আমাদের মাননীয় মন্ত্রী একজন ঠগবাজঃ সন্তু লারমা
‘পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাকে আমরা কোনোভাবেই স্বাভাবিক পরিস্থিতি বলতে পারি না।’ পার্বত্য শান্তিচুক্তির ১৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাঙামাটিতে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)।
তিনি বলেন, ‘চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে ১৪ বছর আগে। এর পরপরই তখনকার সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল, যে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, জেলা পরিষদ আইন পাস হয়েছে। গেজেট প্রকাশিত হয়েছে এবং তার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক অবস্থার উন্নয়নে তৎকালীন সরকার কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিল।’
চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘চুক্তির বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে বা হয়নি, সে ব্যাপারে আমরা আগামী ২ ডিসেম্বরের আগে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করতে যাচ্ছি। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন কার্যকর করার জন্য যে আইনি বিষয় রয়েছে, তা কার্যকর করতে কোনো সরকারই উদ্যোগ নেয়নি এবং পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর কাছে যে ৩৩টি বিষয় হস্তান্তর করার কথা, তার বেশিরভাগই এখনো হস্তান্তর করা হয়নি। বিশেষ করে ১৯৯৮ সালে জেলা পরিষদ আইন পাস করার পর সেই সময় সরকার প্রায় ৩ বছর সময় পেলেও একটি বিভাগও জেলা পরিষদে হস্তান্তর করেনি। এমন কি সেই একই সরকার বর্তমানে ক্ষমতায় থাকলেও এই ৩ বছরেও কোনো বিভাগ তারা হস্তান্তর করেনি।’
সন্তু লারমা চুক্তি বাস্তবায়নে বর্তমান সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে জানিয়ে বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়ন যা হয়েছে, তা বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে হয়েছে।’
সন্তু লারমা অভিযোগ করেন, ‘চুক্তির যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আছে, তার অধিকাংশই অবাস্তবায়িত আছে। চুক্তি স্বাক্ষরের অন্যতম পক্ষ ছিল জনসংহতি সমিতি। তারা যথাসময়ে যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু বর্তমানে যে বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত আছে, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। সরকার যেহেতু বাস্তবায়নে এগিয়ে আসছে না এবং বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়, বিধায় চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটা আজও অবধি দেখতে পাচ্ছি না। ১৪ বছরেও তাই আমরা উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখি না।’
সন্তু লারমা আরও বলেন, ‘২০০১ সালে তৎকালীন সরকার ক্ষমতা ছাড়ার আগে পাহাড়ের ভূমি সমস্যার সমাধানে একটি আইন করেছিল, যার নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন। সেই সময় আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদকে পাস কাটিয়ে সরকার আইনটি পাস করেছিল; যে কারণে এই আইনের মধ্যে বেশ কিছু চুক্তিবিরোধী ধারা রয়েছে। পরবর্তীতে বিরোধাত্মক ধারাগুলো সংশোধনের জন্য লিখিতভাবে সরকারের কাছে দেওয়া হয়। কিন্তু আজ অবধি আইনটি অসংশোধিত অবস্থায় পড়ে আছে। আমরা জানি না এই আইন কবে সংসদে উঠবে।’
তিনি সরকারের বিরুদ্ধে চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ করে বলেন, ‘বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৩ বছর পার হয়ে যাচ্ছে, সরকার মুখে অনেক কিছু বললেও যে সব কাজ করেছে, তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। আহ্বায়ক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া, টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান হিসেবে যতীন্দ্রলাল ত্রিপুরা, উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে বীর বাহাদুর এবং ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ৩৫টি সেনাক্যাম্প ও কাপ্তাই থেকে সেনা বিগ্রেড সরানো হয়েছে। এর বাইরে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার কোনো উদ্যোগ বা কাজ করেছে বলে আমাদের জানা নেই। অথচ সরকার অনেক কথা বলে।’
পার্বত্য প্রতিমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্যের সূত্র ধরে সন্তু লারমা বলেন, ‘পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী যেসব কথা বলেছেন তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে যেসব দাবি করেছেন, তাও সত্য নয়। আমাদের রিপোর্ট দেখলে আপনারা দেখবেন মন্ত্রী সত্যি বলছেন কি না? নাকি মিথ্যার বেসাতি করেছেন! নিজের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করেছেন তিনি।’
জনসংহতি সমিতির সভাপতি বলেন, ‘ভূমি সমস্যা পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম সমস্যা। কিন্তু একমাত্র বা প্রধান সমস্যা নয়। এখানকার প্রধান সমস্যা হচ্ছে, প্রশাসনিক সমস্যা বা রাজনৈতিক সমস্যা। মূল সমস্যা হলো- জেলা পরিষদ বা আঞ্চলিক পরিষদকে কার্যকর না করা। এটা কার্যকর না হলে চুক্তির অন্যান্য বিষয়গুলো নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। ৩ পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও আঞ্চলিক পরিষদ আইন কার্যকর করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভূমি বিরোধ অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। কিন্ত এর আইন সংশোধনের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ের আলমারিতে ফেলে রাখা হয়েছে বলে অমাদের জেনেছি।’
ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনী নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার বর্ণনা দিতে গিয়ে সন্তু লারমা বলেন, ‘পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে একটি সংশোধনী প্রস্তাবনা আকারে ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয় নতুন প্রস্তাব দিলো, এটা চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির কাছে পাঠাতে হবে। অথচ চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির কোনো অফিস নেই, কর্মচারী নেই, কোনো ঠিকানাও নেই। তাহলে সবকিছু জেনে-শুনে ভূমি মন্ত্রণালয় কেনো এ সিদ্ধান্ত নিতে গেল? তারা এটি আটকে রেখেছে। এটা জানা সত্ত্বেও পার্বত্য প্রতিমন্ত্রীর সরাসরি না বলে ঘুরিয়ে-পেচিয়ে কথা বলার মানে কী? এর মানে সরকারের সদিচ্ছা নেই। হয়ত এখানে অন্য কিছু আছে, যা আমরা জানি না বা আমাদের জানতে দেওয়া হচ্ছে না।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘এতকিছুুর পরও এতদিন পরে সরকার কেনো ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে উদ্যোগ নেয় না? প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘ভূমি সমস্যা প্রধান সমস্যা, তাহলে কেনো তিনি এর সমাধানে উদ্যোগ নিচ্ছেন না?’
