আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৫২)-মনের গহিন ভেতর থেকে by আলী যাকের
করাচিতে চাকরিজীবী বাঙালিদের মধ্যে কেউ কেউ নানা রকম সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে আগ্রহী ছিলেন। তাঁদেরই একজন 'নয়া দেশ' নামে একটি সাময়িকী বের করতেন। এই সাময়িকীতে আমি বোধ হয় গোটা দুয়েক লেখা দিয়েছিলাম। একটি নাটকের দলও একবার কল্যাণ মিত্রের একটি নাটক মঞ্চায়ন করেছিল, যাতে একটি ছোট ভূমিকায় আমি অভিনয় করেছিলাম। মঞ্চে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে ওই নাটকটিই ছিল আমার প্রথম এবং শেষ
অভিনীত নাটক। এরপর যখন নাট্যশিল্পের গভীরে প্রবেশ করি, তখন অনেক চিন্তাভাবনা করে, অনেক বিশ্লেষণ করে অভিনয় করতে শিখেছি। তবে সে তো আরো অনেক পরের ব্যাপার।
করাচিতে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হয়েছে প্রতিদিনই। সপ্তাহে একদিন ছুটি পেতাম, বরিবার। আমার আবাল্য বন্ধু ইমরুল চৌধুরীও তখন করাচি নিবাসী। তার সঙ্গেও আড্ডা জমত মাঝেমধ্যে। ইমরুল রেডিও পাকিস্তানের বাংলা সংবাদ পাঠক ছিল। ওরই চেষ্টায় আমিও রেডিও পাকিস্তান থেকে বাংলায় রাতের খবর পড়ার একটা কাজ পেয়ে গেলাম। সেখান থেকেও যৎসামান্য পয়সা আসত। আমার অর্থনৈতিক অবস্থা তখন যা, তাতে করে এই পয়সাটির প্রয়োজন ছিল খুবই। তবে খবর পড়ে কখনোই তৃপ্তি পাইনি। পাকিস্তানি খবর সাধারণত মিথ্যা কথায় ভরা থাকত। সেটাই রাতের পর রাত পড়তে বড্ড খারাপ লাগত। ফলে অচিরেই ওই কাজ ছেড়ে দিলাম। করাচিতে একমাত্র অর্থের অপ্রতুলতা ছাড়া তেমন কোনো অসুবিধা ছিল না। তবুও মন পড়ে থাকত ঢাকায়। ভাবতাম বন্ধুদের কথা। ইতিমধ্যে আইয়ুব খানবিরোধী রাজনীতি দানা পাকিয়ে উঠেছে এবং সামরিক শাসকের যেমন চরিত্র হয়ে থাকে, এই জেনারেলও গণবিরোধী কার্যকলাপ শুরু করে দিয়েছিলেন। যেখানেই প্রতিবাদ উঠছে, তিনি ফৌজ পাঠিয়ে তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের অ-পাঞ্জাবি প্রদেশগুলোতেও তখন রাজনৈতিক অসন্তোষ বিক্ষোভ আকারে দেখা দিচ্ছিল। আর বাংলাদেশে তো এই বিক্ষোভ তুঙ্গে। এ সময় কার ইচ্ছে করে ভিনদেশে কেবল একটা চাকরির জন্য দিনাতিপাত করতে! ফলে প্রাণ আইঢাই করতে লাগল। কিন্তু তত দিনে নিজের আয়ে নির্ভরশীল হওয়ার স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে গেছি। কাজেই দেশে ফিরে কারো গলগ্রহ হব, সেই ইচ্ছেও নেই।
