একজন সোনাবরু এবং রাজনৈতিক অনশন by খোন্দকার সোহেল
যে সোনাবরু এক মুঠো ভাতের জন্য প্রশ্ন ছুড়ে যায় ‘মা আমরা এত গরীব কেন?’ তার ক্ষুধার্ততায়ই আমি অনশনের সত্যতা খুঁজে পাই। পাই সামগ্রিক স্বত্ত্বার বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ প্রতিবাদী দৃশ্যপট। আমি অনশনের সত্যতা খুঁজে পাই ছিন্নমূল বিলকিসের মাঝে।
এরাই বাস্তবিক অর্থে অনশন করছে। সোনাবরুর অনশন ছিল “আমরণ অনশন”, সর্বনাশা এই অনশনের কারণে ফুটফুটে সোনাবরু নিজ গলায়ই ঝুলিয়ে দিয়েছিল ফাঁসির রশি। একমুঠো ভাতের জন্য সোনাবরু মিথ্যে আশ্বাসের শিকার হয়েছিল গর্ভধারিণীর কাছেও। “মা ভাত খাব”, “স্কুলে যা সোনা, এখনও চাল জোগাড় হয়নি। দুপুরে আমরা পেটপুরে ভাত খাব”। ক্ষুধায় কাতর সোনাবরু দু’মুঠো ভাতকে স্বপ্ন বানিয়ে গ্রামের মাঠ ধরেই ছুটে যায় পাঠশালায়।
২১ সেপ্টেম্বর ২০১১, দিনটি ছিল সোনাবরু জন্মদিন। বরগুনা সদর উপজেলার জাকিরতবক গ্রামের ১০ বছর বয়সী ফেরদৌসি আকতার সোনাবরুর দু’দিন ধরে পেটে ভাত পড়েনি। আশায় বুক বেঁধেছিল জন্মদিনে অন্তত পেটে কিছু দানাপানি দিতে পারবে বলে। ভাতের চেয়ে বেশি কিছু তার চাওয়ারও ছিল না। ক্ষুধায় কাতর সোনাবরু বিদ্যালয়ে ছিল সহপাঠীদের খুব প্রিয়ভাজন। সহপাঠীরা সোনাবরুর জন্মদিনটি উদযাপনের জন্য পার্শ্ববর্তী দোকান থেকে ৫ টাকা দিয়ে একটি কেক কিনে এনে খেলার ছলে শিশুসুলভ মননে পালনও করল সোনাবরুর জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে অন্তত ক্ষুধা লাঘব হবে এমনই উৎফুল্লতায় সোনাবরু সহপাঠীদের বলল, “জানিস, মা বলেছে আজ দুপুরে মুরগি জবাই করবে। আমি পেট পুরে ভাত খাব।” কিন্তু সোনাবরুর কপালে যে আর ভাত জুটবে না এবং এই জন্মবার্ষিকীই যে ফি বছর হবে মৃত্যুবার্ষিকী তা’ও তার জানা ছিল না। স্কুলে সোনাবরু গিয়েছিল ঠিকই, তবে লেখাপড়ায় ধ্যান ছিল না। মাত্র দু’টি ক্লাশ করেই ক্ষুধায় কাতর সোনাবরু সহপাঠী শিল্পীকে বলল- “এই শিল্পী, তুই ছুটি হলে আসিস, আমি যাই; এতক্ষেণ ভাত হয়ে গেছে”। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে মাঠ পেরিয়ে সোনাবরু পৌঁছে যায় রান্না ঘরে। কিন্তু হায়!, সোনাবরুর স্বপ্ন! দু’দিন ধরে ভাতের হাড়িটা যেমন শূন্য ছিল এখনও তা শূন্যতায়ই খা খা করছে। দু’দিনের উপোষ সোনাবরু অন্তত জন্মদিনে পেটপুরে খেতে পাবে এমনটিই আশা করেছিল। কিন্তু জন্মদিনেও হাড়িতে ভাত খুঁজে না পাওয়ার কষ্ট আর বেদনা সে সহ্য করতে পারল না। মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল- “মা ভাত কই?” লজ্জায় মা আকলিমা লাল হয়ে গেল। জন্মদিনে মেয়ের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার ব্যর্থতায় নিজে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। কেঁদে উঠল সোনাবরুও। নিজের পেটের ক্ষুধা আর মায়ের চোখের জল সোনাবরুকে আরও কষ্টের সাগরে ঠেলে দিল। কাঁদতে কাঁদতে সোনাবরু মায়ের কোলেই মূর্ছা গেল দু’-তিনবার। জ্ঞানহীন সোনাবরুর কঁচি মুখটা আকলিমা বুকের ভিতরে টেনে নিয়ে কাঁদতে থাকে। আবার দু’হাতে তুলে নিয়ে দু’গালে চুমো খায়। কিন্তু সোনাবরুর জ্ঞান ফেরে না। অচেতন সোনাবরুকে শুইয়ে রেখেই মা আকলিমা ছুটে চলে ভাতের খোঁজে প্রতিবেশীদের কাছে। কিন্তু কোথাও মেলেনি দু’মুঠো ভাত। ভাতে খোঁজে আকলিমা ছুটে যায় বাবার বাড়ি। কিন্তু নিয়তির পরিহাস সেখানেও আকলিমাকে কিছু গৃহস্থালীর কাজ করে দিয়ে তবেই চাল নিয়ে ফিরতে হয়। সন্ধ্যা নাগাদ আকলিমা বাড়ি ফিরে এসে দেখে ঘরের দরজা-জানালা সব খোলা। কোথাও সাড়াশব্দ নেই। কেমন একটা গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছে বাড়ি জুড়ে। তাড়াহুড়ো করে ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে ওঠে মা আকলিমা। তার কলিজার ধন সোনাবরুর নিথর দেহটা শূন্যে ঝুলছে। হাতে শক্ত করে ধরে আছে এক টুকরো চিরকুট। আকলিমার আর্তচিৎকারে ছুটে আসে দরিদ্র পাড়া প্রতিবেশীরা। সোনাবরুর নিথর দেহটা নামায় শূন্য থেকে। হাতের চিরকুটটায় সোনাবরু তার মাকে উদ্দেশ্য করে লিখে রেখে যায় কিছু প্রশ্ন- “মা, আমরা এত গরীব কেন? মা আমার বাবা কোথায়? বাবা থাকলে আমাদের আর ভাতের অভাব হত না, তাই না মা?” সেই সাথে সোনাবরু এই সমাজের বিত্তবান আর তথাকথিত জনদরদি সমাজপতিদের গালে কষে একটা থাপ্পর মেরে যায় গরীবের প্রতি ভালবাসা দেখানোর ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচন করে দিয়ে।
আজ সোনাবরু নেই, বেঁচে আছেন পাগলীনি প্রায় মা আকলিমা। এখনো তার পরিবারের অভাব কাটেনি। জোটেনা ঠিকমতো দু’মুঠো ভাত। মেয়ে হারানোর পর ভাবনা আর রোগে-শোকে পাথর হয়ে গেছেন আকলিমা। শারীরিক কাঠামোই জানান দিয়ে দেয় তার দারিদ্রতা। ঠিকমত মুখ ফুটে কথাও বলতে পারছেন না আকলিমা। সোনাবরুর কথা উঠলেই চোখ বেয়ে নেমে আসে অবিরাম ধারায় জল। ছেলে ইউনুস ও ফেরদৌসকে নিয়ে বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই চালাচ্ছেন অনবরত। অভাবের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে ফেরদৌসেরও লেখাপড়া। স্বামী কাসেম আলী দফাদার অসুখে ভুগে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন মেয়ের মৃত্যুরও আগে। আজও আকলিমা অন্নহীন থাকেন। যদিও বা মানুষের কাজ করে দিয়ে কিছু ভাত মাঝে মধ্যে জোগার করেন, কিন্তু তাও আর মুখে উঠেনা। মুখে নিতে গেলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সোনাবরুর ক্ষুুধার্ত চেহারা। শুনতে পান একটি প্রতিধ্বনি- “মা ভাত খাব।” এখনো চরম দারিদ্রতায় ভোগা আকলিমা জানান, সোনাবরুর মৃত্যুর পর অনেকেই তার বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন। বহুজন দিয়েছিল বহু প্রতিশ্রুতি। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। একমাত্র নাগরিক অধিকার নামক একটি মানবাধিকার সংগঠন আকলিমাকে একটি দুধের গরু কিনে দিয়েছিল। তাই নিয়েই এখন সময় কাটে আকলিমার। কোন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এসেছিল কিনা জানতে চাইতেই দেখলাম আকলিমার চোখে মুখে ফুটে ওঠেছে ভীতির ছাপ। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর জানালেন- “এসেছিল, তবে আমার সোনাবরুকে দেখতে না। আমাকে শাষাতে। সোনাবরু ক্ষুধার কারণে মারা গেছে এটা যেন আমি কারো কাছে………” আকলিমা যখন থতমত মুখ কথাগুলো বলছিলেন তার মুখ থেকে একরকম কথা টেনে নিয়েই ষাটোর্ধ আবদুর রাজ্জাক বললেন- “নেতাদের গ্রামে আসার সময় কোথায়? তারা গ্রামে আসে শুধু ভোটের সময়। ভোট হয়ে গেলে আর কেউ আমাদের খোঁজ নেয় না। মানুষ না খেয়ে মারা গেলে তাতেও নেতাদের কিছু যায় আসে না।” ক্ষোভ আর আক্ষেপ নিয়েই রাজ্জাক বলে ওঠে- “আমরা কি মানুষ? আমরা মানুষের মধ্যে পড়ি? আল্লায় আমাগো মানুষ বানায় নাই। মানুষ বানাইছে ওগো (নেতাদের); ওরাই বাঁইচা থাক, আমরা সব না খাইয়া মরলেই ওরা বাঁইচা যায়।”
ভাতের অভাবে সোনাবরুর আত্মহত্যার খবরে দেশজুড়ে হৈ চৈ পড়ে গেলে কিছু লোক ছুটে গিয়েছিলেন মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রতিশ্রুতির পাহাড় নিয়ে। কিন্তু ওই গ্রামে পা রাখেননি কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা সরকারি মহলের কেউ। রাজনীতিবীদদের সহানুভুতিতো আকলিমা পানই-নি; বরং শুনতে হয়েছে তাদের ধমক আর হুমকি। যেন ভাতের অভাবে সোনাবরুর মৃত্যুটাও একটা অপরাধ হয়েছে। আজ আকলিমা মুখ ফুটে বলতে পারেন না সোনাবরুর অকাল পরিণতির কথা। রাজনীতির কাছেই আজ আকলিমার ক্ষুধার্ততার স্বীকারোক্তিও বন্দি হয়ে গেছে। অথচ ক্ষুধায় কাতর সোনাবরু যখন ভাতের অভাবে কাতরাচ্ছিল তখনও তার সামনে এ সমাজের কেউ ভাত নিয়ে আসেনি। সমাজ তাকে ভাত না দিলেও দিয়েছিল গলায় ফাঁসের জন্য এক টুকরো রশি। ভাত পাগল (!) সোনাবরু ফাঁসের রশিটিকেই আপন করে নিয়েই হয়ে উঠল এ সমাজের বাস্তব অনশনের এক প্রতীক।
ভাতের জন্য সোনাবরুর এই লাশ এই সমাজকে বদলাতে পারেনি, পারেনি রাষ্ট্রকে; এমনকি পারেনি আমাদেরকেও। আমরা এখনও সত্যিকারের অনশন খুঁজি এবং তা ভালও বাসি। পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি করে তর্ক যুদ্ধেও লিপ্ত হই। ভাতের জন্য জীবন হারানো সোনাবরুর অনশনটা (ক্ষুধার্ততা) এখন আর আমাদের বিবেককে স্পর্শ করে না; করে অনশনের নামে ভদ্রবেশীদের নাটক। কেউ বলে “চাই সত্যিকারের অনশন”। আমি বলি সত্যিকারের অনশন চাওয়া আর নিজেকে সোনাবরুর খুনে রাঙানো একই কথা। সত্যিকারের অনশন কোন ভদ্রবেশীদের কাছে প্রত্যাশা করি না। কারণ, অনশনের সত্যতা নিয়ে এদেশে এখনো লাখ লাখ সোনাবরু প্রতিটি মূহুর্ত অনশন (ক্ষুধার্ত) করে যাচ্ছে। তাই আজ যারা সোনাবরুদের লাশের উপর দাঁড়িয়ে নাট্যমঞ্চেই অনশনের নাটক সাজান, সেটাকে আমি অনশন বলি না, বলি সোনাবরুদের সাথে ভদ্রবেশীদের ঠাট্টা আর প্রহসন। এটাকে যদি আমি অনশন বলে মেনে নেই, তাহলে সোনাবরুদের ক্ষুধার্ততাকে আমি কি বলব? কি জবাব দেব আমি সোনাবরুর আত্মার কাছে? যতদিন এ সমাজ, রাষ্ট্রে এসব সোনাবরুরা অনশনে (ক্ষুধার্ত) থাকবে ততদিন আমি কোন ভদ্রবেশীকে অনশনে দেখতে চাই না। আমি চাইনা কেউ আমার সোনাবরুদেরকে উপহাস করুক॥
(লেখাটি মঙ্গলধ্বনি’র ২য় প্রিন্ট সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।)
২১ সেপ্টেম্বর ২০১১, দিনটি ছিল সোনাবরু জন্মদিন। বরগুনা সদর উপজেলার জাকিরতবক গ্রামের ১০ বছর বয়সী ফেরদৌসি আকতার সোনাবরুর দু’দিন ধরে পেটে ভাত পড়েনি। আশায় বুক বেঁধেছিল জন্মদিনে অন্তত পেটে কিছু দানাপানি দিতে পারবে বলে। ভাতের চেয়ে বেশি কিছু তার চাওয়ারও ছিল না। ক্ষুধায় কাতর সোনাবরু বিদ্যালয়ে ছিল সহপাঠীদের খুব প্রিয়ভাজন। সহপাঠীরা সোনাবরুর জন্মদিনটি উদযাপনের জন্য পার্শ্ববর্তী দোকান থেকে ৫ টাকা দিয়ে একটি কেক কিনে এনে খেলার ছলে শিশুসুলভ মননে পালনও করল সোনাবরুর জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে অন্তত ক্ষুধা লাঘব হবে এমনই উৎফুল্লতায় সোনাবরু সহপাঠীদের বলল, “জানিস, মা বলেছে আজ দুপুরে মুরগি জবাই করবে। আমি পেট পুরে ভাত খাব।” কিন্তু সোনাবরুর কপালে যে আর ভাত জুটবে না এবং এই জন্মবার্ষিকীই যে ফি বছর হবে মৃত্যুবার্ষিকী তা’ও তার জানা ছিল না। স্কুলে সোনাবরু গিয়েছিল ঠিকই, তবে লেখাপড়ায় ধ্যান ছিল না। মাত্র দু’টি ক্লাশ করেই ক্ষুধায় কাতর সোনাবরু সহপাঠী শিল্পীকে বলল- “এই শিল্পী, তুই ছুটি হলে আসিস, আমি যাই; এতক্ষেণ ভাত হয়ে গেছে”। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে মাঠ পেরিয়ে সোনাবরু পৌঁছে যায় রান্না ঘরে। কিন্তু হায়!, সোনাবরুর স্বপ্ন! দু’দিন ধরে ভাতের হাড়িটা যেমন শূন্য ছিল এখনও তা শূন্যতায়ই খা খা করছে। দু’দিনের উপোষ সোনাবরু অন্তত জন্মদিনে পেটপুরে খেতে পাবে এমনটিই আশা করেছিল। কিন্তু জন্মদিনেও হাড়িতে ভাত খুঁজে না পাওয়ার কষ্ট আর বেদনা সে সহ্য করতে পারল না। মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল- “মা ভাত কই?” লজ্জায় মা আকলিমা লাল হয়ে গেল। জন্মদিনে মেয়ের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার ব্যর্থতায় নিজে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। কেঁদে উঠল সোনাবরুও। নিজের পেটের ক্ষুধা আর মায়ের চোখের জল সোনাবরুকে আরও কষ্টের সাগরে ঠেলে দিল। কাঁদতে কাঁদতে সোনাবরু মায়ের কোলেই মূর্ছা গেল দু’-তিনবার। জ্ঞানহীন সোনাবরুর কঁচি মুখটা আকলিমা বুকের ভিতরে টেনে নিয়ে কাঁদতে থাকে। আবার দু’হাতে তুলে নিয়ে দু’গালে চুমো খায়। কিন্তু সোনাবরুর জ্ঞান ফেরে না। অচেতন সোনাবরুকে শুইয়ে রেখেই মা আকলিমা ছুটে চলে ভাতের খোঁজে প্রতিবেশীদের কাছে। কিন্তু কোথাও মেলেনি দু’মুঠো ভাত। ভাতে খোঁজে আকলিমা ছুটে যায় বাবার বাড়ি। কিন্তু নিয়তির পরিহাস সেখানেও আকলিমাকে কিছু গৃহস্থালীর কাজ করে দিয়ে তবেই চাল নিয়ে ফিরতে হয়। সন্ধ্যা নাগাদ আকলিমা বাড়ি ফিরে এসে দেখে ঘরের দরজা-জানালা সব খোলা। কোথাও সাড়াশব্দ নেই। কেমন একটা গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছে বাড়ি জুড়ে। তাড়াহুড়ো করে ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে ওঠে মা আকলিমা। তার কলিজার ধন সোনাবরুর নিথর দেহটা শূন্যে ঝুলছে। হাতে শক্ত করে ধরে আছে এক টুকরো চিরকুট। আকলিমার আর্তচিৎকারে ছুটে আসে দরিদ্র পাড়া প্রতিবেশীরা। সোনাবরুর নিথর দেহটা নামায় শূন্য থেকে। হাতের চিরকুটটায় সোনাবরু তার মাকে উদ্দেশ্য করে লিখে রেখে যায় কিছু প্রশ্ন- “মা, আমরা এত গরীব কেন? মা আমার বাবা কোথায়? বাবা থাকলে আমাদের আর ভাতের অভাব হত না, তাই না মা?” সেই সাথে সোনাবরু এই সমাজের বিত্তবান আর তথাকথিত জনদরদি সমাজপতিদের গালে কষে একটা থাপ্পর মেরে যায় গরীবের প্রতি ভালবাসা দেখানোর ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচন করে দিয়ে।
আজ সোনাবরু নেই, বেঁচে আছেন পাগলীনি প্রায় মা আকলিমা। এখনো তার পরিবারের অভাব কাটেনি। জোটেনা ঠিকমতো দু’মুঠো ভাত। মেয়ে হারানোর পর ভাবনা আর রোগে-শোকে পাথর হয়ে গেছেন আকলিমা। শারীরিক কাঠামোই জানান দিয়ে দেয় তার দারিদ্রতা। ঠিকমত মুখ ফুটে কথাও বলতে পারছেন না আকলিমা। সোনাবরুর কথা উঠলেই চোখ বেয়ে নেমে আসে অবিরাম ধারায় জল। ছেলে ইউনুস ও ফেরদৌসকে নিয়ে বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই চালাচ্ছেন অনবরত। অভাবের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে ফেরদৌসেরও লেখাপড়া। স্বামী কাসেম আলী দফাদার অসুখে ভুগে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন মেয়ের মৃত্যুরও আগে। আজও আকলিমা অন্নহীন থাকেন। যদিও বা মানুষের কাজ করে দিয়ে কিছু ভাত মাঝে মধ্যে জোগার করেন, কিন্তু তাও আর মুখে উঠেনা। মুখে নিতে গেলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সোনাবরুর ক্ষুুধার্ত চেহারা। শুনতে পান একটি প্রতিধ্বনি- “মা ভাত খাব।” এখনো চরম দারিদ্রতায় ভোগা আকলিমা জানান, সোনাবরুর মৃত্যুর পর অনেকেই তার বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন। বহুজন দিয়েছিল বহু প্রতিশ্রুতি। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। একমাত্র নাগরিক অধিকার নামক একটি মানবাধিকার সংগঠন আকলিমাকে একটি দুধের গরু কিনে দিয়েছিল। তাই নিয়েই এখন সময় কাটে আকলিমার। কোন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এসেছিল কিনা জানতে চাইতেই দেখলাম আকলিমার চোখে মুখে ফুটে ওঠেছে ভীতির ছাপ। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর জানালেন- “এসেছিল, তবে আমার সোনাবরুকে দেখতে না। আমাকে শাষাতে। সোনাবরু ক্ষুধার কারণে মারা গেছে এটা যেন আমি কারো কাছে………” আকলিমা যখন থতমত মুখ কথাগুলো বলছিলেন তার মুখ থেকে একরকম কথা টেনে নিয়েই ষাটোর্ধ আবদুর রাজ্জাক বললেন- “নেতাদের গ্রামে আসার সময় কোথায়? তারা গ্রামে আসে শুধু ভোটের সময়। ভোট হয়ে গেলে আর কেউ আমাদের খোঁজ নেয় না। মানুষ না খেয়ে মারা গেলে তাতেও নেতাদের কিছু যায় আসে না।” ক্ষোভ আর আক্ষেপ নিয়েই রাজ্জাক বলে ওঠে- “আমরা কি মানুষ? আমরা মানুষের মধ্যে পড়ি? আল্লায় আমাগো মানুষ বানায় নাই। মানুষ বানাইছে ওগো (নেতাদের); ওরাই বাঁইচা থাক, আমরা সব না খাইয়া মরলেই ওরা বাঁইচা যায়।”
ভাতের অভাবে সোনাবরুর আত্মহত্যার খবরে দেশজুড়ে হৈ চৈ পড়ে গেলে কিছু লোক ছুটে গিয়েছিলেন মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রতিশ্রুতির পাহাড় নিয়ে। কিন্তু ওই গ্রামে পা রাখেননি কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা সরকারি মহলের কেউ। রাজনীতিবীদদের সহানুভুতিতো আকলিমা পানই-নি; বরং শুনতে হয়েছে তাদের ধমক আর হুমকি। যেন ভাতের অভাবে সোনাবরুর মৃত্যুটাও একটা অপরাধ হয়েছে। আজ আকলিমা মুখ ফুটে বলতে পারেন না সোনাবরুর অকাল পরিণতির কথা। রাজনীতির কাছেই আজ আকলিমার ক্ষুধার্ততার স্বীকারোক্তিও বন্দি হয়ে গেছে। অথচ ক্ষুধায় কাতর সোনাবরু যখন ভাতের অভাবে কাতরাচ্ছিল তখনও তার সামনে এ সমাজের কেউ ভাত নিয়ে আসেনি। সমাজ তাকে ভাত না দিলেও দিয়েছিল গলায় ফাঁসের জন্য এক টুকরো রশি। ভাত পাগল (!) সোনাবরু ফাঁসের রশিটিকেই আপন করে নিয়েই হয়ে উঠল এ সমাজের বাস্তব অনশনের এক প্রতীক।
ভাতের জন্য সোনাবরুর এই লাশ এই সমাজকে বদলাতে পারেনি, পারেনি রাষ্ট্রকে; এমনকি পারেনি আমাদেরকেও। আমরা এখনও সত্যিকারের অনশন খুঁজি এবং তা ভালও বাসি। পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি করে তর্ক যুদ্ধেও লিপ্ত হই। ভাতের জন্য জীবন হারানো সোনাবরুর অনশনটা (ক্ষুধার্ততা) এখন আর আমাদের বিবেককে স্পর্শ করে না; করে অনশনের নামে ভদ্রবেশীদের নাটক। কেউ বলে “চাই সত্যিকারের অনশন”। আমি বলি সত্যিকারের অনশন চাওয়া আর নিজেকে সোনাবরুর খুনে রাঙানো একই কথা। সত্যিকারের অনশন কোন ভদ্রবেশীদের কাছে প্রত্যাশা করি না। কারণ, অনশনের সত্যতা নিয়ে এদেশে এখনো লাখ লাখ সোনাবরু প্রতিটি মূহুর্ত অনশন (ক্ষুধার্ত) করে যাচ্ছে। তাই আজ যারা সোনাবরুদের লাশের উপর দাঁড়িয়ে নাট্যমঞ্চেই অনশনের নাটক সাজান, সেটাকে আমি অনশন বলি না, বলি সোনাবরুদের সাথে ভদ্রবেশীদের ঠাট্টা আর প্রহসন। এটাকে যদি আমি অনশন বলে মেনে নেই, তাহলে সোনাবরুদের ক্ষুধার্ততাকে আমি কি বলব? কি জবাব দেব আমি সোনাবরুর আত্মার কাছে? যতদিন এ সমাজ, রাষ্ট্রে এসব সোনাবরুরা অনশনে (ক্ষুধার্ত) থাকবে ততদিন আমি কোন ভদ্রবেশীকে অনশনে দেখতে চাই না। আমি চাইনা কেউ আমার সোনাবরুদেরকে উপহাস করুক॥
(লেখাটি মঙ্গলধ্বনি’র ২য় প্রিন্ট সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।)
No comments