লিবিয়ায় হামলা-‘সভ্য দুনিয়ার প্রতিনিধিদের’ কী কাজ by ফারুক ওয়াসিফ
নিরীহ মুখে মিথ্যা বলা সবাই পারে না, বারাক ওবামা পারেন। তিনি হাসতে হাসতে ড্রোন হামলায় নিরীহ মানুষ হত্যার খবর দেন, আবার নয়নভরা জল নিয়ে ‘লিবিয়ার মানববিপর্যয় উপেক্ষা করতে পারি না’ বলে কেঁদে ফেলেন। ওদিকে মার্কিন-সৌদি আঁতাতের মিত্র বাহরাইন ও ইয়েমেনে বিক্ষোভকারীদের হত্যা চললেও ফুঁসতে থাকেন কেবল সিরিয়ার
বিরুদ্ধে। কেবল নোবেল পুরস্কারে তাঁকে ঠিক সম্মান জানানো যায় না, হলিউডের অস্কার প্রতিযোগিতায় সেরা অভিনেতার শিরোপা পেলেই তবে সোনায় সোহাগা হয়। ইতিহাসে তাঁর আসন অক্ষয়, তিনি প্রথম কালো মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি কালো আফ্রিকায় আগ্রাসন চালালেন।
যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন-ফ্রান্সের ত্রি-শূল মিসর-তিউনিসিয়ায় বাড়ি খেয়ে গিয়ে পড়েছে লিবিয়ার বুকে। যখন বন্দুক-বিমান কথা বলে, তখন মানুষের স্লোগান আর শোনা যায় না, রাজনীতি তখন পিছু হটে। আরবজুড়ে সমস্যাটা ছিল রাজনৈতিক। স্যুট-কোট পরা সেনাশাসনের বিরুদ্ধে গণমানুষের অহিংস উত্থান ছিল এর প্রতীক ও কৌশল। কিন্তু লিবীয় নাটকের প্রথম অঙ্কেই সশস্ত্র বিদ্রোহীদের দেখা মিলতে থাকে, যাদের অনেকেই আবার সরকারেরই সাবেক কর্মকর্তা। সেখানে নেই কোনো তাহরির স্কয়ার, নেই গণতন্ত্র দাবির প্ল্যাকার্ড-পোস্টার হাতে হাজার হাজার নর-নারীর মুখর উপস্থিতি। ফরাসি রাজনৈতিক দার্শনিক আঁলা বাদিউ যেমন বলেছেন, আরব মহাজাগরণের অন্যতম প্রধান প্রতীক নারী বিক্ষোভকারীরা লিবিয়ায় গরহাজির। এককথায়, লিবিয়ায় পশ্চিমা আগ্রাসনের জন্য একটি অজুহাতের দরকার ছিল এবং পশ্চিমা গণমাধ্যমের সহায়তায় যুদ্ধপ্রিয় ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’ সেই অজুহাত তৈরি করে নিয়েছে। তারা মুফতে রাজনৈতিক সমস্যাকে সামরিক সমস্যায় পরিণত করেছে। লাখো-কোটি মানুষের উত্থানের সামনে পরাশক্তিও যখন অসহায়, তখন তারা মাঠে নামায় জঙ্গি বা বিদ্রোহীদের। বিপ্লবকে তারা যুদ্ধে পরিণত করতে চায়। কারণ, সেনাসংখ্যা আর অস্ত্রের মজুদ দিয়ে জনগণের বিক্ষোভকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে বলে তারা আশা করে। যুদ্ধের মাধ্যমে কেমন গণতন্ত্র কায়েম হয়, আফগানিস্তান আর ইরাক তার প্রমাণ।
স্বৈরশাসকেরা সর্বদাই আরও বড় অপশক্তিকে সুযোগ করে দেন, যেভাবে দিয়েছিলেন ইরাকের সাদ্দাম। পশ্চিমা শক্তি গাদ্দাফিকে নিশানা করে আরব রাজনৈতিক ভূমিকম্পকে যুদ্ধের ঝাঁকুনি দিয়ে স্থির করতে চাইছে। গাদ্দাফিভীতি ছড়িয়ে, তাঁকে দানব ও উন্মাদের ভাবমূর্তি দিয়ে নিজ দেশের জনমতকে তারা ধোঁকা দিতে সক্ষমও হয়েছে। পশ্চিমা মিডিয়া দারুণ রসিক, ঘটনার বহু বছর পরে তাদের বোধোদয় হয়। ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্রের গালগল্প শুনিয়ে যখন যুদ্ধের জন্য রক্ত গরম করা দরকার ছিল, তখন তারা তা-ই করেছে। এখন শোনাচ্ছে উল্টোগীত। আশা করি, লিবিয়ায় ন্যাটো হামলার অন্তরালের কাহিনিও একসময় তারা বলবে।
