বোল্ট-শ্যালির ইতিহাস...-চার বছর পর লন্ডন অলিম্পিকেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এবারও ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ডের রাজা-রানী হয়েছেন বোল্ট ও শ্যালি by মোঃ নুরুল ইসলাম পাঠান

খুব বেশি দিনের কথা নয়। অলিম্পিক, বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ কিংবা অন্যান্য আসর। সব জায়গাতেই দৌড় মানেই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ্যাথলেটদের একচ্ছত্র আধিপত্য। এ আধিপত্যে বিগত বেশ কয়েক বছর থেকেই ভাঙ্গন ধরিয়েছে জ্যামাইকান এ্যাথলেটরা।


ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশটি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অনুষ্ঠিত আসরগুলোতে তাক লাগানো সাফল্য প্রদর্শন করে চলেছে। যার প্রমাণ তারা রাখল চলমান লন্ডন অলিম্পিকেও। চার বছর আগে ২০০৮ বেজিং অলিম্পিকে পুরুষ ও মহিলা বিভাগের ১০০ মিটার স্প্রিন্টের স্বর্ণ জিতে দ্রুততম মানবমানবী হয়েছিলেন জ্যামাইকার উসাইন বোল্ট ও শ্যালি-এ্যান ফ্রেশার-প্রাইস। চার বছর পর লন্ডন অলিম্পিকেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এবারও ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ডের রাজা-রানী হয়েছেন বোল্ট ও শ্যালি। ধারাবাহিক এই সাফল্যে স্পষ্ট প্রতীয়মান, দৌড় মানেই জ্যামাইকানদের একচ্ছত্র আধিপত্য।
চার বছর আগে ২০০৮ বেজিং অলিম্পিক, ২০০৯ ও ২০১১ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে উসাইন বোল্ট ক্রীড়াবিশ্বকে দেখিয়েছিলেন সাফল্যের জন্য তাঁর ইচ্ছেটাই আসল। কিন্তু সম্প্রতি পড়তি ফর্ম ও গত বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ফলস স্টার্টের কারণে ‘ডিসকোয়ালিফাইড’ হয়ে সম্মান হাতছাড়া হওয়ার পর অনেকেই ভেবে নিয়েছিলেন বোল্ট অধ্যায় হয়ত শেষ! এই পালে নব হাওয়া লাগে স্বদেশী অনুশীলন সতীর্থ ইয়োহান ব্লেকের কাছে জ্যামাইকার অলিম্পিক ট্রায়ালে দুইবার হার মানলে। লন্ডন অলিম্পিকের ১০০ মিটার স্প্রিন্টের হিট ও সেমিফাইনালের টাইমিংও বোল্টের অধঃগতির ছাপ রেখেছিল। জ্যামাইকান গতির রাজার মুকুট রক্ষা নিয়ে তাই সন্দিহান ছিলেন অনেকেই। আমুদে স্বভাবের হলেও এ নিয়ে খুব বেশি কথা বলেননি গতিসম্রাট। হয়ত জবাব দেয়ার জন্য মুখিয়ে ছিলেন। অবশেষে লন্ডনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে ৮০ হাজার দর্শকের সামনে ইতিহাস গড়ে জবাব দিয়েছেন উসাইন বোল্ট। বাংলাদেশ সময় গত রবিবার অনন্য গৌরবগাথা রচনা করেন ২৫ বছর বয়সী বোল্ট। এদিন নতুন অলিম্পিক রেকর্ড গড়ে ১০০ মিটার স্প্রিন্টের স্বর্ণ জয় করেন তিনি। সেই সঙ্গে অক্ষুণœ রাখেন শ্রেষ্ঠত্ব। ২০০৮ বেজিং অলিম্পিকেও এ ইভেন্টে স্বর্ণপদক জয় করেছিলেন জ্যামাইকান তারকা। এবার বেজিংয়ের চেয়েও কম সময়ে দৌড় শেষ করেন। নতুন অলিম্পিক রেকর্ড গড়ে অর্থাৎ ৯.৬৩ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করে স্বর্ণপদক জয় করেন বোল্ট। এর ফলে বেজিংয়ের পর লন্ডন অলিম্পিকেরও দ্রুততম মানব হওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন জ্যামাইকান কালো মানিক।