সন্তু লারমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানের জন্য শান্তিচুক্তি হয়েছে। এখন চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে, এর সমাধান হবে না, আমরা সমাধান দেখবো না।’
সন্তু লারমা পাহাড়ে শান্তি আসার জন্য চুক্তি বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়ন ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। চুক্তি বাস্তবায়নের ওপর সমস্ত কিছু নির্ভর করছে। মন্ত্রী মহোদয় যা দেখছেন বা বলছেন, তা হলো মূল বিষয় আড়াল করে গৌণ বিষয় সামনে নিয়ে এসে সরকারের যে চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিকতা নেই, সদিচ্ছা নেই, সরকার যে প্রতারণা করছে, ভাওতাবাজি করছে, এটাকে আড়াল করার জন্য মন্ত্রী মহোদয়রা, দীপংকর তালুকদার, বীর বাহাদুরের মতো নেতারা এসব কথা বলার চেষ্টা করছেন। কিভাবে তিনি এ ধরনের কথাবার্তা বলতে পারেন?’
বাস্তবতাকে অস্বীকার করে সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন অভিযোগ করে সন্তু লারমা বলেন,‘চুক্তি যে আজ স্থবির হয়ে আছে, অবাস্তবায়িত অবস্থায় পড়ে আছে, এটা কে না জানে? স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জানেন, সবাই জানেন। জেনেও তারা এসব কথা বলছেন। কারণ, সরকারের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা আছে, উগ্র জাত্যাভিমান আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল করার যে ষড়যন্ত্র, তার ধারাবাহিকতা বাস্তবায়নের জন্য এই সরকারও উদ্যত। এছাড়া আমাদের দীপংকর বাবুদের মতো নেতারা, যারা নিজেদের পরিচয় হারিয়ে ফেলেছেন, তারা এই ধরনের অবান্তর কথা বলতেই পারেন!’
তিনি বলেন, ‘সরকার এবং দীপংকর বাবুরা বলেন-তারা চুক্তি বাস্তবায়ন করতে চান, কিন্তু সন্তু লারমা বা জনসংহতিরা সহযোগিতা করছেন না। এই কথাটা যে কতটা মিথ্যা, ভাঁওতাবাজি, প্রতারণামুলক, তা যে কেউই বুঝতে পারবেন।’
তিনি বলেন, ‘যে সন্তু লারমা বা জনসংহতি জীবনের সবকিছু বিকিয়ে দিয়ে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম করে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, সেই চুক্তির বাস্তবায়ন তারা চাইবেন না, এটা একজন ছোট্ট শিশুও বিশ্বাস করবে না। চুক্তিতে যে বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব তো সরকারেরই!’
আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘দীপংকর বাবু একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন এবং সেটা হচ্ছে- পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। দায়িত্বটা তার, সর্বাগ্রে তাকেই চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্বটা নিতে হবে। আজকে দীপংকর বাবু চুক্তিবিরোধী বলে এই সমস্ত কথা বলতে পারেন, যে কথাগুলোর কোনো অর্থ নেই। এই দীপংকর বাবু কাদের সহযোগিতায় বিগত সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন, তা আপনারা সবাই জানেন। পার্বত্যাঞ্চলে যারা সশস্ত্র সন্ত্রাস করছে, চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি এবং জনসংহতির নেতৃত্বকে নষ্ট করার জন্য যারা কাজ করছে, সেই ইউপিডিএফের প্রত্যক্ষ সাহায্যে সশস্ত্র সন্ত্রাস করে দীপংকর বাবু এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি তাই আজ তাদের পক্ষে কথা বলেন।’
পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদারের বক্তব্য খ-ন করে সন্তু লারমা বলেন, ‘ইউপিডিএফের পক্ষে তিনি সাংবাদিকদের কাছে যা বলেছেন, তার এই কথা কেনো কি উদ্দেশে, কেনো বলেছেন, তা কারো অজানা থাকতে পারে না।’
সন্তু লারমা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘তিনি (দীপংকর তালুকদার) ইউপিডিএফের সহযোগিতায় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, জনগণের ভোটে নয়। তিনি তো ইউপিডিএফ এর পক্ষে কথা বলবেনই। যে কথা তিনি বলেছেন, তা একজন মন্ত্রীর কথা হতে পারে না, ইউপিডিএফের সহযোগিতায় নির্বাচিত দীপংকর তালুকদারের কথা এমন হতেই পারে।’
২০০১ সালে অপহৃত বিদেশি উদ্ধারে দীপংকর তালুকদারের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলে সন্তু লারমা বলেন, ‘তিনি (দীপংকর তালুকদার) ইউপিডিএফের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। ২০০১ সালে যে বিদেশি অপহরণ হয়েছিল, সেখানে দীপংকর চাঁদাবাজি করে নাই? যে কোটি কোটি টাকা দিতে হয়েছিল বিদেশিদের উদ্ধারে, তার কত ভাগ তিনি পেয়েছেন, তার উত্তর কি তিনি দিতে পারবেন? কত টাকা তিনি নিয়েছেন, তার ভাগে কত পড়েছে, আমরা তা জানি!’
তিনি দীপংকর তালুকদারে বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা কি জানি না, কারা সেই টাকার ভাগীদার ছিলেন? আজকে দীপংকর বাবুরাই চাঁদাবাজি করছে।’
পাহাড়ে চাঁদাবাজির সঙ্গে জনসংহতি সমিতি যুক্ত নয় দাবি করে সন্তু লারমা বলেন, ‘সন্তু লারমারা চাঁদাবজি করে না। তারা এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সম্প্রতি যে ২শ‘ ৬৩ জন শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে, সেখানে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়েছে। এখান থেকে দীপংকর বড় অংশের ভাগ পেয়েছেন। তাহলে চাঁদাবাজি করে কে? চাঁদাবাজি সন্তু লারমা করে না, চাঁদাবাজি করে দীপংকর এবং তার সঙ্গে সহযোগিতা করে যারা, তারা। এই বিষয়গুলো আড়াল করার জন্য দীপংকর বাবু নিজের দোষ অন্যের গাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন।’
জনসংহতি সমিতির কোনো সশস্ত্র গ্রুপ নেই দাবি করে তিনি আরও বলেন, জেএসএস সশস্ত্র সন্ত্রাস করছে না। জেএসএসের হাতে কোনো অস্ত্র নেই। আমাদের হাতে অস্ত্র নেই, থাকার কথাও না। চুক্তি সাক্ষরের পরপরই ইউপিডিএফের জন্ম দেওয়া হয়েছে। জনসংহতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করার জন্য এবং চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা-এই দুটি মূল উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের জন্ম। সরকার তথা শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ মহলের সহযোগিতায় তাদের জন্ম হয়েছে।
ইউপিডিএফ প্রসঙ্গে সন্তু লারমা বলে, ‘খাগড়াছড়িতে চুক্তি স্বাক্ষরের সময় সারা বিশ্বের সামনে, মন্ত্রী পরিষদসহ সবার সমানে তারা চুক্তির বিরোধিতা করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন, ব্যানার দেখিয়েছেন, কালো চুক্তি মানি না বলেছেন। এখন তারা আবার বলেন, তারা নাকি চুক্তি মানেন, চুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে চান। কিন্তু সেদিন তো তারা চুক্তি মানেননি। সবার সামনে তারা চুক্তির বিরোধিতা করা সত্ত্বেও তাদের কোনো শাস্তি দেওয়া হয় নি। এমন কি তাদের গ্রেপ্তারও করা হয় নি। কেনো করা হয় নি?’