বাস্তবত, সেখানে ভাড়াটে লোকজনের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে গৃহযুদ্ধ বাধানোর সব আয়োজন তারা করেছে। গোপনে উপদেষ্টা, অস্ত্র-প্রশিক্ষক ও গোয়েন্দাদের পাঠানো হয়, এদের একটা অংশ আবার ধরাও পড়ে। তারপর বলা হয়, গাদ্দাফি নিরস্ত্র জনতার ওপর বিমান হামলা চালাচ্ছেন—যদিও এর কোনো প্রমাণ দিতে তারা ব্যর্থ হয়। এভাবে জনমত গঠনের পর জাতিসংঘকে ব্যবহার করে ইরাক-আফগানিস্তান ধ্বংসকারীরা লিবিয়ায় জঙ্গি ‘মানবতাবাদী’ অভিযান শুরু করে। ওদিকে গাদ্দাফিরই সাবেক এক সহযোগী হাজির হন ‘বিপ্লবী সরকারের প্রধান’ হিসেবে। এ কেমন গণ-অভ্যুত্থান, যেখানে জনগণ নেই কিন্তু বিপুল অস্ত্র আছে? আর কেমন বিপ্লবী তারা, যারা আগ্রাসনকারীদের অভ্যর্থনা জানায়? স্পষ্টতই, লিবিয়ায় যা চলছে তা বিপ্লব নয়, পশ্চিমা পরাশক্তির মদদপুষ্ট প্রতিবিপ্লব। যাঁরা আরবজুড়ে বিক্ষোভের ঢেউ পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁরা কেবল কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমের ফাঁকি ধরতে পারবেন। আর যারা এমন কূট ও নিষ্ঠুর দান চালছে, তাদেরই আমাদের মানতে হবে ‘সভ্য দুনিয়ার’ প্রতিনিধি হিসেবে?
দেখা যাক, সভ্য দুনিয়ার প্রতিনিধিদের কাছে লিবিয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। প্রথমত, আরব অভ্যুত্থানের জোয়ারকে থামাতে না পারলে আখেরে তা ইসরায়েলের দুর্গে আঘাত হানবে। সুতরাং যুদ্ধপরিস্থিতির মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানের জোয়ারকে বিভ্রান্ত করো। এতে এক ঢিলে বহু পক্ষী নিহত হওয়ার সম্ভাবনা: আফ্রিকা মহাদেশে ন্যাটোর প্রাধান্য বিস্তার, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে লিবিয়ার নিজস্ব অবস্থান ধ্বংস, লিবিয়ার তেল-গ্যাস সম্পদ দখল করে পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া, যেমনটা তুলে দেওয়া হয়েছে ইরাকে এবং যেমনটা চলছে সৌদি থেকে কুয়েত-কাতার-দুবাই পর্যন্ত। লিবিয়ার গ্যাসভান্ডার আফ্রিকার মধ্যে বৃহত্তম এবং তা উত্তোলনের খরচ সবচেয়ে কম। আফ্রিকা থেকে চীনের অবস্থান হটানো এবং আরব জাতির মুক্তিদাতার ভড়ং দেখিয়ে আরব বিশ্বে হারানো সমর্থন পুনরুদ্ধার করাও তাদের উদ্দেশ্য রয়েছে। এই কাজের জন্য প্রয়োজনে লিবিয়াকে বলকান অঞ্চলের মতো বিভক্ত করা। ভাগ করো, শাসন করো—এই ঔপনিবেশিক কৌশল এখনো কাজে দেয়। তবে এসবের মধ্যে আরেকটি লক্ষ্যের কথা তারা আলোচনায় আনে না বটে, কিন্তু ফ্রান্সের অতি-উৎসাহের আসল কারণটা সেখানেই। লিবিয়ার মরুভূমির তলায় রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভূগর্ভস্থ জলাধার। এতে রয়েছে তিন লাখ ৭৫ হাজার কিউবিক কিলোমিটার পানি। প্রায় ২০ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকায় এটা বিস্তৃত। ২০০৭ সালের চাহিদার হিসাবে এই পানি দিয়ে লিবিয়ার এক হাজার বছরের প্রয়োজন মিটবে। এই জলাধারের সুফল নিতে, মরু এলাকাকে সবুজ করে তুলতে লিবিয়ার সরকার বিশ্বের বৃহত্তম কৃত্রিম ভূগর্ভস্থ জলপ্রবাহের পাইপলাইন গড়ে তুলেছে। এতে যুক্ত আছে এক হাজার ৩০০ কূপ, পশ্চিম ইউরোপের সমান এলাকাকে আবৃত করা ৩৫ হাজার কিলোমিটারের পাইপলাইন। এই প্রকল্পের নাম গ্রেট ম্যান মেড রিভার (জিএমএমআর)। বিশ্বে পানির ব্যবসায় ফ্রান্স একচেটিয়া। ফ্রান্স এখন চাইছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠা বিশুদ্ধ পানির ভান্ডারগুলোর ওপর দখল কায়েম করতে। লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপে ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজির উন্মাদনার কারণ এটিই। টার্গেট যে লিবিয়ার সম্পদের দিকেই, তার প্রমাণ পাওয়া যায় হামলা শুরুর আগেই বিদেশি ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানে সঞ্চিত লিবিয়ার সম্পদ ও বিনিয়োগ জব্দ করা। বড় বড় বৈশ্বিক ব্যাংকও তাই সাম্রাজ্যের চানমারি ও কুচকাওয়াজে বরাবরের মতোই আনন্দের সঙ্গে শামিল।
গাদ্দাফি ভালো বা মন্দ, এর বিচার করবে সে দেশের মানুষ। তবে এ কথা সত্য যে, ১০০ জন গাদ্দাফির পক্ষেও ন্যাটোর সমান গণহত্যা চালানো সম্ভব নয়। এও সত্য, জনগণের জাগরণ ছাড়া কখনোই দিন বদলায় না, দিনবদলের জন্য ন্যাটো গঠিত হয়নি, নিপীড়িত জাতিগুলোকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সাম্রাজ্যের সেনারা প্রশিক্ষিত হয়নি। তাই লিবিয়ায় ন্যাটোর আগ্রাসনের বিরোধিতা না করে আরব জাগরণকে সমর্থন করা বর্তমান বাস্তবতায় কপটতা ছাড়া আর কিছু নয়। আগ্রাসী যুদ্ধ সব সময়ই পরিবর্তনের গর্ভপাত ঘটায়, কিছু সৃষ্টি করে না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
faৎukwasif@yahoo.com
যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন-ফ্রান্সের ত্রি-শূল মিসর-তিউনিসিয়ায় বাড়ি খেয়ে গিয়ে পড়েছে লিবিয়ার বুকে। যখন বন্দুক-বিমান কথা বলে, তখন মানুষের স্লোগান আর শোনা যায় না, রাজনীতি তখন পিছু হটে। আরবজুড়ে সমস্যাটা ছিল রাজনৈতিক। স্যুট-কোট পরা সেনাশাসনের বিরুদ্ধে গণমানুষের অহিংস উত্থান ছিল এর প্রতীক ও কৌশল। কিন্তু লিবীয় নাটকের প্রথম অঙ্কেই সশস্ত্র বিদ্রোহীদের দেখা মিলতে থাকে, যাদের অনেকেই আবার সরকারেরই সাবেক কর্মকর্তা। সেখানে নেই কোনো তাহরির স্কয়ার, নেই গণতন্ত্র দাবির প্ল্যাকার্ড-পোস্টার হাতে হাজার হাজার নর-নারীর মুখর উপস্থিতি। ফরাসি রাজনৈতিক দার্শনিক আঁলা বাদিউ যেমন বলেছেন, আরব মহাজাগরণের অন্যতম প্রধান প্রতীক নারী বিক্ষোভকারীরা লিবিয়ায় গরহাজির। এককথায়, লিবিয়ায় পশ্চিমা আগ্রাসনের জন্য একটি অজুহাতের দরকার ছিল এবং পশ্চিমা গণমাধ্যমের সহায়তায় যুদ্ধপ্রিয় ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’ সেই অজুহাত তৈরি করে নিয়েছে। তারা মুফতে রাজনৈতিক সমস্যাকে সামরিক সমস্যায় পরিণত করেছে। লাখো-কোটি মানুষের উত্থানের সামনে পরাশক্তিও যখন অসহায়, তখন তারা মাঠে নামায় জঙ্গি বা বিদ্রোহীদের। বিপ্লবকে তারা যুদ্ধে পরিণত করতে চায়। কারণ, সেনাসংখ্যা আর অস্ত্রের মজুদ দিয়ে জনগণের বিক্ষোভকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে বলে তারা আশা করে। যুদ্ধের মাধ্যমে কেমন গণতন্ত্র কায়েম হয়, আফগানিস্তান আর ইরাক তার প্রমাণ।
স্বৈরশাসকেরা সর্বদাই আরও বড় অপশক্তিকে সুযোগ করে দেন, যেভাবে দিয়েছিলেন ইরাকের সাদ্দাম। পশ্চিমা শক্তি গাদ্দাফিকে নিশানা করে আরব রাজনৈতিক ভূমিকম্পকে যুদ্ধের ঝাঁকুনি দিয়ে স্থির করতে চাইছে। গাদ্দাফিভীতি ছড়িয়ে, তাঁকে দানব ও উন্মাদের ভাবমূর্তি দিয়ে নিজ দেশের জনমতকে তারা ধোঁকা দিতে সক্ষমও হয়েছে। পশ্চিমা মিডিয়া দারুণ রসিক, ঘটনার বহু বছর পরে তাদের বোধোদয় হয়। ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্রের গালগল্প শুনিয়ে যখন যুদ্ধের জন্য রক্ত গরম করা দরকার ছিল, তখন তারা তা-ই করেছে। এখন শোনাচ্ছে উল্টোগীত। আশা করি, লিবিয়ায় ন্যাটো হামলার অন্তরালের কাহিনিও একসময় তারা বলবে।
বাস্তবত, সেখানে ভাড়াটে লোকজনের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে গৃহযুদ্ধ বাধানোর সব আয়োজন তারা করেছে। গোপনে উপদেষ্টা, অস্ত্র-প্রশিক্ষক ও গোয়েন্দাদের পাঠানো হয়, এদের একটা অংশ আবার ধরাও পড়ে। তারপর বলা হয়, গাদ্দাফি নিরস্ত্র জনতার ওপর বিমান হামলা চালাচ্ছেন—যদিও এর কোনো প্রমাণ দিতে তারা ব্যর্থ হয়। এভাবে জনমত গঠনের পর জাতিসংঘকে ব্যবহার করে ইরাক-আফগানিস্তান ধ্বংসকারীরা লিবিয়ায় জঙ্গি ‘মানবতাবাদী’ অভিযান শুরু করে। ওদিকে গাদ্দাফিরই সাবেক এক সহযোগী হাজির হন ‘বিপ্লবী সরকারের প্রধান’ হিসেবে। এ কেমন গণ-অভ্যুত্থান, যেখানে জনগণ নেই কিন্তু বিপুল অস্ত্র আছে? আর কেমন বিপ্লবী তারা, যারা আগ্রাসনকারীদের অভ্যর্থনা জানায়? স্পষ্টতই, লিবিয়ায় যা চলছে তা বিপ্লব নয়, পশ্চিমা পরাশক্তির মদদপুষ্ট প্রতিবিপ্লব। যাঁরা আরবজুড়ে বিক্ষোভের ঢেউ পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁরা কেবল কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমের ফাঁকি ধরতে পারবেন। আর যারা এমন কূট ও নিষ্ঠুর দান চালছে, তাদেরই আমাদের মানতে হবে ‘সভ্য দুনিয়ার’ প্রতিনিধি হিসেবে?
দেখা যাক, সভ্য দুনিয়ার প্রতিনিধিদের কাছে লিবিয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। প্রথমত, আরব অভ্যুত্থানের জোয়ারকে থামাতে না পারলে আখেরে তা ইসরায়েলের দুর্গে আঘাত হানবে। সুতরাং যুদ্ধপরিস্থিতির মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানের জোয়ারকে বিভ্রান্ত করো। এতে এক ঢিলে বহু পক্ষী নিহত হওয়ার সম্ভাবনা: আফ্রিকা মহাদেশে ন্যাটোর প্রাধান্য বিস্তার, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে লিবিয়ার নিজস্ব অবস্থান ধ্বংস, লিবিয়ার তেল-গ্যাস সম্পদ দখল করে পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া, যেমনটা তুলে দেওয়া হয়েছে ইরাকে এবং যেমনটা চলছে সৌদি থেকে কুয়েত-কাতার-দুবাই পর্যন্ত। লিবিয়ার গ্যাসভান্ডার আফ্রিকার মধ্যে বৃহত্তম এবং তা উত্তোলনের খরচ সবচেয়ে কম। আফ্রিকা থেকে চীনের অবস্থান হটানো এবং আরব জাতির মুক্তিদাতার ভড়ং দেখিয়ে আরব বিশ্বে হারানো সমর্থন পুনরুদ্ধার করাও তাদের উদ্দেশ্য রয়েছে। এই কাজের জন্য প্রয়োজনে লিবিয়াকে বলকান অঞ্চলের মতো বিভক্ত করা। ভাগ করো, শাসন করো—এই ঔপনিবেশিক কৌশল এখনো কাজে দেয়। তবে এসবের মধ্যে আরেকটি লক্ষ্যের কথা তারা আলোচনায় আনে না বটে, কিন্তু ফ্রান্সের অতি-উৎসাহের আসল কারণটা সেখানেই। লিবিয়ার মরুভূমির তলায় রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভূগর্ভস্থ জলাধার। এতে রয়েছে তিন লাখ ৭৫ হাজার কিউবিক কিলোমিটার পানি। প্রায় ২০ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকায় এটা বিস্তৃত। ২০০৭ সালের চাহিদার হিসাবে এই পানি দিয়ে লিবিয়ার এক হাজার বছরের প্রয়োজন মিটবে। এই জলাধারের সুফল নিতে, মরু এলাকাকে সবুজ করে তুলতে লিবিয়ার সরকার বিশ্বের বৃহত্তম কৃত্রিম ভূগর্ভস্থ জলপ্রবাহের পাইপলাইন গড়ে তুলেছে। এতে যুক্ত আছে এক হাজার ৩০০ কূপ, পশ্চিম ইউরোপের সমান এলাকাকে আবৃত করা ৩৫ হাজার কিলোমিটারের পাইপলাইন। এই প্রকল্পের নাম গ্রেট ম্যান মেড রিভার (জিএমএমআর)। বিশ্বে পানির ব্যবসায় ফ্রান্স একচেটিয়া। ফ্রান্স এখন চাইছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠা বিশুদ্ধ পানির ভান্ডারগুলোর ওপর দখল কায়েম করতে। লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপে ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজির উন্মাদনার কারণ এটিই। টার্গেট যে লিবিয়ার সম্পদের দিকেই, তার প্রমাণ পাওয়া যায় হামলা শুরুর আগেই বিদেশি ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানে সঞ্চিত লিবিয়ার সম্পদ ও বিনিয়োগ জব্দ করা। বড় বড় বৈশ্বিক ব্যাংকও তাই সাম্রাজ্যের চানমারি ও কুচকাওয়াজে বরাবরের মতোই আনন্দের সঙ্গে শামিল।
গাদ্দাফি ভালো বা মন্দ, এর বিচার করবে সে দেশের মানুষ। তবে এ কথা সত্য যে, ১০০ জন গাদ্দাফির পক্ষেও ন্যাটোর সমান গণহত্যা চালানো সম্ভব নয়। এও সত্য, জনগণের জাগরণ ছাড়া কখনোই দিন বদলায় না, দিনবদলের জন্য ন্যাটো গঠিত হয়নি, নিপীড়িত জাতিগুলোকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সাম্রাজ্যের সেনারা প্রশিক্ষিত হয়নি। তাই লিবিয়ায় ন্যাটোর আগ্রাসনের বিরোধিতা না করে আরব জাগরণকে সমর্থন করা বর্তমান বাস্তবতায় কপটতা ছাড়া আর কিছু নয়। আগ্রাসী যুদ্ধ সব সময়ই পরিবর্তনের গর্ভপাত ঘটায়, কিছু সৃষ্টি করে না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
faৎukwasif@yahoo.com
No comments