সময়ের প্রতিধ্বনি-অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কে হবেন? by মোস্তফা কামাল

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সেই সরকারে বিএনপিও যোগ দিতে পারে। যদিও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন, তবে ইস্যুটি নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়েছে।


কেউ বলছেন, প্রধানমন্ত্রী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে আগের অনড় অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছেন। আবার কেউ বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাবের ওপর কোনো বিশ্বাস নেই। তিনি নিজের বক্তব্যে স্থির থাকতে পারেন না। কিছুদিন পর তিনি নতুন আরেকটি প্রস্তাব হাজির করবেন।
এদিকে দেশের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, 'বিবিসির হার্ডটকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আমার মনে হয়েছে, সমঝোতা হবেই। এখন বিরোধী দলের ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত।'
রফিক-উল হকের মতো আমরাও আশাবাদী হতে চাই। কিন্তু দেশের জটিল মারপ্যাঁচের রাজনীতি বারবারই আমাদের আশাহত করে। বিবিসির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব দেওয়ার পর দেশের মানুষ ভেবেছিল, সরকার কিছুটা হলেও রাজনৈতিক সংকট সমাধানের ব্যাপারে আন্তরিক। কিন্তু বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোট নেতাদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করায় সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এ ধরনের রাজনৈতিক হয়রানি কখনোই ভালো ফল দেয় না। বরং সংঘাতের রাজনীতিকে উৎসাহিত করে। অবশ্য গত সোমবার হাইকোর্ট ১৮ দলীয় জোট নেতাদের বিচারকাজ স্থগিত ঘোষণা করেছেন। এখন হয়তো বিরোধী নেতারা কিছুটা স্বস্তিতে থাকবেন। কিন্তু এতে কি বিরোধীদের প্রতি সরকারের নিপীড়নমূলক মনোভাবের পরিবর্তন ঘটবে?
আমরা জানি, সংবিধানের আলোকে প্র্রধানমন্ত্রী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবটি দিয়েছেন। সংবিধানে বলা আছে, সরকারের শেষ তিন মাস হবে অন্তর্বর্তী সরকার। আর প্রধানমন্ত্রীই সেই সরকারের নেতৃত্ব দেবেন। এ সরকারে যোগ দিতে বিরোধী দল কি রাজি হবে? এ ক্ষেত্রে বিকল্প একটি ফর্মুলা বের করা যেতে পারে। সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি উভয় দলের সমানসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবেন। একজন নির্দলীয় ব্যক্তি থাকবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। অন্তর্বর্তী সরকার পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে (৯০ দিন) নির্বাচন পরিচালনা করবে।
তবে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার মধ্যে ফাঁক রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা কী হবে তা বলেননি। সরকারের উচিত অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখাটি জনসমক্ষে প্রকাশ করা। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কে হবেন, এ সরকার কত সদস্যবিশিষ্ট হবে, তাতে বিরোধী দলের কতজন সদস্যকে রাখা হবে- এসব বিষয়ে একটা সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া উচিত। তারপর বিরোধী দলের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাঠিয়ে সংলাপে বসা যেতে পারে।
তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একটি প্রস্তাব দিয়েছেন; আর বিরোধী দল সেই প্রস্তাব শুনে আনন্দে আত্মহারা হবে- এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কাছে পাঠানো উচিত। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাবের সঙ্গে ১৯৯৫ সালে কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ানের প্রস্তাবের কিছু মিল পাওয়া যায়।
তখন বিএনপি ক্ষমতায়। আর আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে। রাজনীতি যখন সংঘাতের রূপ ধারণ করল, তখন কমনওয়েলথ মহাসচিব মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিলেন। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনার জন্য বিশেষ দূত করে স্যার নিনিয়ানকে ঢাকায় পাঠালেন। উভয় দলের সঙ্গে আলোচনার পর স্যার নিনিয়ান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব দিলেন। সেই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ১১ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হবে। সেই মন্ত্রিপরিষদে প্রধানমন্ত্রীসহ বিএনপি থেকে পাঁচজন, বিরোধী দল থেকে পাঁচজন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এর বাইরে একজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যিনি হবেন দলীয় রাজনীতির বাইরের কেউ। তবে উভয় দলের সম্মতিতে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তাঁর হাতেই থাকবে স্বরাষ্ট্র ও সংস্থাপনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। সেই প্রস্তাব আওয়ামী লীগ প্রত্যাখ্যান করেছিল।
প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা কী হবে, তা কেউ জানে না। তবে রাজনীতিকরা ধারণা করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার হবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে। বর্তমান সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যেতে বলবেন এবং তাঁর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে। সেই সরকারের দায়িত্ব হবে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে সব কিছু প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই পরিচালিত হবে। সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন তাঁর নির্দেশেই সব কাজ সম্পাদন করবে। বিএনপি থেকে পাঁচজন সদস্য নেওয়া হলেও তাঁদের কোনো কাজ থাকবে না। বর্তমান সরকার যেভাবে চলছে, অন্তর্বর্তী সরকারও সেভাবেই চলবে। কাজেই দেশবাসী আরেকটি দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার দেখতে পাবে। আর বিএনপি এ প্রস্তাবে রাজি হবে কেন? বিএনপিকে রাজি করাতে হলে ক্ষমতাসীন দলকে আরেকটু ছাড় দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্যার নিনিয়ানের প্রস্তাবটি নিয়ে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান থাকবেন একজন দলনিরপেক্ষ ব্যক্তি।
বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসন করতে হলে সরকারকে অবিলম্বে অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করতে হবে। যদি সরকার ঘোষিত অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে বিএনপিও তা মানতে বাধ্য হবে। বিএনপি অব্যাহতভাবে যদি অযৌক্তিক-অবাস্তব দাবি করতে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষের সমর্থন হারাবে। কাজেই বিএনপিকেও সেই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
কোন ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন হবে- এই বিতর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। সেটা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও স্বাধীন করার বিষয়টি। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন এবং শক্তিশালী হলে অন্য কোনো ব্যবস্থারই প্রয়োজন পড়ে না। অথচ নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করার ব্যাপারে কেউ কোনো কথা বলছেন না। কারণ ক্ষমতায় যেতে পারলে নির্বাচন কমিশনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে।
অবশ্য কাগজ-কলমে আমাদের নির্বাচন কমিশন ভারতের নির্বাচন কমিশনের চেয়েও শক্তিশালী। অথচ দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো নির্বাচন কমিশনকেও 'নখ ও দন্তবিহীন বাঘ' বানিয়ে রাখা হয়েছে। এ কারণেই নির্বাচন কমিশনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা কম। বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা কোনো কাজে আসেনি। এখনো নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। অর্থের জন্য কমিশনকে সরকারের কাছে হাত পাততে হয়। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী প্রয়োজন হলে সরকারের কাছে ধরনা দিতে হয়। নির্বাচনের সময় প্রশাসনকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত করা হলেও নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকেই যাচ্ছে।
অথচ দেশ বিভাজনের পর থেকে ভারতে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করছে। সেখানে নির্বাচনের সময় দৈনন্দিন রুটিন কাজের বাইরে সরকার আর কিছুই করতে পারে না। ভারতের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এখনো তেমন কোনো বিতর্ক শোনা যায়নি। অথচ বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অনির্বাচিত ব্যক্তিদের টেনে আনতে হয়। এটা দেশের রাজনীতিকদের জন্য লজ্জাকর। তার পরও রাজনীতিকরা সেই লজ্জার কাজটি বারবার করেন।
বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বের কাছে আমাদের অনুরোধ, আপনারা বলুন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেও নির্বাচন যেতে আপনারা রাজি। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হবেন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি। এ বিষয়ে আপনারা একটি বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করুন। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার প্রস্তাব দিন এবং তা কার্যকর করতে প্রয়োজনে আন্দোলন করুন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি করে রাজনীতিকদের প্রতি নতুন করে অনাস্থা জ্ঞাপন করবেন না। এই প্রবণতা গণতন্ত্রের জন্যও শুভ নয়।
এ কথা তো ঠিক যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ত্রুটির কারণেই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় ছিল। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা অনেকটা নিরাপদ। তবে প্রধানমন্ত্রীকে বহাল রেখে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হবে না। একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করতে হবে এবং তাঁর অধীনে স্বরাষ্ট্র ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো থাকতে হবে। এ ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হবে না। এ ধরনের একটি প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ হতে পারে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.