সপ্তাহের হালচাল- রংপুরের রাজনীতি কি প্রলম্বিত ছায়া ফেলবে? by আব্দুল কাইয়ুম
আগামী ডিসেম্বরে যদি নবগঠিত রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়, সেটা কেমন হবে? আর সেই নির্বাচনের ফলাফল কি পরবর্তী ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচনে প্রলম্বিত ছায়া ফেলবে? এ ব্যাপারে আমরা পরে আসছি।
আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি তো সরকারি দল। রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাদের সমর্থিত একক মেয়র প্রার্থী থাকবেন, না আলাদা, নাকি প্রতিটি দলের পরিচয় বহনকারী দু-তিনজন করে প্রার্থী থাকবেন—এ প্রশ্নগুলো সংগতভাবেই ওঠে। একাধিক প্রার্থী থাকলে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীর সুবিধা হবে, অবশ্য যদি তাঁরা নির্বাচন করেন। এসব বিষয়ে চূড়ান্ত কিছু বলার সময় এখনো আসেনি।
জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছে। আর সেটা নিশ্চিত না হওয়ায় তারা উপনির্বাচনেও যাচ্ছে না। কাপাসিয়ার শূন্য আসনে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য স্থানীয় নির্বাচনে যাবে না, এমন কথা তারা এখনো বলেনি। তাই আমরা ধরে নেব যে তারা অন্তত রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যাবে। যদি তা-ই হয়, তাহলে তা আগামী সাধারণ নির্বাচনে সব দলের অংশ নেওয়ার সম্ভাবনার একটি খিড়কি দুয়ার খুলে যাবে। সেদিক থেকে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটি জাতীয় তাৎপর্য বহন করে।
একটা ভালো লক্ষণ হলো, সব দল-মতের নেতা-কর্মীরা সিটি করপোরেশনকে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে চাইছেন। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি বা বিএনপির মধ্যে রাজনীতিতে পাল্টাপাল্টি আছে, সেটা জাতীয় রাজনীতির ব্যাপার বলে তাঁরা মনে করেন। আর সিটি করপোরেশন হলো নিজেদের ঘরের ব্যাপার। একে সব রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার কথা বলছেন তিনটি দলের নেতারা।
সম্প্রতি রংপুরে প্রথম আলোর উদ্যোগে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মূলত এ কথাটাই বলে গেলেন। তাঁরা আন্দোলন করে সিটি করপোরেশন পেয়েছেন। এর উন্নয়নই এখন সবার একমাত্র চিন্তা।
গোলটেবিল বৈঠকে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল, ‘কেমন সিটি করপোরেশন চাই?’ আলোচনায় নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার একান্ত প্রত্যাশার কথা সবাই বলেছেন। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, আইনের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, নতুন চাকরির ব্যবস্থার কথা জোরেশোরে এসেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও পাতালরেলের কথাও কেউ কেউ বলেছেন। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এসব করতে হবে—সিটি করপোরেশনের কাছে এটাই প্রত্যাশা। আর এ জন্য সবচেয়ে আগে দরকার রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সিটি করপোরেশনের জন্য কাজ করা। মেয়র যে দলের মনোনীত প্রার্থীই হোন, তাঁকে এ ব্যাপারে সচেতন থেকে কাজ করতে হবে।
তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা বেশ দৃঢ়ভাবে বলেছেন, যদি সব দলের সহযোগিতা থাকে, তাহলে রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রত্যাশিত উন্নয়ন সম্ভব। এমনকি রংপুর হতে পারে বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় রাজধানী’। চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক রাজধানীর পর উল্লেখযোগ্য অবস্থানে থাকবে রংপুর। চিকিৎসক ও সমাজকর্মী মফিজুল ইসলাম অনেকটা আস্থার সঙ্গে কথাটা বলেছেন, সবাই সমর্থনও করেছেন, ‘রংপুরে গ্যাস চাই। চাই আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল, পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়।’
রংপুর সিটি করপোরেশনকে রাজনৈতিক দলের নেতারা যে কত গভীর দৃষ্টিতে দেখেন, তা সত্যিই উৎসাহী হওয়ার মতো। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোজাফ্ফর হোসেন জানান, নির্বাচিত মেয়রকে মানুষের কাছে যেতে হবে। অর্থাৎ তাঁর বিবেচনায়, মানুষই হবে মেয়রের সব কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। জাতীয় পার্টির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য মশিউর রহমান মনে করেন, সিটি করপোরেশন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। পাঁচ থেকে ১০ বছর নয়, শত বছর, হাজার বছর পর কী হবে, সে রকম ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা নিতে হবে। আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রথম কয়েক বছর বাজেটের বড় অংশ কেন্দ্র থেকে বরাদ্দ দিতে হবে। কারণ, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধার ব্যবস্থা করতে প্রচুর টাকা লাগবে, সিটি করপোরেশনের ক্ষমতায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য চাই সিটি গভর্নমেন্ট।’
আগে পৌরসভা ছিল ছোট। এখন সিটি করপোরেশনে বিশাল এলাকা অন্তর্ভুক্ত হবে। চারপাশের তুলনামূলক কম উন্নত এলাকার মানুষকেও বাড়তি হারে কর দিতে হবে, যদিও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে তাদের আরও বেশ কিছুদিন হয়তো বঞ্চিতই থাকতে হবে। এ ব্যাপারে রংপুরের একজন সাধারণ নাগরিক আবুল কাশেম বলেন, ‘বড় কিছু পেতে হলে তো কিছু দিতেই হবে। আমরাও কর দেব, কিন্তু উন্নয়ন না হলে মানুষ হতাশ হবে।’ আবুল কাশেম একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। ঢাকার উত্তরায় বাড়ি আছে। কিন্তু তিনি স্থায়ীভাবে রংপুরে থাকছেন ১৯৬৩ সাল থেকে। সবাই ঢাকা যেতে চায়, আর তিনি কেন রংপুরে থাকছেন? এর উত্তরে তিনি জানান, রংপুর হলো শান্তির শহর। ঢাকায় বেড়াতে গেলে কয়েক দিনের মধ্যেই ছেলেমেয়েরা হাঁপিয়ে ওঠে। বলে, ‘বাবা, চলো বাড়ি যাই!’
মো. হায়বতজান খান চাকরি করেন। রংপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। তিনি জানান, যাঁরা যোগ্য, দুর্নীতির ঊর্ধ্বে, তাঁদের মধ্য থেকে মেয়র নির্বাচিত করতে হবে। তিনি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
এ সবই হয়তো সম্ভব, যদি একটা শর্ত পূরণ হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি সহযোগিতার সম্পর্ক থাকে। রংপুর সিটি করপোরেশন যদি আটকায়, তাহলে এখানেই আটকাবে। জাতীয় রাজনীতিতে যে হিংসা ও হানাহানি চলছে, রংপুর তার বাইরে থাকতে পারবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।
অন্তত রংপুর সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকার উন্নয়নে রাজনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখার যে কথা মূল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা সেদিন গোলটেবিল বৈঠকে বলেছেন, সেটা যদি তাঁদের মনের কথা হয়, তাহলে আগামী ডিসেম্বরে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সিটি করপোরেশন নির্বাচন হওয়ার কথা। সেখানে যদি বিএনপি তাদের সমর্থিত প্রার্থীর মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সহনশীল রাজনীতির একটি শুভসূচনা উত্তরাঞ্চল থেকে ঘটতে পারে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সাধারণত জাতীয় রাজনীতির সূক্ষ্ম হিসাবের বাইরে রাখা হয়। স্থানীয় উন্নয়নের ইস্যুই সেখানে প্রাধান্য পায়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে স্থানীয় নির্বাচনকেও দলীয় রাজনীতির কালো চশমায় দেখার ঝোঁক সৃষ্টি হয়েছে। এই আপদ যত দ্রুত দূর হবে, ততই মঙ্গল।
যদি রংপুরে একটি ভালো নির্বাচন হয়, তাহলে আগামী বছর ঢাকা এবং এরপর অন্যান্য সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এরপর আসবে উপজেলা নির্বাচন। এসব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনের একটি পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে।
সেদিক থেকে বিচার করলে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন আসলে জাতীয় রাজনীতির জন্য একটি এসিড টেস্ট হিসেবে কাজ করবে। যদি সেটা সময়মতো না হয়, অথবা নানা আইনের মারপ্যাঁচে নির্বাচন ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, অথবা যদি নানা অজুহাতে বিএনপি এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে আগামী সাধারণ নির্বাচনের নীল আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা এখন থেকেই শুরু হয়ে যাবে। যদি বিএনপি সমর্থন করে, আর তারপর যদি নির্বাচনে বল প্রয়োগে কোনো মেয়র প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার অপচেষ্টা হয়, তাহলে তা দেশের রাজনীতিতে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। আর যদি এসব আশঙ্কা অমূলক বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে আগামী দিনের বাংলাদেশের রাজনীতি মানিক মিয়া এভিনিউয়ের মতো একেবারে অবাধ, সোজা ও সব দলকে আশ্বস্ত করার মতো বেশ প্রশস্ত হবে। আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি ভালোয় ভালোয়, সব দলের সমর্থনে অনুষ্ঠিত হোক। এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলে এর শুভ প্রভাবের সুশীতল প্রলম্বিত ছায়া পড়তে পারে আগামী জাতীয় নির্বাচনে। আমরা সেই কাঙ্ক্ষিত পরিণতির দিকে তাকিয়ে আছি।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছে। আর সেটা নিশ্চিত না হওয়ায় তারা উপনির্বাচনেও যাচ্ছে না। কাপাসিয়ার শূন্য আসনে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য স্থানীয় নির্বাচনে যাবে না, এমন কথা তারা এখনো বলেনি। তাই আমরা ধরে নেব যে তারা অন্তত রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যাবে। যদি তা-ই হয়, তাহলে তা আগামী সাধারণ নির্বাচনে সব দলের অংশ নেওয়ার সম্ভাবনার একটি খিড়কি দুয়ার খুলে যাবে। সেদিক থেকে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটি জাতীয় তাৎপর্য বহন করে।
একটা ভালো লক্ষণ হলো, সব দল-মতের নেতা-কর্মীরা সিটি করপোরেশনকে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে চাইছেন। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি বা বিএনপির মধ্যে রাজনীতিতে পাল্টাপাল্টি আছে, সেটা জাতীয় রাজনীতির ব্যাপার বলে তাঁরা মনে করেন। আর সিটি করপোরেশন হলো নিজেদের ঘরের ব্যাপার। একে সব রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার কথা বলছেন তিনটি দলের নেতারা।
সম্প্রতি রংপুরে প্রথম আলোর উদ্যোগে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মূলত এ কথাটাই বলে গেলেন। তাঁরা আন্দোলন করে সিটি করপোরেশন পেয়েছেন। এর উন্নয়নই এখন সবার একমাত্র চিন্তা।
গোলটেবিল বৈঠকে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল, ‘কেমন সিটি করপোরেশন চাই?’ আলোচনায় নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার একান্ত প্রত্যাশার কথা সবাই বলেছেন। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, আইনের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, নতুন চাকরির ব্যবস্থার কথা জোরেশোরে এসেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও পাতালরেলের কথাও কেউ কেউ বলেছেন। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এসব করতে হবে—সিটি করপোরেশনের কাছে এটাই প্রত্যাশা। আর এ জন্য সবচেয়ে আগে দরকার রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সিটি করপোরেশনের জন্য কাজ করা। মেয়র যে দলের মনোনীত প্রার্থীই হোন, তাঁকে এ ব্যাপারে সচেতন থেকে কাজ করতে হবে।
তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা বেশ দৃঢ়ভাবে বলেছেন, যদি সব দলের সহযোগিতা থাকে, তাহলে রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রত্যাশিত উন্নয়ন সম্ভব। এমনকি রংপুর হতে পারে বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় রাজধানী’। চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক রাজধানীর পর উল্লেখযোগ্য অবস্থানে থাকবে রংপুর। চিকিৎসক ও সমাজকর্মী মফিজুল ইসলাম অনেকটা আস্থার সঙ্গে কথাটা বলেছেন, সবাই সমর্থনও করেছেন, ‘রংপুরে গ্যাস চাই। চাই আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল, পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়।’
রংপুর সিটি করপোরেশনকে রাজনৈতিক দলের নেতারা যে কত গভীর দৃষ্টিতে দেখেন, তা সত্যিই উৎসাহী হওয়ার মতো। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মোজাফ্ফর হোসেন জানান, নির্বাচিত মেয়রকে মানুষের কাছে যেতে হবে। অর্থাৎ তাঁর বিবেচনায়, মানুষই হবে মেয়রের সব কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। জাতীয় পার্টির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য মশিউর রহমান মনে করেন, সিটি করপোরেশন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। পাঁচ থেকে ১০ বছর নয়, শত বছর, হাজার বছর পর কী হবে, সে রকম ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা নিতে হবে। আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রথম কয়েক বছর বাজেটের বড় অংশ কেন্দ্র থেকে বরাদ্দ দিতে হবে। কারণ, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধার ব্যবস্থা করতে প্রচুর টাকা লাগবে, সিটি করপোরেশনের ক্ষমতায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য চাই সিটি গভর্নমেন্ট।’
আগে পৌরসভা ছিল ছোট। এখন সিটি করপোরেশনে বিশাল এলাকা অন্তর্ভুক্ত হবে। চারপাশের তুলনামূলক কম উন্নত এলাকার মানুষকেও বাড়তি হারে কর দিতে হবে, যদিও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে তাদের আরও বেশ কিছুদিন হয়তো বঞ্চিতই থাকতে হবে। এ ব্যাপারে রংপুরের একজন সাধারণ নাগরিক আবুল কাশেম বলেন, ‘বড় কিছু পেতে হলে তো কিছু দিতেই হবে। আমরাও কর দেব, কিন্তু উন্নয়ন না হলে মানুষ হতাশ হবে।’ আবুল কাশেম একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। ঢাকার উত্তরায় বাড়ি আছে। কিন্তু তিনি স্থায়ীভাবে রংপুরে থাকছেন ১৯৬৩ সাল থেকে। সবাই ঢাকা যেতে চায়, আর তিনি কেন রংপুরে থাকছেন? এর উত্তরে তিনি জানান, রংপুর হলো শান্তির শহর। ঢাকায় বেড়াতে গেলে কয়েক দিনের মধ্যেই ছেলেমেয়েরা হাঁপিয়ে ওঠে। বলে, ‘বাবা, চলো বাড়ি যাই!’
মো. হায়বতজান খান চাকরি করেন। রংপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। তিনি জানান, যাঁরা যোগ্য, দুর্নীতির ঊর্ধ্বে, তাঁদের মধ্য থেকে মেয়র নির্বাচিত করতে হবে। তিনি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
এ সবই হয়তো সম্ভব, যদি একটা শর্ত পূরণ হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি সহযোগিতার সম্পর্ক থাকে। রংপুর সিটি করপোরেশন যদি আটকায়, তাহলে এখানেই আটকাবে। জাতীয় রাজনীতিতে যে হিংসা ও হানাহানি চলছে, রংপুর তার বাইরে থাকতে পারবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।
অন্তত রংপুর সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকার উন্নয়নে রাজনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখার যে কথা মূল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা সেদিন গোলটেবিল বৈঠকে বলেছেন, সেটা যদি তাঁদের মনের কথা হয়, তাহলে আগামী ডিসেম্বরে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সিটি করপোরেশন নির্বাচন হওয়ার কথা। সেখানে যদি বিএনপি তাদের সমর্থিত প্রার্থীর মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সহনশীল রাজনীতির একটি শুভসূচনা উত্তরাঞ্চল থেকে ঘটতে পারে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সাধারণত জাতীয় রাজনীতির সূক্ষ্ম হিসাবের বাইরে রাখা হয়। স্থানীয় উন্নয়নের ইস্যুই সেখানে প্রাধান্য পায়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে স্থানীয় নির্বাচনকেও দলীয় রাজনীতির কালো চশমায় দেখার ঝোঁক সৃষ্টি হয়েছে। এই আপদ যত দ্রুত দূর হবে, ততই মঙ্গল।
যদি রংপুরে একটি ভালো নির্বাচন হয়, তাহলে আগামী বছর ঢাকা এবং এরপর অন্যান্য সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এরপর আসবে উপজেলা নির্বাচন। এসব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনের একটি পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে।
সেদিক থেকে বিচার করলে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন আসলে জাতীয় রাজনীতির জন্য একটি এসিড টেস্ট হিসেবে কাজ করবে। যদি সেটা সময়মতো না হয়, অথবা নানা আইনের মারপ্যাঁচে নির্বাচন ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, অথবা যদি নানা অজুহাতে বিএনপি এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে আগামী সাধারণ নির্বাচনের নীল আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা এখন থেকেই শুরু হয়ে যাবে। যদি বিএনপি সমর্থন করে, আর তারপর যদি নির্বাচনে বল প্রয়োগে কোনো মেয়র প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার অপচেষ্টা হয়, তাহলে তা দেশের রাজনীতিতে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। আর যদি এসব আশঙ্কা অমূলক বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে আগামী দিনের বাংলাদেশের রাজনীতি মানিক মিয়া এভিনিউয়ের মতো একেবারে অবাধ, সোজা ও সব দলকে আশ্বস্ত করার মতো বেশ প্রশস্ত হবে। আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি ভালোয় ভালোয়, সব দলের সমর্থনে অনুষ্ঠিত হোক। এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলে এর শুভ প্রভাবের সুশীতল প্রলম্বিত ছায়া পড়তে পারে আগামী জাতীয় নির্বাচনে। আমরা সেই কাঙ্ক্ষিত পরিণতির দিকে তাকিয়ে আছি।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments