ঈদের আগে চাঁদাবাজি- ঈদ সামনে রেখে ঢাকায় চাঁদাবাজেরা বেপরোয়া by নজরুল ইসলাম

রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বর সেকশনে পোশাক কারখানার মালিক মোহাম্মদ সজীবের কাছে গত রোববার চাঁদা চেয়ে চিরকুট পাঠিয়েছে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করলেও ভয়ে আছেন ওই ব্যবসায়ী।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার চাঁদা না পেয়ে সন্ত্রাসীরা পল্লবীতে নির্মাণাধীন বাড়িতে ঢুকে লিটন হোসেন (২২) নামের


এক নির্মাণশ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে। একই দিন চাঁদার জন্য সন্ত্রাসীরা রামপুরার উলনে ৩০টি দোকান ভাঙচুর করে।
পুলিশের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ‘ঈদ বকশিশের’ নামে রাজধানীতে সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ী, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি কর্মকর্তা ও নির্মাণাধীন বাড়িমালিককে লক্ষ্য করে চাঁদাবাজি করছে সন্ত্রাসীরা। অনেক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীরা নিজেদের নাম ও মুঠোফোন নম্বর লিখে চাঁদা দিতে যোগাযোগ করার জন্য বাড়ির দারোয়ান, অফিসের পিয়ন বা কর্মচারীদের কাছে চিরকুট দিয়ে যায়। চিরকুট নিতে গড়িমসি করলে কিংবা না নিতে চাইলে তাদের গুলি বা মারধর করা হয়ে থাকে। এ রকম চিরকুট নিতে রাজি না হওয়ায় সন্ত্রাসীরা গত ৩ জুলাই মিরপুর ১২ নম্বরে নির্মাণাধীন বাড়ির শ্রমিক আবদুল মালেককে গুলি করে আহত করে। এমনকি চাঁদার জন্য খুনের ঘটনাও ঘটছে। দুই লাখ টাকা চাঁদার জন্য সন্ত্রাসীরা গত শনিবার বিকেলে শেওড়াপাড়ায় ব্যবসায়ী নূরুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করে।
১০ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে না পেয়ে সন্ত্রাসীরা গত ২৬ জুলাই পল্লবীর প্যারিস রোডের হারুন অর রশীদের বাসায় বোমা পেতে রাখে। পরে ডিবির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল সেটি নিষ্ক্রিয় করে। এর আগে ২২ জুলাই সন্ত্রাসীরা চাঁদার জন্য বাড্ডার মগরোদিয়া এলাকায় কবির হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে গুলি করে আহত করে।
রমজান মাসের গত ১৮ দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদার দাবিতে হুমকি ও হামলার শতাধিক ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা থানা-পুলিশ পর্যন্ত যান না। গেলেও খুব একটা প্রতিকার পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে থানায় মামলা ও জিডি করার পরপর সেই খবর সন্ত্রাসীদের কাছে চলে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে অনেকে গোপনে সন্ত্রাসীদের হাতে চাঁদা তুলে দিয়ে নিরাপদে থাকতে চান।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের মুখপাত্র মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদাবাজি ঠেকাতে রোজার আগে ঢাকার ব্যবসায়ীদের নিয়ে সভা করেছে মহানগর পুলিশ। ঈদের বাজারে চাঁদাবাজি ঠেকাতে ইতিমধ্যে মহানগর পুলিশ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। তিনি বলেন, চাঁদাবাজ প্রতিরোধে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি সেল রয়েছে। চাঁদাবাজির শিকার ব্যক্তিদের ডিবিতে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেন তিনি।
পুলিশ সূত্র জানায়, অনেক ক্ষেত্রে ছিঁচকে সন্ত্রাসীরাও কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করে থাকে বলে অভিযোগ আছে। বিদেশে পলাতক কুখ্যাত সন্ত্রাসী শাহাদতের সহযোগী গাজী সুমন পরিচয় দিয়ে গত বৃহস্পতিবার এক ব্যক্তি মুঠোফোনে মিরপুর ১ নম্বরে কাপড়ের ব্যবসায়ী মোসাদ্দেক হোসেনের কাছে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দিলে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ওই ব্যবসায়ী শাহ আলী থানায় জিডি করেছেন।
এর আগে গত ১৯ জুলাই নিজেকে সন্ত্রাসী সাগির পরিচয় দিয়ে ভারতীয় মুঠোফোন নম্বর থেকে ফোন করে মিরপুরের ব্যবসায়ী খবিরুজ্জামানের কাছে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, সাগির অনেক আগেই পুরান ঢাকায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। তাঁর নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করার অভিযোগে স্থানীয় দুই সন্ত্রাসীকে পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছে। তবে খবিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ওই দুই সন্ত্রাসী জামিনে বেরিয়ে আসায় তিনি শঙ্কিত।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের উৎপাত অনেক কমে গিয়েছিল। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এদের অনেকে আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে চাঁদাবাজি করছে। পুলিশের হিসাবে রাজধানীতে তিন শতাধিক সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার এড়িয়ে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে।
পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মাঠে রয়েছে। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। জানতে চাইলে র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিচ্ছিন্ন কিছু চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে। ঈদের বাজারে চাঁদাবাজি ঠেকাতে বাস, রেল ও লঞ্চ টার্মিনাল এবং মার্কেটগুলোর সামনে র‌্যাব সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে।
কোন এলাকায় কারা চাঁদাবাজ: ঢাকা মহানগর পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন সময় ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার চাঁদাবাজদের একটি তালিকা তৈরি করেছে পুলিশ।
এই তালিকা অনুযায়ী, মিরপুর, দারুস সালাম, শাহ আলী ও রূপনগর এলাকায় পলাতক সন্ত্রাসী শাহাদতের নাম ভাঙিয়ে গাজী সুমন, আজম, পিয়াল, লোটাস, মুজিবুল, রুনু, সাগর, মিন্টু, পাভেল, আশিক, লিটন, রমজান, শাকিল, হিমেল, নাদিম, লম্বা মাসুদ, গালিব, আলী নূর, কাঁকন, সাহেবাতুল, রাজু, রাকিব, লেলিন, মামুন, বোমা মনির, মুক্তার, ডিস শাহীন, হাসান, মিজান, কিলার হাইশ্যা, মুরগী মিলন (মিরপুর), কামাল ওরফে টুণ্ডা কামাল, মন্টু, বাতেন, ডাইল মাহফুজ, বনি, রুবেল, মনু, বিল্লাল, বাবু, রকি, নজরুল, কিরন, নোমান, সিট্টু মিজান, মহসীন, সুজন, দেলোয়ার, মামুন, বদন, মিঠু, জাকির, সাজু সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিতে জড়িত। একই এলাকায় কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে আবার চাঁদাবাজিতে জড়িয়েছে রেজু, এবাদুল, ব্যাঙ্গা বাবু, হাত কাটা নিজাম, মুন্সী কাইয়ুম, পল্টন, কম্পিউটার সোহেল, টিপু, বল্টু রাসেল, জাকির, জসিম, পাংকা সুমন ও রহমত। পল্লবী থানার ১১ নম্বর ও ১২ নম্বর এবং বেনারসি পল্লিতে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে চান, আশিক, মামুন ও মিজান।
কাফরুল থানা এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে শাহাদতের ঘনিষ্ঠ শাহীন সিকদার। তার হয়ে চাঁদা আদায় করছে মেহেদি, হারুন, চামাইরা বাবু, কামাল, জনি, খসরু, ভাইগনা মাসুদ, লিটন, আবু, কাওছার, জনি ও রাজু। একই এলাকায় কিলার আব্বাস ও তাজ কারাগার থেকে মুঠোফোনে সহযোগী নুরু, মুক্তার ও স্বপনের মাধ্যমে চাঁদাবাজি করছে বলেও পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে।
মোহাম্মদপুরে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে হালিম, হাসু, পিয়ারুল, মামুন ওরফে পরকা মামুন, মুরগি টিপু, আবদুস সাত্তার, বাবু ওরফে এক্সেল বাবু, রুবেল ওরফে রুমেল, সুমন, কামরুল হাসান, শাহ মোহাম্মদ মজিদ, আনোয়ার হোসেন সেন্টু ও ফরিদ।
ধানমন্ডিতে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে ক্যাট বাবু, সোহেল, জমির, ডিব্বা বাবু, বরুন, কাজল জালালি, নাদিম, তানভীর, সুলতান, সিরাজ, স্বপন, আরিফ, চান্দু ও আকরাম। আদাবরে সক্রিয় সন্ত্রাসী নবী হোসেনের সহযোগীরা।
রমনা-মৌচাক-মগবাজার-মালিবাগ এলাকায় সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের সহযোগী জিসান, খিজির আলম স্বপন, আরিফ, সোহেল, সালাম, সুলতান, সিরাজ, আকরাম, গাজী সিদ্দিকুর রহমান, শফিকুল ইসলাম বাবুল, মুন্না, লন্ড্রি দুলাল, হোন্ডা বাবু, নুরুল ইসলাম, শামীম, ইলিয়াস, উৎপল, স্বপন ও শান্ত চাঁদাবাজিসহ অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। তেজগাঁওয়ে আশিক বাহিনী, সাইদুল, সায়েম, বাদল, মনির, বিপ্লব, বাবুল, খোকন; সবুজবাগে মঞ্জুরুল ইসলাম, কাজল, সাত্তার, জুয়েল, বাবু; যাত্রাবাড়ীতে সজল, রনি ও জোবায়ের; পল্টনে আমিনুল, সুমন, রফিক, কাজল, বিলু; মতিঝিলে জসিম, মালু, রিপন, সাগর ওরফে পরিমল; শাহবাগে আলম, সেলিম, বেলাল, চায়না বাবু, গোবিন্দ, বাবুল চাঁদাবাজি করে বলে পুলিশের তালিকায় নাম রয়েছে।
পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে নিহত ডাকাত শহীদের সহযোগী স্বপন, খোকন, দুলাল ওরফে রাজু, টিটু, সেন্টু, নাজিম; কোতোয়ালিতে হাজি কামাল, কালা বাবু, পবন, কোরবান ও গোপীবাগে মনা বাহিনীকে চাঁদাবাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। বাড্ডায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে জিসান, শাহাজাদা; হাজারীবাগে রমজান, সাইদুল ওরফে সাইদুল্লাহ, সাইদ আকাশ, সোহেল, শাহ পরান, বিল্লাল ও আবুল; শ্যামপুরে শাহীন, বাবুল, সজল, রনি, ডেমরায় বুলু, এজাজ, মোহন ও মোজা; উত্তরখানে আল আমিন, পাভেল, সজীব, মাসুদ, রাজু ওরফে হাবিব, মাসুদ; উত্তরায় নাসিম কবীর বাবু, টর্নেডো বাবু, চায়না রাজু, রানা ও মঞ্জু চাঁদাবাজি করছে।

No comments

Powered by Blogger.