বিশেষ রচনা : রশীদ করীম-মধ্যবিত্তের গোপন কুঠরির পর্যবেক্ষক by মিল্টন বিশ্বাস
গত ২৬ নভেম্বর ৮৬ বছর বয়সে মারা গেলেন আমাদের মনোজগতের গহিনে ডুব দিয়ে অজানা খনি আবিষ্কারের অন্যতম লেখক রশীদ করীম। বাংলাদেশের একজন প্রকৃত লেখক প্রয়াত হলেন। কারণ তিনি যা বিশ্বাস করতেন, উপলব্ধি করতেন, তা-ই শব্দবন্দি করে গেছেন। অন্তর্মুখী এই লেখক বাংলাদেশের উপন্যাসের উপস্থাপনায় ভিন্নতা এনেছেন। সামাজিক দিক থেকে তাঁর রচনাসমগ্র যেমন মূল্যবান, তেমনি তিনি কিছু রচনার কারণে স্মরণীয় হয়ে
থাকবেন। গল্প দিয়ে শুরু হলেও প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর আর গল্প লিখতে উৎসাহী ছিলেন না তিনি। চার দশক ধরে রশীদ করীম বাংলাদেশের অন্যতম ঔপন্যাসিক হিসেবে নন্দিত। ১৯৩৯ সালে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র রশীদ করীম প্রথম গল্প লেখেন। ১৯৪২ সালে সাহিত্য পত্রিকা সওগাতে 'আয়েশা' নামে গল্প প্রকাশিত হয়। 'একটি মেয়ের আত্মকাহিনী', 'অভিভাবক', 'মোতাহার চাচা', 'মুহূর্ত', 'চিঠি', 'কাহিনী নয়' তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্প। এরপর তিনি লেখা ছেড়ে দেন। ১৯৬১ সালে তাঁর সাহিত্যচর্চার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় 'উত্তম পুরুষ' প্রকাশের মধ্য দিয়ে। উপন্যাসটি আদমজী পুরস্কার পেলে তিনি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে 'প্রসন্ন পাষাণ'(১৯৬৩) প্রকাশিত হলে তিনি পরিণত হন বাংলাদেশের অন্যতম কথাকারে। এরপর স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত তাঁর নীরবতা লক্ষণীয়। মুক্তিযুদ্ধোত্তর 'আমার যত গ্লানি'র (১৯৭৩) পর একে একে প্রকাশিত হয় 'প্রেম একটি লাল গোলাপ' (১৯৭৮), 'একালের রূপকথা' (১৯৮০), 'সাধারণ লোকের কাহিনী' (১৯৮২), 'সোনার পাথরবাটি' (১৯৮৪), 'বড়ই নিঃসঙ্গ' (১৯৮৫), 'মায়ের কাছে যাচ্ছি' (১৯৮৯), 'পদতলে রক্ত' (১৯৯০), 'চিনি না' (১৯৯০) প্রভৃতি উপন্যাস। একমাত্র গল্পগ্র্রন্থ 'প্রথম প্রেম' (১৯৮৪) এবং 'আর এক দৃষ্টিকোণ', 'অতীত হয় নতুন পুনরায়' ও 'মনের গহনে তোমার মুরতিখানি' নামে তিনটি প্রবন্ধের বই রচনা করেন তিনি। তিনি যে একজন পণ্ডিত ও জ্ঞানপিপাসু লেখক ছিলেন, তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর প্রবন্ধ রচনার কলাকৌশলে। মনন ও মেধায় অভিজাত; স্বল্পসংখ্যক গ্রন্থের রচয়িতা, কিন্তু প্রচারবিমুখ তিনি ছিলেন লেখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক। সস্তা জনপ্রিয়তার মোহে কখনো লেখেননি তিনি। 'জীবনমরণ' নামে তাঁর একটি আত্মজৈবনিক গ্রন্থও রয়েছে। ১৯৯৩ সালে শেষ উপন্যাস 'লাঞ্চ বঙ্' প্রকাশিত হয়। সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন আদমজী পুরস্কার (১৯৬৯), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭২), একুশে পদক (১৯৮৪), লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৯১)। উল্লেখ্য, কথাসাহিত্যিক আবু রুশদ তাঁর অগ্রজ।
রশীদ করীম ১৯২৫ সালের ১৪ আগস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করে দেশভাগের পর বাংলাদেশে চলে আসেন। চাকরি নেন মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডে। সেখান থেকেই তিনি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। রশীদ করীমের সাহিত্যে বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘুরেফিরে এসেছে। ১৯৯২ সালে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত মানুষ। তিনি খ্যাতি কুড়িয়েছেন সমালোচনা-সাহিত্যেও। ভালোকে ভালো এবং মন্দকে মন্দ বলতে দ্বিধাহীন ছিলেন তিনি। তাঁর সম্পর্কে কবি শামসুর রাহমান বলেছিলেন, "রশীদ করীম আমাদের দেশের অন্যতম সেরা গদ্যকার। তাঁর 'উত্তম পুরুষ' উপন্যাসের ভাষা আশ্চর্য সহজ-সরল ও আধুনিক।" কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধে তিনি নিজস্ব গদ্যভাষার