বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৭৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. ইব্রাহিম, বীর প্রতীক বীর যোদ্ধা সাহসী যোদ্ধা ১৯৭১ সালের ২ নভেম্বর। গভীর রাত (ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ৩ নভেম্বর)। শীতের রাতে নিঃশব্দে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে সমবেত হলেন মো. ইব্রাহিমসহ (মো. ইব্রাহিম খান) একদল মুক্তিযোদ্ধা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের বর্তমান কাঁচপুর সেতুর কাছে। তখন সেখানে সেতু ছিল না। অদূরে সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র।
মো. ইব্রাহিমদের লক্ষ্য ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র। তাঁরা সেখানে গেরিলা অপারেশন করবেন। আক্রমণ নয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্রান্সফরমার ধ্বংস করে সটকে পড়া। আক্রান্ত হলে যুদ্ধের প্রস্তুতিও তাঁদের আছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওয়াচ টাওয়ারে সার্চলাইট জ্বালানো। আলো ছড়িয়ে পড়েছে নদীসহ চারদিকে। টাওয়ারে সতর্ক পাহারায় আছে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীরা। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অপারেশন করতে হবে।
প্রায় দুঃসাধ্য এক মিশন। পাকিস্তানি সেনারা যদি টের পায় তবে সব পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে। সে জন্য মো. ইব্রাহিমসহ সবাই সতর্ক। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনা ও সহযোগীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি ও তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা যেতে সক্ষম হলেন ট্রান্সফরমারের কাছে। বাকিরা থাকলেন তাঁদের নিরাপত্তায়।
ট্রান্সফরমার ধ্বংসের জন্য বানানো হয়েছে পিকে চার্জ। ট্রান্সফরমারের গায়ে সেটা লাগিয়ে সংযোগ করা হবে কর্ডেক্স। কর্ডেক্সের মাঝ বরাবর ডেটোনেটর। সংযোগ তারে আগুন দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘটবে বিস্ফোরণ। সফলতার সঙ্গেই সব কাজ শেষ হলো।
এবার নিরাপদে ফিরে যাওয়ার পালা। মো. ইব্রাহিম ও তাঁর সহযোদ্ধারা ফিরে যাচ্ছেন। তখনই ঘটল বিপত্তি। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল অনেক অস্ত্র। মো. ইব্রাহিমেরা পাল্টা গুলি করতে করতে দ্রুত পিছিয়ে যেতে থাকলেন।
পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে গুলির পাশাপাশি হ্যান্ডগ্রেনেডও ছুড়তে থাকল। বিস্ফোরিত একটি হ্যান্ডগ্রেনেডের স্প্লিন্টার অলক্ষে ছুটে এল মো. ইব্রাহিমের দিকে। নিমেষে আঘাত করল তাঁর মুখে। ছিটকে পড়লেন মাটিতে। তবে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন। একজন সহযোদ্ধার সহযোগিতায় চলে গেলেন নিরাপদ স্থানে।
এ সময়ই বিদ্যুৎ চমকের মতো একঝলক আলো। তারপর পাকিস্তানিদের হতবাক করে দিয়ে একের পর এক ঘটল বিকট বিস্ফোরণ। চারদিক নিকষ অন্ধকারে ছেয়ে গেল। বাতাসে ট্রান্সফরমার কয়েলের পোড়া গন্ধ। রক্তাক্ত মো. ইব্রাহিম ভুলে গেলেন সব যন্ত্রণা।
সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনে ধ্বংস হয় সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারটি ট্রান্সফরমার। এতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের অনেক অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। আর মো. ইব্রাহিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছোড়া গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হন। তাঁর ডান চোখ নষ্ট ও চোয়ালের হাড় ভেঙে যায়।
মো. ইব্রাহিম চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুন মাসের মাঝামাঝি যুদ্ধে যোগ দেন। ২ নম্বর সেক্টরে প্রশিক্ষণ নিয়ে ক্র্যাক প্লাটুনের অধীনে যুদ্ধ করেন। তাঁর দলনেতা ছিলেন কাজী কামাল উদ্দীন (বীর বিক্রম)। ঢাকা শহর ও আশপাশ এলাকায় বেশ কয়েকটি গেরিলা অপারেশনে তিনি অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মো. ইব্রাহিমকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী, তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৩৪। তাঁর প্রকৃত নাম মো. ইব্রাহিম খান।
মো. ইব্রাহিম খান ১৯৯১ সালে নিজ ঘরে লাগা আগুন নেভাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাঁর পৈতৃক বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বরঙ্গাখোলা গ্রামে। তবে তিনি বসবাস করতেন নারায়ণগঞ্জের ১১০ নবাব সিরাজউদ্দৌলা রোডে। তাঁর উত্তরাধিকারীরা বর্তমানে এ ঠিকানায় বাস করেন। তাঁর বাবার নাম জমসের খান, মা আমাতুন বিবি। স্ত্রী খুরশিদা বেগম। তাঁদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে।