তিনি নিজেই এর জবাব দিয়ে বলেন, ‘করা হয় নি এ কারণে যে, দীপংকর বাবুরা এতে জড়িত ছিলেন!’
দীপংকর তালুকদার ইউপিডিএফকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন অভিযোগ করে সন্তু লারমা বলেন, ‘তারাই (দীপংকর তালুকদার) এই ইউপিডিএফকে আশ্রয়-প্রশয় দিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি এবং ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালাতে সহায়তা দিয়েছেন। চুক্তি বাস্তবায়ন যেন এগিয়ে যেতে না পারে, সেই জন্য এই ইউপিডিএফ!’
তিনি বলেন, ‘ইউপিডিএফের ১৪ বছরের যে সন্ত্রাস, প্রথমে ছিল কিছু কাগজপত্রে লেখালেখি, তারপর নিলো লাঠি, তারপর চাইনিজ কুড়াল, তারপর পাইপগান তারপর বিশেষ হাতিয়ার। এগুলো হয়েছে- এই দীপংকর বাবু আর সরকারের বিশেষ মহলের সহযোগিতায়। ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসের কারণে পার্বত্যাঞ্চলে অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে (পাহাড়ে) কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে। এখানে শত শত মানুষকে জিম্মি করে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তাই ইউপিডিএফের হাতে নিপীড়িত মানুষ সংগঠিত হয়েছে এবং ইউপিডিএফের বিরোধী একটি সশস্ত্র গ্রুপ গড়ে উঠেছে। আত্মরক্ষার জন্য, নিজস্ব প্রতিরক্ষার জন্য যে গ্রুপটি গড়ে উঠেছে, তারা চুক্তির সপক্ষের, চুক্তির বাস্তবায়ন চায় এবং একটা নিরাপদ জীবন পেতে চায়। তারাই ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসের বিপক্ষে অস্ত্র ধরেছেন এবং আজকের বিভিন্ন স্থানে যে সংঘাত চলছে, তা হচ্ছে, ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে যারা আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র ধরেছেন তাদের মধ্যে। এটা জেএসএস নয়। জেএসএস এখনো সেই পথে যায় নি। জেএসএস এখনো চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের কাছে কাকুতি-মিনতি করছে, পায়ে ধরছে, কিন্তু ১৪ বছরে কোনো সরকার এগিয়ে আসে নি। তারা মনে করছে, জনসংহতি সমিতি খুবই দুর্বল, নিঃশেষ হয়ে গেছে। ওয়ান ইলেভেনের ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে কিছুসংখ্যক জনসংহতির নেতা আদর্শচ্যুত হয়েছেন, রূপায়ন বাবু, পেলে বাবুরা সরকারের বিশেষ মহলের সঙ্গে আঁতাত করে দল থেকে বেরিয়ে গেছেন। আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে, গণতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করছি। চুক্তি করেছি বলেই আমাদের দাবি-দাওয়া, কথা-বার্তা বেশি হবে। কিন্তু ইউপিডিএফকে আশ্রয়-প্রশয় দেওয়া ঠিক হবে না।’
তিনি বলেন, ‘ইউপিডিএফের সম্পর্কে সবকিছু জেনেও সরকার তাদের লালন-পালন করছে। তাদের অত্যাচারে, তাদের বিরুদ্ধে কিছু মানুষ অস্ত্র ধরেছে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য, জীবন বাঁচানোর জন্য। সেটাকে আপনার ইউপিডিএফের সঙ্গে জেএসএসের সংঘাত বলতে পারেন না।’
পাহাড়ের সংবাদ প্রকাশে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে সন্তু লারমা বলেন, ‘আমি দেখি মিডিয়াতে তাই লেখা হয়, দেখানো হয়। কিন্তু, এটা ঠিক নয়। এটা আপনারা কেনো লেখেন তা আমি জানি না।’
তিনি সংবাদ মাধ্যমের উদ্দেশে বলেন, ‘জেএসএস এখনো ওই পথে যায় নি। তাই, আমরা ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ করার দাবি করছি। কিন্তু আমাদের দীপংকর বাবু হুমকি দিচ্ছেন যে, জেএসএসকে নিষিদ্ধ করবেন।’
এ সময় তিনি দীপংকর তালুকদারের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, ‘বাপের বেটা হলে আপনি করে দেখান, জনসংহতিকে আপনি নিষিদ্ধ করতে পারেন। তখন দেখা যাবে, আপনি দীপংকর বাবু কোথায় থাকেন, কোথায় যান?’
ভূমি কমিশন সংশোধনের কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে- পার্বত্য প্রতিমন্ত্রীর এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে ক্ষোভের সঙ্গে জেএসএস সভাপতি বলেন, ‘উনি (দীপংকর তালুকদার) তো দিন-রাত মিথ্যা কথা বলেন। উনি একেক জায়গায় একেক কথা বলেন। উনি কাউখালিতে এক কথা, বাঘাইছড়িতে আরেক কথা, ঢাকায় গিয়ে অন্য কথা বলেন। উনি কোন কথাটা ঠিক বলেন?’
সন্তু লারমা প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদারকে প্রতারক হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের মাননীয় মন্ত্রী একজন ঠগবাজ ব্যক্তি, যাকে আমরা অনেক আগেই জাতীয় কুলাঙ্গার হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। তাকে কেনো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এত আদর যত্ম করে মন্ত্রনণালয়ে পাঠান, এটা আমরা বুঝি না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের চুক্তির কারণে সৃষ্ট আমাদের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে তিনি (দীপংকর তালুকদার) চুক্তিবিরোধী অবস্থান নিয়ে আছেন। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এবং কাজ দেখেই বোঝা যায়, এই সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়। এই সরকার চায়, চুক্তি নামে থাকুক, এটা যেন কাজে পরিণত না হয়!’
