গাছে আটকা ঘুড়ি by রশীদ করীম

শ্বিন মাসের সকালবেলা; কিন্তু শরৎকালের দেখা নেই। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। বাতাস নেই। সারাটা রাত গুমোট গরম ছিল_ সুনিদ্রা হয়নি। ফর্সা হওয়ার আগেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। শয্যায় পড়ে থেকে শরীরটা তেতে আছে। বাইরের খোলা বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। এই মাত্র আজান হয়ে গেল। আমাদের পাড়ার মসজিদের মোয়াজ্জিন আজান দেন খুব ভালো। শুনতে খুব ভালো লাগে। লম্বা বারান্দাটিতে পায়চারী করছি। সারাদিনে এইটেই আমার একমাত্র


শরীরচর্চা। হাঁটা-চলা ও ব্যায়াম কোনোটাই হয়ে ওঠে না।আমাদের এই ফ্ল্যাটটা চারতলায়। চারদিকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। একটু আগেই মসজিদে কয়েকজনকে নামাজের জন্য যেতে দেখেছি; কিন্তু এখন পথ নির্জন। কোনোদিকে কোনো সাড়া-শব্দও নেই। পথে একটি লোকও চোখে পড়বে না। পাড়াটা এখনও ঘুমিয়ে আছে।
আমাদের বাড়িটি চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের মধ্যেই একটা বড় রকম ফলের বাগান। আমই বেশি; কিন্তু কাঁঠাল, জাম, নারিকেল আর পেয়ারা গাছও আছে। এসব ফলগাছের ভিড়েই একটি মাধবী গাছও কেমন করে জায়গা করে নিয়েছে এবং অনেক উঁচু পর্যন্ত মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য গাছের ডালপালার সঙ্গে মাধবী গাছের ডালপালাও মিলেমিশে আছে। হঠাৎ একটি মসৃণ সবুজ আমের গায়েই একগুচ্ছ লাল মাধবী ফুল দেখতে বেশ লাগে। এখন অবশ্য আমের সময় নয়।
একে এখনও সূর্য ওঠেনি, তার ওপর আকাশ মেঘে ঢাকা। তাই ছেলেটিকে পাঁচিলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলাম। পাঁচিলের কাছেই একটি আমগাছে একটি ঘুড়ি আটকে আছে। সেই ঘুড়ির ওপরই ছেলেটির চোখ। হাতে একটা লম্বা বাঁশের লগি। লগিটা ঘুড়ি পর্যন্ত পেঁৗছায় ঠিকই, কিন্তু খুব লিকলিকে বলে নুয়ে নুয়ে পড়ে। ঘুড়ি থেকে সুতো ঝুলছে। লগি দিয়ে সুতো পেঁচিয়ে টান মারাই ছেলেটির উদ্দেশ্য। কিন্তু সুতোর কাছে পেঁৗছেও লগিটার মাথা হঠাৎ নুয়ে পড়ে। তাই ছেলেটা কিছুতেই সুতো পেঁচাতে পারছে না।
ছেলেটার পরনে কালো রঙের হাফপ্যান্ট। ফুটবলাররা এই রকম প্যান্ট পরে মাঠে নামেন। তবে প্যান্টটা ছেঁড়া। গায়ে আর কিছু নেই। দেখেই মনে হয় গরিব; কিন্তু বুকে মাংস আছে। হাত-পায়ের পেশিও চোখে পড়ে। ছেলেটির রঙ কালো। বয়স আট-নয়ের বেশি হবে না। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। তেলবিহীন নয়; কিন্তু অবিন্যস্ত।
সবচেয়ে আকর্ষণ করে ছেলেটির চোখের দৃষ্টি। মেঘের ফাটল দিয়ে সূর্যের রশ্মি ঝকঝকে ইস্পাতের পাতের মতো একবার দেখা দিয়েই জানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল যে, সূর্য উঠছে। তখন দেখেছিলাম ছেলেটার চোখ। প্রখর উজ্জ্বল; সেই মুহূর্তে একাগ্র আর জ্বলন্ত। অবস্থা ভালো হলে মেধাবী ছাত্র হতে পারত। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটি দেখে তাই মনে হয়। কিন্তু এখন সেই চোখ দুটির সমস্ত মনোযোগ ওই ঘুড়িটির ওপর। ঘুড়িটিকে গাছ থেকে নামাতে হবে। শুধু তার দৃষ্টিই নয়, মুখের প্রতিটি রেখা, শরীরের সব ক'টি পেশি, তীক্ষষ্ট আর সজাগ হয়ে আছে। মনপ্রাণ দিয়ে এভাবে কোনো কিছু চাইবার ক্ষমতা শুধু এই বয়সেই থাকে। বয়স্করা পারে না। কোনো কিছুই ঠিক অতটা কাম্য মনে হয় না। লগিটা লক্ষ্যস্থলে পেঁৗছেও কাত হয়ে পড়ছে। লগিটাকে সুতোর কাছে স্থিরভাবে ধরে রাখবার সে বারবার চেষ্টা করছে। প্রতিবারই বিফল হচ্ছে। এখন দেখছি একবারের পর দ্বিতীয় চেষ্টার মাঝখানে বিরতিটা বেড়ে চলেছে। ছেলেটা বোধহয় বুঝতে পারছে, সে পারবে না। ওই লগিটা দিয়ে সে কিছুতেই ঘুড়িটা নামাতে পারবে না। বেশ বোঝা যায়, ছেলেটা হাঁফিয়ে পড়ছে। হাল ছেড়ে দিয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এক সময় চোখ তুলে ঘুড়িটাকে দেখে আবার নতুন উৎসাহে লগিটাকে তুলে ধরে।
ছেলেটা একটা কাজ করলে পারে। উঁচু পাঁচিলে যখন উঠতে পেরেছে, নিশ্চয় গাছেও চড়তে পারে। ছেলেটা যে গাছে উঠছে না তার কারণ এই নয় যে, সে উঠতে পারে না। আসলে সাহস হচ্ছে না তার। গাছে উঠলেই বাড়িওয়ালা বাধা দেবেন। মনে করবেন ছেলেটি ফল পাড়তে এসেছে; কিন্তু এখন কোনো ফলই নেই। মাধবী ফুলের জন্য কেউ অত উঁচু ডালে ওঠে না। হাতের নাগালের মধ্যে আছে। তবু উঠে পড়লেই পারত। সবাই ঘুমিয়ে আছেন। এই ফাঁকে চট করে ঘুড়িটা নাবিয়ে নিলে পারত। সে চিন্তা নিশ্চয় ছেলেটির মাথায়ও এসেছে। তবু সে সাহস করছে না।
ছেলেটির জন্য আমার বেশ দুঃখ হচ্ছে। একবার ভাবলাম ছেলেটাকে ডেকে এনে দুটো টাকা দিয়ে দিই। ঘুড়ি কিনবে সে। খুব খুশি হবে; কিন্তু ব্যাপারটা একটু নাটকীয় হয়ে যাবে মনে করে শেষ পর্যন্ত আর তা করলাম না।
পথ দিয়ে দুটো কুকুর যাচ্ছিল। ছেলেটিকে ঐভাবে পাঁচিলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারাও দাঁড়িয়ে পড়ল। নিশ্চয় এক্ষুণি ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করবে। আর ছেলেটি ধরা পড়বে; কিন্তু তা করল না। কুকুর দুটো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে একবার ছেলেটিকে, একবার ঘুড়িটিকে এবং একবার ছেলেটার ঘুড়ি ধরবার চেষ্টা দেখছে। তাদের সহানুভূতি ছেলেটার দিকে। তারাও চায়, ঘুড়িটা আসুক ছেলেটির হাতে।
একতলায় এক মহিলাকে দেখলাম। বাগানে এসে দাঁড়িয়েছেন। বিশ-পঁচিশ বয়স হবে। দেখতে ভালো। শরীরের বাঁধুনি আরও ভালো। আমি ঠিক জানি না, কিন্তু আমার অনুমান, তিনি বাড়িওয়ালার কোনো গরিব আত্মীয়। কিছুদিন হলো এসেছেন। দেখেই মনে হয়, গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছেন। আমি ভাবলাম, এই-বা ছেলেটির বিপদ। তিনি নিশ্চয় বাধা দেবেন, চেঁচামেচি শুরু করবেন। একবার কিছু বলতে উদ্যত হয়েও বললেন না। খুব সম্ভব প্রাকৃতিক তাড়নাই তার কারণ। হাতে মগ ছিল। মহিলা গাছের আড়ালে একটি কোণে গিয়ে বসলেন। বাড়ির ঝি-চাকররা সেখানেই পেচ্ছাব করে। অনেক ডালপালা। চারতলার বারান্দা থেকে যে কিছু দেখা যায় তা বলা যায় না! শুধু একটা আভাস পাওয়া যায়।
