক্রুশে দিয়ে হত্যা করে। খ্রিষ্ট সেই পৈশাচিক মৃত্যুকেই বরণ করে নেন। তাঁর কার্যকারণের সবকিছুকেই আমাদের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে দেখতে হবে। মানুষের পাপের দণ্ড মোচনের জন্যই যিশুখ্রিষ্ট পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাঁর জীবন ছিল আমাদের পাপমুক্তির জন্য মুক্তিপণ। ঈশ্বরের পবিত্রতা ও অনুগ্রহ এতে চূড়ান্তভাবে ফুটে উঠেছে। খ্রিষ্টের ক্রুশমৃত্যুর তাৎপর্য গভীরভাবে ফুটে উঠেছে সাধু মথি, মার্ক, লুক ও যোহনের লেখা ওই মৃত্যুর বিশদ বর্ণনায়।
মথি তাঁর সুসমাচারের ৩৩ ভাগ ব্যবহার করেছেন যিশুর জীবনের সর্বশেষ দিনগুলোর বিষয়ে আর মার্ক ৩৭, লুক ২৫ ও যোহন ৪২ ভাগ ব্যবহার করেছেন। পুরোনো নিয়মে খ্রিষ্টের এ মৃত্যুর বিষয়ে অনেক ভাববাণী আছে; নতুন নিয়মের মধ্যে ১৭৫টিই সরাসরি উক্তি আছে এ প্রসঙ্গে। গলগথা বা কালভেরি নামের স্থানে খ্রিষ্টের বিভীষিকাময় পৈশাচিক মৃত্যু ছিল অবশ্যই এক অভিশপ্ত মৃত্যু। বাইবেলে যেমন বলা আছে, ‘যে ব্যক্তিকে গাছে (অর্থাৎ ক্রুশে) টাঙানো যায়, সে ঈশ্বরের শাপগ্রস্ত’ (দ্বিতীয় বিবরণ ২১:২৩)। সেই অভিশপ্ত দণ্ডই পাপীর মহামুক্তির স্বার্থে খ্রিষ্ট বরণ করেন। ক্রুশ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মানুষের জন্য পবিত্র ঈশ্বরের প্রেম, অনুগ্রহ ও ক্ষমার কথা। তাই খ্রিষ্টের মৃত্যু সাধারণ মরণ নয়। মানুষের পাপমুক্তির জন্য ঈশ্বরের মেষশাবকরূপে তাঁরই এক জাত পবিত্র পুত্র হত হয়েছিলেন, পাপীর দণ্ড তিনি নিয়েছেন। এভাবে একাধারে ঈশ্বরের পবিত্রতা ও ন্যায্যতা এবং অন্যদিকে মানুষের প্রতি তাঁর প্রেম প্রকাশিত হয়েছে। মানুষের চিন্তা ও ঈশ্বরচিন্তা এক নয়; ঈশ্বর মানববুদ্ধির অতীত কাজ করেন। যিশাইয় নবীর মাধ্যমে ঈশ্বর বলেছিলেন, ‘আমার সংকল্প সকল ও তোমাদের সংকল্প সকল এক নয় এবং তোমাদের পথ সকল ও আমার পথ সকল এক নয়।’ (যিশাইয় ৫৫:৮)। কিংবা খ্রিষ্টের বাণী প্রচারক পৌলের কথায়, ‘কেননা ঈশ্বরের যে মূর্খতা, তাহা মনুষ্যদের অপেক্ষা অধিক জ্ঞানযুক্ত এবং ঈশ্বরের যে দুর্বলতা, তাহা মনুষ্যদের অপেক্ষা অধিক সবল।’ (১ করিন্থীয় ১:২৫)।
ঈশ্বরের পরাক্রম ও প্রজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে খ্রিষ্টের ওই ক্রুশে। মানুষ তার জ্ঞান, বুদ্ধি, উদ্ভাবনী শক্তি, কলাকৌশল, নিজের ধর্মকর্ম দিয়ে পাপের অধীনতা থেকে মুক্তি পেতে পারে না। যদি তা সম্ভব হতো, তা হলে আমাদের এই পুরোনো পৃথিবীতে মানবজাতির এখন যে অবস্থা, তা হতো না। ক্রুশে হত খ্রিষ্টের পবিত্র জীবনোৎসর্গে বিশ্বাস স্থাপন ও তাঁর শিক্ষা আত্মস্থ করা আমাদের পাপ ও অধর্মের প্রতিকারের জন্য ঈশ্বরের ব্যবস্থা। মানুষের হিংসা ও অধার্মিকতার অন্ধকারের কাছে খ্রিষ্টের আপাত-আত্মসমর্পণেই কিন্তু সব শেষ হয়ে যায়নি।
অশুভ শক্তির অন্ধকার জ্যোতির্ময় খ্রিষ্টের জীবনপ্রদীপ চিরতরে নিভিয়ে দিতে পারেনি। তাই ঈশ্বর তাঁর পুত্রকে পবিত্র আত্মার পরাক্রমে মৃত্যু থেকে রূপান্তরিত দেহে পুনরুত্থিত করেছেন। খ্রিষ্টীয় ধর্মবিশ্বাসের মূল স্তম্ভের এপিঠ-ওপিঠ হলো খ্রিষ্টের ক্রুশমৃত্যু ও তাঁর গৌরবদীপ্ত পুনরুত্থান। সারা জীবনই যিশুখ্রিষ্ট শয়তান ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। পাপের সব ধরনের কুফল ও কুপ্রভাব থেকে মানুষের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি ও কল্যাণের লক্ষ্যে যে অমূল্য আত্মত্যাগ তিনি করেছিলেন, ধর্মে-কর্মে, সমাজে, ব্যক্তি কী সামষ্টিক জীবনে সত্য ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য যে সিদ্ধ জীবন তিনি যাপন করেছিলেন, তার পুরস্কার ও পূর্ণতা ছিল ওই পুনরুত্থানে। খ্রিষ্ট তাই মৃত্যুঞ্জয়ী ও চিরঞ্জীব।
খ্রিষ্টের অনুসারীদের এসব বিশ্বাস আজ আমরা কীভাবে দেখব? আজ তাঁর প্রকাশ নিয়ে আমাদের নিজেদের আন্তরিক হওয়ার বিকল্প নেই। খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের ডকট্রিন বা ডগমা সব মানুষ না মানলেও খ্রিষ্টের শেখানো মানবীয় মূল্যবোধকে যুগে যুগে সব মানুষ সম্মান করে এসেছে। তাঁর প্রেম, ক্ষমা ও মানবসেবার সুশিক্ষার মূল্য স্থান, কাল, পাত্রভেদে অনস্বীকার্য। আজ পৃথিবীতে যে অন্যায়, অবিচার ও মানুষে মানুষে হিংসার হলাহল, তা থেকে মানুষকে উদ্ধার পেতে হলে খ্রিষ্টের আদর্শ মানতে হবে। মৃত্যু ও কবরের অন্ধকার থেকে খ্রিষ্টের পুনরুত্থানে বিশ্বাসের মূল্য থাকে না, যদি তার জীবন খ্রিষ্টের আদর্শে পরিচালিত না হয়। আজ তাই আমাদের জীবনে আর একবার এসেছে হিংসা ও স্বার্থের ঊর্ধ্বে নতুন জীবনের আহ্বান। মানবজীবনের সব গৌরব ও মহিমায় উচ্চকিত হওয়ার পথে মৃত্যুঞ্জয়ী খ্রিষ্টের দিব্য জ্যোতিতে আজ জীবন আমাদের হোক আলোকিত, হোক গতিময়। বিশ্বকবির ভাষায় আজ যেন বলতে ইচ্ছা হয়, ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের ’পর, কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান! না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।’ আমাদের মনপ্রাণ ও চিত্ত আজকের এই নতুন প্রভাতে খ্রিষ্টের আলোয় পূর্ণ হোক, ধন্য হোক ঈশ্বর ও মানুষকে আরও ভালোবাসতে।
মার্টিন অধিকারী: ধর্মতাত্ত্বিক, সমাজসেবক।

No comments

Powered by Blogger.