বাঙালিদের সংগঠন সমঅধিকার আন্দোলন প্রসঙ্গে সন্তু লারমা বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়নে আমি সমঅধিকারকে বড় বাধা মনে করি না। এটা সরকারের সৃষ্টি। এখানে স্মরণ করতে হয়, দুর্নীতির মাধ্যমে নির্বাচিত এমপি ওয়াদুদ ভূঁইয়াকে। তাকে শিখ-ি হিসেবে দাঁড় করিয়ে এটা করা হয়েছে।’
ইউপিডিএফের পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন বলে কোনো ব্যবস্থা সারা পৃথিবীতে নেই। এটা একটি অর্থহীন শব্দ। স্বায়ত্ত্বশাসনের মাত্রা ও পরিধি ভিন্ন হতে পারে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে স্বায়ত্ত্বশাসনের বিভিন্ন রূপ আছে। কিন্তু পূর্ণস্বায়ত্ত্বশাসন বলে কিছু নেই। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এই স্বায়ত্ত্বশাসনের এই মাত্রাও ভিন্ন ভিন্ন। পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন নামে কোনো শব্দ কোথাও নেই। এটা ইউপিডিএফের আবিষ্কার। এটা মিনিংলেস (অর্থহীন)।’
জনসংহতির সঙ্গে ইউপিডিএফের সমঝোতা চুক্তি প্রসঙ্গে সন্তু লারমা বলেন, ‘তাদের (ইউপিডিএফ) সঙ্গে আমাদের কখনই কোনো চুক্তি হয় নি। তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে অনেকবার। তারা সন্ত্রাসী হলেও আমরা এই এলাকার শান্তির স্বার্থে ধৈর্য ধরে, দূরদর্শী হয়ে আমরা চেষ্টা করেছি সমঝোতার। আমরা তাদের একটা কথা বলেছি- তোমরা অস্ত্র ত্যাগ করো, তোমাদের অস্ত্র কাকে জমা দেবে, তা আমরা জানি না, সে অস্ত্র জমা দিয়ে তোমরা ১০টা রাজনৈতিক দল করো, এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে আমাদের দলে সুযোগ নেই। আমাদের দলে আসতে গেলে তার একটা প্রক্রিয়া আছে, পদ্ধতি আছে। ইচ্ছে করলেই জনসংহতির সদস্য হওয়া যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এরা (ইউপিডিএফ) সন্ত্রাসী, এদের সঙ্গে কিসের চুক্তি হবে? এদের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। আমরা বলেছি, এখনো বলছি- এই মুহূর্তে তারা যদি অস্ত্র ত্যাগ করে এসে বলে আমাদের কাছে আর অস্ত্র নেই,আমরা আর কাউকে খুন করবো না, পঙ্গু করবো না, তাহলে ঐক্য হতে পারে। এটাও আমরা আহ্বান করেছিলাম। কিন্তু তারা সেটা মানে নি।’
সংবিধানে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির চলমান দাবি প্রসঙ্গে জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা বলেন, ‘আদিবাসী কোনো জাতিবাচক শব্দ নয়। যে ৫৪টা জাতি এই দেশে বাস করি, আমরা সবাই মিলে চাই একটি সম্মিলিত পরিচিতি থাকবে, সেটাই আমাদের দাবি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সংবিধান সংশোধন কমিটিকে বলেছি- আমাদের স্ব স্ব জাতিগত পরিচয় দিয়েই আমাদেরকে সংবিধানে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা সেই জন্য পঞ্চদশ সংশোধনীতে আমাদের যে বাঙালি করা হয়েছে, আমরা এটার বিরোধিতা করি এবং এখনো বলি, এটা বাতিল করতে হবে। ‘আদিবাসী’ একটি ‘সমষ্টিগত’ পরিচয়। এটা ‘জাতিগত’ পরিচয় নয়। এখানে ইউপিডিএফ কি বললো বা কি করলে এটা আমাদের ব্যাপার না।’
চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সন্তু লারমা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে। কারণ, চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে তাদের নেতিবাচক ভূমিকা। চুক্তি বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ স্বাভাবিক ভূমিকা রাখছে না বলে তাদের সঙ্গে দূরত্ব ধীরে ধীরে বাড়ছে, এটা বলতেই পারেন। তবে, আওয়ামী লীগ আর জনসংহতির আদর্শ কখনোই কাছাকাছি ছিল না। চুক্তির বিষয় নিয়ে আমাদের সম্প্রীতি হয়েছিল, এখন চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা হওয়ায়, দূরত্ব তো একটু বাড়বেই!’
পার্বত্য চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ বিশেষ করে জুম্মদের মধ্যে যারা আওয়ামী লীগ করেন- ‘জুম্ম আওয়ামী লীগ’ তারা তো আরো বেশি খারাপ বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বান্দরবানের নেতা প্রসন্ন বাবু, রাঙামাটিতে দীপংকর বাবু নেতা, খাগড়াছড়িতে যতীন বাবু নেতা আজকে তারা কি করছেন? চোখের সামনে তারা চুক্তির বিরোধিতা করছেন। তিন জেলা পরিষদও চুক্তি বিরোধিতায় রয়েছে। আমাদের রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তো আঞ্চলিক পরিষদের পাশ দিয়ে হাঁটাহাঁটি করেন, কিন্তু তিনি আঞ্চলিক পরিষদ কোথায়, ঠিকানা খুঁজে পান না।’
পাহাড়ে চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পার্বত্য এলাকার চেয়েও ঢাকায় চাঁদাবাজি বেশি হয়। ঢাকায় একটি ওয়ার্ডে যে চাঁদাবাজি হয়, গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামেও তো তা হয় না। কিন্তু, মিডিয়াতে এত ফলাওভাবে প্রচার করা হয়, মনে হয় পার্বত্যাঞ্চলে হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়! সন্ত্রাসের কথাও যদি বলা হয়, ঢাকার একটি ওয়ার্ডে সারা বছর যে সন্ত্রাস হয়, আমাদের ৩ পার্বত্য জেলা মিলেও সেই পরিমাণ সন্ত্রাস হয় না। শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ মহল এগুলো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করছে। আসল কাজটাকে আড়াল করার জন্য।’
পার্বত্য প্রতিমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, দীপংকর তালুকদার বিগত ৩বছর ধরে যে সব কথা বলে আসছেন, তার আগাও নাই, গোড়াও নাই। তিনি কি বলেন, তা তিনি নিজেও বোঝেন না বা বোঝার চেষ্টাও করেন না। তিনি যে মন্ত্রিপরিষদে আছেন, সেই মন্ত্রিপরিষদ এবং সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো অবস্থাতেই আন্তরিক নয়।’
চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘চুক্তির বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে বা হয়নি, সে ব্যাপারে আমরা আগামী ২ ডিসেম্বরের আগে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করতে যাচ্ছি। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন কার্যকর করার জন্য যে আইনি বিষয় রয়েছে, তা কার্যকর করতে কোনো সরকারই উদ্যোগ নেয়নি এবং পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর কাছে যে ৩৩টি বিষয় হস্তান্তর করার কথা, তার বেশিরভাগই এখনো হস্তান্তর করা হয়নি। বিশেষ করে ১৯৯৮ সালে জেলা পরিষদ আইন পাস করার পর সেই সময় সরকার প্রায় ৩ বছর সময় পেলেও একটি বিভাগও জেলা পরিষদে হস্তান্তর করেনি। এমন কি সেই একই সরকার বর্তমানে ক্ষমতায় থাকলেও এই ৩ বছরেও কোনো বিভাগ তারা হস্তান্তর করেনি।’
সন্তু লারমা চুক্তি বাস্তবায়নে বর্তমান সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে জানিয়ে বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়ন যা হয়েছে, তা বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে হয়েছে।’
সন্তু লারমা অভিযোগ করেন, ‘চুক্তির যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আছে, তার অধিকাংশই অবাস্তবায়িত আছে। চুক্তি স্বাক্ষরের অন্যতম পক্ষ ছিল জনসংহতি সমিতি। তারা যথাসময়ে যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু বর্তমানে যে বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত আছে, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। সরকার যেহেতু বাস্তবায়নে এগিয়ে আসছে না এবং বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়, বিধায় চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটা আজও অবধি দেখতে পাচ্ছি না। ১৪ বছরেও তাই আমরা উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখি না।’
সন্তু লারমা আরও বলেন, ‘২০০১ সালে তৎকালীন সরকার ক্ষমতা ছাড়ার আগে পাহাড়ের ভূমি সমস্যার সমাধানে একটি আইন করেছিল, যার নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন। সেই সময় আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদকে পাস কাটিয়ে সরকার আইনটি পাস করেছিল; যে কারণে এই আইনের মধ্যে বেশ কিছু চুক্তিবিরোধী ধারা রয়েছে। পরবর্তীতে বিরোধাত্মক ধারাগুলো সংশোধনের জন্য লিখিতভাবে সরকারের কাছে দেওয়া হয়। কিন্তু আজ অবধি আইনটি অসংশোধিত অবস্থায় পড়ে আছে। আমরা জানি না এই আইন কবে সংসদে উঠবে।’
তিনি সরকারের বিরুদ্ধে চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ করে বলেন, ‘বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৩ বছর পার হয়ে যাচ্ছে, সরকার মুখে অনেক কিছু বললেও যে সব কাজ করেছে, তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। আহ্বায়ক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া, টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান হিসেবে যতীন্দ্রলাল ত্রিপুরা, উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে বীর বাহাদুর এবং ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ৩৫টি সেনাক্যাম্প ও কাপ্তাই থেকে সেনা বিগ্রেড সরানো হয়েছে। এর বাইরে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার কোনো উদ্যোগ বা কাজ করেছে বলে আমাদের জানা নেই। অথচ সরকার অনেক কথা বলে।’
পার্বত্য প্রতিমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্যের সূত্র ধরে সন্তু লারমা বলেন, ‘পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী যেসব কথা বলেছেন তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে যেসব দাবি করেছেন, তাও সত্য নয়। আমাদের রিপোর্ট দেখলে আপনারা দেখবেন মন্ত্রী সত্যি বলছেন কি না? নাকি মিথ্যার বেসাতি করেছেন! নিজের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করেছেন তিনি।’
জনসংহতি সমিতির সভাপতি বলেন, ‘ভূমি সমস্যা পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম সমস্যা। কিন্তু একমাত্র বা প্রধান সমস্যা নয়। এখানকার প্রধান সমস্যা হচ্ছে, প্রশাসনিক সমস্যা বা রাজনৈতিক সমস্যা। মূল সমস্যা হলো- জেলা পরিষদ বা আঞ্চলিক পরিষদকে কার্যকর না করা। এটা কার্যকর না হলে চুক্তির অন্যান্য বিষয়গুলো নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। ৩ পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও আঞ্চলিক পরিষদ আইন কার্যকর করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভূমি বিরোধ অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। কিন্ত এর আইন সংশোধনের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ের আলমারিতে ফেলে রাখা হয়েছে বলে অমাদের জেনেছি।’
ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনী নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার বর্ণনা দিতে গিয়ে সন্তু লারমা বলেন, ‘পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে একটি সংশোধনী প্রস্তাবনা আকারে ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয় নতুন প্রস্তাব দিলো, এটা চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির কাছে পাঠাতে হবে। অথচ চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির কোনো অফিস নেই, কর্মচারী নেই, কোনো ঠিকানাও নেই। তাহলে সবকিছু জেনে-শুনে ভূমি মন্ত্রণালয় কেনো এ সিদ্ধান্ত নিতে গেল? তারা এটি আটকে রেখেছে। এটা জানা সত্ত্বেও পার্বত্য প্রতিমন্ত্রীর সরাসরি না বলে ঘুরিয়ে-পেচিয়ে কথা বলার মানে কী? এর মানে সরকারের সদিচ্ছা নেই। হয়ত এখানে অন্য কিছু আছে, যা আমরা জানি না বা আমাদের জানতে দেওয়া হচ্ছে না।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘এতকিছুুর পরও এতদিন পরে সরকার কেনো ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে উদ্যোগ নেয় না? প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘ভূমি সমস্যা প্রধান সমস্যা, তাহলে কেনো তিনি এর সমাধানে উদ্যোগ নিচ্ছেন না?’
