মিসি ফ্র্যাঙ্কলিন ॥ অভিষেকেই রঙিন by ফারজানা আক্তার সাথী

বয়স মাত্র ১৭। হাই স্কুলের গণ্ডি এখনও পার হতে পারেননি। তাতে কি, এমন বয়সে বিশ্বজয় করে ফেলেছেন মিসি ফ্র্যাঙ্কলিন। লন্ডন অলিম্পিকে অভিষেকই মাত করেছেন। রীতিমতো ঝড় তুলেছেন পুলে। দুটি বিশ্ব রেকর্ডসহ স্বর্ণ জিতেছেন চারটিতে। ব্রোঞ্জসহ পদকের তালিকা পৌঁছেছে ৫টিতে।


গত বেজিং অলিম্পিকে তিনটি স্বর্ণ জিতে রানীতে ভূষিত হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার স্টেফানি রাইস। এবার মিসি ফ্র্যাঙ্কলিন। অনেকটা জাদুর মতোই। এলাম দেখলাম জয় করলাম। অভিষেক অলিম্পিকেই যুক্তরাষ্ট্রের এই উদীয়মান সাঁতারু কৃতিত্বে মুগ্ধ গোটা বিশ্ব। কেউ কেউ বলছেন আমেরিকার মহিলা ফেলপস এখন ফ্র্যাঙ্কলিনই। তবে ১৮টি স্বর্ণ জেতা সেরা অলিম্পিয়ানের খেতাবে ভূষিত মাইকেল ফেলপসের সঙ্গে তুলনায় যেতে চান না ফ্র্যাঙ্কলিন। কারণ সবে তো শুরু। লন্ডন অলিম্পিকে অভিষেক হয়েছে তাঁর। যেখানে ফেলপসের শেষ সেখানেই মিসি ফ্র্যাঙ্কলিনের শুরু। আর এ শুরুতেই নিজেকে বিশ্বব্যাপী চিনিয়ে দিয়েছেন তিনি। ৪টি স্বর্ণপদক জয়ের পাশাপাশি দুটি বিশ্বরেকর্ডও গড়ে নৈপুণ্য ছড়িয়েছেন পুরোদমে। আর এ কারণেই তাঁকে বলা হচ্ছে ‘মহিলা ফেলপস’। ফেলপসের সঙ্গে তুলনায় যাওয়াটা এখন চাট্টিখানি কথা নয়। ইতোমধ্যেই ১৮টি স্বর্ণ, দুটি রৌপ্য ও দুটি ব্রোঞ্জ জিতে সর্বমোট ২২টি পদক নিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন ফেলপস। আটদিনের সাঁতার ইভেন্টে ১৭ বছর বয়েসী মিসি ফ্র্যাঙ্কলিন ইতোমধ্যেই ১০০ মিটার ও ২০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকে ব্যক্তিগত স্বর্ণপদক জয় করেছেন। এছাড়াও দলগতভাবে ৪ী২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল ও ৪ী১০০ মিটার মিডলে রিলেতেও স্বর্ণ জিতেছেন তিনি। ২০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকে সবার চোখ কপালে তুলে দেন মিসি ফ্র্যাঙ্কলিন। ৩ বছর ধরে অম্লান ছিল ক্রিস্টি কভেন্ট্রির বিশ্বরেকর্ড। সেটিকে ভেঙ্গে ফেলেন মিসি। আবার ২০০৯ সালে চায়নিজরা ৪ী১০০ মিটার মিডলে রিলেতে সেরা টাইমিংয়ের রেকর্ড ধরে রেখেছিল। সেটিও মিসি ফ্র্যাঙ্কলিনের নেতৃত্বে ভেঙ্গে ফেলে যুক্তরাষ্ট্র। এবার সবেমাত্র ১৭ বছর বয়েসেই এমন চমক দেখিয়েছেন মিসি। রিও ডি জেনেরিওতে আগামী অলিম্পিক আসতে আসতে জীবনের ২১তম বসন্তও দেখা হয়ে যাবে মিসির। হবেন আরও পরিণত, অভিজ্ঞ এবং পরিপুষ্ট একজন সাঁতারু। ইতোমধ্যেই যা দেখিয়েছেন তাতে করে প্রমাণ হয়েছে তাঁর ভেতর সামর্থ্য আছে আরও অনেক বেশি পদক জয় করার। আর লন্ডনে অলিম্পিক পুলে ফেলপসের ঝড় তোলাও স্বচক্ষে অবলোকন করেছেন। এ বিষয়ে মিসি বলেন, ‘ফেলপসকে জানতে পেরে এবং তাঁকে চিৎকার করে উৎসাহ দিতে পেরে আমি অভিভূত। তিনি সবচেয়ে বেশি পদকজয়ী অলিম্পিয়ান হয়েছেন এটা খুবই আনন্দের বিষয়। এটা আমার জন্যও অনুপ্রেরণাদায়ক। তাঁর এ অর্জন আমাকে অনেক বেশি উদ্বুদ্ধ করবে। আমি কখনই মনে করি না তাঁর অভাব কখনও পূরণ করা সম্ভব হবে। তবে আমি তাঁর পথেই অগ্রসর হওয়ার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী।’ গত বছর সাংহাইয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও স্বর্ণ জয় করেন মিসি। ৬ ফুটর ১ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যরে এ দীর্ঘাঙ্গিনী নিজের আগমন বার্তা তাই ভালভাবেই ঘোষণা করেছেন। আগামী বছর কলোরাডো হাইস্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করবেন মিসি। এরপরই তাঁর সিনিয়র ক্যারিয়ার শুরু হবে। এ বিষয়ে মিসি বলেন, ‘আগামী চার বছরের মধ্যে আমাকে অনেক কিছুর ভেতর দিয়ে যেতে হবে। আমি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠব। আমার একটি কলেজে ভর্তি হতে হবে। তবে আমি বর্তমান সময়কে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ ২০১৬ অলিম্পিকে দারুণ কিছু করতে চাই। আমি একবারে শুধু একটি অলিম্পিক নিয়েই চিন্তা করতে চাই এবং আমি দেশের পতাকা উড়তে দেখে অনুপ্রাণিত হই।’ বেজিংয়ে একবারে ৭টি বিশ্বরেকর্ডসহ ৮টি স্বর্ণ জয় কওে রেকর্ড গড়েছিলেন ফেলপস। কিন্তু মিসিকে দেখার পর বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তিনি নিজেও। ফেলপস বলেছেন, ‘এই মেয়েটি এত শক্তি কোথায় থেকে অর্জন করল?’ ওই বিষয়ে মিসি ব্যাখ্যা দিয়েছেন পরে, ‘আমি আমার দলের সতীর্থ, বন্ধু আর কোচদের কাছ থেকে এ শক্তি অর্জন করেছি। তাঁরা অবিশ্বাস্য সমর্থন দিয়েছেন আমাকে। একটি রেসের পর যখন উঠে আসি তখন সবার মুখে উচ্ছ্বসিত হাসি এবং সে মুখম-লে ফুটে ওঠা অভ্যর্থনা আমাকে অন্যরকম পুলক দেয়। তবে মাইকেলের (ফেলপস) সাঁতার দেখা সত্যিই ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। তাঁকে দেখলেই বোঝা যায় তিনি আসলে কি করার শপথ নিয়ে পুলে নেমেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের দলে তাঁকে পাওয়া এবং নিয়মিত তাঁকে দেখার সুযোগ যে কোন সাঁতারুর জন্য বড় পাওয়া।’
ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসেডেনায় ১৯৯৫ সালে জন্ম ফ্র্যাঙ্কলিনের। বেড়ে উঠেছেন কলোরাডোর অরোরাতে। মাত্র ৫ বছর বয়স থেকেই সাঁতারে হাতেখড়ি। সেটা মায়ের পীড়াপীড়িতেই। বাবা-মা দু’জনই কানাডিয়ান। তবে নাগরিকত্ব রয়েছে আমেরিকারও। বাবার ইচ্ছা ছিল কানাডার হয়ে মেয়েকে কিছু একটা করাতে। নিজে ছিলেন অল কানাডিয়ান ফুটবল দলের সদস্য। তবে হঠাৎ এক ইনজুরি সব শেষ করে দেয়। এরপর পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই মেডিক্যাল ছাত্রী ডি এ ফ্র্যাঙ্কলিনের সঙ্গে পরিচয়, অতঃপর বিয়ে। স্থায়ী বসবাস শুরু করেন কলোরাডোতেই। এখানেই জন্ম নেন আজকের উদীয়মান সাঁতারু ফ্রাঙ্কলিন। বাবার মতো মায়ের ইচ্ছাও ছিল কানাডার হয়ে সাঁতারে প্রতিনিধিত্ব করুক ফ্র্যাঙ্কলিন। বাবা মায়ের ধারণা ছিল প্রতিযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রের সাঁতারে কুলিয়ে উঠতে পারবে না তাঁদের মেয়ে। তবে নাছোড়বান্দা ফ্র্যাঙ্কলিন শোনেননি কারও কথা। নিজের ইচ্ছাতেই নাম লিখিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাঁতারে। ১৩ বছর বয়সে যোগ দিতে চেয়েছিলেন বেজিং অলিম্পিকে। তবে ট্রায়ালে টিকতে পারেননি। এটা একদিক থেকে ভালই হয় তাঁর জন্য। কঠোর অধ্যবসায় আর পরিশ্রমে নিজেকে দক্ষ কওে তোলেন লন্ডন অলিম্পিকের জন্য। এর আগে বিভিন্ন পূর্ণপ্রতিযোগিতামূলক আসরে চমক দেখান ফ্র্যাঙ্কলিন। ২০১১ সালে ফিনা সুইমিং ওয়ার্ল্ড কাপে ২০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকে বিশ্বরেকর্ড গড়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দেন তিনি। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ক্রমে এগিয়েছেন, সাফল্য পেয়েছেন হাতেনাতে। লন্ডন অলিম্পিকে তাঁর স্বাক্ষর রেখেছেন। এবার ফ্র্যাঙ্কলিনের চোখ ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরো অলিম্পিকে। যখন তাঁর বয়স দাঁড়াবে ২১। অভিজ্ঞতার ভা-ারও হবে সমৃদ্ধ, নিজেও হবেন পরিপক্ব। রিও ডি জেনিরো অলিম্পিকে ইতিহাস গড়ার মানসেই যেন ফ্র্যাঙ্কলিনের পথচলা শুরু হলো নতুন করে।

No comments

Powered by Blogger.