সিরিয়ায় তুরস্কের ভূমিকা by ড. আহমদ খলিলুর রহমান
সিরিয়ায় চলছে শিয়া-সুন্নি গৃহযুদ্ধ। শিয়া সংখ্যালঘুর স্বৈরাচারী সমর-সরকার আর ব্যাপকতর বিপুল সংখ্যাগুরু নিরস্ত্র সুন্নি জনসাধারণ ও তাদের ভেতর থেকে জনপ্রতিরক্ষায় অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে যারা, সেই সুন্নি বিপ্লবী- তাদের এ গৃহযুদ্ধ বিস্তৃত হচ্ছে উত্তরে তুরস্ক আর পূর্বে ইরাকে, উদ্বাস্তু আর মুক্তিবাহিনীর আশ্রয়স্থল হিসেবে ওই দুই দেশের জমি
ব্যবহৃত হওয়ার ভেতর দিয়ে। ইরাকে এর আগেই ষড়যন্ত্র ও বহির্দেশীয় হস্তক্ষেপের ব্যবহারের মাধ্যমে শিয়া চক্র ক্ষমতা দখল করায় ইরাকের মাটিতে আশ্রয়প্রার্থী সিরীয় উদ্বাস্তু আর মুক্তিযোদ্ধাদের পড়তে হচ্ছে আরো বিপাকে। অনেকটা বন্দিদশায় পড়ার মতো। সিরিয়ার স্বৈরাচারী শিয়া সমর-শাসকগোষ্ঠীই এর আগে পশ্চিমের লেবাননে বারংবার সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে হিজবুল্লাহর মতো নিজেদের ঠেঙাড়ে বাহিনী দিয়ে সেখানকার জনসাধারণের বিবিধ অংশকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। সেই বাহানায় পশ্চিম সীমানায় অন্যান্য শক্তির হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা সারাক্ষণই ঘাপটি মেরে আছে। দক্ষিণে ক্ষুদ্র রাজ্য জর্দানের নবী বংশীয় সুন্নি রাজা এর মধ্যে বেশ কিছু দিন আগে বলেছেন, নবী বংশের 'মহব্বতের' অভিনয়কারী শিয়ারা যেন চারদিক থেকে জর্দানকে ঘিরে ফেলছে। ক্ষুদ্র এক গৃহযুদ্ধ বলে মনে হচ্ছে যেই সিরিয়া সংঘাতকে, আসলে তা এক ভয়ংকর আন্তর্জাতিক যুদ্ধের রূপ নিতে পারে। যদি এর আগুনকে অঙ্কুরেই নিভিয়ে না ফেলা যায়। এখানে পুরো এলাকার সবচেয়ে শক্তিশালী সমরশক্তিধর গণতান্ত্রিক সরকারাধীন তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, তুরস্ক সেই ভূমিকাই পালনে ব্রতী। তবে খুব টিমটিমেভাবে। তুরস্কের এ বিষয়ে আরো বেশি নিশ্চিত ও শক্তিশালী ভূমিকাধর হওয়া দরকার। ইতিহাসের ধারায় আর তুরস্কের ঐতিহ্যে এটাই এখন তুরস্কের নিয়তি নির্ধারিত ভূমিকা। মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকার সূচনা ষোড়শ শতাব্দীতে তুর্কি শাসক সুলায়মানের প্রতি সর্বশেষ আব্বাসীয় খলিফার খেলাফত অর্পণের মাধ্যমে।
সপ্তম শতাব্দীতে মদিনা শরিফে নবী হিসেবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্য, তথা মুসলমান অধ্যুষিত বিশ্বে যে এক নতুন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তাকে খেলাফত বলে। আজকাল আধুনিক রাজনৈতিক ধারণায় অভ্যস্ত কিছু লোক এই খেলাফতকে 'ইসলামী রাষ্ট্র' বা এ রকম কিছু বলে থাকে যা ঠিক নয়। কেননা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাত্রেরই যা জানার কথা, 'রাষ্ট্র' নামক শাসনব্যবস্থাটির উৎপত্তি হয় ১৬৪০ সালের ওয়েস্টফালিয়া চুক্তির মাধ্যমে উত্তর-পশ্চিম জার্মানিতে। তার প্রায় হাজার বছর আগ থেকেই সুদূর আরব্যোপদ্বীপে এক বাস্তব শাসনব্যবস্থা হিসেবে চলে আসা 'খেলাফত' এই রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনো রূপ- 'ইসলামী' বা অন্য কোনো- যে হতে পারে না, তা-ও সাধারণ যুক্তিতেই বোঝা যায়। 