কেমন আছ মা-৪০ বছরে কেউ খোঁজ নেয়নি আমাদের-রোকেয়া খাতুন
বিজয়ের ৪০ বছর পূর্ণ হচ্ছে এই ডিসেম্বরে। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের মায়েরা কেমন আছেন, তা নিয়েই ধারাবাহিক এই আয়োজনআমার স্বামী মোতাহার হোসেন ছিলেন পাবনা আলিয়া মাদ্রাসার সাধারণ শাখার প্রধান শিক্ষক। ১৯৭১ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। বড় ছেলে মোজাম্মেল হোসেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এসে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় সে।
মেজ ছেলে মোকাররম হোসেন পাবনা জেলা বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী ছিল। তৃতীয় ছেলে মনসুর হোসেন ঢাকা ওয়াপদার সিনিয়র অফিস সহকারী ছিল। চতুর্থ ছেলে মোস্তাক হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষ অনার্সের এবং পঞ্চম ছেলে মোশাররফ হোসেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। আমার এই পাঁচ ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। বড় ছেলে মোজাম্মেল ছাড়া বাকি চারজন যুদ্ধে শহীদ হয়। তাদের সঙ্গে শহীদ হয় আমার জামাতা ইউসুফ আলীও।
২৬ মার্চ পাবনা পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে বড় একটা যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মোকাররম অংশ নেয়। যুদ্ধের পর পরিবারের সবাইকে নিয়ে আমরা সুজানগরের উলাট গ্রামে চলে যাই। সেখানে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মোকাররম, মনসুর, মোস্তাক আর মোশাররফ আমাকে কিছু না বলেই একদিন বাড়ি থেকে কোথায় যেন চলে যায়। পরে জানতে পারি, যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে তারা ইন্ডিয়া চলে গেছে। জুন কি জুলাই মাসে ট্রেনিং শেষ করে হঠাৎ একদিন মোকাররম, মোস্তাক আর মোশাররফ উলাট গ্রামে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে। তাদের কাছ থেকে জানতে পারি, মনসুর আগরতলায় গেরিলা ট্রেনিং শেষে ঢাকায় চলে গেছে। দুই-তিন দিন গ্রামে থেকে ছেলেরা সবাই আবার যুদ্ধে চলে যায়। আর আমরা ঢাকায় গিয়ে উঠি মোজাম্মেলের মগবাজারের বাড়িতে। যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত আমরা সেখানেই ছিলাম। এ সময়ে যুদ্ধে যাওয়া ছেলেদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। সরাসরি তাদের কোনো খবর না পেলেও অন্য যোদ্ধাদের কাছ থেকে জানতে পারি, যুদ্ধের পুরো সময়ে আমার ছেলেরা ২ নম্বর সেক্টরের রূপগঞ্জে খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধে অংশ নেয়।
ডিসেম্বর মাসের ১১ তারিখে মোকাকরম, মনসুর আর ইউসুফ আলী হঠাৎ একদিন দুপুরে চুপি চুপি বাসায় এসে জানাল, ডিসেম্বর মাসের ৮ তারিখে ঢাকা দখলের সময় সম্মুুখযুদ্ধে আমার দুই ছেলে মোশাররফ ও মোস্তাক শহীদ হয়েছে। ছেলেদের শোক সামলে উঠে তাদের রাতটা বাসায় থেকে যেতে বলি। কিন্তু এ খবর পেয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মি। পরদিন ১২ ডিসেম্বর বিকেল ৩টার দিকে কয়েক ট্রাক পাকিস্তানি আর্মি আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। আর্মির অফিসাররা সোজা আমাদের দোতলায় উঠে আসে। তাদের হাতে ছিল একটি কাগজ। কাগজে লেখা নাম ধরে ধরে আমার ছেলেদের ডাকতে থাকে তারা। পুরো বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে দোতলার একটা ঘর থেকে মোকাররম, মনসুর, ইউসুফ আলী এবং ষষ্ঠ ছেলে মোকাব্বর হোসেন বিজুকে জিপে তুলে নিয়ে যায়। বয়স অল্প হওয়ায় বিজুকে তারা মগবাজার ওয়্যারলেস গেটের কাছে জিপ থেকে নামিয়ে দেয়। সেই যে ছেলেরা গেল আর ফিরে আসেনি। আমি আমার শহীদ চার ছেলে আর জামাইয়ের লাশও দেখতে পারিনি। একসময় যুদ্ধ শেষ হলো। অনেক যোদ্ধা ঘরে ফিরল। কিন্তু আমার ছেলেরা আর মেয়ের জামাই ফিরে এল না।
আমার স্বামী মারা যান ১৯৯২ সালে। ২০০২ সালের ২৯ নভেম্বর বড় ছেলে মারা যায়। এরপর থেকে আমি দুই ছেলে, এক মেয়ে, এক পুত্রবধূ আর চার নাতি-নাতনি নিয়ে পাবনার সাধুপাড়ার বাসায় বাস করছি।
আমার চার ছেলে আর এক জামাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে। মুক্তিবার্তায় তাদের নামও আছে। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে ৪০ বছরে কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। সরকারিভাবে আজ অবধি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বা অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা পাইনি আমরা। আমার একটাই গর্ব, আমার ছেলেরা দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। মানুষ আমাকে সম্মান করে। যে কয়েক দিন বেঁচে আছি, এই পাওয়া নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।
রোকেয়া খাতুন : পাবনার সাধুপাড়ার শহীদ চার মুক্তিযোদ্ধা মোকাররম হোসেন, মনসুর হোসেন, মোস্তাক হোসেন ও মোশাররফ হোসেনের মা। বয়স প্রায় ৯০ বছর। শহরের সবাই তাঁকে চেনেন শহীদ মাতা হিসেবে।
অনুলিখন : আহমেদ উল হক রানা (পাবনা প্রতিনিধি)
২৬ মার্চ পাবনা পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে বড় একটা যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মোকাররম অংশ নেয়। যুদ্ধের পর পরিবারের সবাইকে নিয়ে আমরা সুজানগরের উলাট গ্রামে চলে যাই। সেখানে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মোকাররম, মনসুর, মোস্তাক আর মোশাররফ আমাকে কিছু না বলেই একদিন বাড়ি থেকে কোথায় যেন চলে যায়। পরে জানতে পারি, যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে তারা ইন্ডিয়া চলে গেছে। জুন কি জুলাই মাসে ট্রেনিং শেষ করে হঠাৎ একদিন মোকাররম, মোস্তাক আর মোশাররফ উলাট গ্রামে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে। তাদের কাছ থেকে জানতে পারি, মনসুর আগরতলায় গেরিলা ট্রেনিং শেষে ঢাকায় চলে গেছে। দুই-তিন দিন গ্রামে থেকে ছেলেরা সবাই আবার যুদ্ধে চলে যায়। আর আমরা ঢাকায় গিয়ে উঠি মোজাম্মেলের মগবাজারের বাড়িতে। যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত আমরা সেখানেই ছিলাম। এ সময়ে যুদ্ধে যাওয়া ছেলেদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। সরাসরি তাদের কোনো খবর না পেলেও অন্য যোদ্ধাদের কাছ থেকে জানতে পারি, যুদ্ধের পুরো সময়ে আমার ছেলেরা ২ নম্বর সেক্টরের রূপগঞ্জে খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধে অংশ নেয়।
ডিসেম্বর মাসের ১১ তারিখে মোকাকরম, মনসুর আর ইউসুফ আলী হঠাৎ একদিন দুপুরে চুপি চুপি বাসায় এসে জানাল, ডিসেম্বর মাসের ৮ তারিখে ঢাকা দখলের সময় সম্মুুখযুদ্ধে আমার দুই ছেলে মোশাররফ ও মোস্তাক শহীদ হয়েছে। ছেলেদের শোক সামলে উঠে তাদের রাতটা বাসায় থেকে যেতে বলি। কিন্তু এ খবর পেয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মি। পরদিন ১২ ডিসেম্বর বিকেল ৩টার দিকে কয়েক ট্রাক পাকিস্তানি আর্মি আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। আর্মির অফিসাররা সোজা আমাদের দোতলায় উঠে আসে। তাদের হাতে ছিল একটি কাগজ। কাগজে লেখা নাম ধরে ধরে আমার ছেলেদের ডাকতে থাকে তারা। পুরো বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে দোতলার একটা ঘর থেকে মোকাররম, মনসুর, ইউসুফ আলী এবং ষষ্ঠ ছেলে মোকাব্বর হোসেন বিজুকে জিপে তুলে নিয়ে যায়। বয়স অল্প হওয়ায় বিজুকে তারা মগবাজার ওয়্যারলেস গেটের কাছে জিপ থেকে নামিয়ে দেয়। সেই যে ছেলেরা গেল আর ফিরে আসেনি। আমি আমার শহীদ চার ছেলে আর জামাইয়ের লাশও দেখতে পারিনি। একসময় যুদ্ধ শেষ হলো। অনেক যোদ্ধা ঘরে ফিরল। কিন্তু আমার ছেলেরা আর মেয়ের জামাই ফিরে এল না।
আমার স্বামী মারা যান ১৯৯২ সালে। ২০০২ সালের ২৯ নভেম্বর বড় ছেলে মারা যায়। এরপর থেকে আমি দুই ছেলে, এক মেয়ে, এক পুত্রবধূ আর চার নাতি-নাতনি নিয়ে পাবনার সাধুপাড়ার বাসায় বাস করছি।
আমার চার ছেলে আর এক জামাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে। মুক্তিবার্তায় তাদের নামও আছে। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে ৪০ বছরে কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। সরকারিভাবে আজ অবধি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বা অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা পাইনি আমরা। আমার একটাই গর্ব, আমার ছেলেরা দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। মানুষ আমাকে সম্মান করে। যে কয়েক দিন বেঁচে আছি, এই পাওয়া নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।
রোকেয়া খাতুন : পাবনার সাধুপাড়ার শহীদ চার মুক্তিযোদ্ধা মোকাররম হোসেন, মনসুর হোসেন, মোস্তাক হোসেন ও মোশাররফ হোসেনের মা। বয়স প্রায় ৯০ বছর। শহরের সবাই তাঁকে চেনেন শহীদ মাতা হিসেবে।
অনুলিখন : আহমেদ উল হক রানা (পাবনা প্রতিনিধি)
No comments