দুই মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ by সাবি্বর নেওয়াজ ও মাসুক আলতাফ চৌধুরী
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীর ছড়াছড়ি থাকলেও ভোটারদের মাঝে ঘুরেফিরে দুই হেভিওয়েট প্রার্থীর নামই বেশি আলোচিত হচ্ছে। কোনো কারণে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করলে মেয়র পদের মূল লড়াইটা যে এ দু'জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে এ নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। এ দু'জন হলেন আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া অ্যাডভোকেট আফজল খান ও কুমিল্লা পৌরসভার সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু। দুই বড় রাজনৈতিক
দলের এ দুই নেতার একদিকে যেমন রয়েছে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন, একইভাবে নানা অপকর্মেও বিভিন্ন সময়ে তাদের নাম জড়িয়ে গেছে। দু'জনই নির্বাচনের মাঠের ভালো খেলোয়াড়। একাধিক নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং জয়-পরাজয়ের অভিজ্ঞতা তাদের
রয়েছে। কুসিক নির্বাচন সামনে রেখে আবার নতুনভাবে তাদের 'আমলনামা' বিচার-বিশ্লেষণ করছেন কুমিল্লার ভোটাররা।
আফজল খান : জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক বর্ষীয়ান নেতা অ্যাডভোকেট আফজল খান। কুমিল্লার রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তিনিই বয়সে সর্বজ্যেষ্ঠ। নিজেই সমকালকে জানান সে কথা। বলেন, 'আমার চেয়ে বেশি বয়সের আর কোনো নেতা কোনো দলে কুমিল্লায় নেই। শেষ বয়সে এখন মেয়র হিসেবে কুমিল্লাবাসীর সেবা করে যেতে চাই।' সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী এ নেতার 'সাদা' জামায় 'কাদা'র দাগও নেহাত কম নয়। '৬৫ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন তিনি। ষাটের দশকে ছিলেন ছাত্রলীগের দুর্দান্ত প্রতাপশালী নেতা। '৭০-এর নির্বাচনে তিনি সে সময়কার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য প্রার্থী অধ্যাপক খোরশেদ আলমের পক্ষে কাজ না করায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। অবশ্য '৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এ কারণে '৭২ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করেন। তিনি কুমিল্লা শহর ও কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। '৭৩-এ তিনি জেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক হন। '৭৫-পরবর্তী সময়ে রাজনীতি আবার উন্মুক্ত হলে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। পরে সাধারণ সম্পাদক হন। '৮৯-এ উপজেলা নির্বাচনের সময় তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। যান জাতীয় পার্টিতে। ওই সময় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। '৯৩ সালে আবার দলে ফিরে আসেন। '৯৪-এ দলীয় কাউন্সিলরদের ভোটে জেলার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। '৯৮ সালে শহরের বহুল আলোচিত শংকর হত্যাকাণ্ডের পর তাকে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ২০০৯-এর সংসদ নির্বাচনের কিছুদিন আগে তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। নির্বাচনের পর ৫৪ সদস্য বিশিষ্ট জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি একই সঙ্গে ১৪ দলের সমন্বয়ক ও জেলা মহাজোটের আহ্বায়ক।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, আফজল খান তার ভাই, ভাতিজা ও নিকটাত্মীয়দের নানামুখী অপকর্মে, বিশেষ করে বেশ ক'টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিতর্কিত হয়ে পড়েন। '৯৭ সালে নগরীর শাকতলায় শ্রমিক নেতা কালু হত্যাকাণ্ড এর মধ্যে অন্যতম। '৯৮ সালে ঠাকুরপাড়া এলাকায় শংকর হত্যাকাণ্ডে তার বড় ছেলে, মেয়ের জামাই ও ভাতিজা প্রধান আসামি হিসেবে অভিযুক্ত হন। শংকর হত্যাকাণ্ডের তিন মাস আগে তার ভাগ্নে জালাল রহস্যজনকভাবে খুন হন শহরের গোবিন্দপুরে। ওই ঘটনার রেশ ধরেই শংকর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ভাতিজা কামরুল খান রিকশাচালক আলম হত্যাকাণ্ডের আসামি ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সালে ওয়াপদা অফিসের পিয়ন হত্যার অভিযোগ রয়েছে। পরে কামরুল নিজেও ২০০৪ সালে র্যাবের ক্রসফায়ারে মারা যান। আফজল খানের বড় ছেলে ইমরান খান কুমিল্লা চেম্বারের সভাপতি। এ পদে দীর্ঘদিন ছিলেন আফজল খান। ওয়ান-ইলেভেনের পর আফজল খান নিজে, তার ছেলে, ভাই ও ভাতিজারা পলাতক ছিলেন। সে সময় তার বাসায় অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে প্রচুর অবৈধ গুলি উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। ওই অভিযোগে তার ছেলে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা হয়। ওই মামলায় তার ২০ বছরের সাজা হয়েছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় এ মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের এক মামলায় ১৯৯৯ সালে আফজল খান জেল খাটেন। তার স্ত্রী নার্গিস সুলতানা তার প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা মডার্ন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। ওয়ান-ইলেভেনের সময় অর্থ লুটের মামলার আসামি হিসেবে তিনিও জেল খাটেন। প্রবীণ এ নেতার একমাত্র মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা আইন ভঙ্গ করে একই সঙ্গে কুমিল্লা পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবার সদর উপজেলার নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেন। এ নেতার ছোট ছেলে আরমান খানের বিরুদ্ধে দ্রুতবিচার আইনের মামলাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। তিনিও পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী। পুলিশের খাতায় আরমান এখন পলাতক।
নিজের প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা মডার্ন স্কুলে বসে সমকাল প্রতিবেদকদ্বয়ের কাছে এসব ব্যাপারে আফজল খান বলেন, 'আমি কখনও কোনো সন্ত্রাস করিনি। আমি ১৭টি স্কুল-কলেজ করেছি। এলাকায় শিক্ষা বিস্তার করেছি।' তিনি বলেন, 'জাতীয় পার্টিতে আমি যোগ দিইনি। কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না। তবে রাষ্ট্রপতি এরশাদের এক শ্যালিকার মাধ্যমে তার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি হয়। তিনি আমাকে দিয়ে বেশ কিছু কাজ করিয়ে নেন।'
মনিরুল হক সাক্কু : সদ্য বিলুপ্ত কুমিল্লা পৌরসভার সাবেক মেয়র তিনি। এছাড়া তিনি জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। দলীয়ভাবে বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ না নিলেও তিনি নির্বাচনের মাঠ ছাড়বেন না বলেই কুমিল্লাবাসী মনে করছে।
পৌর মেয়র হিসেবে এলাকায় বেশকিছু উন্নয়নমূলক কাজ করলেও সাক্কুর বিরুদ্ধে হত্যা, কলেজে আগুন দেওয়া, আয়কর ফাঁকিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। '৭৯ সালে সাক্কুর বিরুদ্ধে প্রবীর হত্যার অভিযোগে মামলা হয়। নিহত প্রবীর সাক্কুর সঙ্গেই চলাফেরা করতেন। শহরের টিক্কারচর শ্মশান এলাকায় ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে। ওই সময় জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। এরপর সাক্কু সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যান। এরশাদের সামরিক শাসনামলে সাক্কু কুমিল্লা শহরে ফিরে আসেন। এলাকাবাসী জানান, কুমিল্লা সদরের ৫ বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও প্রয়াত মন্ত্রী কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন সে সময় সাক্কুকে মামলা থেকে বাঁচাতে সাহায্য করেন। মেয়র প্রার্থী সাক্কু প্রয়াত মন্ত্রী আকবর হোসেনের আপন মামাতো ভাই। কুমিল্লা শহরের ফরিদা বিদ্যায়তন এলাকার চাঞ্চল্যকর পংকজ হত্যাকাণ্ডে সাক্কু জড়িত_ এমন জনশ্রুতি প্রবল। পংকজ ছিলেন সাক্কুর ম্যানেজার। ১৯৯৬ সালে কুমিল্লা অজিত গুহ কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন েপছানোর জন্য রাতের আঁধারে কলেজে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ওই হত্যাকাণ্ডে সাক্কুর ক্যাডার কাপ্তানবাজারের ছুট্টু আগুন লাগাতে গিয়ে পুড়ে পরে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। ওই মামলায়ও সাক্কু আসামি ছিলেন। এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ বিজ্ঞানাগারে আগুন লাগে। ওই মামলায়ও সাক্কু আসামি হন।