লন্ডনে শুরুটা অবশ্য খুব একটা ভাল হয়নি বোল্টের। পিছিয়ে ছিলেন বেশ খানিকটা। কিন্তু শেষ ৫০ মিটারে সবাইকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়েন তিনি। ৯.৭৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে এ ইভেন্টে রৌপ্যপদক জয় করেন বোল্টের স্বদেশী ও অনুশীলন পার্টনার ইয়োহান ব্লেক। জ্যামাইকানদের একচ্ছত্র আধিপত্যের মাঝে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে সান্ত¡Íনাসূচক ব্রোঞ্জপদক জয় করেন জাস্টিন গ্যাটলিন। তিনি সময় নেন ৯.৭৯ সেকেন্ড। ব্লেক ও গ্যাটলিন দু’জনই নিজেদের সেরা টাইমিং করেন। কিন্তু অদম্য বোল্ট ঝড়ের সামনে তারা তেমন প্রতিরোধই গড়তে পারেননি। অবশ্য সেমিফাইনালে বোল্টের (৯.৮৭ সেকেন্ড) চেয়ে গ্যাটলিন (৯.৮২ সেকেন্ড) ও ব্লেকের (৯.৮৫ সেকেন্ড) টাইমিং ভাল ছিল। কিন্ত শেষ হাসি হাসেন ‘বজ্র-বোল্ট’ই। অসাধারণ ধারাবাহিকতায় মুকুট অক্ষুণœ রাখার মধ্য দিয়ে অসাধারণ রেকর্ডের সঙ্গী হয়েছেন বোল্ট। অলিম্পিক ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয় স্প্রিন্টার হিসেবে পুরুষ বিভাগে টানা দুই গেমসে দ্রুততম মানব হলেন তিনি। এর আগে ১৯৮৮ সিউল অলিম্পিকে দ্রুততম মানব হয়ে অলিম্পিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ১০০ মিটার স্প্রিন্টের খেতাব ধরে রেখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কার্ল লুইস। অবশ্য বেন জনসন ডোপপাপী হওয়ায় তিনি পরবর্তীতে এ সম্মান পেয়েছিলেন। এদিক দিয়ে বোল্টের অর্জনই সবার সেরা।
অলিম্পিক স্টেডিয়ামে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই মিশন শুরু করেছিলেন বোল্ট। সেমিফাইনালে সময়টা একটু বেশি নিলেও দৌড় শেষ করেছিলেন অনেকটা আয়েশী ভঙ্গিতে। কেননা সেখানে যে বোল্টের সঙ্গে টেক্কা দেয়ারই কেউ ছিল না! মূল লড়াইয়ে দেখা গেল সেই স্বভাবসুলভ ধনুক এ্যাকশন, শিশুসুলভ অঙ্গভঙ্গি। ক্ষিপ্রগতিতে দৌড় শেষ করে দর্শকদের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দেন ভালবাসার নিদর্শন। এরপরই হাঁটু গেড়ে ট্র্যাকে এঁকে দেন চুম্বন। এরপর গ্যালারির প্রায় লাখখানেক দর্শকের ভালবাসায় সিক্ত হন বোল্ট। টিভি পর্দায় কোটি কোটি দর্শকও মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন বোল্টের শিশুসুলভ উদ্যাপন। ১০০ মিটারের বিশ্বরেকর্ড বোল্টের দখলে। ২০০৯ সালের ১৬ আগস্ট বার্লিন বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ৯.৫৮ সেকেন্ডে হয়েছিলেন বিশ্বের দ্রুততম মানব। এবার লন্ডন অলিম্পিকে ৯.