শৈলী তৈরি করেছেন। তাঁর ছিল বিশ্বসাহিত্যের নিবিড় জ্ঞান। কিন্তু জ্ঞানের তথ্য উপন্যস্তে ব্যস্ত ছিলেন না তিনি; তিনি নির্মাণ করেছেন সহজ-সরল অভিব্যক্তি। পাঠকের হৃদয়ে প্রবেশের জন্য এক মাধুর্যমণ্ডিত কারুকার্যময় ভাষার অধিকারী ছিলেন তিনি। তিনি শব্দ ব্যবহারে উদার এবং নতুন শব্দ ও বাক্য তৈরিতে অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন। গদ্যের নিরীক্ষা তাঁর সৃজনশীলতার অনন্য স্বাক্ষর। তাঁর বর্ণনা ও সংলাপ ব্যতিক্রমী। তাঁর গ্রন্থ একটানা পড়ে শেষ করা যায়। প্রথম উপন্যাস 'উত্তম পুরুষ' থেকেই গদ্যভাষায় তিনি সঞ্চার করেছিলেন ক্ষিপ্র ও অনিবার্য গতিবেগ।
রশীদ করীম নাগরিক মধ্যবিত্ত ও ক্রমবিকাশমান উচ্চবিত্তের জীবনের কণ্ঠস্বর। তিনি কলকাতার নাগরিক রুচি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে জীবনকে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর কথাসাহিত্যে নর-নারী সম্পর্কের যে জটিল তন্তুজাল উন্মোচিত হয়েছে তা বিস্ময়কর। সমকালীন সমাজ এবং রাজনীতির পরিবর্তন ও বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় তিনি আশ্চর্য রকমের আধুনিক ও মানবিক। জীবনদৃষ্টির গভীরতায় ও সংস্কারমুক্ত মানসিকতায় তাঁর প্রগতিশীল ভূমিকা অনন্য।
'উত্তম পুরুষ'-এর আখ্যানে রয়েছে চলি্লশের দশকের ব্রিটিশ ভারত। এ বছর এটি প্রকাশের অর্ধশত বছর পূর্ণ হলো। সমরেশ বসু উপন্যাসটির প্রশংসা করেছিলেন। কাহিনীর অন্তর্বয়নে প্রথম থেকে রশীদ করীম নাগরিক সমাজের ছবি এঁকেছেন। কোনো চরিত্রের কলকাতার বাইরে গ্রামে ভ্রমণের সূত্রে গ্রামীণ জীবনের পরিচয় বর্ণিত হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লেখক তাঁর ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতার কথাই উপন্যাসে ব্যক্ত করেছেন। এমনকি এক উপন্যাসের চরিত্রকে অন্য উপন্যাসে স্থাপন করলেও সমস্যার সৃষ্টি হয় না। 'উত্তম পুরুষ'-এর শাকের সহজেই মানিয়ে যায় 'প্রসন্ন পাষাণ'-এর চরিত্রের সঙ্গে; 'প্রসন্ন পাষাণ'-এর তিশনাকে 'উত্তম পুরুষ'-এ প্রতিস্থাপন করলে এমন কিছু যায়-আসে না। কলকাতাকেন্দ্রিক মুসলমানদের মানসিকতা উন্মোচিত হয়েছে শাকের চরিত্রের মাধ্যমে। পাকিস্তান আন্দোলনের আবেগের সঙ্গে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমাজ-রাজনীতির ঢেউ স্পষ্ট হয়েছে এখানে। মুসলিম সমাজের অনিবার্য প্রতিনিধি শাকের মুসলিম লীগকে সমর্থন করে; জিন্নাহর ভক্ত সে। এমনকি গান্ধীজি ও হিন্দু নেতারা তার চক্ষুশূল; যদিও সে বিশ্বাস করে, পাকিস্তান হবে হিন্দু-মুসলমান উভয়ের মাতৃভূমি। উপন্যাসটিতে 'আমি' শব্দটির কথন ভাষ্যের মধ্য দিয়ে চরিত্রের মানসিক জগৎ উন্মোচিত; আখ্যানের সমাপ্তি ঘটেছে শাকেরের কলকাতা থেকে ঢাকায় আগমনের মধ্য দিয়ে। গল্পকথন ও সমাজচিত্রের চেয়ে রশীদ করীম মনোযোগী চরিত্রের অবচেতনের গোপন কুঠরিতে_এর প্রমাণ পাওয়া যায় প্রথম উপন্যাস থেকেই।
দ্বিতীয় উপন্যাস 'প্রসন্ন পাষাণ'-এ একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। আখ্যানের সূচনা কলকাতা নগরে। প্রধান চরিত্র তিশনা উপন্যাসটির কথক। উত্তম পুরুষের বর্ণনা ভাষ্যে উপন্যাসটির পুরো ঘটনা রূপায়িত। এখানে কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত মুসলিম সমাজের বস্তুনিষ্ঠ চিত্রের চেয়ে তিশনার জীবনের ঘটনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ঔপন্যাসিক তিশনার স্কেচে তার ছোট ফুফু ও ছোট চাচার ঘটনা সংযুক্ত করেছেন। আলিম ও কামিল চরিত্র দুটি কাহিনীতে তাৎপর্যবহ হয়ে উঠেছে। উপন্যাস শেষে তিশনা কামিলের প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করেছে; ভালোবেসেছে তাকে; কামিল তার দিকে মুখ ফিরেও তাকায়নি। সমাজ সংস্কারের জন্য সে তার কাছে পেঁৗছাতে পারেনি। আলিমের একতরফা প্রেম নিবেদনের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং পরে কামিলের