২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপির ক্ষমতার সময় তার বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি ও বালু মহাল দখল করে কোটি কোটি টাকা লুটে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ছিলেন পলাতক। ওই সময় তার নাম শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের তালিকায় প্রকাশিত হয়। এমনকি তার বিরুদ্ধে কর ফাঁকিসহ একাধিক মামলাও দায়ের হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সালে জেলা বিএনপির সম্মেলনে রজনীগন্ধা কমিউনিটি সেন্টারে সাক্কুর নেতৃত্বে হামলা চালানো হয়। ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর কুমিল্লা টাউন হলে অনুষ্ঠিত যুবদলের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে শহরের কান্দিরপাড় এলাকায় তার ক্যাডাররা ব্যাপক অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটায়। বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র কামাল উদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর ২০০৫ সালের উপনির্বাচনে মনিরুল হক সাক্কু পৌর মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি ওই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর আগুনের মামলার আসামি হয়ে পলাতক ছিলেন। এতে তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। মামলা ও আইনি জটিলতা শেষ করে ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে আবার পৌর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান। সাক্কু ১৯৯৩ সালে জেলা যুবদলের সভাপতি হন। ওই পদে ২০১০ পর্যন্ত বহাল ছিলেন। ২০০৩ সালে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হন। বর্তমানে কুমিল্লা জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য।
তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের জবাবে মনিরুল হক সাক্কু বলেন, আমি কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটাইনি। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাকে মামলায় জড়ানো হয়। আদালত আমাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন। তিনি বলেন, আমি যেন পৌর মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে না পারি, সে কারণে কলেজে আগুন দেওয়ার মামলায় আমাকে আসামি করা হয়। তিনি বলেন, আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আমি যুবদলের সম্মেলনে অস্ত্রবাজি করেছি বলে অপপ্রচার করছে। আমি ৩৪ বছর ধরে বিএনপি করছি। যতই ষড়যন্ত্র হোক কুমিল্লার মানুষের পাশে থাকতে চাই। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে এখন কোনো মামলা নেই। যেগুলো আছে আইনগতভাবে মোকাবেলা করছি।
রয়েছে। কুসিক নির্বাচন সামনে রেখে আবার নতুনভাবে তাদের 'আমলনামা' বিচার-বিশ্লেষণ করছেন কুমিল্লার ভোটাররা।
আফজল খান : জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক বর্ষীয়ান নেতা অ্যাডভোকেট আফজল খান। কুমিল্লার রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তিনিই বয়সে সর্বজ্যেষ্ঠ। নিজেই সমকালকে জানান সে কথা। বলেন, 'আমার চেয়ে বেশি বয়সের আর কোনো নেতা কোনো দলে কুমিল্লায় নেই। শেষ বয়সে এখন মেয়র হিসেবে কুমিল্লাবাসীর সেবা করে যেতে চাই।' সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী এ নেতার 'সাদা' জামায় 'কাদা'র দাগও নেহাত কম নয়। '৬৫ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন তিনি। ষাটের দশকে ছিলেন ছাত্রলীগের দুর্দান্ত প্রতাপশালী নেতা। '৭০-এর নির্বাচনে তিনি সে সময়কার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য প্রার্থী অধ্যাপক খোরশেদ আলমের পক্ষে কাজ না করায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। অবশ্য '৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এ কারণে '৭২ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করেন। তিনি কুমিল্লা শহর ও কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। '৭৩-এ তিনি জেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক হন। '৭৫-পরবর্তী সময়ে রাজনীতি আবার উন্মুক্ত হলে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। পরে সাধারণ সম্পাদক হন। '৮৯-এ উপজেলা নির্বাচনের সময় তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। যান জাতীয় পার্টিতে। ওই সময় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। '৯৩ সালে আবার দলে ফিরে আসেন। '৯৪-এ দলীয় কাউন্সিলরদের ভোটে জেলার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। '৯৮ সালে শহরের বহুল আলোচিত শংকর হত্যাকাণ্ডের পর তাকে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ২০০৯-এর সংসদ নির্বাচনের কিছুদিন আগে তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। নির্বাচনের পর ৫৪ সদস্য বিশিষ্ট জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি একই সঙ্গে ১৪ দলের সমন্বয়ক ও জেলা মহাজোটের আহ্বায়ক।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, আফজল খান তার ভাই, ভাতিজা ও নিকটাত্মীয়দের নানামুখী অপকর্মে, বিশেষ করে বেশ ক'টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিতর্কিত হয়ে পড়েন। '৯৭ সালে নগরীর শাকতলায় শ্রমিক নেতা কালু হত্যাকাণ্ড এর মধ্যে অন্যতম। '৯৮ সালে ঠাকুরপাড়া এলাকায় শংকর হত্যাকাণ্ডে তার বড় ছেলে, মেয়ের জামাই ও ভাতিজা প্রধান আসামি হিসেবে অভিযুক্ত হন। শংকর হত্যাকাণ্ডের তিন মাস আগে তার ভাগ্নে জালাল রহস্যজনকভাবে খুন হন শহরের গোবিন্দপুরে। ওই ঘটনার রেশ ধরেই শংকর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ভাতিজা কামরুল খান রিকশাচালক আলম হত্যাকাণ্ডের আসামি ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সালে ওয়াপদা অফিসের পিয়ন হত্যার অভিযোগ রয়েছে। পরে কামরুল নিজেও ২০০৪ সালে র্যাবের ক্রসফায়ারে মারা যান। আফজল খানের বড় ছেলে ইমরান খান কুমিল্লা চেম্বারের সভাপতি। এ পদে দীর্ঘদিন ছিলেন আফজল খান। ওয়ান-ইলেভেনের পর আফজল খান নিজে, তার ছেলে, ভাই ও ভাতিজারা পলাতক ছিলেন। সে সময় তার বাসায় অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে প্রচুর অবৈধ গুলি উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। ওই অভিযোগে তার ছেলে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা হয়। ওই মামলায় তার ২০ বছরের সাজা হয়েছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় এ মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের এক মামলায় ১৯৯৯ সালে আফজল খান জেল খাটেন। তার স্ত্রী নার্গিস সুলতানা তার প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা মডার্ন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। ওয়ান-ইলেভেনের সময় অর্থ লুটের মামলার আসামি হিসেবে তিনিও জেল খাটেন। প্রবীণ এ নেতার একমাত্র মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা আইন ভঙ্গ করে একই সঙ্গে কুমিল্লা পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবার সদর উপজেলার নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেন। এ নেতার ছোট ছেলে আরমান খানের বিরুদ্ধে দ্রুতবিচার আইনের মামলাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। তিনিও পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী। পুলিশের খাতায় আরমান এখন পলাতক।
নিজের প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা মডার্ন স্কুলে বসে সমকাল প্রতিবেদকদ্বয়ের কাছে এসব ব্যাপারে আফজল খান বলেন, 'আমি কখনও কোনো সন্ত্রাস করিনি। আমি ১৭টি স্কুল-কলেজ করেছি। এলাকায় শিক্ষা বিস্তার করেছি।' তিনি বলেন, 'জাতীয় পার্টিতে আমি যোগ দিইনি। কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না। তবে রাষ্ট্রপতি এরশাদের এক শ্যালিকার মাধ্যমে তার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি হয়। তিনি আমাকে দিয়ে বেশ কিছু কাজ করিয়ে নেন।'
মনিরুল হক সাক্কু : সদ্য বিলুপ্ত কুমিল্লা পৌরসভার সাবেক মেয়র তিনি। এছাড়া তিনি জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। দলীয়ভাবে বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ না নিলেও তিনি নির্বাচনের মাঠ ছাড়বেন না বলেই কুমিল্লাবাসী মনে করছে।
পৌর মেয়র হিসেবে এলাকায় বেশকিছু উন্নয়নমূলক কাজ করলেও সাক্কুর বিরুদ্ধে হত্যা, কলেজে আগুন দেওয়া, আয়কর ফাঁকিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। '৭৯ সালে সাক্কুর বিরুদ্ধে প্রবীর হত্যার অভিযোগে মামলা হয়। নিহত প্রবীর সাক্কুর সঙ্গেই চলাফেরা করতেন। শহরের টিক্কারচর শ্মশান এলাকায় ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে। ওই সময় জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। এরপর সাক্কু সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যান। এরশাদের সামরিক শাসনামলে সাক্কু কুমিল্লা শহরে ফিরে আসেন। এলাকাবাসী জানান, কুমিল্লা সদরের ৫ বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও প্রয়াত মন্ত্রী কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন সে সময় সাক্কুকে মামলা থেকে বাঁচাতে সাহায্য করেন। মেয়র প্রার্থী সাক্কু প্রয়াত মন্ত্রী আকবর হোসেনের আপন মামাতো ভাই। কুমিল্লা শহরের ফরিদা বিদ্যায়তন এলাকার চাঞ্চল্যকর পংকজ হত্যাকাণ্ডে সাক্কু জড়িত_ এমন জনশ্রুতি প্রবল। পংকজ ছিলেন সাক্কুর ম্যানেজার। ১৯৯৬ সালে কুমিল্লা অজিত গুহ কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন েপছানোর জন্য রাতের আঁধারে কলেজে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ওই হত্যাকাণ্ডে সাক্কুর ক্যাডার কাপ্তানবাজারের ছুট্টু আগুন লাগাতে গিয়ে পুড়ে পরে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। ওই মামলায়ও সাক্কু আসামি ছিলেন। এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ বিজ্ঞানাগারে আগুন লাগে। ওই মামলায়ও সাক্কু আসামি হন।
২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপির ক্ষমতার সময় তার বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি ও বালু মহাল দখল করে কোটি কোটি টাকা লুটে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ছিলেন পলাতক। ওই সময় তার নাম শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের তালিকায় প্রকাশিত হয়। এমনকি তার বিরুদ্ধে কর ফাঁকিসহ একাধিক মামলাও দায়ের হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সালে জেলা বিএনপির সম্মেলনে রজনীগন্ধা কমিউনিটি সেন্টারে সাক্কুর নেতৃত্বে হামলা চালানো হয়। ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর কুমিল্লা টাউন হলে অনুষ্ঠিত যুবদলের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে শহরের কান্দিরপাড় এলাকায় তার ক্যাডাররা ব্যাপক অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটায়। বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র কামাল উদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর ২০০৫ সালের উপনির্বাচনে মনিরুল হক সাক্কু পৌর মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি ওই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর আগুনের মামলার আসামি হয়ে পলাতক ছিলেন। এতে তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। মামলা ও আইনি জটিলতা শেষ করে ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে আবার পৌর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান। সাক্কু ১৯৯৩ সালে জেলা যুবদলের সভাপতি হন। ওই পদে ২০১০ পর্যন্ত বহাল ছিলেন। ২০০৩ সালে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হন। বর্তমানে কুমিল্লা জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য।
তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের জবাবে মনিরুল হক সাক্কু বলেন, আমি কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটাইনি। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাকে মামলায় জড়ানো হয়। আদালত আমাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন। তিনি বলেন, আমি যেন পৌর মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে না পারি, সে কারণে কলেজে আগুন দেওয়ার মামলায় আমাকে আসামি করা হয়। তিনি বলেন, আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আমি যুবদলের সম্মেলনে অস্ত্রবাজি করেছি বলে অপপ্রচার করছে। আমি ৩৪ বছর ধরে বিএনপি করছি। যতই ষড়যন্ত্র হোক কুমিল্লার মানুষের পাশে থাকতে চাই। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে এখন কোনো মামলা নেই। যেগুলো আছে আইনগতভাবে মোকাবেলা করছি।
No comments