৬৩ সেকেন্ড সময় বোল্টের দ্বিতীয় সেরা। বেজিং অলিম্পিকে ৯.৬৯ সেকেন্ড তৃতীয় সেরা টাইমিং। অর্থাৎ ১০০ মিটার স্প্রিন্টের পাঁচটি সেরা টাইমিংয়ের প্রথম তিনটিই বোল্টের দখলে। বাকি দু’টির মালিকানা যুক্তরাষ্ট্রের টাইসন গের দখলে। ২০০৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সাংহাইয়ে ৯.৬৯ সেকেন্ডে এবং একই বছরের ১৬ আগস্ট বার্লিনে ৯.৭১ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করেন মার্কিন তারকা।
জ্যামাইকার স্বপ্নপুরুষের স্বপ্নের সৌধটি অবশ্য এ্যাথলেটিক্সের মাধ্যমে রচিত হয়নি। ছোটবেলায় তিনি হোল্ডিং, মার্শাল, ওয়ালশদের উত্তরসূরি হতে চেয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে নিয়মিত ফাস্ট বল করতেন বোল্ট স্কুল ক্রিকেটে। সাফল্যও পেতেন প্রত্যাশিত। তাঁর গতির আগুনে পুড়ে ছারখার হতেন ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু হুট করে আজব এক চিন্ত মাথায় আসে বোল্টের। এত দীর্ঘ সময় ধরে খেলা সম্ভব নয়, দ্রুত শেষ করা যায় এমন খেলায় ঝুঁকতে হবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। এক্ষেত্রে এগিয়ে এলেন জ্যামাইকান এক কোচ। এ কোচ আগে থেকেই বোল্টকে স্প্রিন্টে আনার চিন্তাভাবনা করেছিলেন। বোল্টের আগ্রহ দেখে কাজটি সহজ হয় তাঁর। শুরু কররেন জ্যামাইকার কালো মানিককে নিয়ে ঘষামাজা। ফল আজকের বিস্ময় গতিদানব বোল্ট।
বোল্টের একদিন আগেই মেয়েদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টের খেতাব অক্ষুণœ রাখেন তাঁর স্বদেশী শ্যালি-এ্যান ফ্রেশার-প্রাইস। গত শনিবার চলমান লন্ডন অলিম্পিকে মেয়েদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টের স্বর্ণপদক জিতে তিনি এ কৃতিত্ব দেখান। দ্রুততম মানবী হওয়ার পথে শ্যালি-এ্যান ফ্রেশার সময় নেন ১০.৭৫ সেকেন্ড। মাত্র ০.০৩ সেকেন্ড সময় বেশি অর্থাৎ ১০.৭৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে রৌপ্যপদক জেতেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের কার্মেলিটা জেটার। অলিম্পিক এ্যাথলেটিক্সের সবচেয়ে আকর্ষণীয়, মর্যাদাকর ও প্রত্যাশিত এ ইভেন্টে ব্রোঞ্জপদক জিতেছেন শ্যালির স্বদেশী জ্যামাইকার আরেক এ্যাথলেট ভেরোনিকা ক্যাম্পবেল-ব্রাউন। তিনি সময় নেন ১০.৮১ সেকেন্ড। উসাইন বোল্টের মতো অতটা আমুদে নন শ্যালি-এ্যান ফ্রেশার। তবে তাঁর হাসিতে ঝরে মুক্তা। অতি আবেগে ভেসে না গিয়ে মুকুট রক্ষা নিশ্চিত হওয়ার পর নিজ দেশ জ্যামাইকার জাতীয় পতাকা শরীরে জড়িয়ে দর্শকদের অভিবাদনের জবাব দেন তিনি। মেয়েদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণ ও ব্রোঞ্জপদক জয় করে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ জ্যামাইকা আরও একবার প্রমাণ করল এ্যাথলেটিক্সে এই মুহূর্তে তারাই বিশ্বসেরা।
