ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে নিহত ৩২৭ by ফজলে এলাহী,

নেক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয়েছিল পার্বত্য শান্তিচুক্তি। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের সেই স্বপ্ন ভাঙতে সময় লাগেনি। চুক্তি স্বাক্ষরের পরও নেভেনি পার্বত্যবাসীর অস্বস্তি আর অশান্তির দাবানল। চুক্তি স্বাক্ষরের পর পার হয়ে গেছে দীর্ঘ ১৪টি বছর। এই সময়কালে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের জের ধরে ৩২৭টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। চুক্তি স্বাক্ষর কোনো ইতিবাচক ফলই বয়ে আনতে পারেনি। চুক্তি স্বাক্ষরের পর খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে


আনুষ্ঠানিক অস্ত্রসমর্পণের সময় সেখানেই চুক্তির বিরোধিতা করে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয় একটি পক্ষ। পরবর্তী সময়ে এই পক্ষ চুক্তিবিরোধী হিসেবে পরিচিতি পায়। তাদের নিয়েই সংগঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আনুষ্ঠানিক এক কনভেনশনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু এই সংগঠনের। মূলত এরপর থেকেই পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তার ইস্যুতে চুক্তি স্বাক্ষরকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে তারা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এই সংঘাত বন্ধ হয়নি চুক্তি স্বাক্ষরের গত ১৪টি বছরেও। থামেনি সশস্ত্র সন্ত্রাস। যদিও দুই পক্ষের কেউই এই বিরোধে নিজেদের দায়দায়িত্ব স্বীকার করে না।
পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মাত্র ৪৭ দিন পর ১৯৯৮ সালের ১৮ জানুয়ারি রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলাধীন কুতুকছড়িতে চুক্তিবিরোধীদের মারধরে নিহত হন জনসংহতির এক সমর্থক। জনসংহতি সমিতি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য তৎকালীন প্রসিত-সঞ্চয় গ্রুপকে (যাদের নেতৃত্বে পরে গঠিত হয় ইউপিডিএফ) দায়ী করে। তবে ইউপিডিএফের দাবি, ১৯৯৮ সালের ৪ এপ্রিল খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লতিবান এলাকায় জনসংহতি কর্মীদের হাতে খুন হন তাদের সমর্থক প্রদীপ লাল চাকমা ও কুসুমপ্রিয় চাকমা। আর এর মাধ্যমেই পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের পাল্টাপাল্টি দাবির সূচনা। বাস্তবতা হলো, ইউপিডিএফের দেওয়া তথ্য অনুসারে গত ১৪ বছরে নিহত হয়েছে তাদের ২১০ জন নেতা-কর্মী ও সমর্থক। অন্যদিকে জনসংহতির পক্ষে নিহত হয়েছে ১০০ কর্মী-সমর্থক। পাশাপাশি ১৯৯৮ সালে জনসংহতি সমিতি থেকে বেরিয়ে নতুন সংগঠন জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) নামে আত্মপ্রকাশ করা সংগঠনটির ১৭ জন নেতা-কর্মী নিহত হওয়ার তথ্য জানায় সংগঠনটি। সে হিসাবে গত ১৪ বছরে নিহত হয়েছে তিনটি সংগঠনের ৩২৭ জন নেতা-কর্মী ও সমর্থক। এমনকি বাবার সঙ্গে নিহত হয়েছে তিন মাসের শিশুও।
ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত প্রসঙ্গে ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা বলেন, 'এটা শুরু হয় চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৯৯৮ সালে চেয়ারম্যান কুসুমপ্রিয় ও প্রদীপলালকে হত্যার মধ্য দিয়ে। সে সময় সন্তু লারমার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ফেরার পথে পানছড়ি উপজেলার লতিবান এলাকায় সন্তু লারমার নির্দেশে তাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে সন্তু লারমারা একের পর এক আমাদের সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হত্যা করেছে। আমরা সংঘাত চাইনি। সংঘাত বন্ধে তাদের প্রতি বার বার অনুরোধ জানিয়েছি। কিন্তু তারা সাড়া দেয়নি। সন্তু লারমা এই সংঘাতের জন্য দায়ী।'
এই সংঘাতে নিজেদের ২১০ জন নেতা-কর্মী নিহত এবং পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি অপহরণের শিকার হয়েছে দাবি করে মাইকেল চাকমা বলেন, 'সন্তু লারমাদের সঙ্গে ২০০০ ও ২০০৬ সালে এবং এর মাঝে একবার ঐক্যের ব্যাপারে আমরা বৈঠক করেছি। এ ব্যাপারে চুক্তিও হয়েছিল। গণতান্ত্রিকভাবে যে যার মতো আন্দোলন করে যাবে_এমন সিদ্ধান্তই ছিল চুক্তিতে। কিন্তু সন্তু লারমারাই সেই চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তবুও আমরা এখনো ঐক্য চাই। জনপ্রতিনিধি, মানবাধিকারকর্মী, সমাজের বিশিষ্টজনরা অর্থাৎ তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আলোচনার টেবিলে বসেই আমরা সমস্যার নিরসন চাই। জনসংহতির নেতা-কর্মী হত্যায় নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে তিনি বলেন, তারা (জনসংহতি) কল্পনাপ্রসূত অভিযোগ করে। এটা তাদের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ। তারা জনগণের ওপর নানাভাবে নিপীড়ন চালায়। জনগণের পাল্টা প্রতিরোধে তাদের ক্ষতি বা কেউ মারা যেতে পারে।
অন্যদিকে সন্তু লারমা বলেন, জনসংহতির নেতৃত্ব ধ্বংস ও চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই ইউপিডিএফের জন্ম দেওয়া হয়েছে। এতে তারা সরকার তথা শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ মহলের সহায়তা পেয়েছে। ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসের কারণে পার্বত্যাঞ্চল আজও অশান্ত, নিরাপত্তাহীন। কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজির পাশাপাশি এখানে শত শত মানুষকে জিম্মি করে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। ইউপিডিএফের হাতে নিপীড়িত মানুষগুলো সংগঠিত হয়েছে। গড়ে উঠেছে ইউপিডিএফবিরোধী একটি সশস্ত্র গ্রুপ। তারাই ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসের বিপক্ষে অস্ত্র ধরেছে। জেএসএস এখনো সে পথে যায়নি।
'ইউপিডিএফের জন্মই হয়েছে হীন উদ্দেশ্য নিয়ে' মন্তব্য করে সন্তু লারমা বলেন, 'তাদের সাথে আমাদের কখনো কোনো চুক্তি হয়নি। তবে এটা ঠিক, তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে অনেকবার। আমরা বলেছি, এখনো বলছি_এই মুহূর্তে অস্ত্র ত্যাগ করে তারা যদি বলে যে আর কাউকে খুন করবে না, পঙ্গু করবে না, তাহলে ঐক্য হতে পারে।'
চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন। তাঁরা বলেন, পাহাড়ের মানুষ এই সংঘাত চায় না। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন, আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে এখন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রয়োজন। এই সংঘাত আদিবাসীদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।

No comments

Powered by Blogger.