'খেলাফত' ছিল একটি কাজের নাম- আর তা থেকে ওই কাজের কার্যব্যবস্থাকে 'খেলাফত' বলা হতো। কাজটি ছিল 'খলিফা'র কাজ। 'খলিফা বলা হতো-আরবিতে, এখনো বলা হয় কারো 'খলফ' তথা পেছনে, তার কাজ যে করে যায় তাকে। ইসলামী ধর্মীয় পরিভাষায় 'খলিফা' বলা হলো নবী হিসেবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যে কাজ, তাঁর মনুষ্য সমাজে দৃশ্য সশারীরিক উপস্থিতির অবর্তমানে তাঁর পেছনে তাঁর কাজ করে যান যিনি, তাঁকে। জীবদ্দশায়ও তিনি কখনো কখনো তাঁর কর্মপীঠ মদিনা শরিফ ছেড়ে বাইরে গেলে পুরো সমাজের জন্য সাধারণভাবে একজন, আর তাঁর নিজস্ব নবী বংশের জন্য একজন 'খলিফা' নিয়োগ করে যেতেন- সাধারণত প্রথমোক্ত প্রকার 'খলিফা' হিসেবে 'অন্ধ সাহাবি' বলে খ্যাত হজরত আবদুল্লাহ বিন মকতুম (রা.), আর দ্বিতীয় প্রকার 'খলিফা' হিসেবে হজরত আলী (রা.)-কে নিয়োগ দিতেন। একপর্যায়ে ধর্মীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত তথা 'ফতোয়া' দানের জন্য হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত আলী (রা.)সহ ৯ জন সাহাবিকে 'খলিফা' হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। নিজের ইন্তেকালের অব্যবহিত আগে সমগ্র মুসলিম সমাজের জন্য তিনি 'ইমাম' হিসেবে নিজের ভূমিকায় হজরত আবু বকর (রা.)-কে নিযুক্ত করেছিলেন। অন্য এক উপলক্ষে একটি হাদিস শরিফ অনুযায়ী, হজরত আবু বকর (রা.), হজরত ওমর (রা.), হজরত ওসমান (রা.), হজরত আলী (রা.)- এই চারজনকে সমাজের সর্বময় কর্মে নিজের 'খলিফা' নিয়োগ করেছিলেন। বিদায় হজ থেকে ফেরার পথে এক জায়গায় 'বেলায়েত'-এর বিষয়ে হজরত আলী (রা.)-কে নিজের 'খলিফা' অলি নিয়োগ করেছিলেন। এসব ঘটনা দিয়ে মুসলমানদের ভেতর শাসনকার্যসহ সব কাজেই নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শারীরিক অবর্তমানে তাঁর নিয়োজিত খলিফাদের অনুগত্য-অনুসরণ পদ্ধতি ও রেওয়াজ প্রতিষ্ঠিত হয়, তাঁর পার্থিব জীবদ্দশায়ই। তাঁর ইন্তেকালের পরও এই পদ্ধতি ও রেওয়াজ চালু থাকে- শাসনকার্যের ক্ষেত্রে তাতে ছেদ পড়ে ১৯২৪ সালে তুরস্কে কামাল পাশার সামরিক স্বৈরাচারী হস্তক্ষেপের মাধ্যমে।
অন্যান্য ক্ষেত্রে তা তার পরও চলতে থাকে, যদিও পাশ্চাত্য ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলের নিষ্পেষণে তা বহুলাংশে স্তিমিত হয়ে পড়ে। আর তার প্রভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষিতজনরা তা ভুলে বসে।
নবী হিসেবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাজ ছিল প্রধানত দুটি- এক. ঐশী শিক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান বিতরণ। দুই. সমাজে ওই জ্ঞানের প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজ সংস্কার ও সংরক্ষণ। প্রথম কাজটির নাম হলো 'ইমামত'- 'অগ্রণীর কাজ', আর দ্বিতীয়টির নাম হলো 'আমিরত'- 'ব্যবস্থাপকের কাজ'। সমাজের 'ইমাম' তথা 'অগ্রণীর ভূমিকা হলো সেইসব জ্ঞানীর যাঁরা প্রজন্ম পরম্পরায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর তরফ থেকে অর্পিত নিয়োগ পরম্পরার (ইসলাফ) মাধ্যমে ঐশী জ্ঞান বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত হন।