চার বছর আগে বেজিং অলিম্পিকেও দ্রুততম মানবী হয়েছিলেন ২৫ বছর বয়সী শ্যালি-এ্যান ফ্রেশার। ফলে অলিম্পিক ইতিহাসের মাত্র দ্বিতীয় স্প্রিন্টার হিসেবে প্রমীলা বিভাগে মুকুট ধরে রাখার কৃতিত্ব দেখালেন শ্যালি। এর আগে ১৯৯২ ও ১৯৯৬ অলিম্পিক গেমসে প্রমীলাদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণপদক জয় করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের গেইল ডিভার্স। অসাধারণ কীর্তিগাথা রচনার পর স্বাভাবিকভাবেই উচ্ছ্বাসে ভাসছেন জ্যামাইকান তরুণী। ২১ বছর বয়সে বেজিংয়ে অনেকটা চমক দেখিয়েই সবার সেরা হয়েছিলেন কৃষ্ণসুন্দরী শ্যালি। সেবার তাঁর দ্রুততম মানবী হওয়াটা ছিল অনেকটাই অপ্রত্যাশিত! কিন্তু গত চার বছরে অনেকটাই পরিণত হন কিংস্টনের ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ডের রানী। সেরার মুকুট অক্ষুণœ রাখার পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে এমনই বলেন শ্যালি। উসাইন বোল্টের আমুদে স্বভাবের কথা সবারই জানা। জ্যামাইকর গতির রাজা ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ডে সব সময়ই হাসিতামাশায় মশগুল থাকেন। কিন্তু বিপরীত চিত্র যেন শ্যালির ক্ষেত্রে। গতির রানী বিশ্ব জয় করার পরও কেমন যেন নিষ্প্রভ! ২০০৮ অলিম্পিকে দ্রুততম মানবী হওয়ার পর তাই তেমন উচ্ছ্বসিত মন্তব্য পাওয়া যায়নি শ্যালির কাছ থেকে। চার বছর পর অনন্য গৌরবগাথা রচনার পরও দৃশ্যপটের খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। তবে গত আসরে না বলা অব্যক্ত কথা এবার ঠিকই বলেছেন শ্যালি-এ্যান ফ্রেশার। ১০০ মিটার স্প্রিন্টের শ্রেষ্ঠত্ব নিজের অধীনে রাখার পর তিনি বলেন, বেজিংয়ের এটা সম্পূর্ণ আলাদা। আমি তখন অনভিজ্ঞ, বয়স কম এবং কখনও বিশ্বাস করিনি জিততে পারব। এবার কিছুটা নার্ভাস থাকলেও বিশ্বাস ছিল সৃষ্টিকর্তা আমাকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেবেন। তিনি আরও বলেন, আত্মবিশ্বসের কারণেই এ সাফল্য পাওয়া সম্ভব হয়েছে। আমার কোচ, পরিবার ও শুভাকাক্সক্ষীরাও এ সাফল্যের ভাগীদার। এজন্য আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ।
২০০৮ সালে বেজিং অলিম্পিক এবং ২০০৯ সালে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটার জিতে ডবল জয়ের অনন্য কীর্তি গড়া শ্যালি-এ্যান ফ্রেশারের সময়টা ভাল যাচ্ছিল না। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ক্রীড়াযজ্ঞে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন স্বরূপে। মূল লড়াইয়ের আগে শ্যালি প্রথম রাউন্ড হিটে ১১.০০ সেকেন্ড ও সেমিফাইনালে ১০.৮৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে সবার আগে দৌড় শেষ করেছিলেন। মূল লড়াইয়েও সবাইকে টেক্কা দিয়ে জয় করেন কাক্সিক্ষত স্বর্ণপদক।

No comments

Powered by Blogger.