ঢাকায় সরকারী সম্পত্তি বেদখলের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি- দুয়েক দিনের মধ্যে বৈঠক ॥ রিপোর্টের আলোকে ব্যবস্থা by ফিরোজ মান্না

সরকারী সম্পত্তি বেদখলের তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। ঢাকা মহানগর চূড়ান্ত জরিপে ২ হাজার ৮১৫ দশমিক শূন্য ৫৬৯ একর সরকারী জমি বেহাত হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে তাঁরা। এ ঘটনায় ১৫ বছর ধরে চলা ঢাকা মহানগরীর ১৯১ মৌজার চূড়ান্ত জরিপ বাতিল ও সরকারী সম্পত্তি উদ্ধারের বিষয়ে সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।


ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোয়েজ্জদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত ছয় সদস্যের কমিটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোখলেছুর রহমানের কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। দু’একদিনের মধ্যে এ বিষয়ে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। তদন্ত রিপোর্টের আলোকে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোয়েজ্জদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ২ হাজার ৮১৫ দশমিক শূন্য ৫৬৯ একর সরকারী জমি বেহাত হয়ে যাওয়ার প্রমাণ তাঁরা পেয়েছেন। এখন এই জমি কিভাবে উদ্ধার করা যায়Ñ সে বিষয়ে কয়েকটি সুপারিশ দেয়া হয়েছে। কী ধরনের সুপারিশ দেয়া হয়েছে তা জানতে চাইলে তিনি তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে যে জমি ব্যক্তি বিশেষ মালিকানা দাবি নিয়ে বসে আছেন, তাদের কাছ থেকে কোনভাবেই এই জমি উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। যদি কোন প্রতিষ্ঠান জমি দখল করে থাকেÑ তাহলে ওই সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লোক দেখানো ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। এর চেয়ে বেশিকিছু আশা করা যায় না বেদখল হয়ে যাওয়া জমি নিয়ে। কারণ বেশিরভাগ জমিই প্রভাবশালীদের হাতে চলে গেছে। এই জমি উদ্ধার করতে গেলেই হাজার হাজার মামলা হবে। এসব মামলা যুগের পর যুগ চলতে থাকবে। সরকারের পক্ষে এত মামলা মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
ঢাকা মহানগরীর জরিপ কর্মসূচীর আওতায় চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত ১৯১টি মৌজার জরিপ কার্যক্রম বহাল বা বাতিলের সুপারিশের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় ২৭ জুলাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি সাত দিনের মধ্যে ভূমি সচিবের কাছে রিপোর্ট জমা দিয়েছে বলে খবর মিলেছে। কমিটিতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করা হয়। সদস্য করা হয়েছিল যুগ্ম সচিব (আইন), পরিচালক (ভূমি রেকর্ড), ভূমি সংস্কার বোর্ডের এক কর্মকর্তা, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্বÑ ঢাকা), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্বÑ ঢাকা), কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে উপসচিব (আইন) ভূমি মন্ত্রণালয়। তদন্ত কমিটি কতিপয় খতিয়ান ছাড়া মৌজা রেকর্ড চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করা সঠিক ছিল কি না, তড়িঘড়ি করে রেকর্ড প্রদানের কারণ নির্ণয় এবং এর দায়-দায়িত্ব নিরূপণ, মহানগর জরিপে বেহাত হওয়া সরকারী সম্পত্তির পরিমাণ নির্ণয়-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দায়-দায়িত্ব নিরূপণ ও বেহাত হওয়া সম্পত্তি উদ্ধারের বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন, সার্বিকভাবে মহানগর জরিপ বহাল বা বাতিলের বিষয়ে বেশকিছু সুপারিশ করে।
এদিকে, গত ৩১ জুলাই এ বিষয়ে ‘দৈনিক জনকণ্ঠে’ ‘খোদ ঢাকায় পৌনে ২ লাখ কোটি টাকার সরকারী সম্পত্তি বেদখল-দখলের ভয়াবহ চিত্র!’ প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশন জরিপ অধিদফতরে এ-সংক্রান্ত কাগজপত্র তলব করেছে।
কমিটি জরিপসংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্রাদি প্রাসঙ্গিক নথিপত্র পর্যালোচনা ও পরীক্ষা করেছে। কমিটি দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বক্তব্যও শুনেছে। কমিটি ২ হাজার ৮১৫ একর সরকারী জমি কিভাবে বেহাত হয়েছে তার প্রমাণও পেয়েছে। তাঁরা বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েছে। কমিটি কোতোয়ালি সার্কেলে ১৪ মৌজায় ২৬ দশমিক ১৬২০ একর, তেজগাঁও সার্কেলে ৬৩ মৌজায় এক হাজার ১০ দশমিক ৫৪৮০ একর, ডেমরা সার্কেলের ৪৯টি মৌজায় ৫৪৭ দশমিক ৯৫৭৬ একর, ধানম-ি সার্কেলের ২৮টি মৌজায় ২৫৮ দশমিক ৯৫৭৬ একর ও মিরপুর সার্কেলের ৩৭টি মৌজায় ৯৭১ দশমিক ৮৬২৯ একর সরকারী জমি বেদখলের প্রমাণ পেয়েছে। এতে মোট জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮১৫ দশমিক শূন্য ৫৬৯ একর। ঢাকা মহানগরীতে বর্তমানে প্রতিকাঠা জমির গড় মূল্য ১ কোটি টাকা ধরা হলেও এই হিসাবে ২ হাজার ৮১৫ একর জমির মূল্য দাঁড়ায় এক লাখ ৬৮ হাজার ৯ শ’ কোটি টাকা।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, মোটা অঙ্কের টাকার সম্পত্তি জরিপ অধিদফতরের কতিপয় অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে প্রভাবশালীরা নিয়ে গেছে। টানা ১৫ বছর ধরে চলা জরিপ কাজ চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশের পর এই জালিয়াতি ধরা পড়েছে। বিপুল পরিমাণ সরকারী সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য চূড়ান্ত জরিপকাজ বাতিল করা হতে পারে। বিপুল পরিমাণ জমি ব্যক্তিমালিকানায় রেকর্ড হয়েছে।
উল্লেখ্য, মহানগর জরিপের চূড়ান্ত পর্যায়ের রেকর্ড প্রিন্ট করার পর, প্রজাস্বত্ব বিধিমালার বিধি ৪২-এর বিধান মোতাবেক ৯৫ হাজার খতিয়ানের ওপর শুনানি করে সংশোধনের আদেশ দেয়া হয়েছে। ১৯১ মৌজার রেকর্ডসমূহের গেজেট প্রকাশ করার পর ১নং রেজিস্টারসমূহ রেকর্ডরুমে সংরক্ষিত ছিল। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয়য়ের নির্দেশে ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি মহানগর রেকর্ডের ওপর নামজারিসহ অন্যান্য কার্যক্রম শুরু হয়। জেলা রেকর্ডরুমে কর্র্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন রকম অভিযোগ আসে। আবার ভূমি মালিকগণ মহানগর জরিপে তাদের কাক্সিক্ষত খতিয়ান খুঁজে পাচ্ছিল না। খতিয়ানে নামের বানান ভুল, দাগ ও জমির পরিমাণে কম বেশি, জাল খতিয়ান, খতিয়ানের পৃষ্ঠা ফাঁকা ইত্যাদি বিষয়ে কয়েক হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে। সহকারী কমিশনার (ভূমি), আরএস রেকর্ডে সরকারী স্বার্থসংশ্লিষ্ট সরকারী জমি মহানগর রেকর্ডে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের রেকর্ডের অভিযোগ পাওয়া যায়। এ অবস্থায় ভূমি মন্ত্রণালয় মহানগর জরিপের ৫টি সার্কেলের সহকারী কমিশনারদের বেহাত হওয়া জমির তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দেয়। রাজধানীর ৫টি সার্কেলে ২ হাজার ৮১৫ দশমিক শূন্য ৫৬৯ একর জমি বেহাত হয়ে যাওয়ার প্রমাণ পায়।

No comments

Powered by Blogger.