ব্যর্থতার গ্লানি আর কত দিন? by সুজা উদ্দিন

অলিম্পিকের আরেকটি ব্যর্থ মিশন পার করল বাংলাদেশ। এ নিয়ে ৮ বার অলিম্পিকে অংশ নিয়ে প্রতিবারই খালি হাতে বিদায় নিতে হয়েছে লাল-সবুজদের। আর অলিম্পিক উপলক্ষে বাংলাদেশ অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশন (বিওএ) কর্মকর্তা ও সুবিধাপ্রাপ্তদের বিলাসী ভ্রমণ যেন চিরায়ত নিয়মে পরিণত হয়েছে।


ক্রীড়াবিদরা ব্যর্থ হলেও ব্যর্থ হননি ওয়ালিউল্লারা। সামনে নির্বাচনে বিধিবহির্ভূত ডাইরেক্টর পদ স্থিতিশিল করতে উর্ধতনদের মনোরঞ্জন করতে বিওএ’র বহর বাড়িয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। নিজের পরিবারের সদস্যদেরও ইউরোপে বিনোদনের রস দিয়েছেন। এর বাইরে দুর্নীতিবাজ, লুটেরা হিসেবে খ্যাত ওয়ালিউল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে ক্রীড়াবিদদের প্রস্তুতির মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার। সবমিলিয়ে বাজেটও দিয়েছিলেন তিনি বড় অঙ্কের, প্রায় ২ কোটি টাকার মতো।
মোহন, সাইক সিজার, রত্না, সাগর, মিলনদের কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল এবার আকাশচুম্বী। যদিও ওয়াইল্ড কার্ডের বদৌলতে অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া মিলনদের কাছে এতটা আশা করাই বৃথা। লন্ডন অলিম্পিকে প্রত্যাশার বীজ বপন করেছেন অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের ওয়ালিগংই। আর সফলও তাঁরা। ক্রীড়াবিদরা না পারলেও সোনা ছাড়া দেশে ফেরেননি ওয়ালিউল্লা। কারণ তার মিশন সফল। কাজেই এখন তাকে স্বর্ণপদক দেয়া যেতেই পারে। যদিও ক্রীড়াঙ্গনে প্রবাদ রয়েছেÑ ‘তার থুক্কু দাড়ির বিড়বিড়ানি’ বিশেষ শিহরণ জাগিয়ে থাকে ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট অনেক মহিলার। ফলে তাকে অনেকে ‘লুই.. ওয়ালি’ হিসেবেও আখ্যায়িত করে থাকেন, চোর-বাটপারের পাশাপাশি। অলিম্পিককে পুঁজি করে তাঁর সপরিবারে বিদেশ ভ্রমণের কারণে বিওএ থেকে তাকে অপসারণের দাবি এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে ফোনে ওয়ালির প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে লাইন কেটে দেন। আসলে অর্থ লুটপাটের পাশাপাশি স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি নিয়ে সরকারী অর্থে এই লন্ডন সফরের কোন সদুত্তর তাঁর কাছে নেই। ধরা খেয়ে গেছেন বলেই তাঁকে বিতাড়িত করার দাবি জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খোদ বিওএ’র অনেক কর্মকর্তাই।
এ্যাথলেটরা হয়ত তারা সাধ আর সাধ্যের মধ্যে যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছেন ভাল করতে। লন্ডন মিশন শেষে শনিবার দেশে ফিরেছেন শারমিন আক্তার রতœা, ইমদাদুল হক মিলন ও মাহফিজুর রহমান সাগর। সোমবার শেষ ক্রীড়াবিদ হিসেবে দেশে ফেরেন এ্যাথলেট মোহন খান। আর লন্ডন থেকে আমেরিকা ফিরে গেছেন জিমন্যাস্ট সাইক সিজার। নানা প্রতিবন্ধকতার মাঝেও এ্যাথলেটরা নিজেদের সর্বোচ্চ দেয়ার চেষ্টা করেছেন স্বপ্নের অলিম্পিকে। চারজনের মধ্যে সবচেয়ে ভাল করেছেন এ্যাথলেট মোহন খান। হিটে ১০০ মিটারে ১১.২৫ টাইমিং করে গ্রুপে সাতজনে পঞ্চম হয়েছেন। এটি তাঁর ব্যক্তিগত সেরা টাইমিং (ইলেকট্র্র্র্রনিক টাইমিংএ)। বাদ পড়েছেন হিটেই। ২৯ জনের মধ্যে মোহনের অবস্থান ছিল ২১তম। এর আগে ছিল ১১.৩১ গত বছর এশিয়ান এ্যাথলেটিকসে। তবে গত বছর জাতীয় মিটে হাতঘড়িতে ১০.৬০ সেকেন্ড তার টাইমিং ছিল। দেশে ফিরে আক্ষেপ সুরে মোহন জানান, সেখানে যে ঠা-া, তাতে তিনি অভ্যস্ত নন। না হলে আরও কম সময়ে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারতেন। বাংলাদেশের পাঁচ এ্যাথলেটের মধ্যে তাঁর অলিম্পিকে যাওয়াই নিশ্চিত হয়েছে সবার পরে। অন্য দেশের এ্যাথলেটরা এক-দেড় বছর প্রস্তুতি নিয়ে অলিম্পিকে অংশ নিয়েছে। সেখানে তার প্রস্তুতি দেড় মাস! হাস্যকর ব্যাপার। ‘অবশ্য লন্ডনের অভিজ্ঞতাটা নিঃসন্দেহে এসএ গেমসে উৎসাহ যোগাবে। পূরণ করতে চাই দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানবের হওয়ার স্বপ্ন।’ সাঁতারু মাহফিজার রহমান সাগর লন্ডনের এ্যাকুয়াটিক সেন্টারে দ্রুততম জলমানব হওয়ার ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইল ইভেন্ট শেষ করেন ২৪.৬৪ সেকেন্ড। হিটে আটজনের মধ্যে হয়েছেন সপ্তম। ৫৮ জনের মধ্যে ৩৯তম। অবশ্য দেশের পানিতে এর চেয়েও ভাল টাইমিং রয়েছে তার। ২০১০-এ ঢাকা এসএ গেমসে দুটিরুপা ও একটা ব্রোঞ্জ জেতা সাগর এই ইভেন্টে সময় নিয়েছিলেন ২৪.৫৩ সেকেন্ড। গত বছর চীনের সাংহাইয়ে ওয়ার্ল্ড সুইমিংয়ে ২৪.৮২ সেকেন্ড সময় নিয়ে ১২৩টি দেশের সাঁতারুদের মধ্যে ৬৩তম হয়েছিলেন। এবার এবটু পিছিয়ে পড়লেন। ইনজুরির কারণে ইভেন্ট শেষ করতে পারেননি জিমন্যাস্ট সাইক সিজার। ফ্লোর, প্যারালাল বার, হাইবার ও ভল্টে অংশ নিয়ে ৫৮.২৪৮ পয়েন্ট স্কোর করেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এই তরুণ বাঙালী। তবে পারফরমেন্সেও তিনি একেবারে অসন্তুষ্ট নন। ভল্টে সবচেয়ে ভাল করেছেন (১৫.১১৬), প্যারালাল বারে ১৪.৭৬৬, ফ্লোর এক্সারসাইজে ১৪.৬৬৬, হাই বারে ১৩.৭০০। হাতের ব্যথা বেড়ে যাওয়ায় পমেল হর্স ও স্টিল রিংয়ে অংশই নিতে পারেননি। মূলত তাকে নিয়েই প্রত্যাশাটা ছিল বেশি। গত বছর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সোনা জেতার মাধ্যমে নিজেকে চেনানো সাইক সিজার আশাটা জিইয়ে রাখলেন আগামী দিনের জন্য। মহিলা শূটার শারমিন আকতার রতœা ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে ৩৯৩ স্কোর করে ৫৬ জনের মধ্যে ২৭তম হয়েছেন। অলিম্পিকের আগে দু’মাস লন্ডনে অনুশীলনের সুযোগ পেলেও কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। অবশ্য নানা প্রতিবন্ধকতাও সঙ্গী হয়েছিল। এসএ গেমসে ৩৯৮ স্কোর করে সোনা জিতলেন, এরপর কমনওয়েলথ শূটিংয়ে ৩৯৬। বিদেশী কোচ পাননি। বিদেশের মাটিতে দেশীয় কোচ শোয়েবুজ্জামানের অধীনে অনুশীলন করেন। সে হিসেবে ৩৯৩ স্কোরটা হতাশারই বটে! তীরান্দাজ ইমদাদুল হক মিলন প্রাথমিক র‌্যাঙ্কিয়ে ৬১তম হয়ে চার নম্বর বাছাই স্বাগতিক ব্রিটেনের ল্যারি গডফ্রের কাছে হেরেছেন ৬-০ পয়েন্টে। এক সেট জিতলে ২ পয়েন্ট। তিন সেটে গডফ্রে জিতেছেন ২৭-১৮, ২৯-২৬ ও ২৮-১৯ পয়েন্টে। ২০০৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত অনুর্ধ ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে ১ নম্বর ছিলেন মিলন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আসরে তার যে স্কোর তাও করতে পারেননি এখানে। এ জন্য অবশ্য মিলন দায়ী করেন বাতাসকে। আর ব্যাঙ্ককে অনুশীলনের ধরন পরিবর্তন তো পেছনে আছেই।
অনুশীলন নিয়ে অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের টালবাহানা ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা না করাই ৫ ক্রীড়াবিদের খারাপ পারফরমেন্সের জন্য মূলত দায়ী। কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীন কর্মকা ও ভ্রমণবিলাস অবাক করার মতো। অলিম্পিকে কয়েক দফায় প্রায় ২৭ জনের বহর গেলেও এ্যাথলেটদের ঠিকমতো খোঁজখবর নেননি তারা। ২১ বছরী মার্কিন প্রবাসী সাইক সিজারের প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নেয়া নিয়ে নাটক কম হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে তাকে আর্থিক সহযোগিতা নিয়েও। প্রতিশ্রুত অর্থ পায়নি বলে লন্ডনে মিডিয়ার কাছে অভিযোগ করেছেন তার বাবা। শুধু তাই নয়, কর্মকর্তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ঠিকমতো সিডিউল সরবরাহ করতে পারেনি ও খোঁজখবর নেয়নি বলে জোরালো দাবি করেছেন তার বাবা মোহাম্মদ সিজার। তারা নিজেদের প্রমোদ ভ্রমণেই ব্যস্ত থেকেছেন বলে গুরুতর অভিযোগও রয়েছে। আর্থিক সহযোগিতাও ঠিকমতো করা হয়নি তাদের। অথচ সাইকের কোচ ও অনুশীলন বাবদ বিওএ ঠিকই বিপুল অঙ্কের খরচ দেখিয়েছেন ওয়ালিউল্লাহ। দেশে অনুশীলনে থাকা মোহন খান ও সাগরের দিকে কোন দৃষ্টিই ছিল না। মিলন ব্যাঙ্ককে কিছুদিন অনুশীলন করলেও পরিকল্পিত। উল্টো চিত্র রতœার ক্ষেত্রে। রতœাসহ চার শূটারকে অনুশীলনের জন্য নেয়া হয়েছে লন্ডনে। যদিও দেশী কোচের অধীনে! সেখানে ঘটনাক্রমে ডেভিড রজার স্বইচ্ছায় কিছুদিন রতœার মনোবিদ হিসেবে কাজ করলেও ওয়ালিউল্লাহ প্রচার করেছেন তিনি তাকে রতœার জন্য নিয়োগ দিয়েছেন। ভ্রমণপিপাসু ও অর্থলোভী ওয়ালিউল্লাহ মাস দুয়েক আগে চার শূটারকে নিজে লন্ডনে নিয়ে যান। তাদের রেখে ঢাকায় ফিরে মাঝখানে আবার দেখতে গেছেন। রতœাকে রেখে বাকিদের আনার জন্য আবার লন্ডনে গিয়েছেন। এ ভদ্রলোকের বয়স যে কয় বছর, অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের কল্যাণে বিদেশ ভ্রমণ রয়েছে তার চেয়ে বেশি। এবার অন্যদের মনরঞ্জনেও ব্যস্ত পয়ে পড়েছেন তিনি। সামনে অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন। পদে থেকে মওকা পাওয়া ওয়ালিউল্লাহ নির্বাচনে নিজের পথ পরিষ্কার করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন আরও কয়েকজন। তিনি অলিম্পিকের বেতনভুক্ত লোক হয়েও চট্টগ্রাম বিভাগের কাউন্সিলর, যা সম্পূর্ণ অবৈধ্য। আর বিধিবহির্ভূতভাবে সৃষ্ট ‘ডাইরেক্টর’ পদকে তিনি আবারও আঁকড়ে ধরে থাকতে চান। এ জন্য ক্রীড়ামন্ত্রী, ক্রীড়াসচিব এমনকি সচিবের পিএসকেও লন্ডনে সঙ্গে নিয়েছেন। বহরে ছিলেন এনএসসির কয়েক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ সুবিধাপ্রাপ্তরা। বাদ যায়নি স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূও। ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে এ্যাথলেটরা দেশে ফিরলেও এখনও ফেরেননি কর্মকর্তাদের অনেকেই। লন্ডনের যাতায়াতের জন্যই প্রায় কোটি টাকার বাজেট দেয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। এ্যাথলেটদের প্রশিক্ষণ বাবদ বানানো কোটি টাকার হিসাব তো আছেই। তাই এ্যাথলেটদের চেয়ে তারাই এখন বেশি আলোচনায়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এ্যাথলেটরা গায়ে এসব কলঙ্কর দাগ না মাখিয়ে দেশের মান বাড়াতে সামনে এগিয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা ক্রীড়াপ্রেমকিদের।

No comments

Powered by Blogger.