প্রতি অনুরক্ত হলেও অর্থবিত্তের কথা ভেবে আলিমকে বিয়ে করা তিশনার মনোজগতের বিশেষ প্রান্ত। উপন্যাসে তিশনা মূল চরিত্র হলেও তার সক্রিয়তা লক্ষণীয় নয়, বরং তার অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে বর্ণনায়; সে নির্বাক দর্শকও বটে। পাঠকের হৃদয়ে তিশনা নয়, তার দূরসম্পর্কের ফুফু ময়না বেশি গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। বিধবা ময়নার সন্তান কামিল। ময়না তিশনার ছোট চাচার প্রতি গোপন প্রেম লালনকারী। এদিক থেকে পরাশ্রিত এই চরিত্রটি মনোবাস্তবতায় জটিল। তবে কামিল চরিত্রটিও যথার্থ সৃজনী সক্ষমতার পরিচয় বহন করে না। অনেক দিনের বিরতির পর 'আমার যত গ্লানি' প্রকাশিত হলে আমরা দেখতে পাই, রশীদ করীম উপন্যাসের কাহিনী বুননে পরিবর্তন এনেছেন। নগরজীবনভিত্তিক এই উপন্যাসের কাহিনী প্রসারিত ১৯৪৭ থেকে ২৬ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত। এখানে লেখকের বর্ণনা ও এরফান চৌধুরীর কথনে কাহিনী বিবৃত হয়েছে। তবে আয়েশা আর তার স্বামী সামাদ এবং আহসান, নবী, আক্কাস, আবেদ, কোহিনূর_চরিত্রগুলো তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। এরফানের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মিশে গেছে উপন্যাসের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত স্মরণে রেখে লেখক চরিত্রের যুগপৎ মনোবাস্তবতা ও বহির্বাস্তবতাকে প্রকাশ করেছেন। চেতনাপ্রবাহরীতির সঙ্গে আর্থবাস্তবতা উন্মোচনে উপন্যাসটি বিশিষ্ট। তবে লেখক মুক্তিযুদ্ধের শাণিত চেতনা ও অভিঘাতের মূল্যায়নের পরিবর্তে মধ্যবিত্তের যৌন চেতনা ও স্বার্থপরতা এবং জনবিচ্ছিন্নতার ঘটনা উন্মোচনে বেশি মনোযোগী। এরফানকে জমিন যখন জিজ্ঞাসা করে, 'কোথায় যাচ্ছেন', তখন সে বলে, 'শেখ সাহেবের কাছে। স্বাধীনতার কাছে।' কিন্তু আয়েশার শারীরিক প্রেমের আকর্ষণ তার কাছে মুখ্য। পঁচিশে মার্চের ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেও সে মুক্তিযুদ্ধের গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। ক্ষুদ্র বৃত্তে চলমান জীবনে যুদ্ধজীবনের অভিঘাত সত্য হয়ে ধরা দেয়নি; বরং জনবিচ্ছিন্নতার জন্য গ্লানি জেগেছে, আত্মধিক্কারও। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র এরফান চৌধুরীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উচ্চ-মধ্যবিত্ত নাগরিক শ্রেণীর চেতনাকে আবিষ্কার করেছেন লেখক। যৌন তাড়নায় উজ্জীবিত এরফান চৌধুরীর আত্মসুখসন্ধানী মনোবিশ্লেষণ এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
ঢাকার একটি বহুজাতিক ফার্মের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এরফান। অফিসের পর ক্লাবে বসে মদ্যপান ও নারীসঙ্গ, বিশেষত মধ্যবয়সী সুন্দরী আয়েশার সঙ্গে সময় কাটানো তার কাজ। তার আত্মকথন লক্ষণীয়_'আমি লোকটি আসলে একটা খচ্চর, যদিও আমার বাপ লোকটা মোটের উপর ভালই ছিলেন...বেসিনের উপরে বেলজিয়ান কাচের আয়নায় যে মুখটি ফুটে উঠেছিল, তা সাগরপারের ঐ মহার্ঘ্য বস্তুটির মান বজায় রেখেছে ঠিকই। খাসা লাগল চেহারাটি; সামান্য একটু 'নড' করে আমি আমার অনুমোদন জানালাম চেহারাটা ভালো ঠেকলে, চালচলনে, দিবি্ব একটা কনফিডেন্স আসে। অথচ, এই একই আমি, সারারাত বেলেল্লাপনা করে, সকালবেলা খরখরে চোখ নিয়ে যখন উঠি, তখন নিজেকেই অন্য মানুষ মনে হয়।'
তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় আত্মকেন্দ্রিক এরফান চৌধুরীও বাইরের রাজনৈতিক উত্তাপ ও ঘটনাপ্রবাহকে অস্বীকার করতে পারেনি। উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধপূর্ব রাজনৈতিক ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা আখ্যানে বিন্যস্ত হয়েছে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের স্বপ্ন অলক্ষ্যে থাকেনি।
পরবর্তী উপন্যাস 'প্রেম একটি লাল গোলাপ' রশীদ করীমের খ্যাতিকে উচ্চ শিখরে পেঁৗছে দিয়েছে। প্রকৃত সফল উপন্যাস এটি। উপন্যাসটিতে মনোবাস্তবতার বিভিন্ন প্রান্ত অভিব্যক্ত হয়েছে। বহির্জীবনের বাস্তবতাকে অবচেতন মনের ভাবনার সঙ্গে তুলে ধরেছেন তিনি। এখানে তিনি স্বতঃস্ফূর্ত। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রের মধ্যে তিনি যে অসামান্য নির্মাণশৈলী প্রকাশ করতে পারেন, এখানে তারই প্রতিষ্ঠা। উপন্যাসটির সূচনা ১৯৭৩ সালের এক সকালবেলা। উপন্যাসের কথক এক অধ্যাপক। তিনি রানুর কাহিনী বলেছেন। রানু ও তার স্বামী উমর এবং উমরের বস সুফি সাহেবের পারস্পরিক সম্পর্ক, সম্পর্কের দ্বন্দ্ব ও মনোজগতের সংকটের ওপর কাহিনী দাঁড়িয়ে আছে। তবে উপন্যাসের সমাপ্তিতে রানুর দাম্পত্য জীবনে সংকট মোচনের পর স্বাভাবিক চিত্রে সুফি সাহেবের উপস্থিতি বা তার রুমালের প্রসঙ্গ বিচ্ছিন্নতার অনিবার্য সূত্র। 'উমর রানু এখন ভালই আছে। কিন্তু তাদের জীবনে সেই রুমালটির আড়াল বোধ হয় থেকেই গেছে।' এ উপন্যাসে মানবিক ও সামাজিক সম্পর্ক বাণিজ্যিক স্বার্থের টানে বিনষ্ট হয়েছে।
এই একই ধারার উপন্যাস হলো 'একালের রূপকথা' এবং 'সাধারণ লোকের কাহিনী'। শেষের উপন্যাসটি স্বতন্ত্র। কারণ এর প্রকরণ ও উপস্থাপনভঙ্গি ভিন্ন। দুটি অংশ এর: প্রথমে উত্তম পুরুষের বর্ণনা, দ্বিতীয় অংশে আছে সর্বজ্ঞ লেখকের জবানি। দ্বিতীয়টি কখনো কখনো প্রথমে ব্যবহৃত হয়েছে। আর্থিক সচ্ছলতার জীবনপ্রবাহে প্রেম ও দাম্পত্য সম্পর্ক সংকটের মুখে পতিত হয়েছে; অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে 'প্রেম একটি লাল গোলাপে'র মতোই। মধ্যবিত্ত স্বামী মনসুর ও স্ত্রী ফাতেমার দাম্পত্য সুখের চিত্র বিভিন্ন অন্তর্জটিলতার পথ বেয়ে ক্রমপরিণতিতে উপস্থিত হয়েছে। 'সোনার পাথরবাটি' সপ্তম উপন্যাস। এখানে মানুষের জীবনের অন্তর্লীন দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিবৃত। মধ্যবিত্ত সমাজের সংকটগুলো তুলে ধরেছেন লেখক। প্রথম দিকের মতো এ উপন্যাসে নর-নারী সম্পর্কের রহস্য ও মাধুর্য_উভয়ই বর্ণিত। এখানে ৪০ বছর বয়সের অবিবাহিত ও স্বল্প বেতনভুক মিন্টু এবং তার সুন্দরী সহপাঠী শ্যামাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কাহিনী। বেশির ভাগ উপন্যাসের মতো এটির আখ্যান কলকাতায় শুরু হয়ে দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলনের জন্য ছয় দফা আন্দোলন ও অন্যান্য জাতীয় আন্দোলনে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনোভাব বর্ণিত হয়েছে। নানা কারণে পরবর্তী উপন্যাস 'বড়ই নিঃসঙ্গ' স্বতন্ত্র রচনা। অনেক চরিত্রের উপন্যাস এটি নয়। এটি শরীফের কাহিনী, যার বন্ধু-বান্ধবী কেউ নেই; অর্থবিত্ত, লোভ-অহংকারও নেই। অথচ তার অমূল্য ইন্দ্রিয় সংবেদনা রয়েছে। লেখক সেগুলোকে যত্নে এঁকেছেন। সমাজের মধ্যে আগন্তুক এই চরিত্রটি সমাজবহির্ভূত জুঁইয়ের সঙ্গে মিলতে পারে। কারণ তারা দুজনে একই রকম। সমাজের মধ্যে অসমঞ্জস এই সব চরিত্রের প্রতি লেখকের মমত্ব অসীম। 'বড়ই নিঃসঙ্গ' ক্ষুদ্র পরিসরের উপন্যাস। সে তুলনায় দীর্ঘ কলেবরের রচনা 'মায়ের কাছে যাচ্ছি'। দীর্ঘ উপন্যাসটির মধ্যে কলকাতা ও ঢাকা শহরকেন্দ্রিক অভিদ্যোতনা এখানেও লক্ষণীয়। ঔপন্যাসিক মুসলিম মধ্যবিত্তের নাগরিক জীবনকে তুলে ধরেছেন, যা অন্যান্য উপন্যাসেও চিত্রিত হয়েছে। ৫০ বছর বয়সী কমর যে তার বাল্যস্মৃতিতে ফিরে গেছে, তার মধ্যে এরফানকে আবিষ্কার করা শক্ত কিছু নয়; যদিও তারা আচার-আচরণ ও চিন্তায় ভিন্ন। 'মায়ের কাছে যাচ্ছি' রশীদ করীমের পুনরাবৃত্তিময় আখ্যানের উপন্যাস। বিষয়বস্তু ও বর্ণনাধর্ম পৃথক হলেও 'চিনি না' এবং 'নর্তকী'ও একই বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।
বাস্তবিক রশীদ করীমের উপন্যাসে আত্মজৈবনিক উপকরণ বেশি। মধ্যবিত্ত শ্রেণী, তাদের আর্থসামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতি কাহিনীতে ব্যক্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বয়ং লেখকের উপস্থিতি স্পষ্ট নানা জায়গায়। তাঁর 'জীবন মরণে' (সোয়ান সঙ) বর্ণিত প্রকৃত ঘটনার অনেকগুলোই উপন্যাসে ব্যক্ত হয়েছে। তিনি বয়ঃসন্ধিতে জনৈক নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িত ছিলেন, সোয়ান সঙে যা উলি্লখিত। সেই নারীর বিয়ে হয়ে গেলে তার জীবন শোকে প্লাবিত হয় এবং লেখা বন্ধ করে দেন; যদিও লেখক বলতে চেয়েছেন, এই নারী তার জীবনে আবির্ভূত না হলে তিনি কখনোই লেখক হতেন না। একসময় তিনি দুই নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িত ছিলেন, যা তাঁর উপন্যাসের একটি সাধারণ ঘটনা। তবে সেই নারী ও তার বিয়ে রশীদ করীমের উপন্যাসকে ফিকে করে দেয়নি; বরং বিভাগোত্তর সময়ে কলকাতা থেকে ঢাকায় আগমন তাঁর স্মৃতিকথায় এবং উপন্যাসে বেশি জায়গা নিয়ে বসেছে।
রশীদ করীমের উপন্যাস পাঠককে ধরে রাখতে সক্ষম। কারণ মানুষকে কেবল ভালো কিংবা মন্দরূপে চিত্রিত করেননি তিনি। তিনি দেখেছেন সময়, সমাজ ও চেতনাধারায় মানুষের বিচিত্র বাস্তবতা। আধুনিক মানুষের অন্তঃসার উন্মোচনে তিনি বাংলাদেশের উপন্যাসে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। প্রেম, যৌনতা_সব কিছু মিলে যে আধুনিক মানুষ, সেই মানুষকে ভেতর থেকে দেখার সক্ষমতা ছিল রশীদ করীমের; তাঁর সমকালে যা অন্য কারো মধ্যে দেখা যায়নি। মানব মনের গহিনে প্রবেশ করেছিলেন তিনি; নাগরিক মধ্যবিত্ত চরিত্রের অন্তস্তল দ্যোতিত করার কৃতিত্ব একমাত্র তাঁরই।
রশীদ করীম ১৯২৫ সালের ১৪ আগস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করে দেশভাগের পর বাংলাদেশে চলে আসেন। চাকরি নেন মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডে। সেখান থেকেই তিনি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। রশীদ করীমের সাহিত্যে বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘুরেফিরে এসেছে। ১৯৯২ সালে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত মানুষ। তিনি খ্যাতি কুড়িয়েছেন সমালোচনা-সাহিত্যেও। ভালোকে ভালো এবং মন্দকে মন্দ বলতে দ্বিধাহীন ছিলেন তিনি। তাঁর সম্পর্কে কবি শামসুর রাহমান বলেছিলেন, "রশীদ করীম আমাদের দেশের অন্যতম সেরা গদ্যকার। তাঁর 'উত্তম পুরুষ' উপন্যাসের ভাষা আশ্চর্য সহজ-সরল ও আধুনিক।" কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধে তিনি নিজস্ব গদ্যভাষার শৈলী তৈরি করেছেন। তাঁর ছিল বিশ্বসাহিত্যের নিবিড় জ্ঞান। কিন্তু জ্ঞানের তথ্য উপন্যস্তে ব্যস্ত ছিলেন না তিনি; তিনি নির্মাণ করেছেন সহজ-সরল অভিব্যক্তি। পাঠকের হৃদয়ে প্রবেশের জন্য এক মাধুর্যমণ্ডিত কারুকার্যময় ভাষার অধিকারী ছিলেন তিনি। তিনি শব্দ ব্যবহারে উদার এবং নতুন শব্দ ও বাক্য তৈরিতে অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন। গদ্যের নিরীক্ষা তাঁর সৃজনশীলতার অনন্য স্বাক্ষর। তাঁর বর্ণনা ও সংলাপ ব্যতিক্রমী। তাঁর গ্রন্থ একটানা পড়ে শেষ করা যায়। প্রথম উপন্যাস 'উত্তম পুরুষ' থেকেই গদ্যভাষায় তিনি সঞ্চার করেছিলেন ক্ষিপ্র ও অনিবার্য গতিবেগ।
রশীদ করীম নাগরিক মধ্যবিত্ত ও ক্রমবিকাশমান উচ্চবিত্তের জীবনের কণ্ঠস্বর। তিনি কলকাতার নাগরিক রুচি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে জীবনকে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর কথাসাহিত্যে নর-নারী সম্পর্কের যে জটিল তন্তুজাল উন্মোচিত হয়েছে তা বিস্ময়কর। সমকালীন সমাজ এবং রাজনীতির পরিবর্তন ও বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় তিনি আশ্চর্য রকমের আধুনিক ও মানবিক। জীবনদৃষ্টির গভীরতায় ও সংস্কারমুক্ত মানসিকতায় তাঁর প্রগতিশীল ভূমিকা অনন্য।
'উত্তম পুরুষ'-এর আখ্যানে রয়েছে চলি্লশের দশকের ব্রিটিশ ভারত। এ বছর এটি প্রকাশের অর্ধশত বছর পূর্ণ হলো। সমরেশ বসু উপন্যাসটির প্রশংসা করেছিলেন। কাহিনীর অন্তর্বয়নে প্রথম থেকে রশীদ করীম নাগরিক সমাজের ছবি এঁকেছেন। কোনো চরিত্রের কলকাতার বাইরে গ্রামে ভ্রমণের সূত্রে গ্রামীণ জীবনের পরিচয় বর্ণিত হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লেখক তাঁর ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতার কথাই উপন্যাসে ব্যক্ত করেছেন। এমনকি এক উপন্যাসের চরিত্রকে অন্য উপন্যাসে স্থাপন করলেও সমস্যার সৃষ্টি হয় না। 'উত্তম পুরুষ'-এর শাকের সহজেই মানিয়ে যায় 'প্রসন্ন পাষাণ'-এর চরিত্রের সঙ্গে; 'প্রসন্ন পাষাণ'-এর তিশনাকে 'উত্তম পুরুষ'-এ প্রতিস্থাপন করলে এমন কিছু যায়-আসে না। কলকাতাকেন্দ্রিক মুসলমানদের মানসিকতা উন্মোচিত হয়েছে শাকের চরিত্রের মাধ্যমে। পাকিস্তান আন্দোলনের আবেগের সঙ্গে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমাজ-রাজনীতির ঢেউ স্পষ্ট হয়েছে এখানে। মুসলিম সমাজের অনিবার্য প্রতিনিধি শাকের মুসলিম লীগকে সমর্থন করে; জিন্নাহর ভক্ত সে। এমনকি গান্ধীজি ও হিন্দু নেতারা তার চক্ষুশূল; যদিও সে বিশ্বাস করে, পাকিস্তান হবে হিন্দু-মুসলমান উভয়ের মাতৃভূমি। উপন্যাসটিতে 'আমি' শব্দটির কথন ভাষ্যের মধ্য দিয়ে চরিত্রের মানসিক জগৎ উন্মোচিত; আখ্যানের সমাপ্তি ঘটেছে শাকেরের কলকাতা থেকে ঢাকায় আগমনের মধ্য দিয়ে। গল্পকথন ও সমাজচিত্রের চেয়ে রশীদ করীম মনোযোগী চরিত্রের অবচেতনের গোপন কুঠরিতে_এর প্রমাণ পাওয়া যায় প্রথম উপন্যাস থেকেই।
দ্বিতীয় উপন্যাস 'প্রসন্ন পাষাণ'-এ একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। আখ্যানের সূচনা কলকাতা নগরে। প্রধান চরিত্র তিশনা উপন্যাসটির কথক। উত্তম পুরুষের বর্ণনা ভাষ্যে উপন্যাসটির পুরো ঘটনা রূপায়িত। এখানে কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত মুসলিম সমাজের বস্তুনিষ্ঠ চিত্রের চেয়ে তিশনার জীবনের ঘটনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ঔপন্যাসিক তিশনার স্কেচে তার ছোট ফুফু ও ছোট চাচার ঘটনা সংযুক্ত করেছেন। আলিম ও কামিল চরিত্র দুটি কাহিনীতে তাৎপর্যবহ হয়ে উঠেছে। উপন্যাস শেষে তিশনা কামিলের প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করেছে; ভালোবেসেছে তাকে; কামিল তার দিকে মুখ ফিরেও তাকায়নি। সমাজ সংস্কারের জন্য সে তার কাছে পেঁৗছাতে পারেনি। আলিমের একতরফা প্রেম নিবেদনের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং পরে কামিলের প্রতি অনুরক্ত হলেও অর্থবিত্তের কথা ভেবে আলিমকে বিয়ে করা তিশনার মনোজগতের বিশেষ প্রান্ত। উপন্যাসে তিশনা মূল চরিত্র হলেও তার সক্রিয়তা লক্ষণীয় নয়, বরং তার অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে বর্ণনায়; সে নির্বাক দর্শকও বটে। পাঠকের হৃদয়ে তিশনা নয়, তার দূরসম্পর্কের ফুফু ময়না বেশি গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। বিধবা ময়নার সন্তান কামিল। ময়না তিশনার ছোট চাচার প্রতি গোপন প্রেম লালনকারী। এদিক থেকে পরাশ্রিত এই চরিত্রটি মনোবাস্তবতায় জটিল। তবে কামিল চরিত্রটিও যথার্থ সৃজনী সক্ষমতার পরিচয় বহন করে না। অনেক দিনের বিরতির পর 'আমার যত গ্লানি' প্রকাশিত হলে আমরা দেখতে পাই, রশীদ করীম উপন্যাসের কাহিনী বুননে পরিবর্তন এনেছেন। নগরজীবনভিত্তিক এই উপন্যাসের কাহিনী প্রসারিত ১৯৪৭ থেকে ২৬ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত। এখানে লেখকের বর্ণনা ও এরফান চৌধুরীর কথনে কাহিনী বিবৃত হয়েছে। তবে আয়েশা আর তার স্বামী সামাদ এবং আহসান, নবী, আক্কাস, আবেদ, কোহিনূর_চরিত্রগুলো তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। এরফানের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মিশে গেছে উপন্যাসের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত স্মরণে রেখে লেখক চরিত্রের যুগপৎ মনোবাস্তবতা ও বহির্বাস্তবতাকে প্রকাশ করেছেন। চেতনাপ্রবাহরীতির সঙ্গে আর্থবাস্তবতা উন্মোচনে উপন্যাসটি বিশিষ্ট। তবে লেখক মুক্তিযুদ্ধের শাণিত চেতনা ও অভিঘাতের মূল্যায়নের পরিবর্তে মধ্যবিত্তের যৌন চেতনা ও স্বার্থপরতা এবং জনবিচ্ছিন্নতার ঘটনা উন্মোচনে বেশি মনোযোগী। এরফানকে জমিন যখন জিজ্ঞাসা করে, 'কোথায় যাচ্ছেন', তখন সে বলে, 'শেখ সাহেবের কাছে। স্বাধীনতার কাছে।' কিন্তু আয়েশার শারীরিক প্রেমের আকর্ষণ তার কাছে মুখ্য। পঁচিশে মার্চের ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেও সে মুক্তিযুদ্ধের গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। ক্ষুদ্র বৃত্তে চলমান জীবনে যুদ্ধজীবনের অভিঘাত সত্য হয়ে ধরা দেয়নি; বরং জনবিচ্ছিন্নতার জন্য গ্লানি জেগেছে, আত্মধিক্কারও। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র এরফান চৌধুরীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উচ্চ-মধ্যবিত্ত নাগরিক শ্রেণীর চেতনাকে আবিষ্কার করেছেন লেখক। যৌন তাড়নায় উজ্জীবিত এরফান চৌধুরীর আত্মসুখসন্ধানী মনোবিশ্লেষণ এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
ঢাকার একটি বহুজাতিক ফার্মের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এরফান। অফিসের পর ক্লাবে বসে মদ্যপান ও নারীসঙ্গ, বিশেষত মধ্যবয়সী সুন্দরী আয়েশার সঙ্গে সময় কাটানো তার কাজ। তার আত্মকথন লক্ষণীয়_'আমি লোকটি আসলে একটা খচ্চর, যদিও আমার বাপ লোকটা মোটের উপর ভালই ছিলেন...বেসিনের উপরে বেলজিয়ান কাচের আয়নায় যে মুখটি ফুটে উঠেছিল, তা সাগরপারের ঐ মহার্ঘ্য বস্তুটির মান বজায় রেখেছে ঠিকই। খাসা লাগল চেহারাটি; সামান্য একটু 'নড' করে আমি আমার অনুমোদন জানালাম চেহারাটা ভালো ঠেকলে, চালচলনে, দিবি্ব একটা কনফিডেন্স আসে। অথচ, এই একই আমি, সারারাত বেলেল্লাপনা করে, সকালবেলা খরখরে চোখ নিয়ে যখন উঠি, তখন নিজেকেই অন্য মানুষ মনে হয়।'
তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় আত্মকেন্দ্রিক এরফান চৌধুরীও বাইরের রাজনৈতিক উত্তাপ ও ঘটনাপ্রবাহকে অস্বীকার করতে পারেনি। উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধপূর্ব রাজনৈতিক ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা আখ্যানে বিন্যস্ত হয়েছে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের স্বপ্ন অলক্ষ্যে থাকেনি।
পরবর্তী উপন্যাস 'প্রেম একটি লাল গোলাপ' রশীদ করীমের খ্যাতিকে উচ্চ শিখরে পেঁৗছে দিয়েছে। প্রকৃত সফল উপন্যাস এটি। উপন্যাসটিতে মনোবাস্তবতার বিভিন্ন প্রান্ত অভিব্যক্ত হয়েছে। বহির্জীবনের বাস্তবতাকে অবচেতন মনের ভাবনার সঙ্গে তুলে ধরেছেন তিনি। এখানে তিনি স্বতঃস্ফূর্ত। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রের মধ্যে তিনি যে অসামান্য নির্মাণশৈলী প্রকাশ করতে পারেন, এখানে তারই প্রতিষ্ঠা। উপন্যাসটির সূচনা ১৯৭৩ সালের এক সকালবেলা। উপন্যাসের কথক এক অধ্যাপক। তিনি রানুর কাহিনী বলেছেন। রানু ও তার স্বামী উমর এবং উমরের বস সুফি সাহেবের পারস্পরিক সম্পর্ক, সম্পর্কের দ্বন্দ্ব ও মনোজগতের সংকটের ওপর কাহিনী দাঁড়িয়ে আছে। তবে উপন্যাসের সমাপ্তিতে রানুর দাম্পত্য জীবনে সংকট মোচনের পর স্বাভাবিক চিত্রে সুফি সাহেবের উপস্থিতি বা তার রুমালের প্রসঙ্গ বিচ্ছিন্নতার অনিবার্য সূত্র। 'উমর রানু এখন ভালই আছে। কিন্তু তাদের জীবনে সেই রুমালটির আড়াল বোধ হয় থেকেই গেছে।' এ উপন্যাসে মানবিক ও সামাজিক সম্পর্ক বাণিজ্যিক স্বার্থের টানে বিনষ্ট হয়েছে।
এই একই ধারার উপন্যাস হলো 'একালের রূপকথা' এবং 'সাধারণ লোকের কাহিনী'। শেষের উপন্যাসটি স্বতন্ত্র। কারণ এর প্রকরণ ও উপস্থাপনভঙ্গি ভিন্ন। দুটি অংশ এর: প্রথমে উত্তম পুরুষের বর্ণনা, দ্বিতীয় অংশে আছে সর্বজ্ঞ লেখকের জবানি। দ্বিতীয়টি কখনো কখনো প্রথমে ব্যবহৃত হয়েছে। আর্থিক সচ্ছলতার জীবনপ্রবাহে প্রেম ও দাম্পত্য সম্পর্ক সংকটের মুখে পতিত হয়েছে; অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে 'প্রেম একটি লাল গোলাপে'র মতোই। মধ্যবিত্ত স্বামী মনসুর ও স্ত্রী ফাতেমার দাম্পত্য সুখের চিত্র বিভিন্ন অন্তর্জটিলতার পথ বেয়ে ক্রমপরিণতিতে উপস্থিত হয়েছে। 'সোনার পাথরবাটি' সপ্তম উপন্যাস। এখানে মানুষের জীবনের অন্তর্লীন দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিবৃত। মধ্যবিত্ত সমাজের সংকটগুলো তুলে ধরেছেন লেখক। প্রথম দিকের মতো এ উপন্যাসে নর-নারী সম্পর্কের রহস্য ও মাধুর্য_উভয়ই বর্ণিত। এখানে ৪০ বছর বয়সের অবিবাহিত ও স্বল্প বেতনভুক মিন্টু এবং তার সুন্দরী সহপাঠী শ্যামাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কাহিনী। বেশির ভাগ উপন্যাসের মতো এটির আখ্যান কলকাতায় শুরু হয়ে দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলনের জন্য ছয় দফা আন্দোলন ও অন্যান্য জাতীয় আন্দোলনে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনোভাব বর্ণিত হয়েছে। নানা কারণে পরবর্তী উপন্যাস 'বড়ই নিঃসঙ্গ' স্বতন্ত্র রচনা। অনেক চরিত্রের উপন্যাস এটি নয়। এটি শরীফের কাহিনী, যার বন্ধু-বান্ধবী কেউ নেই; অর্থবিত্ত, লোভ-অহংকারও নেই। অথচ তার অমূল্য ইন্দ্রিয় সংবেদনা রয়েছে। লেখক সেগুলোকে যত্নে এঁকেছেন। সমাজের মধ্যে আগন্তুক এই চরিত্রটি সমাজবহির্ভূত জুঁইয়ের সঙ্গে মিলতে পারে। কারণ তারা দুজনে একই রকম। সমাজের মধ্যে অসমঞ্জস এই সব চরিত্রের প্রতি লেখকের মমত্ব অসীম। 'বড়ই নিঃসঙ্গ' ক্ষুদ্র পরিসরের উপন্যাস। সে তুলনায় দীর্ঘ কলেবরের রচনা 'মায়ের কাছে যাচ্ছি'। দীর্ঘ উপন্যাসটির মধ্যে কলকাতা ও ঢাকা শহরকেন্দ্রিক অভিদ্যোতনা এখানেও লক্ষণীয়। ঔপন্যাসিক মুসলিম মধ্যবিত্তের নাগরিক জীবনকে তুলে ধরেছেন, যা অন্যান্য উপন্যাসেও চিত্রিত হয়েছে। ৫০ বছর বয়সী কমর যে তার বাল্যস্মৃতিতে ফিরে গেছে, তার মধ্যে এরফানকে আবিষ্কার করা শক্ত কিছু নয়; যদিও তারা আচার-আচরণ ও চিন্তায় ভিন্ন। 'মায়ের কাছে যাচ্ছি' রশীদ করীমের পুনরাবৃত্তিময় আখ্যানের উপন্যাস। বিষয়বস্তু ও বর্ণনাধর্ম পৃথক হলেও 'চিনি না' এবং 'নর্তকী'ও একই বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।
বাস্তবিক রশীদ করীমের উপন্যাসে আত্মজৈবনিক উপকরণ বেশি। মধ্যবিত্ত শ্রেণী, তাদের আর্থসামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতি কাহিনীতে ব্যক্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বয়ং লেখকের উপস্থিতি স্পষ্ট নানা জায়গায়। তাঁর 'জীবন মরণে' (সোয়ান সঙ) বর্ণিত প্রকৃত ঘটনার অনেকগুলোই উপন্যাসে ব্যক্ত হয়েছে। তিনি বয়ঃসন্ধিতে জনৈক নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িত ছিলেন, সোয়ান সঙে যা উলি্লখিত। সেই নারীর বিয়ে হয়ে গেলে তার জীবন শোকে প্লাবিত হয় এবং লেখা বন্ধ করে দেন; যদিও লেখক বলতে চেয়েছেন, এই নারী তার জীবনে আবির্ভূত না হলে তিনি কখনোই লেখক হতেন না। একসময় তিনি দুই নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িত ছিলেন, যা তাঁর উপন্যাসের একটি সাধারণ ঘটনা। তবে সেই নারী ও তার বিয়ে রশীদ করীমের উপন্যাসকে ফিকে করে দেয়নি; বরং বিভাগোত্তর সময়ে কলকাতা থেকে ঢাকায় আগমন তাঁর স্মৃতিকথায় এবং উপন্যাসে বেশি জায়গা নিয়ে বসেছে।
রশীদ করীমের উপন্যাস পাঠককে ধরে রাখতে সক্ষম। কারণ মানুষকে কেবল ভালো কিংবা মন্দরূপে চিত্রিত করেননি তিনি। তিনি দেখেছেন সময়, সমাজ ও চেতনাধারায় মানুষের বিচিত্র বাস্তবতা। আধুনিক মানুষের অন্তঃসার উন্মোচনে তিনি বাংলাদেশের উপন্যাসে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। প্রেম, যৌনতা_সব কিছু মিলে যে আধুনিক মানুষ, সেই মানুষকে ভেতর থেকে দেখার সক্ষমতা ছিল রশীদ করীমের; তাঁর সমকালে যা অন্য কারো মধ্যে দেখা যায়নি। মানব মনের গহিনে প্রবেশ করেছিলেন তিনি; নাগরিক মধ্যবিত্ত চরিত্রের অন্তস্তল দ্যোতিত করার কৃতিত্ব একমাত্র তাঁরই।
No comments