তখন করাচিতে আমাকে কেন্দ্র করে একটি মজার ঘটনা ঘটে। ঢাকার একজন তরুণী সুবদ্ধ সংগীতশিল্পী করাচিতে বেড়াতে আসেন। তিনি করাচিতে এক প্রবাসী বাঙালি বন্ধুর বোন। এই তরুণীর গানে আমি মুগ্ধ ছিলাম। বিশেষ করে তাঁর তান এবং লয় মন্ত্রমুঙ্কর ছিল। ঢাকায় থাকতে অনেক রাতেই তাঁর গান একেবারে সামনে বসে শুনেছি। এই গান ভালো লাগা থেকে ভদ্রমহিলার প্রতি হয়তো কোনো দুর্বলতাও জন্মে থাকবে। যৌবনের ধর্মই বোধ করি এই। যত্রতত্র নারী সন্দর্শনে মনটা হুহু করে ওঠে। অল্প বয়সে আমরা ঠাট্টাচ্ছলে বলতাম, 'হা হুতাশ, দখিনা বাতাস'। যাহোক, তিনি যখন করাচিতে এলেন এবং কয়েকটি বাঙালি বাড়িতে শ্রোতার আসরে গাইলেন, তখন কোনো এক বন্ধুর কাছে তাঁর গানের প্রতি আমার দুর্বলতার কথা বলেছিলাম। হয়তো একটু বেশিই বলেছিলাম। তাই তিনি ভেবেছিলেন যে আমি এই শিল্পীর প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। রসাল গুজব ছড়াতে বাঙালি যেমন পটু, অল্প দিনেই করাচি নিবাসী তাবৎ বাঙালি তরুণ জেনে গেল যে আমি ওই শিল্পীর প্রেমে দিওয়ানা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সব বাঙালি সমাজেই যেকোনো 'অরক্ষিত' তরুণীর কিছু 'স্বনিযুক্ত' তরুণ অভিভাবক থাকে। করাচিতেও এর কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। এক রবিবার সকালে আমি যখন ঘুমে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত, একদল তরুণ আমার শোবার ঘরে এসে আমাকে ঘুম থেকে ওঠাল এবং আমাকে রীতিমতো শাসাতে শুরু করল যে কী সাহস আমার, আমি সেই প্রখ্যাত শিল্পীর মতো এক তরুণীর প্রেমে আসক্ত! একজন এমনও বলল যে বামন হয়ে আমি চাঁদে হাত বাড়ানোর মতো ধৃষ্টতা দেখাচ্ছি। আর বেশি বাড়াবাড়ি করলে সেই হাতটি ভেঙে দেওয়া হবে। এরা সবাই ভদ্র সন্তান, আমার পরিচিত বন্ধুপ্রতিম এবং যত দূর মনে পড়ে, মার্জিত রুচির মানুষ ছিল। তবে এহেন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না বিধায় তারা চলে যাওয়ার পর মনের দুঃখে বনে যাওয়ার দশা হলো আমার। ক্লিফটনের সমুদ্রসৈকতে গিয়ে একা বসে বসে কাঁদলাম। তারপর ঢাকায় ভাইয়াকে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখলাম, ইংরেজিতে। সেই চিঠিতে আমার সব দুঃখ এবং আমার বন্ধুদের আচরণ সম্পর্কে আমি তাঁকে জানালাম। এর জবাবে ভাইয়া আমাকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে যেকোনো আচরণে আমার বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা আমার প্রয়াত গুরুজনদের আশীর্বাদ আমার ওপর আছে। আমাকে বললেন তাঁদের উদাহরণ স্মরণ করতে। মনে করিয়ে দিলেন, এ রকম একটি অনভিপ্রেত পরিস্থিতি আমাদের বাবা কী অনায়াসে মোকাবিলা করতেন। এই চিঠি পাওয়ার পর আমি আরেক দফা হাউমাউ করে কাঁদলাম। এই সামান্য দুর্ঘটনা সম্পর্কে যখন লিখছি, তখন আমার মনে দুটো প্রশ্ন আমায় উত্ত্যক্ত করছে। প্রথম প্রশ্ন হলো, আমার বন্ধুদের দ্বারা অপমানিত হয়ে আমি কেঁদেছিলাম কেন? তাহলে কি আমার হৃদয়ে সেই যুবতীর প্রতি সামান্য হলেও ভালোবাসা ছিল? আর দুই নম্বর হলো, ভাইয়া যখন আমাকে আমার গুরুজনদের উদাহরণ, তাঁদের চারিত্রিক ঋজুতার কথা মনে করিয়ে দিলেন, তখন কেন কেঁদেছিলাম? প্রথমটির উত্তর আমি এখনো জানি না। তবে দ্বিতীয়টির জবাব আমি পেয়ে গেছি সেই দিনই। যেকোনো কঠিন অবস্থা, কী সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হলে এখনো মনের গহিন ভেতর থেকে বাবা, মা, দিদির সেই স্নেহময় চেহারা ভেসে ওঠে চোখে। তাঁদের চারিত্রিক দৃঢ়তা আমাকে অনুপ্রেরণা জোগায়। আমি শক্তি খুঁজে পাই।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
করাচিতে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হয়েছে প্রতিদিনই। সপ্তাহে একদিন ছুটি পেতাম, বরিবার। আমার আবাল্য বন্ধু ইমরুল চৌধুরীও তখন করাচি নিবাসী। তার সঙ্গেও আড্ডা জমত মাঝেমধ্যে। ইমরুল রেডিও পাকিস্তানের বাংলা সংবাদ পাঠক ছিল। ওরই চেষ্টায় আমিও রেডিও পাকিস্তান থেকে বাংলায় রাতের খবর পড়ার একটা কাজ পেয়ে গেলাম। সেখান থেকেও যৎসামান্য পয়সা আসত। আমার অর্থনৈতিক অবস্থা তখন যা, তাতে করে এই পয়সাটির প্রয়োজন ছিল খুবই। তবে খবর পড়ে কখনোই তৃপ্তি পাইনি। পাকিস্তানি খবর সাধারণত মিথ্যা কথায় ভরা থাকত। সেটাই রাতের পর রাত পড়তে বড্ড খারাপ লাগত। ফলে অচিরেই ওই কাজ ছেড়ে দিলাম। করাচিতে একমাত্র অর্থের অপ্রতুলতা ছাড়া তেমন কোনো অসুবিধা ছিল না। তবুও মন পড়ে থাকত ঢাকায়। ভাবতাম বন্ধুদের কথা। ইতিমধ্যে আইয়ুব খানবিরোধী রাজনীতি দানা পাকিয়ে উঠেছে এবং সামরিক শাসকের যেমন চরিত্র হয়ে থাকে, এই জেনারেলও গণবিরোধী কার্যকলাপ শুরু করে দিয়েছিলেন। যেখানেই প্রতিবাদ উঠছে, তিনি ফৌজ পাঠিয়ে তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের অ-পাঞ্জাবি প্রদেশগুলোতেও তখন রাজনৈতিক অসন্তোষ বিক্ষোভ আকারে দেখা দিচ্ছিল। আর বাংলাদেশে তো এই বিক্ষোভ তুঙ্গে। এ সময় কার ইচ্ছে করে ভিনদেশে কেবল একটা চাকরির জন্য দিনাতিপাত করতে! ফলে প্রাণ আইঢাই করতে লাগল। কিন্তু তত দিনে নিজের আয়ে নির্ভরশীল হওয়ার স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে গেছি। কাজেই দেশে ফিরে কারো গলগ্রহ হব, সেই ইচ্ছেও নেই।
তখন করাচিতে আমাকে কেন্দ্র করে একটি মজার ঘটনা ঘটে। ঢাকার একজন তরুণী সুবদ্ধ সংগীতশিল্পী করাচিতে বেড়াতে আসেন। তিনি করাচিতে এক প্রবাসী বাঙালি বন্ধুর বোন। এই তরুণীর গানে আমি মুগ্ধ ছিলাম। বিশেষ করে তাঁর তান এবং লয় মন্ত্রমুঙ্কর ছিল। ঢাকায় থাকতে অনেক রাতেই তাঁর গান একেবারে সামনে বসে শুনেছি। এই গান ভালো লাগা থেকে ভদ্রমহিলার প্রতি হয়তো কোনো দুর্বলতাও জন্মে থাকবে। যৌবনের ধর্মই বোধ করি এই। যত্রতত্র নারী সন্দর্শনে মনটা হুহু করে ওঠে। অল্প বয়সে আমরা ঠাট্টাচ্ছলে বলতাম, 'হা হুতাশ, দখিনা বাতাস'। যাহোক, তিনি যখন করাচিতে এলেন এবং কয়েকটি বাঙালি বাড়িতে শ্রোতার আসরে গাইলেন, তখন কোনো এক বন্ধুর কাছে তাঁর গানের প্রতি আমার দুর্বলতার কথা বলেছিলাম। হয়তো একটু বেশিই বলেছিলাম। তাই তিনি ভেবেছিলেন যে আমি এই শিল্পীর প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। রসাল গুজব ছড়াতে বাঙালি যেমন পটু, অল্প দিনেই করাচি নিবাসী তাবৎ বাঙালি তরুণ জেনে গেল যে আমি ওই শিল্পীর প্রেমে দিওয়ানা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সব বাঙালি সমাজেই যেকোনো 'অরক্ষিত' তরুণীর কিছু 'স্বনিযুক্ত' তরুণ অভিভাবক থাকে। করাচিতেও এর কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। এক রবিবার সকালে আমি যখন ঘুমে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত, একদল তরুণ আমার শোবার ঘরে এসে আমাকে ঘুম থেকে ওঠাল এবং আমাকে রীতিমতো শাসাতে শুরু করল যে কী সাহস আমার, আমি সেই প্রখ্যাত শিল্পীর মতো এক তরুণীর প্রেমে আসক্ত! একজন এমনও বলল যে বামন হয়ে আমি চাঁদে হাত বাড়ানোর মতো ধৃষ্টতা দেখাচ্ছি। আর বেশি বাড়াবাড়ি করলে সেই হাতটি ভেঙে দেওয়া হবে। এরা সবাই ভদ্র সন্তান, আমার পরিচিত বন্ধুপ্রতিম এবং যত দূর মনে পড়ে, মার্জিত রুচির মানুষ ছিল। তবে এহেন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না বিধায় তারা চলে যাওয়ার পর মনের দুঃখে বনে যাওয়ার দশা হলো আমার। ক্লিফটনের সমুদ্রসৈকতে গিয়ে একা বসে বসে কাঁদলাম। তারপর ঢাকায় ভাইয়াকে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখলাম, ইংরেজিতে। সেই চিঠিতে আমার সব দুঃখ এবং আমার বন্ধুদের আচরণ সম্পর্কে আমি তাঁকে জানালাম। এর জবাবে ভাইয়া আমাকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে যেকোনো আচরণে আমার বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা আমার প্রয়াত গুরুজনদের আশীর্বাদ আমার ওপর আছে। আমাকে বললেন তাঁদের উদাহরণ স্মরণ করতে। মনে করিয়ে দিলেন, এ রকম একটি অনভিপ্রেত পরিস্থিতি আমাদের বাবা কী অনায়াসে মোকাবিলা করতেন। এই চিঠি পাওয়ার পর আমি আরেক দফা হাউমাউ করে কাঁদলাম। এই সামান্য দুর্ঘটনা সম্পর্কে যখন লিখছি, তখন আমার মনে দুটো প্রশ্ন আমায় উত্ত্যক্ত করছে। প্রথম প্রশ্ন হলো, আমার বন্ধুদের দ্বারা অপমানিত হয়ে আমি কেঁদেছিলাম কেন? তাহলে কি আমার হৃদয়ে সেই যুবতীর প্রতি সামান্য হলেও ভালোবাসা ছিল? আর দুই নম্বর হলো, ভাইয়া যখন আমাকে আমার গুরুজনদের উদাহরণ, তাঁদের চারিত্রিক ঋজুতার কথা মনে করিয়ে দিলেন, তখন কেন কেঁদেছিলাম? প্রথমটির উত্তর আমি এখনো জানি না। তবে দ্বিতীয়টির জবাব আমি পেয়ে গেছি সেই দিনই। যেকোনো কঠিন অবস্থা, কী সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হলে এখনো মনের গহিন ভেতর থেকে বাবা, মা, দিদির সেই স্নেহময় চেহারা ভেসে ওঠে চোখে। তাঁদের চারিত্রিক দৃঢ়তা আমাকে অনুপ্রেরণা জোগায়। আমি শক্তি খুঁজে পাই।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments