সিরিয়ার রাজধানীর বুকে যুদ্ধের ঢেউ

সিরিয়ায় যুদ্ধের ঢেউ রাজধানী দামেস্কতে আঘাত হেনেছে। কয়েকদিন আগে সেখানে সরকারপন্থী টিভি চ্যানেল আখবারিয়ার ওপর বিদ্রোহী বাহিনীর হামলায় তিন সাংবাদিকসহ ৭ জন নিহত হয়। এর ঠিক একদিন আগে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ঘোষণা করেছিলেন যে সিরিয়ায় যুদ্ধাবস্থা চলছে।


তিনি সরকারবিরোধী অভ্যুত্থান দমনে সর্বশক্তি নিয়োগের জন্য নতুন মন্ত্রিসভার প্রতি নির্দেশ দিয়ে বলেন, আমরা যুদ্ধে যখন লিপ্ত হয়েই গেছি তখন এতে জয়ী হবার জন্য সকল শক্তি ও সামর্থ্যকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে।
বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে সরকারী বাহিনীর হাতে কোণাঠাসা হয়ে থাকার পর সশস্ত্র বিদ্রোহীরা ফ্রি সিরিয়ান আর্মির ছত্রছায়ায় সংঘবদ্ধ হয়ে এখন আক্রমণ চালাচ্ছে এবং একের পর এক সাফল্য লাভ করছে। বেশ কিছু শহর তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারী বাহিনীর ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ইউনিটগুলোর সঙ্গে গোপন আলোচনার পর এই সাফল্য এসেছে। দামেস্কের কাছাকাছি উপত্যকায় অবস্থিত গুচ্ছগ্রাম ওয়াদি বারাদার এক বাসিন্দাকে বলতে শোনা গেছে ‘আমাদের কোন সরকারের প্রয়োজন নেই। কারণ আমরা নিজেরাই নিজেদের চালাচ্ছি।’
বিদ্রোহী বাহিনীর কমান্ড কাঠামো এখনও ছোট হলেও তা ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। এতে বিদ্রোহীদের মনোবল বাড়ছে। তাদের সাংগঠনিক শক্তি জোরদার হচ্ছে। কোন কোন জায়গায় এডহক কমিটির স্থলাভিষিক্ত হয়েছে সামরিক পরিষদ। বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক ও সামরিক শাখার মধ্যে কয়েক মাস ধরে যে বিবাদ-বিসম্বাদ চলছিল শীঘ্রই তার অবসানের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সিরিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিল নিজেকে অপেক্ষমাণ সরকার হিসেবে দেখে থাকে। কউন্সিল তার নতুন নেতা হিসেবে আবদুল বাসিত সাইদাকে বেছে নিয়েছে। ইনি একজন মধ্যপন্থী কুর্দী যিনি ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’র প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছেন।
দীর্ঘদিন আগে সমর্থকদের প্রতিশ্রুত হাল্কা অস্ত্র, অর্থ ও মোবাইল ফোন এখন বিদ্রোহীদের হাতে আসতে শুরু করেছে। বেশিরভাগ আসছে ধনাঢ্য উপসাগরীয় আরবদের কাছ থেকে। এমনকি প্রবাসী সিরীয় ব্যবসায়ীরা যারা আগে শুধু ফিল্ড ক্লিনিকগুলোকে টাকা-পয়সা দিত তারা এখন অস্ত্রের জন্য টাকা দিতে অধিকতর আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তবে বিদ্রোহীদের অস্ত্রসম্ভার এখনও অতি সামান্য। তাই তারা গেরিলা যুদ্ধ কৌশল অনুসরণ করছে। এই কৌশলের দ্বারা গত ২৯ মে থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২৫টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছে তারা। বোমা হামলা ও বাস্তার পাশে চোরাগোপ্তা আক্রমণে কিছু সরকারী সৈন্য নিহত হয়েছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমে সরকারী বাহিনী মূলত সাজোয়া যানে চলাফেরা করে। দক্ষিণের সেনা ইউনিটগুলোকে তাদের নিরাপত্তা ঘাঁটির শক্তি বৃদ্ধি করতে হয়েছে। ১২ এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে। আর ১৬ মাসের লড়াইয়ে সৈন্য, বিদ্রোহী ও সাধারণ মানুষ মিলিয়ে মারা গেছে ১২ হাজারেরও বেশি। সিরীয় বাহিনী বহুলাংশে এক সুসংবদ্ধ বাহিনী। ওবে ইদানীং সৈন্য হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও বেড়ে গেছে। গত ১০ জুন পশ্চিমের তালবিশে শহরের কাছে বিমান-প্রতিরক্ষা ব্যাটেলিয়ানের প্রায় এক শ’ সৈন্য অস্ত্র ও গ্রেনেডসহ পালিয়ে গেছে।
রাজধানী দামেস্কে সরকারী বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে মাঝে মধ্যেই সংঘর্ষ হচ্ছে। প্রায় ক্ষেত্রে সরকারী অফিসের কাছাকাছি এই সংঘর্ষ ঘটে। গত ৮ জুন কয়েক শ’ বিদ্রোহী সমন্বিত আক্রমণ চালায়। তারা একটা মন্ত্রণালয়ে বোমা বিস্ফোরণেরও চেষ্টা করে। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজধানীতে ফ্রি সিরিয়ান আর্মির উপস্থিতি গণঅভ্যুত্থান শুরুর পর থেকে প্রথমবারের মতো অনুভূত হতে শুরু করেছে।
কিন্তু তারপরও সরকারের সামরিক শক্তির কাছে বিদ্রোহীদের শক্তি কিছুই নয়। যতই আক্রান্ত হচ্ছে সরকারী বাহিনী ততই বেশি নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিচ্ছে। সরকারী বাহিনীর দ্বারা অবরুদ্ধ পশ্চিমের হাফেহ শহরে হামলার কাজে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে। বিদ্রোহীদের সমর্থকদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার খবর অবশ্যই শোনা যায়। জাতিসংঘ সূত্রে বলা হয় ক্রমবর্ধমান সংখ্যক শিশুকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এই কাজটা করছে শাবিহা নামে পরিচিত সরকারপন্থী মিলিশিয়া। এরা শাসক আসাদ পরিবার এবং এর সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে যুক্ত ক্লাবগুলোর সদস্য এবং বিবিধ অপরাধ কর্মে জড়িত।
এক পর্যবেক্ষকের মতো হাত ছাড়া হওয়া এলাকায় সরকারের কর্তৃত্ব ফিরে পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই তাদের একমাত্র পথ হচ্ছে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় এসব লোক পাঠিয়ে স্থানীয়দের হত্যা করা। তবে সব শাবিহাই যে বাশারের শিয়া গোত্র আলাভী সম্প্রদায়ের সদস্য তা নয়। এদের রিক্রুট করা সহজ।
দেশের উত্তর-পশ্চিমে আলাভি সম্প্রদায়ের র‌্যাডিকেল অংশ শোনা যায় এমন পরিকল্পনার কথা ভাবছে যে তারা আশপাশের সুন্নি গ্রামগুলো থেকে সুনিীদের হটিয়ে দিয়ে একটা রাষ্ট্র গঠন করবে যা রক্ষা করতে পারা তাদের জন্য সহজতর। সে কারণেই হয়ত সুন্নি প্রধান এলাকা ইউলা ও কুবেইর-এ ব্যাপক হত্যাকা- চালানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই জাতিসংঘের বিশেষ দূতের পদ থেকে কফি আনান সরে দাঁড়িয়েছে । ফলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে । এর মধ্যে সাধারণ পরিষদের নিন্দা প্রস্তাব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উপর আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য চাপ সৃস্টি করেছে ।
সূত্র : দি ইকোনমিস্ট

No comments

Powered by Blogger.