সন্তু লারমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানের জন্য শান্তিচুক্তি হয়েছে। এখন চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে, এর সমাধান হবে না, আমরা সমাধান দেখবো না।’
সন্তু লারমা পাহাড়ে শান্তি আসার জন্য চুক্তি বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়ন ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। চুক্তি বাস্তবায়নের ওপর সমস্ত কিছু নির্ভর করছে। মন্ত্রী মহোদয় যা দেখছেন বা বলছেন, তা হলো মূল বিষয় আড়াল করে গৌণ বিষয় সামনে নিয়ে এসে সরকারের যে চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিকতা নেই, সদিচ্ছা নেই, সরকার যে প্রতারণা করছে, ভাওতাবাজি করছে, এটাকে আড়াল করার জন্য মন্ত্রী মহোদয়রা, দীপংকর তালুকদার, বীর বাহাদুরের মতো নেতারা এসব কথা বলার চেষ্টা করছেন। কিভাবে তিনি এ ধরনের কথাবার্তা বলতে পারেন?’
বাস্তবতাকে অস্বীকার করে সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন অভিযোগ করে সন্তু লারমা বলেন,‘চুক্তি যে আজ স্থবির হয়ে আছে, অবাস্তবায়িত অবস্থায় পড়ে আছে, এটা কে না জানে? স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জানেন, সবাই জানেন। জেনেও তারা এসব কথা বলছেন। কারণ, সরকারের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা আছে, উগ্র জাত্যাভিমান আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল করার যে ষড়যন্ত্র, তার ধারাবাহিকতা বাস্তবায়নের জন্য এই সরকারও উদ্যত। এছাড়া আমাদের দীপংকর বাবুদের মতো নেতারা, যারা নিজেদের পরিচয় হারিয়ে ফেলেছেন, তারা এই ধরনের অবান্তর কথা বলতেই পারেন!’
তিনি বলেন, ‘সরকার এবং দীপংকর বাবুরা বলেন-তারা চুক্তি বাস্তবায়ন করতে চান, কিন্তু সন্তু লারমা বা জনসংহতিরা সহযোগিতা করছেন না। এই কথাটা যে কতটা মিথ্যা, ভাঁওতাবাজি, প্রতারণামুলক, তা যে কেউই বুঝতে পারবেন।’
তিনি বলেন, ‘যে সন্তু লারমা বা জনসংহতি জীবনের সবকিছু বিকিয়ে দিয়ে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম করে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, সেই চুক্তির বাস্তবায়ন তারা চাইবেন না, এটা একজন ছোট্ট শিশুও বিশ্বাস করবে না। চুক্তিতে যে বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব তো সরকারেরই!’
আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘দীপংকর বাবু একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন এবং সেটা হচ্ছে- পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। দায়িত্বটা তার, সর্বাগ্রে তাকেই চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্বটা নিতে হবে। আজকে দীপংকর বাবু চুক্তিবিরোধী বলে এই সমস্ত কথা বলতে পারেন, যে কথাগুলোর কোনো অর্থ নেই। এই দীপংকর বাবু কাদের সহযোগিতায় বিগত সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন, তা আপনারা সবাই জানেন। পার্বত্যাঞ্চলে যারা সশস্ত্র সন্ত্রাস করছে, চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি এবং জনসংহতির নেতৃত্বকে নষ্ট করার জন্য যারা কাজ করছে, সেই ইউপিডিএফের প্রত্যক্ষ সাহায্যে সশস্ত্র সন্ত্রাস করে দীপংকর বাবু এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি তাই আজ তাদের পক্ষে কথা বলেন।’
পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদারের বক্তব্য খ-ন করে সন্তু লারমা বলেন, ‘ইউপিডিএফের পক্ষে তিনি সাংবাদিকদের কাছে যা বলেছেন, তার এই কথা কেনো কি উদ্দেশে, কেনো বলেছেন, তা কারো অজানা থাকতে পারে না।’
সন্তু লারমা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘তিনি (দীপংকর তালুকদার) ইউপিডিএফের সহযোগিতায় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, জনগণের ভোটে নয়। তিনি তো ইউপিডিএফ এর পক্ষে কথা বলবেনই। যে কথা তিনি বলেছেন, তা একজন মন্ত্রীর কথা হতে পারে না, ইউপিডিএফের সহযোগিতায় নির্বাচিত দীপংকর তালুকদারের কথা এমন হতেই পারে।’
২০০১ সালে অপহৃত বিদেশি উদ্ধারে দীপংকর তালুকদারের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলে সন্তু লারমা বলেন, ‘তিনি (দীপংকর তালুকদার) ইউপিডিএফের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। ২০০১ সালে যে বিদেশি অপহরণ হয়েছিল, সেখানে দীপংকর চাঁদাবাজি করে নাই? যে কোটি কোটি টাকা দিতে হয়েছিল বিদেশিদের উদ্ধারে, তার কত ভাগ তিনি পেয়েছেন, তার উত্তর কি তিনি দিতে পারবেন? কত টাকা তিনি নিয়েছেন, তার ভাগে কত পড়েছে, আমরা তা জানি!’
তিনি দীপংকর তালুকদারে বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা কি জানি না, কারা সেই টাকার ভাগীদার ছিলেন? আজকে দীপংকর বাবুরাই চাঁদাবাজি করছে।’
পাহাড়ে চাঁদাবাজির সঙ্গে জনসংহতি সমিতি যুক্ত নয় দাবি করে সন্তু লারমা বলেন, ‘সন্তু লারমারা চাঁদাবজি করে না। তারা এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সম্প্রতি যে ২শ‘ ৬৩ জন শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে, সেখানে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়েছে। এখান থেকে দীপংকর বড় অংশের ভাগ পেয়েছেন। তাহলে চাঁদাবাজি করে কে? চাঁদাবাজি সন্তু লারমা করে না, চাঁদাবাজি করে দীপংকর এবং তার সঙ্গে সহযোগিতা করে যারা, তারা। এই বিষয়গুলো আড়াল করার জন্য দীপংকর বাবু নিজের দোষ অন্যের গাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন।’
জনসংহতি সমিতির কোনো সশস্ত্র গ্রুপ নেই দাবি করে তিনি আরও বলেন, জেএসএস সশস্ত্র সন্ত্রাস করছে না। জেএসএসের হাতে কোনো অস্ত্র নেই। আমাদের হাতে অস্ত্র নেই, থাকার কথাও না। চুক্তি সাক্ষরের পরপরই ইউপিডিএফের জন্ম দেওয়া হয়েছে। জনসংহতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করার জন্য এবং চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা-এই দুটি মূল উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের জন্ম। সরকার তথা শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ মহলের সহযোগিতায় তাদের জন্ম হয়েছে।
ইউপিডিএফ প্রসঙ্গে সন্তু লারমা বলে, ‘খাগড়াছড়িতে চুক্তি স্বাক্ষরের সময় সারা বিশ্বের সামনে, মন্ত্রী পরিষদসহ সবার সমানে তারা চুক্তির বিরোধিতা করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন, ব্যানার দেখিয়েছেন, কালো চুক্তি মানি না বলেছেন। এখন তারা আবার বলেন, তারা নাকি চুক্তি মানেন, চুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে চান। কিন্তু সেদিন তো তারা চুক্তি মানেননি। সবার সামনে তারা চুক্তির বিরোধিতা করা সত্ত্বেও তাদের কোনো শাস্তি দেওয়া হয় নি। এমন কি তাদের গ্রেপ্তারও করা হয় নি। কেনো করা হয় নি?’
তিনি নিজেই এর জবাব দিয়ে বলেন, ‘করা হয় নি এ কারণে যে, দীপংকর বাবুরা এতে জড়িত ছিলেন!’
দীপংকর তালুকদার ইউপিডিএফকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন অভিযোগ করে সন্তু লারমা বলেন, ‘তারাই (দীপংকর তালুকদার) এই ইউপিডিএফকে আশ্রয়-প্রশয় দিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি এবং ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালাতে সহায়তা দিয়েছেন। চুক্তি বাস্তবায়ন যেন এগিয়ে যেতে না পারে, সেই জন্য এই ইউপিডিএফ!’
তিনি বলেন, ‘ইউপিডিএফের ১৪ বছরের যে সন্ত্রাস, প্রথমে ছিল কিছু কাগজপত্রে লেখালেখি, তারপর নিলো লাঠি, তারপর চাইনিজ কুড়াল, তারপর পাইপগান তারপর বিশেষ হাতিয়ার। এগুলো হয়েছে- এই দীপংকর বাবু আর সরকারের বিশেষ মহলের সহযোগিতায়। ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসের কারণে পার্বত্যাঞ্চলে অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে (পাহাড়ে) কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে। এখানে শত শত মানুষকে জিম্মি করে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তাই ইউপিডিএফের হাতে নিপীড়িত মানুষ সংগঠিত হয়েছে এবং ইউপিডিএফের বিরোধী একটি সশস্ত্র গ্রুপ গড়ে উঠেছে। আত্মরক্ষার জন্য, নিজস্ব প্রতিরক্ষার জন্য যে গ্রুপটি গড়ে উঠেছে, তারা চুক্তির সপক্ষের, চুক্তির বাস্তবায়ন চায় এবং একটা নিরাপদ জীবন পেতে চায়। তারাই ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসের বিপক্ষে অস্ত্র ধরেছেন এবং আজকের বিভিন্ন স্থানে যে সংঘাত চলছে, তা হচ্ছে, ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে যারা আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র ধরেছেন তাদের মধ্যে। এটা জেএসএস নয়। জেএসএস এখনো সেই পথে যায় নি। জেএসএস এখনো চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের কাছে কাকুতি-মিনতি করছে, পায়ে ধরছে, কিন্তু ১৪ বছরে কোনো সরকার এগিয়ে আসে নি। তারা মনে করছে, জনসংহতি সমিতি খুবই দুর্বল, নিঃশেষ হয়ে গেছে। ওয়ান ইলেভেনের ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে কিছুসংখ্যক জনসংহতির নেতা আদর্শচ্যুত হয়েছেন, রূপায়ন বাবু, পেলে বাবুরা সরকারের বিশেষ মহলের সঙ্গে আঁতাত করে দল থেকে বেরিয়ে গেছেন। আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে, গণতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করছি। চুক্তি করেছি বলেই আমাদের দাবি-দাওয়া, কথা-বার্তা বেশি হবে। কিন্তু ইউপিডিএফকে আশ্রয়-প্রশয় দেওয়া ঠিক হবে না।’
তিনি বলেন, ‘ইউপিডিএফের সম্পর্কে সবকিছু জেনেও সরকার তাদের লালন-পালন করছে। তাদের অত্যাচারে, তাদের বিরুদ্ধে কিছু মানুষ অস্ত্র ধরেছে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য, জীবন বাঁচানোর জন্য। সেটাকে আপনার ইউপিডিএফের সঙ্গে জেএসএসের সংঘাত বলতে পারেন না।’
পাহাড়ের সংবাদ প্রকাশে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে সন্তু লারমা বলেন, ‘আমি দেখি মিডিয়াতে তাই লেখা হয়, দেখানো হয়। কিন্তু, এটা ঠিক নয়। এটা আপনারা কেনো লেখেন তা আমি জানি না।’
তিনি সংবাদ মাধ্যমের উদ্দেশে বলেন, ‘জেএসএস এখনো ওই পথে যায় নি। তাই, আমরা ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ করার দাবি করছি। কিন্তু আমাদের দীপংকর বাবু হুমকি দিচ্ছেন যে, জেএসএসকে নিষিদ্ধ করবেন।’
এ সময় তিনি দীপংকর তালুকদারের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, ‘বাপের বেটা হলে আপনি করে দেখান, জনসংহতিকে আপনি নিষিদ্ধ করতে পারেন। তখন দেখা যাবে, আপনি দীপংকর বাবু কোথায় থাকেন, কোথায় যান?’
ভূমি কমিশন সংশোধনের কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে- পার্বত্য প্রতিমন্ত্রীর এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে ক্ষোভের সঙ্গে জেএসএস সভাপতি বলেন, ‘উনি (দীপংকর তালুকদার) তো দিন-রাত মিথ্যা কথা বলেন। উনি একেক জায়গায় একেক কথা বলেন। উনি কাউখালিতে এক কথা, বাঘাইছড়িতে আরেক কথা, ঢাকায় গিয়ে অন্য কথা বলেন। উনি কোন কথাটা ঠিক বলেন?’
সন্তু লারমা প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদারকে প্রতারক হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের মাননীয় মন্ত্রী একজন ঠগবাজ ব্যক্তি, যাকে আমরা অনেক আগেই জাতীয় কুলাঙ্গার হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। তাকে কেনো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এত আদর যত্ম করে মন্ত্রনণালয়ে পাঠান, এটা আমরা বুঝি না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের চুক্তির কারণে সৃষ্ট আমাদের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে তিনি (দীপংকর তালুকদার) চুক্তিবিরোধী অবস্থান নিয়ে আছেন। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এবং কাজ দেখেই বোঝা যায়, এই সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়। এই সরকার চায়, চুক্তি নামে থাকুক, এটা যেন কাজে পরিণত না হয়!’
বাঙালিদের সংগঠন সমঅধিকার আন্দোলন প্রসঙ্গে সন্তু লারমা বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়নে আমি সমঅধিকারকে বড় বাধা মনে করি না। এটা সরকারের সৃষ্টি। এখানে স্মরণ করতে হয়, দুর্নীতির মাধ্যমে নির্বাচিত এমপি ওয়াদুদ ভূঁইয়াকে। তাকে শিখ-ি হিসেবে দাঁড় করিয়ে এটা করা হয়েছে।’
ইউপিডিএফের পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন বলে কোনো ব্যবস্থা সারা পৃথিবীতে নেই। এটা একটি অর্থহীন শব্দ। স্বায়ত্ত্বশাসনের মাত্রা ও পরিধি ভিন্ন হতে পারে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে স্বায়ত্ত্বশাসনের বিভিন্ন রূপ আছে। কিন্তু পূর্ণস্বায়ত্ত্বশাসন বলে কিছু নেই। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এই স্বায়ত্ত্বশাসনের এই মাত্রাও ভিন্ন ভিন্ন। পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন নামে কোনো শব্দ কোথাও নেই। এটা ইউপিডিএফের আবিষ্কার। এটা মিনিংলেস (অর্থহীন)।’
জনসংহতির সঙ্গে ইউপিডিএফের সমঝোতা চুক্তি প্রসঙ্গে সন্তু লারমা বলেন, ‘তাদের (ইউপিডিএফ) সঙ্গে আমাদের কখনই কোনো চুক্তি হয় নি। তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে অনেকবার। তারা সন্ত্রাসী হলেও আমরা এই এলাকার শান্তির স্বার্থে ধৈর্য ধরে, দূরদর্শী হয়ে আমরা চেষ্টা করেছি সমঝোতার। আমরা তাদের একটা কথা বলেছি- তোমরা অস্ত্র ত্যাগ করো, তোমাদের অস্ত্র কাকে জমা দেবে, তা আমরা জানি না, সে অস্ত্র জমা দিয়ে তোমরা ১০টা রাজনৈতিক দল করো, এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে আমাদের দলে সুযোগ নেই। আমাদের দলে আসতে গেলে তার একটা প্রক্রিয়া আছে, পদ্ধতি আছে। ইচ্ছে করলেই জনসংহতির সদস্য হওয়া যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এরা (ইউপিডিএফ) সন্ত্রাসী, এদের সঙ্গে কিসের চুক্তি হবে? এদের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। আমরা বলেছি, এখনো বলছি- এই মুহূর্তে তারা যদি অস্ত্র ত্যাগ করে এসে বলে আমাদের কাছে আর অস্ত্র নেই,আমরা আর কাউকে খুন করবো না, পঙ্গু করবো না, তাহলে ঐক্য হতে পারে। এটাও আমরা আহ্বান করেছিলাম। কিন্তু তারা সেটা মানে নি।’
সংবিধানে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির চলমান দাবি প্রসঙ্গে জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা বলেন, ‘আদিবাসী কোনো জাতিবাচক শব্দ নয়। যে ৫৪টা জাতি এই দেশে বাস করি, আমরা সবাই মিলে চাই একটি সম্মিলিত পরিচিতি থাকবে, সেটাই আমাদের দাবি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সংবিধান সংশোধন কমিটিকে বলেছি- আমাদের স্ব স্ব জাতিগত পরিচয় দিয়েই আমাদেরকে সংবিধানে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা সেই জন্য পঞ্চদশ সংশোধনীতে আমাদের যে বাঙালি করা হয়েছে, আমরা এটার বিরোধিতা করি এবং এখনো বলি, এটা বাতিল করতে হবে। ‘আদিবাসী’ একটি ‘সমষ্টিগত’ পরিচয়। এটা ‘জাতিগত’ পরিচয় নয়। এখানে ইউপিডিএফ কি বললো বা কি করলে এটা আমাদের ব্যাপার না।’
চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সন্তু লারমা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে। কারণ, চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে তাদের নেতিবাচক ভূমিকা। চুক্তি বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ স্বাভাবিক ভূমিকা রাখছে না বলে তাদের সঙ্গে দূরত্ব ধীরে ধীরে বাড়ছে, এটা বলতেই পারেন। তবে, আওয়ামী লীগ আর জনসংহতির আদর্শ কখনোই কাছাকাছি ছিল না। চুক্তির বিষয় নিয়ে আমাদের সম্প্রীতি হয়েছিল, এখন চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা হওয়ায়, দূরত্ব তো একটু বাড়বেই!’
পার্বত্য চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ বিশেষ করে জুম্মদের মধ্যে যারা আওয়ামী লীগ করেন- ‘জুম্ম আওয়ামী লীগ’ তারা তো আরো বেশি খারাপ বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বান্দরবানের নেতা প্রসন্ন বাবু, রাঙামাটিতে দীপংকর বাবু নেতা, খাগড়াছড়িতে যতীন বাবু নেতা আজকে তারা কি করছেন? চোখের সামনে তারা চুক্তির বিরোধিতা করছেন। তিন জেলা পরিষদও চুক্তি বিরোধিতায় রয়েছে। আমাদের রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তো আঞ্চলিক পরিষদের পাশ দিয়ে হাঁটাহাঁটি করেন, কিন্তু তিনি আঞ্চলিক পরিষদ কোথায়, ঠিকানা খুঁজে পান না।’
পাহাড়ে চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পার্বত্য এলাকার চেয়েও ঢাকায় চাঁদাবাজি বেশি হয়। ঢাকায় একটি ওয়ার্ডে যে চাঁদাবাজি হয়, গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামেও তো তা হয় না। কিন্তু, মিডিয়াতে এত ফলাওভাবে প্রচার করা হয়, মনে হয় পার্বত্যাঞ্চলে হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়! সন্ত্রাসের কথাও যদি বলা হয়, ঢাকার একটি ওয়ার্ডে সারা বছর যে সন্ত্রাস হয়, আমাদের ৩ পার্বত্য জেলা মিলেও সেই পরিমাণ সন্ত্রাস হয় না। শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ মহল এগুলো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করছে। আসল কাজটাকে আড়াল করার জন্য।’
পার্বত্য প্রতিমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, দীপংকর তালুকদার বিগত ৩বছর ধরে যে সব কথা বলে আসছেন, তার আগাও নাই, গোড়াও নাই। তিনি কি বলেন, তা তিনি নিজেও বোঝেন না বা বোঝার চেষ্টাও করেন না। তিনি যে মন্ত্রিপরিষদে আছেন, সেই মন্ত্রিপরিষদ এবং সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো অবস্থাতেই আন্তরিক নয়।’
No comments