সু চির হাত ধরেই বদলাবে মিয়ানমার

দীর্ঘ কয়েক দশক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা মিয়ানমারের সামনে এখন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত। সে সুযোগ গ্রহণ করতে দেশটির নতুন সরকারকে ইচ্ছুক বলেও মনে হচ্ছে। সাবেক জান্তা সরকারের ছায়ায় বেড়ে উঠলেও এ সরকার ইতিমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করেছে আন্তর্জাতিক মহলকে। দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকা গণতন্ত্রের আইকন অং সান সুচিও সরব হয়ে উঠেছেন। বেদনাবিধুর অতীতকে ঝেড়ে ফেলে এক সম্ভাবনাময় মিয়ানমার


গড়ার পথে আবারও উচ্চকিত হয়েছে 'দ্য লেডি'র কণ্ঠ। ভবিষ্যৎ মিয়ানমার তাকিয়ে আছে তার দিকেই।
কয়েক দশকের সামরিক একনায়কত্ব এবং আর্থিক অসচ্ছলতায় জর্জরিত মিয়ানমারের জনগণের সামনে এখন দিনবদলের ইঙ্গিত অনেকটাই স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসতে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রটি তার প্রচেষ্টার ফলও পেতে যাচ্ছে এখন। বিভিন্ন বিধিনিষেধের বেড়াজালে বন্দি হয়ে থাকা দেশটিতে বুধবার তিন দিনের সফরে গেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। এটা হিলারির এক ঐতিহাসিক সফর। গত ৫০ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে এটা হবে মিয়ানমারে উচ্চ পর্যায়ের কোনো মার্কিন কর্মকর্তার সফর। এর আগে বহুবার পরিবর্তনের আশা জাগিয়েছিল এশিয়ার এই সেনাশাসিত দেশটি। তবে তা ছিল জান্তাদের ছল মাত্র। কিন্তু বেসামরিক সরকারের কিছু পদক্ষেপ তাদের সত্যিকারের ইচ্ছার প্রতিফলন বলেই মনে করা হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে হিলারির সফর বার্মিজদের মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
অর্ধ শতাব্দী সামরিক শাসনের পর মিয়ানমারের জান্তারা নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। তবে এই বেসামরিক সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনসহ সাবেক জেনারেলরা রয়েছেন। তারপরও নতুন সরকার বেশ কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সদ্য কারামুক্ত অং সান সু চি এবং অন্য বিরোধী রাজনীতিকদের সঙ্গে সংলাপ। বেশ কিছু রাজনৈতিক কারাবন্দিকে মুক্তিও দিয়েছে সরকার। নতুন সরকার শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার দিয়ে একটি আইন পাস করেছে। অর্থনৈতিক সংস্কারের পরামর্শের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দিকে ঝুঁকেছে। একটি বিতর্কিত মেগা-ড্যাম প্রকল্প স্থগিত করেছে।
বিতর্কিত একটি নির্বাচনী আইনের কারণে গত বছর সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বাতিল হয়ে পড়ে। গত বছরের নির্বাচনও বর্জন করে তার দল। কিছু নেতা এনএলডি থেকে বেরিয়ে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফোর্স (এনডিএফ) গঠন করেন। এখন ওই আইন শিথিল করায় নতুন করে দলের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন সু চি। একটি উপ-নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথাও রয়েছে তার। এনডিএফ নেতা খিন মং সুর্থ অং সান সুচির রাজনীতিতে ফিরে আসার পরিকল্পনার প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, এটা মিয়ানমারের জন্য একটি বড় এবং শুভ রাজনৈতিক পদক্ষেপ।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফেরার পথে মিয়ানমারের জন্য সুচির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলা হচ্ছে, সু চির হাত ধরেই দেশটির পরিবর্তন সূচিত হবে। দেশে পরিবর্তনের জন্য চাপ প্রয়োগের পাশাপাশি তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের প্রতি আরও উদার হওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ অং নেইং বলেন, সুচি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের ফেরার পথে তিনি পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করছেন। একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, সু চি যদি তার হাতের কার্ডগুলো ঠিকমতো খেলতে পারেন এবং একজন উদারপন্থি নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন, তবে অন্য অনেক দেশের চেয়ে মিয়ানমার ভালো অবস্থানে থাকবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মিয়ানমারে এখন সংস্কার চায় এমন সরকারই যে আছে তা শুধু নয়, সু চির মতো এমন একজন ব্যক্তিত্ব তাদের রয়েছেন, যাকে সবাই অসম্ভব শ্রদ্ধা করে। দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রজেক্ট ডিরেক্টর জিম দেলা গিয়াকমা বলেন, মিয়ানমারের বিরোধী দলগুলোর জন্য সু চি বড় এক সম্পদ। সু চি একাই যা করতে পারবেন বিরোধী দলগুলো সম্মিলিতভাবেও তা করতে পারবে না। সু চি মার্কিন কংগ্রেসের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন। মিয়ানমারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই কংগ্রেস।
সু চির বাবা জেনারেল অং সানের হাত ধরেই স্বাধীনতা লাভ করে মিয়ানমার। তবে বাবার মেয়ে হিসেবে তার রাজনীতিতে পদার্পণ হয়নি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ূয়া সু চি বিয়ে করেছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক মাইকেল এরিসকে। দুই ছেলেকে নিয়ে ব্রিটেনেই বসবাস করছিলেন তিনি। ১৯৮৮ সালে অসুস্থ মাকে দেখতে মিয়ানমারে ফেরেন। ওই সময় সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ জান্তা সরকার কঠোর হাতে দমন করে। নিহত হয় অন্তত ৩ হাজার মানুষ। এ ঘটনাই তাকে রাজনীতির মাঠে নামিয়ে আনে। ব্যক্তিগত এসব স্মৃতিকে পাশ কাটিয়ে সু চি এখন মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য আবারও সক্রিয় হয়েছেন। তিনি বলেন, অনেকেই বলছেন রাজনীতিতে নামলে আমার মর্যাদা নষ্ট হতে পারে। কিন্তু আপনি যখন রাজনীতি করবেন তখন নিজের মর্যাদা নিয়ে ভাবলে চলবে না।

No comments

Powered by Blogger.