কিন্তু ভদ্রমহিলা ভেতরের বাথরুম ব্যবহার করলেন না কেন? কেউ আছে বাথরুমগুলোতে? খুব সম্ভব তা নয়। যে যার বেডরুমে শুয়ে আছে দরজা বন্ধ করে। তাই বেডরুমের বাইরে থেকে বাথরুমে যাওয়া সম্ভব নয়। এই ভদ্রমহিলাকে নিশ্চয় খাবার ঘর বা বসার ঘরে শুতে হয়। সকলে উঠে পড়লে নিশ্চয় তিন বাথরুমই ব্যবহার করবেন। কিন্তু এখন ওই গাছের কোণটাই ব্যবহার করতে হচ্ছে। তিনি গ্রামে থাকেন বলেই এত সকালে ওঠার অভ্যাস।
একটু পরই তিনি আবার বাগানে এসে দাঁড়ালেন। আশ্চর্য, ছেলেটিকে কিছুই বললেন না। হাত দুটি মাথার ওপর তুলে তিনি ছেলেটির চেষ্টা দেখছেন। আমার মনে হলো, তাঁর সহানুভূতিও ছেলেটির দিকে। আরও একটি অদ্ভুত কথা মনে হলো। মনে হলো, বাড়িওয়ালার ওপর তাঁর রাগ আছে। বাড়িওয়ালা তাঁর আত্মীয়। কিন্তু তিনি গরিব বলে আর গ্রাম থেকে এসেছেন বলে, তাঁকে খাবার ঘরে থাকতে দিয়েছেন। নিক। বাড়িওয়ালার যা আছে, নিয়ে যাক ছেলেটা।
গরম বলেই হোক কিংবা অভ্যাস নেই বলেই হোক, ভদ্রমহিলা ব্লাউজ পরেননি। মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। বুকের একপাশে থেকে আঁচল সরে গেছে। পাশ দিয়ে সুডৌল স্তন দেখা যাচ্ছে। সেদিকে চোখ না গিয়ে উপায় নেই। সাধারণত গ্রামের মেয়েদের বুক খুব ভালো হয়। তিনি কি জানেন না যে আমি দেখছি? কিংবা কেয়ার করছেন না?
কিন্তু কাল সন্ধ্যাবেলাতেই অন্যরকম ব্যাপার ঘটেছিল। আমি এই বারান্দাতেই এসে দাঁড়িয়েছি। ঐ বাগানেই একটি গাছের নিচে ঘাসের ওপর মাদুর বিছিয়ে চার-পাঁচজন মহিলা গল্প করছিলেন। আমাকে দেখে আর কেউ কিছু করলেন না।
কিন্তু ঐ যে মহিলাটি এখন মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন এবং যাঁর বুক দেখা যাচ্ছে, তিনি এক হাত লম্বা ঘোমটা টেনেছিলেন। আমি এমনিতেই ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম না। অতবড় ঘোমটা টানা দেখে সঙ্গে সঙ্গে সরে এলাম। তার আগে মহিলাদের মৃদু হাসির একটা গুঞ্জন শুনেছিলাম।
পাঁচিলের ওপাশে একটা একতলা টিনের ঘর। সেই ঘরটির জানালা খুলে গেল। জানালায় দেখা গেল দুটি মুখ। একজন তিরিশ-বত্রিশ বছরের এক মহিলা। তিনি ফর্সা। মুখটি খুব সুন্দর। ছেলেটির বয়স ন'-দশ হবে।
'য়্যাই' বলে মহিলাটি ছেলেটিকে একটা তাড়া দিতে উদ্যত হয়েও আর কিছু বললেন না। তাঁর পাশের ছেলেটি আরও একটু বিক্রমের সঙ্গে কিছু বলার জন্য একটা মুখভঙ্গি করেও শেষ পর্যন্ত শুধু কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে থাকল। কোনো সুন্দরী মহিলার ওভাবে 'য়্যাই' বলা উচিত নয়। মুখটা বিকৃত হয়ে যায়। এই মহিলাকে আগেও আমি রাস্তায় দেখেছি। তাঁর মুখটি কোমল। চলার সময় প্রতিটি পদক্ষেপ সুরুচি। তিনি কিছু বলতে গিয়েও কিছু বললেন না কেন? পাঁচিলটি আর গাছটি তাঁর নিজের নয় বলে? এখন বরং মনে হচ্ছে, মাতাপুত্র দু'জনেরই সহানুভূতি ছেলেটির জন্য।
আমাদের সকলের চোখই পাঁচিলের সেই ছেলেটির ওপর। ছেলেটি ঘুড়ি পাড়তে পারছে না কেন? আমাদের সকলের মনেই অস্বস্তি। টেনশন জমে উঠছে। আমরা জানি, যে কোনো মুহূর্তে বাড়িওয়ালা উঠে পড়বেন। তখন ছেলেটার কপালে দুঃখ আছে। ছেলেটার এবার একটা নাম দেওয়া দরকার। ঘটনাটা বলতে অসুবিধা হচ্ছে। মনে করুন, ছেলেটির নাম শাকুর।
'কে রে!' একটা প্রচণ্ড হাঁক শোনা গেল। বাড়িওয়ালা একটা লম্বা বাঁশ নিয়ে ছুটে এলেন। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে। শরীরটা বেশ ভারী। নড়তে-চড়তে কষ্ট হয়। তারই মধ্যে এতটা ক্ষিপ্রতা কোথায় লুকিয়ে ছিল ভাবতে অবাক লাগে।
শাকুরকে তার লগিটার মায়া ত্যাগ করতে হলো। লগিটা সামনের বাগানে ছুড়ে ফেলে, সে দেয়াল থেকে পথের ওপর লাফ দিল। লগিটা রাস্তায় না ফেলে বাগানে ফেললো কেন, বুঝলাম না। রাস্তায় ফেললে লগিটাকে সে বাঁচাতে পারত। কিন্তু এ কথাও জানি, আতঙ্কের মুহূর্তে কাজে ভুল হয়ে যায়।
দেয়ালটি বেশ উঁচু। শাকুর হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছে। এক হাতে হাঁটু চেপে সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড়ূচ্ছে। কিছুদিন আগে রাস্তার মোড়ে চৌদ্দ-পনেরো বছরের চার-পাঁচজন ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। তারা কিছুই করছিল না। শুধু দাঁড়িয়ে ছিল। সামনে দিয়ে একটি কুকুর যাচ্ছিল। একটি ছেলে একটা পাথর তুলে কুকুরটির ঠ্যাং লক্ষ্য করে মারলো। সঙ্গে সঙ্গে বাকি ছেলেরা সামনে যাই পায় তাই দিয়ে কুকুরটিকে মারতে থাকে। সেদিন সেই কুকুরটিকেও এইভাবেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড়ূতে দেখেছিলাম।
দু'দিন পর খুব বৃষ্টি হলো। বৃষ্টিতে ভিজে কোমল হয়ে ঘুড়িটা শতছিন্ন হয়ে গেল। তারপর উঠলো রোদ। ঘুড়িটা এখনও সেই ডালে একটা কঙ্কালের মতো আটকে আছে।
সেদিন সন্ধ্যায় দেখি, শাকুর সেই জানালাটার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে ক'দিন আগেই সেই মহিলার আর তাঁর নয়-দশ বছরের ছেলেকে দেখা গিয়েছিল। জানালার সেই ছেলেটার নাম মনে করুন হামিদ। জানালা দিয়ে হামিদ লগিটা বাড়িয়ে শাকুরকে দিয়ে দিলো। হামিদ যে কখন বাগান থেকে লগিটা নিয়ে এসেছিল কেউ জানে না।
বাড়িওয়ালা যে বাগানের খুব যত্ন করেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গাছপালা সম্পর্কে তিনি অনেক বই পড়েছেন। সেদিন দেখি, তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে ঘুড়ির কঙ্কালটা যেখানে আটকে আছে সেই জায়গাটা দেখছেন। আগেও দু'দিন তাঁকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। চলচ্চিত্র গোয়েন্দাদের চোখে ঐ রকম দৃষ্টি থাকে।
এমন সময় বছর পনেরোর একটি ছেলে এলো। সেদিন ছিল ছুটির দিন। সামাজিকতা করার জন্য আমি নিচে গিয়েছিলাম। বাড়িওয়ালার সংসারে কাজের লোক সকলেই মেয়ে মানুষ। গাছে চড়তে পারে সে রকম কেউ নেই। এই ছেলেটিকে খবর দিয়ে আনিয়েছেন। ছেলেটি গাছে উঠে কঙ্কালটা নামিয়ে আনলো। এক টাকা পারিশ্রমিক লাভ করলো।
বাড়িওয়ালা বললেন, জানেন, গাছে কিছু আটকে থাকলে গাছের ক্ষতি হয়। ফল-ফুল বাধা পায়।
আমি বললাম, সেদিন তাহলে ছেলেটিকে বাধা দিলেন না কেন? সে তো ঘুড়ি পাড়তেই এসেছিল।
বাড়িওয়ালা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
'বাঃ, আমার পাঁচিলে কাউকে উঠতে দেবো কেন? আমার গাছ থেকে কাউকে কিছু পাড়তে দেবো কেন?'

দুই.
ভেবেছিলাম ঘটনাটা এখানেই শেষ হয়ে গেছে; কিন্তু সামান্য কিছুটা বাকি ছিল; সেটা জানলাম দিন দশেক পর।
আমি যেখানটায় বসে লিখিটিখি সেখান থেকে খোলা জানালা দিয়ে রাস্তার ওপারে একটি তেতলা বাড়ির সামনের বারান্দা দেখা যায়। তেতলায় একজন ইঞ্জিনিয়ার থাকেন বলে শুনেছি। স্ত্রী এবং তিন-চার বছরের একটি ফুটফুটে মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। ছুটির দিন ভদ্রলোককে বারান্দায় বসে চা খেতে আর খবরের কাগজ পড়তে দেখেছি। মেয়েটিও একটি ছোট বেতের চেয়ারে হাতে একটি বই নিয়ে বসে থাকে_ নিশ্চয়ই ছবিওয়ালা কোনো বই। স্ত্রী মহিলাটিকে বারান্দার রেলিংয়ে হাত রেখে অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তাঁদের সঙ্গে আমার কোনোই আলাপ-পরিচয় হয়নি।
দিন দশেক লিখবার টেবিলে আসিনি। একদিন দেখি সেই তেতলার ঘরদুয়ার সব বন্ধ। আমি মনে করলাম ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ছুটি নিয়ে সপরিবারে বেড়াতে গেছেন। কিন্তু দেখি, একটু পরই দরজা-জানালা সব খুলে গেল। সব ক'টিতেই পর্দা ছিল। এখন একটিতেও নেই। একটি আসবাব পর্যন্ত নেই। বুঝে নিলাম, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। মনটা হঠাৎ হু-হু করে উঠল। অন্য কেউ বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। একজন মেয়ে মানুষ ন্যাকড়া দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করছে। হাঁটুর ওপর তার শাড়ি উঠে এসেছে। ঘরদোর পরিষ্কার করার পর আসবাব আসবে। বারান্দায় আরও দু'একটি নতুন মুখ দেখলাম। এই লোকগুলোকে অনধিকারী মনে হলো।
আমি বুঝতে পারছি না, যাদের একেবারেই চিনি না, তাদের জন্য এতটা মন খারাপ করছে কেন? কিন্তু সেই ছোট্ট অপরিচিত পরিবারটি আমার অভ্যস্ত পরিবেশ ও জীবনের একটি অংশ ছিলেন। অংশ ছিলেন এ কারণে নয় যে, তাঁরা আমার প্রতিবেশী ছিলেন। সেই একই বাড়ির একতলা ও দোতলাতেও লোকজন আছেন। তাঁরাও নিশ্চয় বারান্দায় ওঠাবসা করেন। কিন্তু তাঁরা আমার চোখের সামনে থেকেও কখনো চোখে পড়েন না। অথচ তেতলার সেই ছোট্ট পরিবারটি কী করে অগোচরে আমার জীবনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন তার কারণ অবশ্য আমি বলতে পারব না। সত্যিই মনে হলো, আমার জীবনের একটা অংশ ধসে পড়লো। রাত্রিবেলাও স্বপ্নে সেই ফুটফুটে মেয়েটির মুখ ভেসে এলো।
পরদিন সূর্যোদয়ের আগেই পথে বেরিয়ে পড়লাম। মনের ভেতরকার গুমোট ভাবটাকে বের করে দিতে হবে। পথের দু'পাশে নালা। আর সবদিক দিয়েই পরিচ্ছন্ন ও আকর্ষণীয় এই পাড়ায় দু'পাশ কাঁচা নর্দমা বড়লোকদের গরিব আত্মীয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।
একটু এগুতেই এক জায়গায় লোকজনের জটলা দেখলাম। সকলেই বেশ উত্তেজিত। চোখে-মুখে একটুখানি ভয়ের ভাবও আছে। তবু মুখের ভাব দেখে মনে হয়, এই ভয়কে তারা উপভোগই করছে। একটি গোক্ষুর দেখা গেছে। কিছুদিন আগেই বন্যা হয়ে গেছে। কোথা থেকে সাপটা এলো তা অবশ্য কেউ জানে না। একটু আগেই দু'তিনজন লোক দেখেছে। নর্দমায় নেমে গেল। গেল তো ঠিকই, কিন্তু কোথায় গেল কেউ দেখতে পায়নি।
সাপের নাম শুনলে শরীর শিরশির করবেই। মনের মধ্যে যে জায়গাটায় তেতলার সেই পরিবারের জন্য দুঃখটা ছিল, এখন সেই দুঃখটাকে ঠেলে বের করে দিয়ে, ঠিক যেন সেই জায়গাটিতেই সাপের ভয় প্রবেশ করলো।
ওদিকে যাওয়া কি ঠিক হবে? হয়তো ওদিকেই সাপটা গেছে। গা ঝাড়া দিয়ে শরীর থেকে ভয়টাকে ফেলে দিলাম। সামনেই এগুতে লাগলাম। পথের মোড়ে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আরেকটি বাড়ি। সেখানেও গাছে একটি ঘুড়ি আটকে আছে। পাঁচিলে সেই ছেলেটি যার নাম দিয়েছি শাকুর। এই দিকটা খুবই নির্জন।
পাঁচিলে দাঁড়িয়ে একটি ছেলে ঘুড়ি পাড়ছে, এ দৃশ্য দেখে আমার দাঁড়িয়ে পড়ার কথা নয়; কিন্তু দাঁড়িয়ে পড়লাম এবং কী করছি বোঝবার আগেই আমার মুখ দিয়ে ধমকের সুরে একটা 'য়্যাই' বেরিয়ে গেল। জানালার সেই ভদ্রমহিলার যেমন বেরিয়েছিল।
শাকুর ফিরে একবার আমাকে দেখলো; কিন্তু কোনা আমল দিলো না। সে ঘুড়ি পাড়তে ব্যস্ত। আমার 'য়্যাই' শুনে একটু ভয় পেল না। এতদিনে সে জেনে গেছে, পাঁচিল যার, বাগান যার, ভয়ের আশঙ্কা কেবল তাদের কাছ থেকেই । বাদ বাকি সকলের বরং সে সহানুভূতিই লাভ করেছে। আচ্ছা ঘুড়ি-পাগলা ছেলে যা হোক। আজ কিন্তু শাকুর ব্যর্থ হলো না। বেশ সহজেই ঘুড়িটা নাবিয়ে নিলো। তারপরই এক লাফে রাস্তায়।
এক হাত দিয়ে ঘুড়িটাকে বুকের ওপর চেপে, অন্য হাতে লগিটা ধরে, ঠিক আমার সামনেই সে এখন দাঁড়িয়ে আছে।
আমি বললাম, দুটি টাকা নিবি?
শাকুর কিছুই বলল না। তার মুখে আগ্রহ বা লোভের চিহ্নই দেখা গেল না।
আমি আবার বললাম, ঘুড়ি কিনবি?
শাকুর তেমনি নির্বিকার আর উদাসীন।
আমি মনে করলাম, সে বুঝি বিশ্বাস করছে না আমি সত্যিই তাকে টাকা দিতে চাই। দুটি টাকা বের করে আমি তার হাতে গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। সে সবলে হাত ছাড়িয়ে নিলো। টাকা সে নেবে না। গাছের ঘুড়িটাকে শাকুর আরও নিবিড় করে বুকে চেপে ধরলো। তারপর এক দৌড়ে অদৃশ্য।
আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। টাকার ওপর ছেলেটার কোনো লোভ নেই। দোকানের ঘুড়িও সে চায় না। সে শুধু চায়, গাছে আটকা ঘুড়ি। া

No comments

Powered by Blogger.