আব্বাসীয় খলিফার শিয়া প্রধানমন্ত্রী বিজাতীয় বর্বর মোঙ্গলদের সঙ্গে গোপনে ষড়যন্ত্র করে মোঙ্গল সর্দার চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে তৎকালের খলিফার রাজধানী বাগদাদ আক্রমণ করিয়ে প্রায় সমগ্র মুসলিম বিশ্বে রক্তগঙ্গা প্রবাহিত করায়। তার আশা ছিল মোঙ্গলরা তাকে 'খলিফার' মসনদে বসিয় দেবে। কয়েক শতাব্দী পর বাংলাদেশে একইভাবে ষড়যন্ত্রকারী শিয়া সেনাপতি মীরজাফরের বিজাতীয় ইংরেজের সহায়তায় বাংলার নবাবের মসনদে স্থায়ীভাবে বসার আশা যেমন সার্থক হয়নি, আব্বাসীয় খলিফার শিয়া ষড়যন্ত্রকারী প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও তা হয়নি। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় আব্বাসীয় খেলাফত প্রায় ভেঙে পড়ে। এমতাবস্থায় মিসরে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া সর্বশেষ আব্বাসী 'খলিফা' তখনকার উদীয়মান তুর্কি বীর সুলায়মানের হাতে 'খেলাফত' কার্য তথা খলিফার ভূমিকা ন্যস্ত করলে তখন থেকেই তুর্কিরা নিজেদের মুসলিম বিশ্বের অভিভাবক হিসেবে দেখতে শুরু করে। আর এই কার্যের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে শিয়া ষড়যন্ত্রকে। প্রায় চার শতাব্দী ধরেই প্রকাশ্যে এবং সজ্ঞানে তারা এই ভূমিকা পালন করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিতে আবারও অন্যান্য কারণের ভেতর খেলাফতের আমলাতন্ত্রের উচ্চপর্যায়ে অনুপ্রবেশকারী শিয়া ষড়যন্ত্রকারীদের ভূমিকার মাধ্যমে তুর্কিদের খেলাফত ধ্বংস হয় ১৯২৪ সালে। তখন থেকে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব, বিশেষ করে তার প্রধান ও মূল ধারা সুন্নিদের অভিভাবক ও তার প্রধান শত্রু শিয়া ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা এই ভূমিকা তুর্কি সমাজ তার সামাজিক অবচেতনায় আত্মস্থ করে রাখে। দরকার মতো তা কখনো কখনো প্রকাশ্যে ও সচেতনায় বেরিয়ে আসে। যেমন কয়েক বছর আগে ইউরোপে বসনিয়ায় মুসলমানদের গণহত্যার সময় তুরস্ক প্রকাশ্যে তাদের অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আজকে আবারও সিরিয়ার স্বৈরাচারী সংখ্যালঘু শিয়া সমরযজ্ঞের প্রতিপক্ষে সিরিয়ার ব্যাপকতর বিপুল সংখ্যাগুরু 'সুন্নি'দের অভিভাবক হিসেবে, সিরিয়ার শিয়া স্বৈরাচারী সরকারের প্রতিপক্ষে তুরস্ক আবির্ভূত হয়েছে।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক, হার্ভার্ড ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সপ্তম শতাব্দীতে মদিনা শরিফে নবী হিসেবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্য, তথা মুসলমান অধ্যুষিত বিশ্বে যে এক নতুন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তাকে খেলাফত বলে। আজকাল আধুনিক রাজনৈতিক ধারণায় অভ্যস্ত কিছু লোক এই খেলাফতকে 'ইসলামী রাষ্ট্র' বা এ রকম কিছু বলে থাকে যা ঠিক নয়। কেননা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাত্রেরই যা জানার কথা, 'রাষ্ট্র' নামক শাসনব্যবস্থাটির উৎপত্তি হয় ১৬৪০ সালের ওয়েস্টফালিয়া চুক্তির মাধ্যমে উত্তর-পশ্চিম জার্মানিতে। তার প্রায় হাজার বছর আগ থেকেই সুদূর আরব্যোপদ্বীপে এক বাস্তব শাসনব্যবস্থা হিসেবে চলে আসা 'খেলাফত' এই রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনো রূপ- 'ইসলামী' বা অন্য কোনো- যে হতে পারে না, তা-ও সাধারণ যুক্তিতেই বোঝা যায়। 'খেলাফত' ছিল একটি কাজের নাম- আর তা থেকে ওই কাজের কার্যব্যবস্থাকে 'খেলাফত' বলা হতো। কাজটি ছিল 'খলিফা'র কাজ। 'খলিফা বলা হতো-আরবিতে, এখনো বলা হয় কারো 'খলফ' তথা পেছনে, তার কাজ যে করে যায় তাকে। ইসলামী ধর্মীয় পরিভাষায় 'খলিফা' বলা হলো নবী হিসেবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যে কাজ, তাঁর মনুষ্য সমাজে দৃশ্য সশারীরিক উপস্থিতির অবর্তমানে তাঁর পেছনে তাঁর কাজ করে যান যিনি, তাঁকে। জীবদ্দশায়ও তিনি কখনো কখনো তাঁর কর্মপীঠ মদিনা শরিফ ছেড়ে বাইরে গেলে পুরো সমাজের জন্য সাধারণভাবে একজন, আর তাঁর নিজস্ব নবী বংশের জন্য একজন 'খলিফা' নিয়োগ করে যেতেন- সাধারণত প্রথমোক্ত প্রকার 'খলিফা' হিসেবে 'অন্ধ সাহাবি' বলে খ্যাত হজরত আবদুল্লাহ বিন মকতুম (রা.), আর দ্বিতীয় প্রকার 'খলিফা' হিসেবে হজরত আলী (রা.)-কে নিয়োগ দিতেন। একপর্যায়ে ধর্মীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত তথা 'ফতোয়া' দানের জন্য হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত আলী (রা.)সহ ৯ জন সাহাবিকে 'খলিফা' হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। নিজের ইন্তেকালের অব্যবহিত আগে সমগ্র মুসলিম সমাজের জন্য তিনি 'ইমাম' হিসেবে নিজের ভূমিকায় হজরত আবু বকর (রা.)-কে নিযুক্ত করেছিলেন। অন্য এক উপলক্ষে একটি হাদিস শরিফ অনুযায়ী, হজরত আবু বকর (রা.), হজরত ওমর (রা.), হজরত ওসমান (রা.), হজরত আলী (রা.)- এই চারজনকে সমাজের সর্বময় কর্মে নিজের 'খলিফা' নিয়োগ করেছিলেন। বিদায় হজ থেকে ফেরার পথে এক জায়গায় 'বেলায়েত'-এর বিষয়ে হজরত আলী (রা.)-কে নিজের 'খলিফা' অলি নিয়োগ করেছিলেন। এসব ঘটনা দিয়ে মুসলমানদের ভেতর শাসনকার্যসহ সব কাজেই নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শারীরিক অবর্তমানে তাঁর নিয়োজিত খলিফাদের অনুগত্য-অনুসরণ পদ্ধতি ও রেওয়াজ প্রতিষ্ঠিত হয়, তাঁর পার্থিব জীবদ্দশায়ই। তাঁর ইন্তেকালের পরও এই পদ্ধতি ও রেওয়াজ চালু থাকে- শাসনকার্যের ক্ষেত্রে তাতে ছেদ পড়ে ১৯২৪ সালে তুরস্কে কামাল পাশার সামরিক স্বৈরাচারী হস্তক্ষেপের মাধ্যমে।
অন্যান্য ক্ষেত্রে তা তার পরও চলতে থাকে, যদিও পাশ্চাত্য ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলের নিষ্পেষণে তা বহুলাংশে স্তিমিত হয়ে পড়ে। আর তার প্রভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষিতজনরা তা ভুলে বসে।
