উচ্চশিক্ষা- রেকর্ডসংখ্যক জিপিএ-৫ ও ভর্তির চ্যালেঞ্জ by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
আরেকটি এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল হয়ে গেল। প্রায় নয় লাখ ২৭ হাজার শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়, পাস করে প্রায় সাত লাখ ২২ হাজার। পাসের হার ৭৮.৬৭। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬১ হাজার ১৬২ জন শিক্ষার্থী, গত বছর পেয়েছিল ৩৯ হাজার ৭৬৯ জন। জিপিএ-৫-এর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে।
আবার সরকারের শিক্ষা নিয়ে নানা উদ্যোগ থাকলেও দেশের শিক্ষার মান যে বিশেষভাবে উন্নত হচ্ছে, তা বলার সুযোগ নেই। ২০ বছর আগে যে শিক্ষার্থীদের পড়াতাম, তাদের তুলনায় এখনকার শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি, একাগ্রতা, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়েনি। এই দোষ শিক্ষার্থীদের নয়। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের মতো কঠিন আসরে আমাদের শিক্ষার্থীদের অর্জন ক্রমশই ভালো হচ্ছে। সেটা অবশ্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কল্যাণে নয়, দেশব্যাপী গণিত উৎসবের মতো সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমরা শিক্ষার্থীদের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা চ্যালেঞ্জ পছন্দ করে। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের কঠিন আসর থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য তারা প্রাণপণ চেষ্টা করে। বোর্ডের পরীক্ষায় আমরা এখনো এ রকম চ্যালেঞ্জ দিতে পারছি না।
বোর্ডের মাপকাঠিতে সর্বোচ্চ ফল করতে আমাদের শিক্ষার্থীদের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় না। এখন জিপিএ-৫ পাওয়া এতই সহজ যে প্রায় ৬১ হাজার শিক্ষার্থী অনায়াসে তা পেয়ে থাকে। মাত্রাতিরিক্ত জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশাও বাড়ে, অথচ শিক্ষার্থীদের পছন্দের প্রকৌশল কিংবা চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য পর্যাপ্ত আসন নেই। অন্যান্য বিষয়েও ভর্তি হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের তুলনায় আসনসংখ্যা নগণ্য। তাই বোর্ডের মাপকাঠিতে সর্বোচ্চ ফল করেও শিক্ষার্থীরা শুধু পছন্দসই বিষয়ই যে পড়তে পারবে না, তা নয়, স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ভর্তি হতে পারবে না। তাহলে তো মাপকাঠি গ্রহণযোগ্য হলো না।
যেভাবে আমরা জিপিএ সিস্টেমের সূচনা করেছি, তা দিয়ে শিক্ষার্থীদের মেধা, দক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাব রয়েছে, ভৌত অবকাঠামোও যথাযোগ্য নয়, নয় আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যথাযোগ্য, অভিজ্ঞ শিক্ষক দিয়ে সমৃদ্ধ। এমতাবস্থায় একমাত্র সুস্থ প্রতিযোগিতার সামনে শিক্ষার্থীদের দাঁড় করিয়ে দিয়ে, তাদের দক্ষতাকে, অফুরন্ত প্রাণশক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেই কেবল ব্যয়সাশ্রয়ীভাবে উৎকর্ষ অর্জন করা সম্ভব। ৬১ হাজার শিক্ষার্থী যদি প্রকৃতই জিপিএ পেয়ে থাকে, এই ফল কোনোভাবেই ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিতে ব্যবহার করার সুযোগ নেই। এইচএসসির ফলাফল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হলে তার গুণগত মান উন্নত করতে হবে। সম্ভবত গ্রেড পয়েন্টের ধাপের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে, প্রশ্নপত্রও উন্নত মানের হতে হবে। অবশ্য নানা বিষয়ে ভর্তির জন্য এইচএসসির ফলাফলের ওপর নির্ভর করলেই হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য স্যাট-জাতীয় টেস্টকে ব্যবহার করা হয়, ভারতবর্ষেও নানা ধরনের ভর্তি পরীক্ষা রয়েছে, যার মধ্যে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা একটি। আমাদের দেশে মেডিকেলে পড়ার জন্য এ রকম একটি সমন্বিত উদ্যোগ রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অন্য কোনো ক্ষেত্রে এ রকম সুযোগ আমরা তৈরি করতে পারিনি, ফলে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অল্প সময়ের মধ্যে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে বিড়ম্বিত হতে হয়।
সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য অনুরূপ অনুষদ অনুযায়ী প্রশ্ন করা যেতে পারে যেমন: বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায়। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য প্রকৌশল, চিকিৎসা, কৃষি। একটি পরীক্ষা দিয়েই শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ে তাদের র্যাংক অনুযায়ী ভর্তি হতে পারবে, ঠিক যে রকম প্রকৌশলের বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিষয়ে আমাদের মেডিকেল কলেজসমূহ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তারা শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোও এই নিয়ম সম্প্রসারিত করেছে। তাদের পক্ষে এই কাজটি করা সম্ভব হলে অন্যদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হবে না কেন? অবশ্য ভর্তি হতে ইচ্ছুক একজন শিক্ষার্থীর মান নির্ধারণে ভর্তি পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলও ব্যবহার করা প্রয়োজন। তবে এই কাজ সুষ্ঠুভাবে করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো স্যাটের অধিকতর সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এর জন্য এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও মূল্যায়ন পদ্ধতিও পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ হবে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও মূল্যায়নে আরও অনেক বেশি সম্পদের বিনিয়োগ হওয়া উচিত। শিক্ষায় হঠাৎ করেই পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না, তবে ভালো প্রশ্নপত্র ও মূল্যায়ন পদ্ধতির সূচনা করে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করা এমন কঠিন কাজ নয়। মুখস্থ করে প্রশ্নের উত্তর করতে পারলে সেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে পারে না, বরং নিত্যনতুন সমস্যা দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণী ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব, যা তাদের সেই দক্ষতা অর্জনে উৎসাহিত করবে।
এইচএসসি পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এখনো সম্ভব নয়। তা ছাড়া, এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলই যদি একজন শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির একমাত্র মাপকাঠি হয়, তাহলে পাবলিক পরীক্ষার পর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মধ্যকার সময়ের জন্য এই তরুণ শিক্ষার্থীদের সামনে চ্যালেঞ্জ কই?
বিভিন্ন দেশে তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগাতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যেমন: দেশের কাজে কিছু সময়ের জন্য শ্রম দেওয়া। কোরিয়ায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তার আগ্রহ অনুসারে দেশের জন্য কাজ করতে হয়। যেমন: গবেষণায় আগ্রহী একজন ভালো স্নাতক অল্প বেতনে দেশের জন্য গবেষণা করবে। আমাদের দেশেও এ ধরনের সুযোগ তৈরি করা উচিত।
দেশের সব উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ভর্তি সুচারুরূপে সম্পন্ন করা উচিত। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময়সূচিও ঘোষিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সমন্বয় থাকলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা মাত্রাতিরিক্ত ভোগান্তি থেকে রেহাই পাবেন।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
No comments