জ্বালানি নিরাপত্তা : ভারতের ভবিষ্যৎ কি আশাপ্রদ? by হাসান কামরুল
দীর্ঘমেয়াদি গ্রোথ বা সমৃদ্ধির জন্য বিদ্যুতের বিকল্প নেই। বিদ্যুৎহীন জাতি অন্ধকারাচ্ছন্ন। কৃষ্টি-কালচার- সব দিক দিয়েই বিদ্যুতের অভাবে একটা জাতিকে পিছিয়ে পড়তে হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ক্রমেই উন্নতির শিখরে ও বিশ্বের প্রভাবশালী দেশে পরিগণিত হওয়ার এক লড়াইয়ে অবতীর্ণ।
কিন্তু ভারতের বর্তমান জ্বালানির হিসাব করলে মাঝপথেই সব কিছু কেমন জানি গোলমেলে হয়ে যায়। এর কারণ ভারতের বিদ্যমান জ্বালানির চেহারা খুব একটা সুবিধার নয়, যা এশিয়া অঞ্চলের মানুষকে খুশি করতে পারে। প্রাকৃতিক কয়লাসমৃদ্ধ দেশ ভারত। ভারতের কয়লার মজুদ পৃথিবীর বৃহত্তম মজুদগুলোর অন্যতম। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল ভারতের গোটা অর্থনীতি, মধ্যবিত্ত জীবন, শিল্প-কারখানা ও চলমান দেশজ মোট উৎপাদনের গতি। ভারতে কয়লা বাদে প্রাকৃতিক তেল-গ্যাসের মজুদ খুব একটা সন্তোষজনক নয়। প্রাকৃতিক কয়লা মজুদের দিক দিয়ে ভারতের অবস্থান পৃথিবীর পাঁচ নম্বরে। আর এই কয়লানির্ভর অর্থনীতিতে গেল পাঁচ বছরে বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে ১৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যার ৬০ শতাংশই হয়েছে প্রাইভেট সেক্টরে একান্তই শিল্পোদ্যোক্তাদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায়।
এতসবের পরও ভারতের জ্বালানির ভবিষ্যৎ গ্রাফে হাঁ করে আছে বিরাট এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন। অঙ্গরাজ্য, সরকারি অফিস-আদালত, সিটি করপোরেশন, নিয়ন্ত্রণ কমিশন, পরিবেশবাদী, সামাজিক সংগঠনসমূহ, দুর্নীতিবিরোধী জোট, আন্না হাজারে, রামদেব প্রকাশ, গ্রাম্যজীবন, মধ্য ও ভারী মানের শিল্প-কারখানা- সর্বত্রই বিরাজমান উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিশ্রুতি। কিন্তু ভবিষ্যৎ ভারত পারবে তো ১০০ কোটি মানুষের নিত্যদিনের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে? পিক আওয়ারে ভারতের মোট চাহিদার বিপরীতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য হয়েই ১০ শতাংশ কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হচ্ছে। রয়েছে গ্রিডলাইনের অপর্যাপ্ততা। ৩০ কোটিরও বেশি মানুষকে প্রতিদিন বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে। অর্থাৎ ৩০০ মিলিয়ন লোকের কাছে ভারত সরকার এখনো বিদ্যুৎই পৌঁছে দিতে পারেনি।
ভারতের পর্যাপ্ত কয়লার মজুদ থাকা সত্ত্বেও উত্তোলনের হার সন্তোষজনক নয়। এর মূল কারণ হচ্ছে, ভারতের কয়লা সেক্টর নির্দিষ্ট গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর হাতে বন্দি। যারা নিজেদের মতো করে শিল্পায়ন করতে গিয়ে মনোপলি ব্যবসায় অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্যগুলোরও করার কিছুই নেই। কারণ পুরো ভারতের রাজনীতিতে এখন ব্যবসায়ীদের প্রভাবই বিরাজমান। ভারতের বৃহত্তম কয়লা মজুদ থেকে ১৯৯৮ সাল থেকে অদ্যাবধি অর্থাৎ ১৪ বছরে মাত্র ৬০০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন হয়েছে। অথচ একই সময়ে চীনের মোট উত্তোলিত কয়লার পরিমাণ ৩.৫ বিলিয়ন টন। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তোলিত কয়লার পরিমাণ প্রায় এক বিলিয়ন টন। অস্ট্রেলিয়া উত্তোলন করেছে ৪০০ মিলিয়ন টন ও সাউথ আফ্রিকার মোট উত্তোলনের পরিমাণ ৩০০ মিলিয়ন টন।
জওহরলাল নেহরু ভারতের রাজনীতির কিংবদন্তি এক মহাপুরুষ। যাঁর হাত ধরে ভারতের স্বাধীনতা এসেছে। মহান এ নেতা ভারত স্বাধীনের পর পরই নদীর স্রোতে বাঁধ নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করার ঘোষণা দেওয়ায় বিশ্বজুড়ে আলোড়ন শুরু হয় এবং নেহরু মনে করতেন, জলবিদ্যুতের আধারই হবে আধুনিক ভারত নির্মাণের সহায়ক শক্তি। জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিবেশসম্মত হওয়ায় জওহরলাল নেহরুর নেওয়া এ উদ্যোগ বিশ্বজুড়েই মডেলে পরিণত হয়। পৃথিবীর বড় বড় দেশ নেহরুর ঘোষণার পর জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোযোগ দেয়। অথচ ভারত এ ক্ষেত্রে খুব একটা সফল হতে পারেনি। ১৯৬০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ভারতের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের মাত্র ১৪ শতাংশ এসেছে জলবিদ্যুৎ থেকে। তবে সম্প্রতি ভারত সরকার মেগা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনে মনোযোগী হয়ে উঠেছে। জলবিদ্যুতের সম্ভাব্য স্থান হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কাশ্মীর ও ভুটানকে। ভারতের জ্বালানিনীতিতে হিমালয়ের ঢলে নেমে আসা জল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। তবে এ প্রক্রিয়া এখনো চিন্তাভাবনা বা ঘোষণা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ, মূল নীতিতে যুক্ত হয়নি।
ভারত উপমহাদেশজুড়েই সৌরালোক ও বায়ু ব্যবহারের দারুণ সুযোগ রয়েছে বলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের ধারণা। আর এ ধারণা থেকেই গুজরাট ও তামিলনাড়ুতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিনিয়োগ প্রক্রিয়াকে সহজতর করা হয়েছে। কিন্তু এ দুই অঙ্গরাজ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অভূত সুযোগ থাকলেও কৃষকরা তাদের জমি দিচ্ছে না বলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে নিউক্লিয়ার পাওয়ারের কথা বিবেচনা করলে ভারত এখনো এ সেক্টরে খুব একটা অগ্রসর হতে পারেনি। এর মূল কারণ রাজনৈতিক মতবিরোধ ও বিরোধী গোষ্ঠীর তৎপরতা। যারা কোনোমতেই ভারতকে নিউক্লিয়ার পাওয়ারের দিকে ধাবিত হতে দিতে চায় না। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট করার যে চুক্তি ভারত করেছে তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি এতদসংক্রান্ত বিষয়ে বন্ধুপ্রতিম দেশ জাপানও সহযোগিতা করতে নারাজ। তবে ভারতে শিল্পবণিকরা চেরনোবিল দুর্ঘটনা ও সাম্প্রতিক ফুকুশিমা দুর্ঘটনাকে আমলে নিতে নারাজ। শিল্পমালিকরা যেকোনো উপায়েই হোক ভারতে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের বাস্তবায়ন চান। কারণটাও স্পষ্ট, শিল্পের জন্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন। আর সেটা যেকোনো উপায়েই আসুক তাতে শিল্পমালিকরা বাদ সাধতে চান না। কিন্তু ভারত সরকার জনসাধারণের বিরোধিতার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না।
বিদ্যুৎ নিয়ে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভারতের রয়েছে মহাপরিকল্পনা। এ পরিকল্পনায় ২০১৭ সাল নাগাদ মোট ৩৫০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কয়লা থেকে বিদ্যুতের সম্ভাব্য উৎপাদন ধরা হয়েছে ২৩০ গিগাওয়াট, জলবিদ্যুৎ থেকে ৭০ গিগাওয়াট, গ্যাসভিত্তিক উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ধরা হয়েছে ২০ গিগাওয়াট, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট থেকে ১০ গিগাওয়াট ও ফসিল ফুয়েল থেকে বাকি ২০ গিগাওয়াট।
ফসিল ফুয়েলের দিক থেকে ভারতের রিজার্ভ খুব একটা আশাপ্রদ নয়। গভীর সমুদ্র এলাকা ও রাজস্থানে গ্যাস ও তেলক্ষেত্র রয়েছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্র থেকে উৎপাদনের মাত্রা খুব একটা প্রমিজিং নয়। তার ওপর চীনের পাইপলাইনের বিস্তৃতি গোটা মধ্য এশিয়ায়। ভারতের কয়লার বৃহত্তম মজুদ আছে ঠিকই; কিন্তু গুণগত মানের দিক থেকে অত্যন্ত নিম্নমানের। কারণ ভারতের কয়লায় প্রচুর পরিমাণে অ্যাশ বা ছাই রয়েছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ভারতের কয়লার দিকে নজর পড়ে ব্রিটিশদের। কয়লা পরিবহনের জন্য ব্রিটিশরা তখন মাল্টি মিলিয়ন ডলার খরচ করে ট্রেন লাইন স্থাপন করে। পূর্ব ভারতজুড়েই কয়লা মজুদের আধিক্য। ৩৭৫ হাজার শ্রমিক প্রতিনিয়ত কাজ করছে ভারতের কয়লা ক্ষেত্রগুলোতে। অধিকাংশ কয়লা খনিতেই উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের চিত্র পরিলক্ষিত। অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য উত্তোলিত কয়লার বাজারমূল্য আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম হওয়ায় দেশি কম্পানিগুলো এ সেক্টরে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। কয়লা খাতকে ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার পর এ সেক্টর তৃতীয় একক খাতে পরিণত হয়েছে। যার সম্ভাব্য মূল্য ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ভারতের মোট ইক্যুইটির ৩৫ ভাগেরও বেশি।
কিন্তু কয়লার এত বড় মজুদ থাকা সত্ত্বেও ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে নানা প্রশ্ন চলে এসেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, কয়লা উত্তোলনের চিত্র খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। ১৯৮৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ভারতের মোট কয়লা উত্তোলনের যে গ্রাফ, তা মোট দেশজ উৎপাদনে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। ২১০০ সাল পর্যন্ত ভারতে মোট বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে ৪০০ গিগাওয়াট। কিন্তু বর্তমান কয়লা উত্তোলনের হার বিবেচনায় নিলে উত্তোলিত কয়লা দিয়ে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে ১০০ গিগাওয়াট। অথচ আগামী শতক ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভারতকে একদিকে মোকাবিলা করতে হবে দেশজ বিদ্যুৎ উৎপাদনের অপ্রতুলতা, অন্যদিকে চীনের অগ্রগতি। এ দুই প্রয়াসে ভারত জয়ী হলেই কেবল সম্ভব বিশ্বে প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করা। কিন্তু ভারতের জ্বালানির চিত্রে যে হতাশা রয়েছে, তা থেকে যেন ভারত কোনোক্রমেই বের হয়ে আসতে পারছে না। যার ফলে বিশ্বজুড়েই জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা যায় ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে। আজকের যুগে এটা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার যে জ্বালানি নিরাপত্তা ব্যতীত কোনো দেশই প্রভাবশালী দেশের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। তাই সামনের সময়গুলোতেই ভারতের অবস্থান ও শক্তির ভিত প্রকাশ হবে অভ্যন্তরীণ জ্বালানি খাতকে ঘিরে।
লেখক : ভূতত্ত্ববিদ ও কলাম লেখক
এতসবের পরও ভারতের জ্বালানির ভবিষ্যৎ গ্রাফে হাঁ করে আছে বিরাট এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন। অঙ্গরাজ্য, সরকারি অফিস-আদালত, সিটি করপোরেশন, নিয়ন্ত্রণ কমিশন, পরিবেশবাদী, সামাজিক সংগঠনসমূহ, দুর্নীতিবিরোধী জোট, আন্না হাজারে, রামদেব প্রকাশ, গ্রাম্যজীবন, মধ্য ও ভারী মানের শিল্প-কারখানা- সর্বত্রই বিরাজমান উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিশ্রুতি। কিন্তু ভবিষ্যৎ ভারত পারবে তো ১০০ কোটি মানুষের নিত্যদিনের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে? পিক আওয়ারে ভারতের মোট চাহিদার বিপরীতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য হয়েই ১০ শতাংশ কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হচ্ছে। রয়েছে গ্রিডলাইনের অপর্যাপ্ততা। ৩০ কোটিরও বেশি মানুষকে প্রতিদিন বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে। অর্থাৎ ৩০০ মিলিয়ন লোকের কাছে ভারত সরকার এখনো বিদ্যুৎই পৌঁছে দিতে পারেনি।
ভারতের পর্যাপ্ত কয়লার মজুদ থাকা সত্ত্বেও উত্তোলনের হার সন্তোষজনক নয়। এর মূল কারণ হচ্ছে, ভারতের কয়লা সেক্টর নির্দিষ্ট গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর হাতে বন্দি। যারা নিজেদের মতো করে শিল্পায়ন করতে গিয়ে মনোপলি ব্যবসায় অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্যগুলোরও করার কিছুই নেই। কারণ পুরো ভারতের রাজনীতিতে এখন ব্যবসায়ীদের প্রভাবই বিরাজমান। ভারতের বৃহত্তম কয়লা মজুদ থেকে ১৯৯৮ সাল থেকে অদ্যাবধি অর্থাৎ ১৪ বছরে মাত্র ৬০০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন হয়েছে। অথচ একই সময়ে চীনের মোট উত্তোলিত কয়লার পরিমাণ ৩.৫ বিলিয়ন টন। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তোলিত কয়লার পরিমাণ প্রায় এক বিলিয়ন টন। অস্ট্রেলিয়া উত্তোলন করেছে ৪০০ মিলিয়ন টন ও সাউথ আফ্রিকার মোট উত্তোলনের পরিমাণ ৩০০ মিলিয়ন টন।
জওহরলাল নেহরু ভারতের রাজনীতির কিংবদন্তি এক মহাপুরুষ। যাঁর হাত ধরে ভারতের স্বাধীনতা এসেছে। মহান এ নেতা ভারত স্বাধীনের পর পরই নদীর স্রোতে বাঁধ নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করার ঘোষণা দেওয়ায় বিশ্বজুড়ে আলোড়ন শুরু হয় এবং নেহরু মনে করতেন, জলবিদ্যুতের আধারই হবে আধুনিক ভারত নির্মাণের সহায়ক শক্তি। জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিবেশসম্মত হওয়ায় জওহরলাল নেহরুর নেওয়া এ উদ্যোগ বিশ্বজুড়েই মডেলে পরিণত হয়। পৃথিবীর বড় বড় দেশ নেহরুর ঘোষণার পর জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোযোগ দেয়। অথচ ভারত এ ক্ষেত্রে খুব একটা সফল হতে পারেনি। ১৯৬০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ভারতের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের মাত্র ১৪ শতাংশ এসেছে জলবিদ্যুৎ থেকে। তবে সম্প্রতি ভারত সরকার মেগা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনে মনোযোগী হয়ে উঠেছে। জলবিদ্যুতের সম্ভাব্য স্থান হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কাশ্মীর ও ভুটানকে। ভারতের জ্বালানিনীতিতে হিমালয়ের ঢলে নেমে আসা জল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। তবে এ প্রক্রিয়া এখনো চিন্তাভাবনা বা ঘোষণা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ, মূল নীতিতে যুক্ত হয়নি।
ভারত উপমহাদেশজুড়েই সৌরালোক ও বায়ু ব্যবহারের দারুণ সুযোগ রয়েছে বলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের ধারণা। আর এ ধারণা থেকেই গুজরাট ও তামিলনাড়ুতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিনিয়োগ প্রক্রিয়াকে সহজতর করা হয়েছে। কিন্তু এ দুই অঙ্গরাজ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অভূত সুযোগ থাকলেও কৃষকরা তাদের জমি দিচ্ছে না বলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে নিউক্লিয়ার পাওয়ারের কথা বিবেচনা করলে ভারত এখনো এ সেক্টরে খুব একটা অগ্রসর হতে পারেনি। এর মূল কারণ রাজনৈতিক মতবিরোধ ও বিরোধী গোষ্ঠীর তৎপরতা। যারা কোনোমতেই ভারতকে নিউক্লিয়ার পাওয়ারের দিকে ধাবিত হতে দিতে চায় না। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট করার যে চুক্তি ভারত করেছে তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি এতদসংক্রান্ত বিষয়ে বন্ধুপ্রতিম দেশ জাপানও সহযোগিতা করতে নারাজ। তবে ভারতে শিল্পবণিকরা চেরনোবিল দুর্ঘটনা ও সাম্প্রতিক ফুকুশিমা দুর্ঘটনাকে আমলে নিতে নারাজ। শিল্পমালিকরা যেকোনো উপায়েই হোক ভারতে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের বাস্তবায়ন চান। কারণটাও স্পষ্ট, শিল্পের জন্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন। আর সেটা যেকোনো উপায়েই আসুক তাতে শিল্পমালিকরা বাদ সাধতে চান না। কিন্তু ভারত সরকার জনসাধারণের বিরোধিতার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না।
বিদ্যুৎ নিয়ে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভারতের রয়েছে মহাপরিকল্পনা। এ পরিকল্পনায় ২০১৭ সাল নাগাদ মোট ৩৫০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কয়লা থেকে বিদ্যুতের সম্ভাব্য উৎপাদন ধরা হয়েছে ২৩০ গিগাওয়াট, জলবিদ্যুৎ থেকে ৭০ গিগাওয়াট, গ্যাসভিত্তিক উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ধরা হয়েছে ২০ গিগাওয়াট, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট থেকে ১০ গিগাওয়াট ও ফসিল ফুয়েল থেকে বাকি ২০ গিগাওয়াট।
ফসিল ফুয়েলের দিক থেকে ভারতের রিজার্ভ খুব একটা আশাপ্রদ নয়। গভীর সমুদ্র এলাকা ও রাজস্থানে গ্যাস ও তেলক্ষেত্র রয়েছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্র থেকে উৎপাদনের মাত্রা খুব একটা প্রমিজিং নয়। তার ওপর চীনের পাইপলাইনের বিস্তৃতি গোটা মধ্য এশিয়ায়। ভারতের কয়লার বৃহত্তম মজুদ আছে ঠিকই; কিন্তু গুণগত মানের দিক থেকে অত্যন্ত নিম্নমানের। কারণ ভারতের কয়লায় প্রচুর পরিমাণে অ্যাশ বা ছাই রয়েছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ভারতের কয়লার দিকে নজর পড়ে ব্রিটিশদের। কয়লা পরিবহনের জন্য ব্রিটিশরা তখন মাল্টি মিলিয়ন ডলার খরচ করে ট্রেন লাইন স্থাপন করে। পূর্ব ভারতজুড়েই কয়লা মজুদের আধিক্য। ৩৭৫ হাজার শ্রমিক প্রতিনিয়ত কাজ করছে ভারতের কয়লা ক্ষেত্রগুলোতে। অধিকাংশ কয়লা খনিতেই উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের চিত্র পরিলক্ষিত। অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য উত্তোলিত কয়লার বাজারমূল্য আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম হওয়ায় দেশি কম্পানিগুলো এ সেক্টরে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। কয়লা খাতকে ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার পর এ সেক্টর তৃতীয় একক খাতে পরিণত হয়েছে। যার সম্ভাব্য মূল্য ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ভারতের মোট ইক্যুইটির ৩৫ ভাগেরও বেশি।
কিন্তু কয়লার এত বড় মজুদ থাকা সত্ত্বেও ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে নানা প্রশ্ন চলে এসেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, কয়লা উত্তোলনের চিত্র খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। ১৯৮৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ভারতের মোট কয়লা উত্তোলনের যে গ্রাফ, তা মোট দেশজ উৎপাদনে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। ২১০০ সাল পর্যন্ত ভারতে মোট বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে ৪০০ গিগাওয়াট। কিন্তু বর্তমান কয়লা উত্তোলনের হার বিবেচনায় নিলে উত্তোলিত কয়লা দিয়ে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে ১০০ গিগাওয়াট। অথচ আগামী শতক ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভারতকে একদিকে মোকাবিলা করতে হবে দেশজ বিদ্যুৎ উৎপাদনের অপ্রতুলতা, অন্যদিকে চীনের অগ্রগতি। এ দুই প্রয়াসে ভারত জয়ী হলেই কেবল সম্ভব বিশ্বে প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করা। কিন্তু ভারতের জ্বালানির চিত্রে যে হতাশা রয়েছে, তা থেকে যেন ভারত কোনোক্রমেই বের হয়ে আসতে পারছে না। যার ফলে বিশ্বজুড়েই জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা যায় ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে। আজকের যুগে এটা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার যে জ্বালানি নিরাপত্তা ব্যতীত কোনো দেশই প্রভাবশালী দেশের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। তাই সামনের সময়গুলোতেই ভারতের অবস্থান ও শক্তির ভিত প্রকাশ হবে অভ্যন্তরীণ জ্বালানি খাতকে ঘিরে।
লেখক : ভূতত্ত্ববিদ ও কলাম লেখক
No comments