চারদিক- বেইজিংয়ে হুমায়ূনের সঙ্গে

প্রিয় লেখক, নাট্যকার ও ছবিনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে সামনাসামনি প্রথম দেখা হলো সুদূর গণচীনের রাজধানী বেইজিংয়ে, ১৯৮৭ সালের গ্রীষ্মকালে। একটি সাংস্কৃতিক সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের হয়ে হুমায়ূন আহমেদ চীন সফরে আসেন। প্রথমে দুই দিন সাংহাই সফর করে রাজধানী বেইজিংয়ে পৌঁছান বিকেলের দিকে।


ডেলিগেশনে আসা সদস্যরা বেইজিংয়ে দুই দিন দুই রাত থাকবেন, বিভিন্ন দ্রষ্টব্য দেখবেন, কিছু কেনাকাটাও করবেন। তাঁরা হয় কোনো হোটেলে অথবা কেউ কেউ রাষ্ট্রদূতের অতিথি হবেন। আমি হুমায়ূন আহমেদকে আমার বাসায় অতিথি রাখতে ইচ্ছা প্রকাশ করায় তিনি রাজি হয়ে গেলেন। রিসেপশন শেষে তাঁকে আমার ১২ তলার অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে এলাম। লাগোয়া বাথরুমসহ আমার একটি সুন্দর গেস্টরুম ছিল, সঙ্গে ঝোলা বারান্দা; অতিথির খুব পছন্দ হলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেইজিংয়ের প্রকৃতি দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বেইজিংয়ের খোলা আকাশে ধুলা আর শব্দের কারণে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার খুব একটা উপভোগ্য হলো না। এর মধ্যে তাঁকে জানালাম, তাঁর ভাই জাফর ইকবালের স্ত্রী ইয়াসমিন সম্পর্কে আমাদের ভাগনি হয়। সেই সুবাদে আমি তাঁর খালা।
বাড়ি আসতে আসতে বুঝলাম, আমি যদি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি কলেজে যোগদান না করে ঢাকা কলেজে যোগ দিতাম, তাহলে হুমায়ূন আহমেদ আমাকে শিক্ষক হিসেবে পেতেন। যেমন আমার সহপাঠী-সহকর্মী কয়েকজন তাঁর সরাসরি শিক্ষক। যা-ই হোক, সম্পর্কটা সহজ হয়ে গেছে এতক্ষণে। ফ্ল্যাটে ফিরে চা নিয়ে বসলাম। বললাম, আমার আরেকটি পরিচয় আছে, আমার চাচা সৈয়দ মুজতবা আলী। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, তিনি যে আমাদের অতি প্রিয় লেখক, গুরুই বলতে পারেন। তারপর চাচার গল্প শুরু হলো।
দূতাবাসের প্রথম সচিব মুন্সি ফয়েজ আমাদের সঙ্গে এসেছিলেন (ফয়েজ বর্তমানে চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত)। কিছুক্ষণ পর ফয়েজ বিদায় নিলে আমরা তিনজন রাতের খাবার সেরে নিলাম মাছ, মুরগি, সবজি, ডাল ও ভাত দিয়ে। হুমায়ূন খুব তৃপ্তি করে খেলেন। দু-তিন দিনে চীনের খাবারে অরুচি ধরেছে বোঝা যাচ্ছে। চা-কফি দেব কি না—জিজ্ঞেস করায় বললেন, চা-কফিতে অরুচি নেই কখনোই। তবে রাত জেগে আড্ডায় এলে আমারই বলা উচিত ছিল, চা-কফি কয়বার লাগবে। চা হাতে সবাই বসে গেলাম। হুমায়ূনের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। বললেন, খালা, অনুমতি ছাড়াই সিগারেট ধরিয়েছি।
এরপর চীনাদের নিয়মনীতি, আচরণ ও ভাষা নিয়ে গল্প। বললাম, একবার সময় নিয়ে আসেন, কাছে থেকে চীনাদের জীবনযাত্রা দেখবেন; আমি আপনাকে গ্রামে নিয়ে যাব।
দিনটি শনিবার, আমার স্কুল ছুটি। পরশু রোববার, ওই দিনও ছুটি। সকালে ফ্রেন্ডশিপ স্টোরে কিছু কেনাকাটা করে ওখান থেকে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে নিয়ে যাব। এক পাশে গ্রেট হল, আরেক পাশে ফরবিডেন সিটি, যতটা পারা যায় দেখে যাবেন।
কিচেনের ব্রেকফাস্ট টেবিলে গৃহকর্তাসহ তিনজন নাশতা খেতে বসলাম। পরোটা, আলুভাজি, অমলেট কী মজা করেই খেলেন। বললাম, মামা, ওয়ালে উঠতে অনেক এনার্জি লাগবে, ওখানে কোনো খাবার পাবেন কি না ঠিক নেই। কয়েকটা আপেল, কমলা, এক বোতল পানি ও কয়েকটা কোক দিয়ে দিলাম একটা ব্যাগে। ওয়াল দেখে আসেন, মতামত রাতে খাওয়ার পর শুনব। আমার কিন্তু মিশ্র মতামত। সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য বটে।
রাতে ডিনার শেষ হওয়ার পর সবাই বিদায় নিলে আজ বেশি রাত পর্যন্ত গল্প হলো না। গত রাত ও সারা দিনের ধকল—দম বেশি নেই। তবু লোভ ছাড়তে পারছি না। আড্ডায় বসলাম যথারীতি চা-কফি হাতে। অনেক সিগারেট ধ্বংস হলো। গ্রেট ওয়ালের বিশালতায় মুগ্ধ! পাহাড়ের গা বেয়ে এত বড় ওয়াল কীভাবে হলো। হুন দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করতে এই বেষ্টনী। অবাক হয়ে দেখে থাকতে হয় বটে, চাঁদ থেকে নাকি পৃথিবীর এই বেষ্টনী চোখে পড়ে। আমি বললাম, শুধু চোখে পড়ে না, মনেও আসে না সেই যুগে এই লাখ লাখ কোটি কোটি পাথরের বড় বড় চাঁই কোন কোন অসহায় শ্রমিক তুলতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের কথা।
পরের দিন সকালে আবার লুচি-তরকারি দিয়ে প্রাতরাশ। কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে ফ্রেন্ডশিপ স্টোরে গেলাম। নিচের তলায় সুপারস্টোর, দোতলা-তিনতলায় সুগন্ধি, পানীয়, গয়না, ঘর সাজানোর সামগ্রী, চারতলায় সিল্ক ও পাঁচতলায় লেদারসামগ্রী। ফিক্সড প্রাইস। সুতরাং, ঘুরে ঘুরে যা খুশি কেনো।
গত রাতের ডিনার থেকে আমি কয়েকটা কাবাব তুলে রেখেছি, তার সঙ্গে এখান থেকে বনরুটি কিনলাম। কোক আছে, পানি আছে; আছে কিছু ফলও। দুপুরের খাবার এই দিয়ে সারতে হবে। গ্রেট হল বাইরে থেকে দেখে ফরবিডেন সিটিতে ঢুকলাম। রাজপ্রাসাদ কাকে বলে! প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে হাতের ডানে-বাঁয়ে কার্টিইয়ার্ডসহ চার পোতায় চারটি করে প্রাসাদ। প্রতিটি প্রাসাদের পাশ দিয়ে গিয়ে আবার চার পোতায় চার প্রাসাদ লাল-সবুজ-সোনালি কারুকাজ করা। সামনে আট-দশ ফুট উঁচু পিতলের ঘড়া।
বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ফ্লাইট ধরার জন্য বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাত্রা। পথে জিজ্ঞাসা করলেন, সৈয়দ মুজতবা আলী কবে, কখন ইন্তেকাল করেন? ১৯৭৪ সালে ঢাকায় মাত্র ৬৪ বছর বয়সে চাচা ইন্তেকাল করেন। গুরুর মতো হুমায়ূনও ৬৪ বছর বয়সেই চলে গেলেন। ক্ষণজন্মা পুরুষদের কি বিধাতা এই আয়ু দেন?
ফাউজিয়া আলী
সাবেক অধ্যক্ষ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি কলেজ।

No comments

Powered by Blogger.