সূত্র: মো. শাহেদ ববি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
মো. ইব্রাহিমদের লক্ষ্য ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র। তাঁরা সেখানে গেরিলা অপারেশন করবেন। আক্রমণ নয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্রান্সফরমার ধ্বংস করে সটকে পড়া। আক্রান্ত হলে যুদ্ধের প্রস্তুতিও তাঁদের আছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওয়াচ টাওয়ারে সার্চলাইট জ্বালানো। আলো ছড়িয়ে পড়েছে নদীসহ চারদিকে। টাওয়ারে সতর্ক পাহারায় আছে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীরা। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অপারেশন করতে হবে।
প্রায় দুঃসাধ্য এক মিশন। পাকিস্তানি সেনারা যদি টের পায় তবে সব পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে। সে জন্য মো. ইব্রাহিমসহ সবাই সতর্ক। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনা ও সহযোগীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি ও তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা যেতে সক্ষম হলেন ট্রান্সফরমারের কাছে। বাকিরা থাকলেন তাঁদের নিরাপত্তায়।
ট্রান্সফরমার ধ্বংসের জন্য বানানো হয়েছে পিকে চার্জ। ট্রান্সফরমারের গায়ে সেটা লাগিয়ে সংযোগ করা হবে কর্ডেক্স। কর্ডেক্সের মাঝ বরাবর ডেটোনেটর। সংযোগ তারে আগুন দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘটবে বিস্ফোরণ। সফলতার সঙ্গেই সব কাজ শেষ হলো।
এবার নিরাপদে ফিরে যাওয়ার পালা। মো. ইব্রাহিম ও তাঁর সহযোদ্ধারা ফিরে যাচ্ছেন। তখনই ঘটল বিপত্তি। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল অনেক অস্ত্র। মো. ইব্রাহিমেরা পাল্টা গুলি করতে করতে দ্রুত পিছিয়ে যেতে থাকলেন।
পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে গুলির পাশাপাশি হ্যান্ডগ্রেনেডও ছুড়তে থাকল। বিস্ফোরিত একটি হ্যান্ডগ্রেনেডের স্প্লিন্টার অলক্ষে ছুটে এল মো. ইব্রাহিমের দিকে। নিমেষে আঘাত করল তাঁর মুখে। ছিটকে পড়লেন মাটিতে। তবে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন। একজন সহযোদ্ধার সহযোগিতায় চলে গেলেন নিরাপদ স্থানে।
এ সময়ই বিদ্যুৎ চমকের মতো একঝলক আলো। তারপর পাকিস্তানিদের হতবাক করে দিয়ে একের পর এক ঘটল বিকট বিস্ফোরণ। চারদিক নিকষ অন্ধকারে ছেয়ে গেল। বাতাসে ট্রান্সফরমার কয়েলের পোড়া গন্ধ। রক্তাক্ত মো. ইব্রাহিম ভুলে গেলেন সব যন্ত্রণা।
সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনে ধ্বংস হয় সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারটি ট্রান্সফরমার। এতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের অনেক অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। আর মো. ইব্রাহিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছোড়া গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হন। তাঁর ডান চোখ নষ্ট ও চোয়ালের হাড় ভেঙে যায়।
মো. ইব্রাহিম চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুন মাসের মাঝামাঝি যুদ্ধে যোগ দেন। ২ নম্বর সেক্টরে প্রশিক্ষণ নিয়ে ক্র্যাক প্লাটুনের অধীনে যুদ্ধ করেন। তাঁর দলনেতা ছিলেন কাজী কামাল উদ্দীন (বীর বিক্রম)। ঢাকা শহর ও আশপাশ এলাকায় বেশ কয়েকটি গেরিলা অপারেশনে তিনি অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মো. ইব্রাহিমকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী, তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৩৪। তাঁর প্রকৃত নাম মো. ইব্রাহিম খান।
মো. ইব্রাহিম খান ১৯৯১ সালে নিজ ঘরে লাগা আগুন নেভাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাঁর পৈতৃক বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বরঙ্গাখোলা গ্রামে। তবে তিনি বসবাস করতেন নারায়ণগঞ্জের ১১০ নবাব সিরাজউদ্দৌলা রোডে। তাঁর উত্তরাধিকারীরা বর্তমানে এ ঠিকানায় বাস করেন। তাঁর বাবার নাম জমসের খান, মা আমাতুন বিবি। স্ত্রী খুরশিদা বেগম। তাঁদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে।
সূত্র: মো. শাহেদ ববি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments