মহীয়সী নারী ফজিলাতুন নেছা by বেবী মওদুদ

গ্রামের নাম টুঙ্গিপাড়া। মধুমতী নদীর একটি শাখা, ‘বাইগার’ এঁকেবেঁকে চলে গেছে এই গ্রামের পাশ দিয়ে। সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিতে ঘেরা একটা সুন্দর ছবির মতো গ্রাম। যেখানে নদীর বাতাস এসে মন ভরিয়ে দেয়। আম-জাম-কাঁঠাল-তাল-তমালে ঘেরা ফসলের প্রান্তর এবং নদীর স্রোতে ভাসা রঙিন পাল তোলা নৌকা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।


এখানকার মানুষ বড় সরল, সাধারণ কৃষিজীবী।
এই টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৮৫৪ সালে নির্মিত দালান বাড়ি আছে। সেই বাড়ির একটি অংশে বাস করতেন শেখ আবুল কাশেম। ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট দুপুরে তাঁদের বাড়িতে জন্ম নিল একটি ফুটফুটে মেয়ে। খুশি হয়ে নাতনির নাম রাখলেন ফজিলাতুন নেছা। ফুলের মতো তার গায়ের রং দেখে মা হোসনে আরা বেগম ডাকতেন রেণু বলে। সেই নামে সবার কাছে তাঁর পরিচিতি হয়ে গেল।
রেণুর বয়স যখন মাত্র তিন বছর, হঠাৎ করেই তাঁর পিতা শেখ জহুরুল হক মারা গেলেন। তখন দাদা শেখ আবুল কাশেম রেণুর চাচাত ভাই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রেণুর বিয়ে দেন। পিতার জমিজমা রেণু ও বড় বোন জিনাতুন নেছাকে লিখে দেন দাদা। রেণুর বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর তখন তাঁর মা মারা গেলেন। বড় বোন জিনাতের সঙ্গে রেণুও এতিম হলো। কিন্তু শেখ মুজিবের মা সায়েরা খাতুন রেণুর চোখের পানি মুছিয়ে কোলে তুলে নিলেন। গভীর মমতায় নিয়ে এলেন নিজের ঘরে। ছোট্ট রেণুর আর কোন দুঃখ রইল না।
বাড়ির অন্যান্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে বড় হতে লাগল রেণু। গৃহশিক্ষক এসে বাড়ির ছেলেমেয়েদের বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজী পড়াতেন। মৌলভী সাহেব ধর্ম শিক্ষা দিতেন। রেণুও সবার সঙ্গে ঘরে বসে লেখাপড়া শিখতে থাকে। ঐ সময়ে মুসলিম ঘরের মেয়েরা ঘরের বাইরে স্কুলে লেখাপড়া করত না বলে তাঁরও আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হয়নি। প্রথমদিকে বাড়ির কাছে একটি পাঠশালায় কিছুদিন লেখাপড়া করে রেণু। তারপর আর স্কুলে যায়নি। ছোটবেলা থেকে রেণু ছিল শান্ত স্বভাবের, অসীম ধৈর্যশীল ও বুদ্ধিমতী। বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শাশুড়ির কাছে ধর্ম, সেলাই ও রান্নাবান্না এবং সংসারের নিয়মনীতির শিক্ষাও তার হয়েছিল। শাশুড়ির খুব স্নেহ ও আদরের পাত্রী ছিলেন রেণু। শেখ মুজিবের বয়স যখন কুড়ি বছর তখন তাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়।
শৈশব থেকে রেণু স্বামীর সঙ্গে একত্রে মানুষ হয়েছেন বলে স্বামী শেখ মুজিবের স্বভাব, চিন্তা-ভাবনাকে খুব ভাল করে জানতেন। পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম লীগের রাজনীতিতে শেখ মুজিব খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহের পাত্র ছিলেন শেখ মুজিব। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের গৌরবগাথা তিনি গভীর আগ্রহে স্বামীর কাছে শুনতেন। শেখ মুজিব যখন কলকাতায় কলেজে লেখাপড়া ও ছাত্র রাজনীতি করতেন, তখনও স্বামীকে অনুপ্রেরণা যোগাতেন রেণু। অনেক সময় প্রয়োজনে নিজের জমির ধান বিক্রির অর্থ পাঠিয়ে স্বামীকে সহযোগিতা করতেন। তিনি বই পড়তে খুব ভালবাসতেন। বড় হয়ে নিজেই ঘরে বসে স্কুল খুলে মেয়েদের লেখাপড়া, সেলাই শেখাতেন। এতেই ছিল তার আনন্দ। অনেক গরিব ছেলেমেয়েকে অর্থ সাহায্য দিতেন লেখাপড়ার জন্য। অনেক মা-বাবাকে অর্থ সাহায্য দিতেন মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য। একজন দানশীল নারী হিসেবে ছোটবেলা থেকেই তাঁর পরিচিতি ছিল। গরিব দুঃখীদের কষ্ট লাঘবে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। প্রথম সন্তান জন্মের সময় মারা যাওয়ার দুঃখ তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। ১৯৪৭ সালে শেখ হাসিনার জন্ম হলে তিনি খুব খুশি হন। এই কন্যাই হয়ে ওঠে তাঁর সুখ-দুঃখের সঙ্গী। আজীবন কন্যার ভালবাসাই তাকে মা-বাবার মমত্ব দিয়ে জড়িয়ে রেখেছিল।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলো। ব্রিটিশরা বিদায় নিল। শেখ মুজিব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শাস্ত্রে ভর্তি হন এবং রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৪৮ সালে শেখ মুজিব পূর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করে ভাষা আন্দোলন শুরু করেন। এরপর ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠিত হলে কারাগারে রাজবন্দী অবস্থায় তিনি যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন থেকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর কাছে তিনি আতঙ্ক হয়ে ওঠেন। মুজিবের পেছনে গোয়েন্দা ও পুলিশ লেগেই থাকত। মাতৃভাষা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব কারাগারে বন্দী ছিলেন। অনশন করার অপরাধে তাঁকে ফরিদপুর কারাগারে নিয়ে রাখা হয়। এ সময় তাঁর শারীরিক অবস্থা ছিল খুব খারাপ। রেণু দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। এক অজানা আশঙ্কায় তখন গভীর বিষণœতায় দিন কাটছিল রেণুর। তারপরও তিনি ধৈর্য হারাননি। কারাগারে অনশনে-অবসাদে মুজিব অত্যন্ত শীর্ণকায় হয়ে যান। শরীর এত দুর্বল হয়ে ওঠে যে, তিনি হাঁটাচলাও করতে পারতেন না। বিছানায় শুয়ে থাকতেন। অবশেষে সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব বাড়ি ফিরে এলে রেণু চোখের জল আর বেদনা বুকে জমিয়ে রেখে সেবা-যতেœ তাঁকে সুস্থ করে তোলেন। এ সময় শেখ মুজিব বেশ কিছুদিন বাড়িতে থাকায় মেয়ে হাসিনা ও ছেলে কামাল বাবার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। হাসিনা পিতার কাছে লেখাপড়াও শিখতে থাকেন।
কিন্তু মুজিব তো তাঁর পরিবারের মধ্যে নিজেকে বেঁধে রাখেননি। পিতা শেখ লুৎফর রহমান তাঁকে লন্ডনে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়তে বললেন। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি ভালবাসা তাঁকে আবার ঢাকায় রাজনীতির মাঠে নিয়ে এলো। ৯ জানুয়ারি দলের কাউন্সিল অধিবেশন হলে তিনি দলের সেক্রেটারি হলেন, এক আত্মনিবেদিত নেতা হিসেবে তিনি রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। দেশব্যাপী দলের সাংগঠনিক কাঠামোকে দৃঢ়ভাবে গড়ে তোলেন তিনি। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুলভাবে বিজয়ী হয়। শেখ মুজিব সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর টুঙ্গিপাড়া থেকে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসে ঢাকার রজনী বোস লেনে একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকতে শুরু করেন। ১৫ মে তিনি কৃষি উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী হিসেবে শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তখন পরিবারের সবাইকে নিয়ে ৩নং মিন্টো রোডের সরকারী বাড়িতে ওঠেন।
কিন্তু বেশি দিন এ সৌভাগ্য থাকেনি। পাকিস্তান সরকার ৩০ মে পূর্ববাংলা মন্ত্রিসভা বাতিল করে ৯২(ক) ধারায় গবর্নরের শাসন জারি করে। শেখ মুজিব আবার কারাবন্দী হলেন। এ অবস্থায় রেণু ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাজিরাবাজারে একটি ছোট ভাড়া বাড়িতে ওঠেন। এদিকে স্বামীর মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবীদের কাছে যাতায়াতও করতেন তিনি। অনেক সময় টাকার অভাবে নিজের গহনা বিক্রি করেও মামলার খরচ যুগিয়েছেন। আবার কারাগারে গিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করা, রান্না করে খাবার নিয়ে যাওয়ায় কোন ক্লান্তি তাঁর ছিল না। মুজিব ২৩ ডিসেম্বর ১৯৫৪ সালে কারামুক্ত হলেন।
তারপর সকলে টুঙ্গিপাড়ায় এসে কিছুদিন কাটালেন।
পরবর্তীতে ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে পূর্ববঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভায় শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও ভিলেজ এইড মন্ত্রী নিযুক্ত হন শেখ মুজিব। আবার ১৫ নম্বর আবদুল গনি রোডে সরকারি বাড়িতে আশ্রয় পেল তাঁর পরিবার। কিন্তু সেখানেও বেশি দিন থাকা হয়নি। কারণ মন্ত্রিত্বের চেয়ে দল তাঁর কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ভেঙে নতুন দল গড়লে ১৯৫৭ সালের ৩০ মে শেখ মুজিব স্বেচ্ছায় মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দল গোছাতে মনোনিবেশ করেন।
৭ অক্টোবর ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে, সংসদ ভেঙে দিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। রাজনৈতিক নেতাদের কারাবন্দী করে রাখে।
১২ অক্টোবর মুজিব কারাবন্দী হন। সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রায় দেড় বছর তাঁকে আটক করে রাখল। যেহেতু স্বামী কারাবন্দী , সে জন্য রেণুকে কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চাইত না। তিন দিনের নোটিসে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। প্রথমে সিদ্ধেশ্বরীর একটি নির্মীয়মাণ বাড়ির দুই কামরার বাড়িতে ছেলেমেয়ে ও শাশুড়িকে নিয়ে ওঠেন। এরপর অনেক কষ্টে সেগুনবাগিচায় দোতলা ছোট একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে তাঁরা বসবাস শুরু করেন। তাঁর মনের জোর ছিল প্রবল। দুঃসময়েও সবদিক লক্ষ্য রেখে শান্ত মনে নিজেই সামলাতে পারতেন সবকিছু। ছেলেমেয়ে নিয়ে বহু কষ্ট আর অভাব-অনটনের মধ্যেও তিনি সংসার চালিয়ে যেতে সমর্থ হন। নিজেই বাচ্চাদের কাপড় সেলাই করতেন। তাদের লেখাপড়ার দিকে লক্ষ্য রাখতেন। পিতার অভাবটা নিজের স্নেহ-ভালবাসায় ভরিয়ে দিতেন। আবার তাঁকে মামলার খোঁজখবর নিতে আইনজীবীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। কারাবন্দী স্বামীর সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতে হয়েছে। ১৯৬০ সালে কারামুক্ত হয়ে শেখ মুজিব মুক্তি পেলেও তখন জেনারেল আইয়ুব খান রাজনীতি নিষিদ্ধ করে রাখে। শেখ মুজিবকে ঢাকার বাইরে যেতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হতো।
১৯৬০ সালে কারামুক্ত হয়ে শেখ মুজিব আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন। সংসারে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। রেণু খুব গুছিয়ে সংসারের খরচ চালাতেন বলে মুজিবকে এই নিয়ে আর চিন্তা করতে হতো না। ঢাকায় এসে বসবাস করলেও তিনি প্রায়ই গ্রামে যেতেন শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখাশোনা করতে। অসুস্থ হলে ঢাকায় এনে সেবাযতœ করতেন।
১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন বাতিলের দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করলে শেখ মুজিব আবার গ্রেফতার হন।
১৯৫৬ সালে শেখ মুজিব এমপি থাকাকালে ধানম-ি বত্রিশ নম্বর সড়কে একটি প্লট বরাদ্দ পান। বুদ্ধিমতী রেণু ঢাকার ৩২ নম্বরের সেই প্লটে বাড়ি নির্মাণে মনোযোগী হন। প্রথমে দুটো কামরা করে বসবাসের জন্য ওঠেন ১ অক্টোবর ১৯৬১ সালে। এরপর ধীরে ধীরে একটা একটা করে কামরা তৈরি করিয়ে নিজেই বাড়িটি বানিয়ে শেষ করলেন। সব কাজ তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করতেন। খরচ বাঁচাবার জন্য নিজের হাতে পানি দেয়া, ইট ভেজানোসহ বহু শ্রম, যতœ ও মমতা দিয়ে ৩২ নম্বরের বাড়িটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে এই ৩২ নম্বরই হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাকেন্দ্র। এ বাড়ি থেকেই শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। বাঙালীর রাজনৈতিক আন্দোলনে এ বাড়িটি ছিল সর্বস্তরের জনগণের আশ্রয়স্থল।
১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের অবসান হলে ১৮ জুন শেখ মুজিব কারামুক্ত হয়ে জেনারেল আইয়ুবের বিরুদ্ধে রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা হয়, মানুষ রুখে দাঁড়ায়। ২৫ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হলে শেখ মুজিব দেশব্যাপী সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর পাকিস্তানী শাসকদের দমন-পীড়ন, বৈষম্য-বঞ্চনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২ জানুয়ারি ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল আইয়ুব খান বিজয়ী হলেন। আর সর্বদলীয় বিরোধী দলের প্রার্থী ছিলেন মিস ফাতেমা জিন্নাহ। শেখ মুজিব মিস ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। কিন্তু নির্বাচনের পূর্বে শেখ মুজিব গ্রেফতার হলেন। ১ মার্চ ১৯৬৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেন এবং ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে লাহোরে বাঙালীর মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন। এ সময় অনেকদিন মুজিব বাড়িতে স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে বেশ আনন্দে জীবনযাপনের সুযোগ পান। সংসারের হাল ধরে থাকতেন ফজিলাতুন নেছা রেণু। নির্ভীক কাণ্ডারির মতো সবদিক পরিচালনা করতেন তিনি। কখনও কোন অনুযোগ অভিযোগ তাঁর কণ্ঠে শোনা যেত না। ধীরস্থির থেকে সবকিছু সামলিয়ে নিতে পারতেন। এ তাঁর এক মহৎ গুণ, যা মানুষকে অনেক বড় মাপের করে তোলে।
১৯৬৬ সালের ৮ মে শেখ মুজিব নারায়ণগঞ্জে ছয় দফার সমর্থনে বিশাল জনসভা করে ঘরে ফেরেন। সেই দিন গভীর রাতে বাড়ি ঘেরাও দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় আইয়ুবের পুলিশ বাহিনী। এর আগে বিভিন্ন জেলায় ছয় দফার ব্যাখ্যা দিয়ে ভাষণ দেয়ার জন্য তাঁকে বারবার গ্রেফতার ও জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। এই আন্দোলনের পেছনেও বেগম মুজিবের এক দুঃসাহসী ভূমিকা ছিল। বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির সভা হতো। তিনি নিজে কাপড় কিনে সেলাই করে চাদর বিছিয়ে সভার ব্যবস্থা করতেন। নিজের হাতে চা-নাশতা বানিয়ে দিতেন। রান্নাবান্না করেও সবাইকে খাওয়াতেন। সভার বিষয়ের প্রতি নজর রাখতেন। শেখ মুজিবের অবর্তমানে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতেন।
ছয় দফার জন্য আটক রাখার দেড় বছর পর ৩ জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়, যার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। এ সময় কয়েক মাস শেখ মুজিবের কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। তাঁকে ১৭ জানুয়ারি ক্যান্টনমেন্টে সৈনিকদের মেসে বন্দী করে সার্বক্ষণিক কড়া নজরদারিতে রাখা হয়। শেখ মুজিব তাঁর সিদ্ধান্ত ও সাধনায় অটল ছিলেন।
ফজিলাতুন নেছা রেণু এ সময় প্রচণ্ড সাহসিকতার পরিচয় দেন। গোয়েন্দা সংস্থার অফিসাররা ৩২ নম্বরের বাসায় এসে তাঁকে জিজ্ঞসাবাদ করত এবং কারাবন্দী রাখার হুমকিও দিত। সে ছিল এক দুঃসময়। সে সময়ে তিনি একদিকে কঠিন হাতে সংসার চালানো, অন্যদিকে দলীয় নেতাকর্মীদের সহযোগিতা করার দায়িত্বও পালন করেন। দলীয় সাংগঠনিক কাজকর্ম দেখাশোনা এবং সভা-সমাবেশের ব্যবস্থাও তাঁকে করতে হতো। নেতাকর্মীদের পরিবারকে অর্থ সাহায্যও করতে হতো। প্রতিটি বন্দী নেতার পরিবারকে মাসের বাজারের টাকা নিজে পৌঁছে দিতেন। দলীয় কর্মীদেরও কিছু আর্থিক সাহায্য দিতেন।
১৯ জুন ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা শুরু হলো। প্রবাসী বাঙালীদের সহযোগিতায় লন্ডন থেকে শেখ মুজিবের জন্য প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামকে আনা হলো। শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে। (চলবে)

লেখক : সাংবাদিক ও সংসদ সদস্য

No comments

Powered by Blogger.