শীবের গীত- অলিম্পিকে বাংলাদেশ by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

লন্ডনে এখন চলছে আধুনিক অলিম্পিকের ত্রিশতম আসর। প্রতিটি আসরই উত্তেজনা, জাঁকজমক এবং নতুন নতুন অর্জনের হিসেবে আগেরটিকে ছাড়িয়ে যায়। এই অলিম্পিকও তার ব্যতিক্রম নয়। এবারের অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি দেখে অবশ্য আমার মনে হয়েছে।


এখন খেলাধুলাটাও, দৃশ্যমাধ্যমের কবলে পড়ে, একটা চটকদার ‘দেখার বিষয়’ হয়ে গেছে। আর বিশ্ব-পুঁজি এখন অলিম্পিকের মতো খেলাধুলার মহাযজ্ঞের গায়েও অবলীলায় একটা দাম বসিয়ে দিচ্ছে। লন্ডনপ্রবাসী আমার এক বন্ধু আমাকে জানিয়েছে, লন্ডনের বাতাসে এখন শুধু পাউন্ড-ডলার উড়ছে। যারা, অর্থাৎ যেসব দেশ, পাউন্ড ডলার ওড়াতে পারে না, তারা কষ্টেসৃষ্টে অলিম্পিকে যায়। তাদের প্রতিযোগীরা খুব মেধাবী হলে পদক জোটে। আর না হলে ‘হিট’ থেকেই ছিটকে পড়ে দর্শক বনে যায়।
বাংলাদেশ সে রকমই একটি দেশ। অর্থনীতিবিদেরা একে নানাভাবে ডাকেন—স্বল্পোন্নত দেশ, নিম্ন আয়ের দেশ, অথবা, তাদের মেজাজ ভালো থাকলে, উন্নয়নশীল দেশ। সে জন্য অলিম্পিকে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ হয় নামকাওয়াস্তে, পত্রপত্রিকার ভাষায় ‘অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য’ ‘বিশ্বমানের ক্রীড়াবিদদের পাশে পেয়ে অনুপ্রাণিত হওয়ার জন্য, অথবা ‘অংশগ্রহণের মাধ্যমে শেখার জন্য’। তা অনেক অলিম্পিকেই তো আমরা গেলাম, কিন্তু অভিজ্ঞতা কতটা হলো, অনুপ্রাণিত কতটা হলাম অথবা কতটা শিখলাম, তার হিসাবটা নিতে গেলে লজ্জায় জিভ কাটতে হবে।
গরিব দেশের জন্য অলিম্পিক একটা বিলাস বটে, তবে এই গরিব কথাটা মানতে লন্ডনপ্রবাসী আমার বন্ধুটি নারাজ। যে খেলাধুলার খুব ভক্ত, তার সৌজন্যে লন্ডনের লর্ডস মাঠে একবার ঢুকতে পেরেছিলাম। লন্ডনে তার রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। এবার অলিম্পিক দেখতে আসা লোকজনের কল্যাণে তার ব্যবসার রমরমা অবস্থা। সে আমাকে প্রশ্ন করল, বাংলাদেশ গরিব দেশ হলে সাংবাদিকদের এত বড় বহর অলিম্পিকের খবর সংগ্রহের জন্য লন্ডনে গেল কীভাবে? প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেল অন্তত একজন সাংবাদিক ও একজন ক্যামেরাম্যান পাঠিয়েছে, প্রায় প্রতিটি চালু পত্রিকা পাঠিয়েছে অন্তত একজন সাংবাদিক। আমার বন্ধু একটি হিসাব দিল: পদক জেতা দেশ দূরে থাক, অংশগ্রহণকারী কোনো দেশের প্রতিযোগীদের অনুপাতে পাঠানো সাংবাদিকদের সংখ্যায় বাংলাদেশ সকল দেশের শীর্ষে। বন্ধুটি রসিকতা করে বলল, ‘অলিম্পিক-বিলাস’ নামক একটি প্রতিযোগিতা শাখা খুললে খেলোয়াড়-পিছু সর্বোচ্চ সাংবাদিক পাঠানোর সোনাটা নির্ঘাত বাংলাদেশের জুটত।
বন্ধুটি অলিম্পিক-বিলাসের আরেকটি শাখার কথা বলল, যেখানে বাংলাদেশের সোনার পদক কেড়ে নেওয়া কোনো দেশের, এমনকি চীন-আমেরিকার পক্ষে সম্ভব নয়। এবং সেটি হলো প্রতিযোগী অনুপাতে কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ। বাংলাদেশে অবশ্য কর্মকর্তাদের এই ভ্রমণ শুধু অলিম্পিকে সীমাবদ্ধ নেই। বিদেশের যেখানে যেকোনো খেলায় বাংলাদেশের একটা দল যাবে, সেখানে খেলোয়াড়দের তুলনায় কর্মকর্তাদের বহরটা অবধারিতভাবেই বেশি হবে। সম্প্রতি ডেনমার্কে আমাদের খুদে ফুটবলারদের একটা দল যাওয়ার কথা ছিল। বিদেশের মাটিতে নিজেদের ঝালিয়ে নেওয়ার একটা সুযোগ পেয়ে খেলোয়াড়েরাও ছিল অনুপ্রাণিত। কিন্তু নিখরচায় ডেনমার্ক ভ্রমণের এবং প্রাণ ভরে দিনেমার সামগ্রী কেনাকাটার সুযোগটা বোধ করি প্রচুর কর্মকর্তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল তার চেয়েও বেশি। কাগজে দেখেছি, শেষ মুহূর্তে কোন কোন কর্মকর্তা বহরে যোগ দেবেন, সে সম্পর্কে নিশ্চিত না হতে পারায় সময়মতো ভিসার আবেদন করা যায়নি। ফলে দলটি ডেনমার্কে যেতে পারেনি। এতে খেলোয়াড়েরা বঞ্চিত হলো ঠিকই, কিন্তু কর্মকর্তারা নিশ্চয় বঞ্চিত হননি। তাঁদের দশজন হয়তো ইতিমধ্যে একজন তিরন্দাজ নিয়ে মঙ্গোলিয়া গেছেন, ১৭ জন গিয়েছেন চারজন ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় নিয়ে চীনে, অথবা সাতজন গিয়েছেন খো খো দল নিয়ে ভারতের চন্ডিগড়ে। অনেকে নিশ্চয় লন্ডন অলিম্পিকের কর্মকর্তা বাহিনীতেও ঢুকে পড়েছেন।
সরকারি আখ্যান মতে, এসব কর্মকর্তার উপস্থিতি ‘অভিজ্ঞতা অর্জনের’ জন্য অপরিহার্য। কী অভিজ্ঞতা তারা অর্জন করেন, তা দেশবাসীর কাছে একটা বিরাট রহস্য। তবে তারা যে অকাতরে দেশের মানুষের শ্রমে-ঘামে উপার্জিত টাকা খরচের অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতে চান না, সে ব্যাপারে কোনো রহস্য নেই। আমি দেখেছি, ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বিদেশের মাটিতে কাবাডি দল নিয়ে গিয়ে বিরল সব অভিজ্ঞতা অর্জন করে দেশে ফিরে সাত দিনের মাথায় মৎস্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে যান। মাছেরা কাবাডি খেলতে জানলে তিনি তাঁর লব্ধ অভিজ্ঞতা নিশ্চয় কাজে লাগাতে পারতেন। কিন্তু মাছেরা, হায়! কাবাডি খেলাটা এখনো শেখেনি।
বিদেশে ক্রিকেট দলের সঙ্গে যাওয়া কর্মকর্তাদের বহরটি বরাবরই বড় হয়। যেহেতু ক্রিকেটে প্রচুর পয়সা। এই দলে মাঝেমধ্যে সাংসদদেরও থাকতে দেখি। তাঁরা নিশ্চয় বিদেশে ক্রিকেটীয় গণতন্ত্রের সংস্কৃতিতে অবগাহন করে দেশে ফিরে আমাদের গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমৃদ্ধ করেন। ক্রিকেটের তুলনায় ফুটবল এ দেশে অনেক গরিব। সে জন্য খুদে ফুটবলারদের ডেনমার্ক যেতে না পারাটা নিশ্চয় খুব হতাশাজনক। তবে ফুটবলাররা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারত, তা নিশ্চয় বয়সে তাদের থেকে অনেক বড় কর্মকর্তারা অনেক বেশি পারতেন। এখন থেকে বরং কোনো দলে খেলোয়াড়দের বদলে শুধু কর্মকর্তাদের পাঠানোই ভালো হয়। তাতে একদিকে যেমন তাঁরা দুই হাত ভরে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন, তেমনি বিদেশের মাটিতে দেশের কোনো দলের শোচনীয় হার আমাদের দেখতে হবে না। এ রকমটি হলে কোচদের বাদ দিয়ে কর্মকর্তাদের পাঠানোর অভিযোগটাও আর শুনতে হবে না।
আগামী অলিম্পিকে কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণের একটি প্রতিযোগিতা শাখা খোলার জন্য বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন এখন থেকেই উদ্যোগ নিতে পারে। তাহলে আগামী অলিম্পিকগুলোতে নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের পতাকা উড়বে, জাতীয় সংগীত গাওয়া হবে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.