নবী হিসেবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাজ ছিল প্রধানত দুটি- এক. ঐশী শিক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান বিতরণ। দুই. সমাজে ওই জ্ঞানের প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজ সংস্কার ও সংরক্ষণ। প্রথম কাজটির নাম হলো 'ইমামত'- 'অগ্রণীর কাজ', আর দ্বিতীয়টির নাম হলো 'আমিরত'- 'ব্যবস্থাপকের কাজ'। সমাজের 'ইমাম' তথা 'অগ্রণীর ভূমিকা হলো সেইসব জ্ঞানীর যাঁরা প্রজন্ম পরম্পরায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর তরফ থেকে অর্পিত নিয়োগ পরম্পরার (ইসলাফ) মাধ্যমে ঐশী জ্ঞান বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত হন।
আব্বাসীয় খলিফার শিয়া প্রধানমন্ত্রী বিজাতীয় বর্বর মোঙ্গলদের সঙ্গে গোপনে ষড়যন্ত্র করে মোঙ্গল সর্দার চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে তৎকালের খলিফার রাজধানী বাগদাদ আক্রমণ করিয়ে প্রায় সমগ্র মুসলিম বিশ্বে রক্তগঙ্গা প্রবাহিত করায়। তার আশা ছিল মোঙ্গলরা তাকে 'খলিফার' মসনদে বসিয় দেবে। কয়েক শতাব্দী পর বাংলাদেশে একইভাবে ষড়যন্ত্রকারী শিয়া সেনাপতি মীরজাফরের বিজাতীয় ইংরেজের সহায়তায় বাংলার নবাবের মসনদে স্থায়ীভাবে বসার আশা যেমন সার্থক হয়নি, আব্বাসীয় খলিফার শিয়া ষড়যন্ত্রকারী প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও তা হয়নি। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় আব্বাসীয় খেলাফত প্রায় ভেঙে পড়ে। এমতাবস্থায় মিসরে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া সর্বশেষ আব্বাসী 'খলিফা' তখনকার উদীয়মান তুর্কি বীর সুলায়মানের হাতে 'খেলাফত' কার্য তথা খলিফার ভূমিকা ন্যস্ত করলে তখন থেকেই তুর্কিরা নিজেদের মুসলিম বিশ্বের অভিভাবক হিসেবে দেখতে শুরু করে। আর এই কার্যের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে শিয়া ষড়যন্ত্রকে। প্রায় চার শতাব্দী ধরেই প্রকাশ্যে এবং সজ্ঞানে তারা এই ভূমিকা পালন করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিতে আবারও অন্যান্য কারণের ভেতর খেলাফতের আমলাতন্ত্রের উচ্চপর্যায়ে অনুপ্রবেশকারী শিয়া ষড়যন্ত্রকারীদের ভূমিকার মাধ্যমে তুর্কিদের খেলাফত ধ্বংস হয় ১৯২৪ সালে। তখন থেকে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব, বিশেষ করে তার প্রধান ও মূল ধারা সুন্নিদের অভিভাবক ও তার প্রধান শত্রু শিয়া ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা এই ভূমিকা তুর্কি সমাজ তার সামাজিক অবচেতনায় আত্মস্থ করে রাখে। দরকার মতো তা কখনো কখনো প্রকাশ্যে ও সচেতনায় বেরিয়ে আসে। যেমন কয়েক বছর আগে ইউরোপে বসনিয়ায় মুসলমানদের গণহত্যার সময় তুরস্ক প্রকাশ্যে তাদের অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আজকে আবারও সিরিয়ার স্বৈরাচারী সংখ্যালঘু শিয়া সমরযজ্ঞের প্রতিপক্ষে সিরিয়ার ব্যাপকতর বিপুল সংখ্যাগুরু 'সুন্নি'দের অভিভাবক হিসেবে, সিরিয়ার শিয়া স্বৈরাচারী সরকারের প্রতিপক্ষে তুরস্ক আবির্ভূত হয়েছে।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক, হার্ভার্ড ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments