রেড ক্যাপসিকাম by জেসমিন মুন্নী
ছোট গাছটির সাদা ফুল থেকে বেরিয়ে আসে হালকা সবুজ রঙের একটি মরিচ, তারপর আস্তে আস্তে টকটকে লাল। কোনো আঙিনায় না, ঢাকা শহরে সেটা কল্পনা করাও অস্বাভাবিক। গাছটি বেড়ে উঠেছে একটি মাঝারি মাটির টবে, দুই ফুট বাই পাঁচ ফুট একটি বারান্দায়। বারান্দাটি দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ হওয়ায় সেখানে সারাক্ষণ রোদের কোনো কমতি নেই। বাবা বলেছিল, ক্যাপসিকাম জন্মানোর জন্য ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রাই যথেষ্ট।' ভিনদেশি একটি গাছ নিজের আয়ত্তে
এনে ফুল থেকে ফল ফলানো বিশাল কিছু অর্জনের মতো মনে হলো। অনেক আকাঙ্ক্ষার পর আসা গর্ভের সন্তানটির মতো সেও ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিল।
ছোটবেলা থেকে শুনে আসছিলাম, মরিচগাছ আমাদের বংশে সহ্য হয় না। আমার বড় ফুপু মরিচ গাছ লাগিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়ার ঘটনা ছোটবেলা থেকে গল্পের মতো শুনে এলেও কুসংস্কার ভেবে উড়িয়ে দিতাম, আবার শঙ্কিতও হতাম, দোটানা মন নিয়ে ভাবতাম, কারণ ছাড়া এই পৃথিবীতে কিছুই ঘটে না। ভুরুতে ভাঁজ ফেলে বলতাম, তাঁর মৃত্যুর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল, বাবার মতো তাঁর রক্তেও কোলেস্টেরল বেশি ছিল অথবা রক্তের ভেইন সাধারণের চেয়ে এক-দেড় মিলিমিটার ন্যারো ছিল। তখন কে এতসব পরীক্ষা করিয়েছিল!
সব কিছু বুঝেশুনেও মরিচের দিকে তাকিয়ে আমার বেলা যেত, বমি বমি ভাব কেটে যেত। গোড়া পরিষ্কার করতাম, পাতাগুলো পানি সপ্রে করে টিস্যু পেপার দিয়ে মুছে দিতাম, একদিন পর একদিন পানি দিতাম, পর্যাপ্ত রোদ পায় কি না সেদিকে খেয়াল নিতাম। কাঁচি দিয়ে অপ্রয়োজনীয় পাতা কেটে দিতাম। এমনকি টবগুলোও ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে প্রতিদিন মুছতাম। অফিস করে এসে বুয়ার হাতের রান্না নাকে-মুখে দিয়ে গাছের কাছে বসে পড়তাম। গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিতাম। মরিচের বংশভূত হলেও ক্যাপসিকামকে বলতে গেলে এক প্রকার ক্যাবেজ কিংবা ব্রকলির মতো বিদেশি সবজি মনে হতো। প্রবল বাগান করার ইচ্ছাশক্তি থেকেই এ গাছ অ্যাডাপ্ট করা, এর আগে একই টবে ছিল বেশ পুরনো একটা ক্যাকটাস। ক্যাকটাসটি টেঙ্াস থেকে আসা আমার বড় চাচার কাছ থেকে এনেছিলাম। এর-ওর কাছ থেকে, বিভিন্ন নার্সারি ঘুরে প্রায় অর্ধশত ক্যাকটাস কালেকশনে ছিল। সেগুলো আমার ফ্ল্যাটের বারান্দা, করিডর, বসার ঘর, শোবার ঘরে সৌন্দর্য বর্ধন করছিল। গাছগুলো ঘরের একটি অংশের মতো হয়ে গিয়েছিল। মনে হতো, গাছগুলো আর কোথাও না, আমার ওইসব জায়গায় বেড়ে উঠতে পেরে নিজেদের জীবন আনন্দিত ও সার্থক মনে করত। রেহানেরও কোনো অভিযোগ ছিল না। হঠাৎ সেদিন কাইফের বার্থডে পার্টিতে তোরাবের মা শায়লা ভাবি ক্যাকটাসগুলো দেখে আঁতকে ওঠে! গলার স্বর প্রায় উঁচিয়ে সবাইকে ডেকে বলে, তাই তো বলি, ভাবির সংসারে কেন এত বিপদ লেগে থাকে! দ্যাখেন দ্যাখেন, এত ক্যাকটাস! ওমা, আপনি তো ধ্বংস হয়ে যাবেন? জানেন, ক্যাকটাস হচ্ছে দোজখের গাছ। ফল নেই, ফুল নেই, সারা শরীরে কী রকম বিচ্ছিরি কাঁটা! যেসব জিনিস পৃথিবীতে দোজখের নিদর্শন হিসেবে আছে, তার মধ্যে ক্যাকটাস একটা। হায়দ্রাবাদে আমার দাদুর পাশের বাড়ির মালেক সাহেবের পরিবার চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে গেছে একমাত্র এই ক্যাকটাসের জন্য!
ভয় ও আতঙ্ক-মিশ্রিত আমার অসহায় দৃষ্টিকে আরো অসহায় করার জন্য বলে, বিশ্বাস না হয় আপনি এক্ষুনি দাদুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমার ফ্যাকাসে মুখ দিয়ে অস্ফুটিতভাবে 'না' বের হতেই সে আরো একধাপ গলা চড়িয়ে বলে, আজই ছাইপাশ ফেলে দিন, তারপর দেখবেন ভাইয়ার প্রমোশন, আপনার পোস্টিং, আপনার সঙ্গে আন্টির সম্পর্ক সব ঠিক হয়ে গেছে।
নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। কেননা এসবই যা আমি নিজে উগরেছিলাম মুঠোফোনের মাধ্যমে তার কাছে, আজ জনসমক্ষে সে সুদসমেত ফেরত দিল সব গেস্টের সামনে, একদম বোকা বনে গেলাম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য মনে শক্তি সঞ্চার করে ভুরু কুঁঞ্চিত করে বললাম, না, মানে.. ক্যাকটাসে তো ফুল হয়... তা ছাড়া এ যুগে কুসংস্কার বিশ্বাস করা!'
মুরদের মতো ধমকের সুরে শায়লা ভাবি আমাকে থামিয়ে চোখ-মুখ উল্টিয়ে বলে, ফুল না ছাই! তার দৃষ্টি দেখে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। মা-ও এসব ক্ষেত্রে আমাদের চোখ দিয়ে শাষণ করত। ভাবি এবার শিক্ষকের রূপ নিলেন, বললেন, কথায় আছে না বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর। আপনার ভালো চাই বলে সাবধান করে দিলাম। বিশ্বাস-অবিশ্বাস আপনার ব্যাপার!'
ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন গাছের ব্যাপারে শুনতাম, যেমন মানিপ্লান্ট গাছ ঘরে থাকলে নাকি টাকা আসে, বকুলগাছে রাতের বেলায় পরীরা নাচে, হাসনাহেনা ফুলের ঘ্রাণে সাপ আসে...। বকুল ও হাসনাহেনা_দুটিই গাছই। আমার নানাবাড়িতে ছিল, কিন্তু জীবনে কেউ পরী কিংবা সাপ দেখেছে বলে শুনিনি। আমার মামার বাড়ির পুরনো কাজের মহিলা, যাকে জন্মের পর থেকে দেখে আসছি, যাকে আমরা সবাই খালা বলে সম্মোধন করতাম তার বাড়িতে প্রথম আমি কুলার মতো বিশাল সাইজের মানিপ্লান্টের পাতা দেখেছিলাম। কই, তার তো কোনো টাকা ছিল না, ভিটাটা ছাড়া! অবশ্য খালার মৃত্যুর পর তার ছেলে টিটু মামা আমেরিকার ডিভি পাওয়ার সুবাদে ভিটাটাও বিক্রি করে এখন আমেরিকান।
এসব কারণে মায়ের কাছে শোনা মরিচগাছ লাগানোর পরের দিন ফুপুর মৃত্যুর ঘটনাটা একটা দুর্ঘটনাই মনে হতো। উল্টো গাছের উপকারিতা সম্পর্কে নিজেকে পণ্ডিতাম্মন্য মনে করে সবাইকে জ্ঞান দিতাম। বলতাম, তোমরা ওসব বাজে কথা না ভেবে বরং পরিবেশ সংরক্ষণে এর অবদান ও ঔষধিগুণ সম্পর্কে ভাবো! গ্রিনহাউসের ব্যাপারে বোঝাতাম। আরো বলতাম, এত বড় বড় ব্যাপার বাদই দিলাম। একটি মরিচগাছ কোনো বাড়িতে থাকলে তাদের সারা বছর মরিচ কিনে খেতে হয় না। অনেকে যখন বলত, মরিচগাছের কথা বাদ দাও; ক্যাকটাস আমাদের কী উপকারে আসে তাই বলো? নিজেকে সামলে দৃঢ়তার সঙ্গে বলতাম, বড় চাচার কাছে শুনেছি, আমাদের দেশে এটা মানুষের শখের জিনিস হলেও বিভিন্ন দেশে এই ক্যাকটাস অনেক উপকারি গাছ। এরা শিকড়ের মধ্যে পানি সংগ্রহ করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। টেঙ্াসে হাজার বছরের ক্যাকটাস আছে..তা ছাড়া ভারতের রাজস্থানে তো একে মরুভূমির গোলাপ বলা হয়!...যাই হোক, যতই বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় পাস দিয়ে আসুক না কেন ক্যাকটাস সম্পর্কে শায়লা ভাবির কথাগুলো ছিল আমার মায়ের মতামতের মতোই। কথাগুলো শোনার পর আমারও মনের সব যুক্তিতর্ক মাথার মধ্যে টগবগ করতে থাকে। আমার কুসংস্কারে বিশ্বাস না থাকলেও টগবগিয়ে ওঠা বিশ্বাসগুলো ক্রমশ উপচে পড়ে মনকে ভাবায়িত করে, সন্দিহান করে... ব্যাপারগুলো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। শাশুড়ি রেহানা বেগমের বিশাল বাড়িতে এক কোণে পোর্চের ওপর ঝুলন্ত উদ্যানে আমার লাগানো ক্যাকটাসগুলো মানিয়ে গেলেও তাঁর হৃদয় ক্যাকটাসের কাঁটার খোঁচায় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিল। যেটা আমি টের পাইনি। একদিন ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবে রেহানা বেগম তার বোগেনভেলিয়ার গাছ ছাঁটতে গিয়ে কয়েকটি ক্যাকটাস কেটে ফেলে।
অফিস থেকে এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে এ রকম দৃশ্য দেখে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজের রাগ উপরে ফেললে রেহানা বেগমও ছেড়ে কথা বলে না। একসময় বলে ফেলে, ভালো না লাগলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও।' এভাবে শুরু এবং শেষ; তারপর আলাদা হওয়া। এই ক্যাকটাসই কি পরোক্ষভাবে দায়ী, না ঢাকা শহরে এই যুগে বউ-শাশুড়ি একই ছাদের নিচে দীর্ঘ পাঁচ বছর একসঙ্গে বসবাস করা সংসার বিভক্ত করার জন্য! যেখানে পশ্চিমা ধাঁচে বেড়ে ওঠা চাকরিজীবী মেয়েদের কাছে পরিবারের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়ে গেছে অনেক আগে। যারা মনে করে পরিবার মানে স্বামী-স্ত্রী ও বাচ্চা। এবং সেখানে পেট অ্যানিমেলের জন্য একটি রুম বরাদ্দ থাকলেও বাবা ও মায়ের জন্য কোনো রুম থাকে না। আমি অবশ্য সে বাতাসে পাল ওড়াইনি আমার মাকে দেখে। আমার মা সারা জীবন নিঃস্বার্থভাবে যৌথ পরিবারের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে গেছেন। আমাকে অনেক বোঝাবার পরও শুধু শাশুড়ির কথার তীক্ষ্ন জবাব দেওয়ার জন্য সেদিন বেরিয়ে এসেছিলাম স্বামী-সন্তান নিয়ে। এর জন্য অবশ্য একতরফাভাবে ক্যাকটাসকে দায়ী করা ঠিক হবে না। কারণ দেখালে হাজারটা দেখানো যাবে।.. তবুও আলাদা হয়ে আমার ভালোই লাগছিল। ফ্ল্যাটে ওঠার পর মনের মতো করে ক্যাকটাস কালেকশন করেছি। শুধু ক্যাকটাস না, ঘরের প্রতিটি কোনা মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজানোর মতো করে সাজিয়েছি। জীবনকে মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে উড়াল দিতে দিয়েছি নিজের আকাশে, উপভোগ করেছি প্রতিটি মুহূর্ত। সব কিছু ঠিকভাবেই চলছিল, শুধু চাকরিতে রেহানের প্রমোশন এবং আমার বনানী থেকে উত্তরায় পোস্টিং হলে কাইফকে অনেক বেশি সময় দিতে পারব এসব সুবিধার কথা ভেবে উচ্চপদস্থ কয়েকজনকে তোষামোদে ব্যস্ত ছিলাম। ঠিক সেই কয়টা দিন বিষয়টা নিয়ে বোকার মতো কিছুটা মাত্রাতিরিক্তভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম বলে কয়েকজনের কানে চলে গিয়েছিল। সুযোগমতো শায়লা ভাবি আমার কাঁটা ঘায়ে লবণের ছিটা দিয়ে গেল। ক্যাকটাসের কথা বাদ দিলাম, তারও প্রায় কয়েক বছর আগে বাবার কারণে ১০ বছরের বনসাইটি নিজ হাতে ধ্বংস করতে হয়েছিল পেটে সন্তান আসায়। দীর্ঘ কয়েক বছরের পরিচর্চায় গাছটি বিকশিত হয়েছিল আমার মতো করে, তার নিজের মতো করে না। পুরাণ চীন-জাপানের সাধকদের ধৈর্যের পরিচায়ক বনসাই চর্চায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম এমএ পরীক্ষার পর। বাবা যখন তার সময় আঙুর ফুলে কলাগাছ হওয়া ব্যাংক মালিক বন্ধুদের কাছে আমার চাকরির জন্য ও ম্যাচ ম্যাকিং প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিয়ের ব্যাপারে ঘুরে ঘুরে জুতার তলা ক্ষয় করছিল, তখন অলস সময় পার করার জন্য বনসাই ট্রেনিং শেষে একটি বটগাছকে বাড়ির কার্নিশ থেকে তুলে এনে পরিচর্চা শুরু করলাম। বনসাই চর্চার পাঁচ বছর পর চাকরি ও বিয়ে একই বছর হলে, তারও পাঁচ বছরের মাথায় অনেক চেষ্টার পর সন্তান পেটে এল, ৫+৫=১০ বছরের সাধনার সম্পদ বনসাইকে হত্যা করেছিলাম নিজের স্বার্থের কারণে। স্বার্থ বলছি, কারণ যদি এমনটা না করতাম তাহলে আমার পেটের সন্তান নাকি বনসাইয়ের মতো হতো! হত্যা বলছি, কারণ আমি গাছটি উপড়ে ফেলেছিলাম। সেদিনের পর অনেক দিন নিজের বিবেকের তাড়নায় পরপর কয়েক রাত ঘুমাতে পারতাম না। স্বপ্নে দেখতাম, আমার পেটে একটি বনসাই বেড়ে উঠছে, যার হাত-পা ছোট ছোট, দেখতে একেবারে আমার বনসাইটির মতো। আমি বিস্ময় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকি, দেখি কী সুন্দর চোখ দিয়ে সে আমাকে দেখছে! আমার চোখের কোণ ভিজে ওঠে... একসময় মা কেঁদো না বলে তার হাতের মতো ডাল দিয়ে জড়িয়ে ধরলে আবেশে আমার সারা শরীর অবশ হয়ে যায়। একসময় তার মুখ থেকে স্পষ্ট কথা বের হয়। বলে, চল মা গাছ হয়ে যাই... মানুষ হয়ে জন্মাতে আমার ভালো লাগে না...। কোনো কিছু বোঝার আগেই অনুভব করি আমার পা থেকে শিকড় বেরিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরছে। চোখের সামনে সব ঘটছে অথচ শত চেষ্টা করেও এক চুল পরিমাণ নড়তে পারছিলাম না। মা... মা... বলে জোরে জোরে চিৎকার করলে সেও মা... মা.., করছিল। সবাই আমার পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ কেউ আমার কথা শুনছে না। বনসাই সন্তানটি মা... মা... বলে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেই যাচ্ছে, মা ভয় পেয়ো না, দেখবে গাছের জীবন কত পরম আনন্দের, কত চরম নিঃস্বার্থের! ...আমি নীরবে শরীরের সব শক্তি দিয়ে মাটি থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য প্রেশার দিলে দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো...। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, বিছানা ঘামে জবুথবু... চিৎকার করে সবাইকে জড়ো করলে দেখি, রক্তের চাপ বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। বিষয়টা নিয়ে সবাই বলাবলি করছিল, হিতে বিপরীত হলো না তো! বনসাইটা থাকলে কী এমন অসুবিধা হতো! এখন তো দেখি দুজনের প্রাণ নিয়ে টানাটানি!' যাই হোক, সেই যাত্রায় কোনো রকমে রক্ষা পেয়েছিলাম আর্লি অপারেশন করিয়ে। জন্মের পর কাইফকে দেখার জন্য উদগ্রীব হলে সবাই বলে, দেখো কী সুন্দর বাচ্চা! তবে নাকটা একেবারে পিনাকিউর মতো গাছের ডালের মতো লম্বা, তাই না! আমার বুকটা ধক করে ওঠে। দ্রুত কোলে নিয়ে খুঁটে খুঁটে দেখি, কোথাও স্বপ্নের সঙ্গে মিল আছে কি না। নাহ্! স্বস্তির নিঃশ্বাসে সেদিন পুরো হাসপাতাল কেঁপে উঠেছিল। কাইফের পঞ্চম জন্মদিনে শায়লা ভাবির বলা কথাগুলোর কয়েক দিন পর আবার অনেক প্রাণ একসঙ্গে হত্যা করতে হবে ভেবে কাজের মেয়েটাকে দিয়ে ক্যাকটাসের টবগুলো ছাদে পাঠিয়ে দিলাম? ভাবলাম, ফ্ল্যাটের ছাদে অযত্নে-অনাদরে গাছগুলো একসময় মরে যাবে। যদিও ক্যাকটাসে বেশি পানি না লাগলেও অতিরিক্ত পানিতে এবং অতিরিক্ত তাপে একসময় মরে যাবে ভাবতেই মনটা কেঁপে ওঠে? ৪০ বছর জীবনে গাছ নিয়ে আমাকে অনেক বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে_শুধু বনসাই আর ক্যাকটাস না, জায়গার অভাবে আম্রপালি ও ভাসুরের হজ থেকে নিয়ে আসা খেজুরের বিচি থেকে জন্ম নেওয়া সৌদি আরবের খেজুরের গাছকে চোখের সামনে মরে যেতে দেখেছি? আম্রপালি আমগাছের শখ ছিল বাবার, তাই আমটি খেয়ে আঁটিটি আলগোছে একটি টবে রেখেছিলাম চারা করে বাবাকে দেব বলে। কিছুদিন পর আঁটি ফেটে চারা বের হলে আমার সন্তান জন্ম দেওয়ার চেয়ে বেশি আনন্দ হতে থাকে? দেখতে দেখতে চোখের সামনে গাছটি বড় হতে থাকলে ব্যস্ত হয়ে পড়ি গাছটির ভবিষ্যৎ নিয়ে। তার জন্য একখণ্ড মাটি কোথায়, মাটি! ঢাকা শহরে সেটা আদৌ সম্ভব! বাবাকে বলি, এই নাও তোমার আমগাছ।'
বাবা হাঁ হয়ে বলে, এটা দিয়ে এখন কী করব!' কেননা বাবার বাড়ি ততদিনে বিল্ডার্সদের দয়ায় বিশাল আটতলা ফ্ল্যাট? এক ইঞ্চি জায়গাও চারদিকে ফাঁকা নেই। গ্রামের বাড়িতেও একখণ্ড মাটি নেই, সব বাপ-চাচার বংশধর আর কাঠগাছের দখলে। নিজের ফ্ল্যাটের টবে পড়ে থাকতে থাকতে পাতা লাল হয়ে কুঁকড়ে মরে গেল। তেমনিভাবে খেজুরগাছটিও। এদিকে ক্যাকটাসগুলো ঘর থেকে বের করে দেওয়ার পর কাকতালীয়ভাবে আমার সংসারে ম্যালা উন্নতি হতে থাকে স্বামীর প্রমোশন, আমার উত্তরা ব্রাঞ্চে পোস্টিং, নতুন গাড়ি, এমনকি আমার পুনরায় কনসেপ করা, যেটার জন্য আমি অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম? ভাবছিলাম, এবার একটা মেয়ে হলে মন্দ হয় না। ছেলে হোক মেয়ে হোক একটি সন্তানই যথেষ্ট_সরকারের এই স্লোগান বদলে দেওয়ার জন্য নতুন উদ্যমে মাঠে নামলাম। সফলও হলাম, সাড়ে তিন মাস কোনো রকম প্রবলেম ছাড়া কেরি করছিলাম... এত কিছুর পরও মনটা তৃপ্তি পেত না, যখন ঘরের ক্যাকটাসশূন্য জায়গাগুলোতে দৃষ্টি যেত। মনটা বিষাদে ভরে যেত, মনে হতো সব আছে তবুও কী যেন নেই! তখনই বৃক্ষ মেলা থেকে লাল-সবুজ-হলুদ ক্যাপসিকামের চারাগুলো এনেছিলাম। গাছগুলোকে নতুনভাবে পেয়ে আমার উচ্ছ্বাস দেখে রেহানও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
সেদিন সকালে বারান্দায় প্রতিদিন রুটিন অনুযায়ী ক্যাপসিকাম গাছগুলোর পাশাপাশি মানিপ্লান্ট গাছে পানি দিতে গিয়ে টাইলসে ডিসেম্বরের রাতে জমে থাকা শিশিরে পা পিছলে গেলে ধপ করে ফ্লোরে পড়ে যাই; কোমর প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে অজানা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে সারা দিন, একটু একটু ব্যথা থাকলেও বিকেলের রোদ রাতের গহ্বরে প্রবেশ করলে সেটা প্রচণ্ড রূপ নেয়। পেট ব্যথ্যা বাড়ে অসহনীয়ভাবে? রাতেই অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতাল, রাতেই ডিএনসি, শাশুড়ি-মা-স্বামী সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে কিভাবে তিন-চারদিন কাটিয়ে দিলাম বুঝতে পারলাম না, পঞ্চম দিন শীতের সকালে বারান্দায় কুয়াশায় ঘোলা হয়ে যাওয়া স্লাইডিং ডোরটা খুলে আমার বুকটা চমকে ওঠে...। মুহূর্তে মনে হল চিত হয়ে শুয়ে চাতক পাখির মতো গলা ফাটিয়ে আকাশটা নামিয়ে ফেলি। সারা শরীর ঘামে জবজব, রক্তশূন্য আমার সাদা চোখের পাতা বন্ধ হওয়ার আগে দেখি_কাত হয়ে পড়া টবের পাশে, গোড়াসহ তুলে ফেলা শুকনো গাছ আঁকড়ে শুয়ে আছে লাল ক্যাপসিকামটি।
ছোটবেলা থেকে শুনে আসছিলাম, মরিচগাছ আমাদের বংশে সহ্য হয় না। আমার বড় ফুপু মরিচ গাছ লাগিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়ার ঘটনা ছোটবেলা থেকে গল্পের মতো শুনে এলেও কুসংস্কার ভেবে উড়িয়ে দিতাম, আবার শঙ্কিতও হতাম, দোটানা মন নিয়ে ভাবতাম, কারণ ছাড়া এই পৃথিবীতে কিছুই ঘটে না। ভুরুতে ভাঁজ ফেলে বলতাম, তাঁর মৃত্যুর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল, বাবার মতো তাঁর রক্তেও কোলেস্টেরল বেশি ছিল অথবা রক্তের ভেইন সাধারণের চেয়ে এক-দেড় মিলিমিটার ন্যারো ছিল। তখন কে এতসব পরীক্ষা করিয়েছিল!
সব কিছু বুঝেশুনেও মরিচের দিকে তাকিয়ে আমার বেলা যেত, বমি বমি ভাব কেটে যেত। গোড়া পরিষ্কার করতাম, পাতাগুলো পানি সপ্রে করে টিস্যু পেপার দিয়ে মুছে দিতাম, একদিন পর একদিন পানি দিতাম, পর্যাপ্ত রোদ পায় কি না সেদিকে খেয়াল নিতাম। কাঁচি দিয়ে অপ্রয়োজনীয় পাতা কেটে দিতাম। এমনকি টবগুলোও ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে প্রতিদিন মুছতাম। অফিস করে এসে বুয়ার হাতের রান্না নাকে-মুখে দিয়ে গাছের কাছে বসে পড়তাম। গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিতাম। মরিচের বংশভূত হলেও ক্যাপসিকামকে বলতে গেলে এক প্রকার ক্যাবেজ কিংবা ব্রকলির মতো বিদেশি সবজি মনে হতো। প্রবল বাগান করার ইচ্ছাশক্তি থেকেই এ গাছ অ্যাডাপ্ট করা, এর আগে একই টবে ছিল বেশ পুরনো একটা ক্যাকটাস। ক্যাকটাসটি টেঙ্াস থেকে আসা আমার বড় চাচার কাছ থেকে এনেছিলাম। এর-ওর কাছ থেকে, বিভিন্ন নার্সারি ঘুরে প্রায় অর্ধশত ক্যাকটাস কালেকশনে ছিল। সেগুলো আমার ফ্ল্যাটের বারান্দা, করিডর, বসার ঘর, শোবার ঘরে সৌন্দর্য বর্ধন করছিল। গাছগুলো ঘরের একটি অংশের মতো হয়ে গিয়েছিল। মনে হতো, গাছগুলো আর কোথাও না, আমার ওইসব জায়গায় বেড়ে উঠতে পেরে নিজেদের জীবন আনন্দিত ও সার্থক মনে করত। রেহানেরও কোনো অভিযোগ ছিল না। হঠাৎ সেদিন কাইফের বার্থডে পার্টিতে তোরাবের মা শায়লা ভাবি ক্যাকটাসগুলো দেখে আঁতকে ওঠে! গলার স্বর প্রায় উঁচিয়ে সবাইকে ডেকে বলে, তাই তো বলি, ভাবির সংসারে কেন এত বিপদ লেগে থাকে! দ্যাখেন দ্যাখেন, এত ক্যাকটাস! ওমা, আপনি তো ধ্বংস হয়ে যাবেন? জানেন, ক্যাকটাস হচ্ছে দোজখের গাছ। ফল নেই, ফুল নেই, সারা শরীরে কী রকম বিচ্ছিরি কাঁটা! যেসব জিনিস পৃথিবীতে দোজখের নিদর্শন হিসেবে আছে, তার মধ্যে ক্যাকটাস একটা। হায়দ্রাবাদে আমার দাদুর পাশের বাড়ির মালেক সাহেবের পরিবার চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে গেছে একমাত্র এই ক্যাকটাসের জন্য!
ভয় ও আতঙ্ক-মিশ্রিত আমার অসহায় দৃষ্টিকে আরো অসহায় করার জন্য বলে, বিশ্বাস না হয় আপনি এক্ষুনি দাদুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমার ফ্যাকাসে মুখ দিয়ে অস্ফুটিতভাবে 'না' বের হতেই সে আরো একধাপ গলা চড়িয়ে বলে, আজই ছাইপাশ ফেলে দিন, তারপর দেখবেন ভাইয়ার প্রমোশন, আপনার পোস্টিং, আপনার সঙ্গে আন্টির সম্পর্ক সব ঠিক হয়ে গেছে।
নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। কেননা এসবই যা আমি নিজে উগরেছিলাম মুঠোফোনের মাধ্যমে তার কাছে, আজ জনসমক্ষে সে সুদসমেত ফেরত দিল সব গেস্টের সামনে, একদম বোকা বনে গেলাম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য মনে শক্তি সঞ্চার করে ভুরু কুঁঞ্চিত করে বললাম, না, মানে.. ক্যাকটাসে তো ফুল হয়... তা ছাড়া এ যুগে কুসংস্কার বিশ্বাস করা!'
মুরদের মতো ধমকের সুরে শায়লা ভাবি আমাকে থামিয়ে চোখ-মুখ উল্টিয়ে বলে, ফুল না ছাই! তার দৃষ্টি দেখে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। মা-ও এসব ক্ষেত্রে আমাদের চোখ দিয়ে শাষণ করত। ভাবি এবার শিক্ষকের রূপ নিলেন, বললেন, কথায় আছে না বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর। আপনার ভালো চাই বলে সাবধান করে দিলাম। বিশ্বাস-অবিশ্বাস আপনার ব্যাপার!'
ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন গাছের ব্যাপারে শুনতাম, যেমন মানিপ্লান্ট গাছ ঘরে থাকলে নাকি টাকা আসে, বকুলগাছে রাতের বেলায় পরীরা নাচে, হাসনাহেনা ফুলের ঘ্রাণে সাপ আসে...। বকুল ও হাসনাহেনা_দুটিই গাছই। আমার নানাবাড়িতে ছিল, কিন্তু জীবনে কেউ পরী কিংবা সাপ দেখেছে বলে শুনিনি। আমার মামার বাড়ির পুরনো কাজের মহিলা, যাকে জন্মের পর থেকে দেখে আসছি, যাকে আমরা সবাই খালা বলে সম্মোধন করতাম তার বাড়িতে প্রথম আমি কুলার মতো বিশাল সাইজের মানিপ্লান্টের পাতা দেখেছিলাম। কই, তার তো কোনো টাকা ছিল না, ভিটাটা ছাড়া! অবশ্য খালার মৃত্যুর পর তার ছেলে টিটু মামা আমেরিকার ডিভি পাওয়ার সুবাদে ভিটাটাও বিক্রি করে এখন আমেরিকান।
এসব কারণে মায়ের কাছে শোনা মরিচগাছ লাগানোর পরের দিন ফুপুর মৃত্যুর ঘটনাটা একটা দুর্ঘটনাই মনে হতো। উল্টো গাছের উপকারিতা সম্পর্কে নিজেকে পণ্ডিতাম্মন্য মনে করে সবাইকে জ্ঞান দিতাম। বলতাম, তোমরা ওসব বাজে কথা না ভেবে বরং পরিবেশ সংরক্ষণে এর অবদান ও ঔষধিগুণ সম্পর্কে ভাবো! গ্রিনহাউসের ব্যাপারে বোঝাতাম। আরো বলতাম, এত বড় বড় ব্যাপার বাদই দিলাম। একটি মরিচগাছ কোনো বাড়িতে থাকলে তাদের সারা বছর মরিচ কিনে খেতে হয় না। অনেকে যখন বলত, মরিচগাছের কথা বাদ দাও; ক্যাকটাস আমাদের কী উপকারে আসে তাই বলো? নিজেকে সামলে দৃঢ়তার সঙ্গে বলতাম, বড় চাচার কাছে শুনেছি, আমাদের দেশে এটা মানুষের শখের জিনিস হলেও বিভিন্ন দেশে এই ক্যাকটাস অনেক উপকারি গাছ। এরা শিকড়ের মধ্যে পানি সংগ্রহ করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। টেঙ্াসে হাজার বছরের ক্যাকটাস আছে..তা ছাড়া ভারতের রাজস্থানে তো একে মরুভূমির গোলাপ বলা হয়!...যাই হোক, যতই বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় পাস দিয়ে আসুক না কেন ক্যাকটাস সম্পর্কে শায়লা ভাবির কথাগুলো ছিল আমার মায়ের মতামতের মতোই। কথাগুলো শোনার পর আমারও মনের সব যুক্তিতর্ক মাথার মধ্যে টগবগ করতে থাকে। আমার কুসংস্কারে বিশ্বাস না থাকলেও টগবগিয়ে ওঠা বিশ্বাসগুলো ক্রমশ উপচে পড়ে মনকে ভাবায়িত করে, সন্দিহান করে... ব্যাপারগুলো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। শাশুড়ি রেহানা বেগমের বিশাল বাড়িতে এক কোণে পোর্চের ওপর ঝুলন্ত উদ্যানে আমার লাগানো ক্যাকটাসগুলো মানিয়ে গেলেও তাঁর হৃদয় ক্যাকটাসের কাঁটার খোঁচায় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিল। যেটা আমি টের পাইনি। একদিন ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবে রেহানা বেগম তার বোগেনভেলিয়ার গাছ ছাঁটতে গিয়ে কয়েকটি ক্যাকটাস কেটে ফেলে।
অফিস থেকে এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে এ রকম দৃশ্য দেখে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজের রাগ উপরে ফেললে রেহানা বেগমও ছেড়ে কথা বলে না। একসময় বলে ফেলে, ভালো না লাগলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও।' এভাবে শুরু এবং শেষ; তারপর আলাদা হওয়া। এই ক্যাকটাসই কি পরোক্ষভাবে দায়ী, না ঢাকা শহরে এই যুগে বউ-শাশুড়ি একই ছাদের নিচে দীর্ঘ পাঁচ বছর একসঙ্গে বসবাস করা সংসার বিভক্ত করার জন্য! যেখানে পশ্চিমা ধাঁচে বেড়ে ওঠা চাকরিজীবী মেয়েদের কাছে পরিবারের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়ে গেছে অনেক আগে। যারা মনে করে পরিবার মানে স্বামী-স্ত্রী ও বাচ্চা। এবং সেখানে পেট অ্যানিমেলের জন্য একটি রুম বরাদ্দ থাকলেও বাবা ও মায়ের জন্য কোনো রুম থাকে না। আমি অবশ্য সে বাতাসে পাল ওড়াইনি আমার মাকে দেখে। আমার মা সারা জীবন নিঃস্বার্থভাবে যৌথ পরিবারের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে গেছেন। আমাকে অনেক বোঝাবার পরও শুধু শাশুড়ির কথার তীক্ষ্ন জবাব দেওয়ার জন্য সেদিন বেরিয়ে এসেছিলাম স্বামী-সন্তান নিয়ে। এর জন্য অবশ্য একতরফাভাবে ক্যাকটাসকে দায়ী করা ঠিক হবে না। কারণ দেখালে হাজারটা দেখানো যাবে।.. তবুও আলাদা হয়ে আমার ভালোই লাগছিল। ফ্ল্যাটে ওঠার পর মনের মতো করে ক্যাকটাস কালেকশন করেছি। শুধু ক্যাকটাস না, ঘরের প্রতিটি কোনা মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজানোর মতো করে সাজিয়েছি। জীবনকে মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে উড়াল দিতে দিয়েছি নিজের আকাশে, উপভোগ করেছি প্রতিটি মুহূর্ত। সব কিছু ঠিকভাবেই চলছিল, শুধু চাকরিতে রেহানের প্রমোশন এবং আমার বনানী থেকে উত্তরায় পোস্টিং হলে কাইফকে অনেক বেশি সময় দিতে পারব এসব সুবিধার কথা ভেবে উচ্চপদস্থ কয়েকজনকে তোষামোদে ব্যস্ত ছিলাম। ঠিক সেই কয়টা দিন বিষয়টা নিয়ে বোকার মতো কিছুটা মাত্রাতিরিক্তভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম বলে কয়েকজনের কানে চলে গিয়েছিল। সুযোগমতো শায়লা ভাবি আমার কাঁটা ঘায়ে লবণের ছিটা দিয়ে গেল। ক্যাকটাসের কথা বাদ দিলাম, তারও প্রায় কয়েক বছর আগে বাবার কারণে ১০ বছরের বনসাইটি নিজ হাতে ধ্বংস করতে হয়েছিল পেটে সন্তান আসায়। দীর্ঘ কয়েক বছরের পরিচর্চায় গাছটি বিকশিত হয়েছিল আমার মতো করে, তার নিজের মতো করে না। পুরাণ চীন-জাপানের সাধকদের ধৈর্যের পরিচায়ক বনসাই চর্চায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম এমএ পরীক্ষার পর। বাবা যখন তার সময় আঙুর ফুলে কলাগাছ হওয়া ব্যাংক মালিক বন্ধুদের কাছে আমার চাকরির জন্য ও ম্যাচ ম্যাকিং প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিয়ের ব্যাপারে ঘুরে ঘুরে জুতার তলা ক্ষয় করছিল, তখন অলস সময় পার করার জন্য বনসাই ট্রেনিং শেষে একটি বটগাছকে বাড়ির কার্নিশ থেকে তুলে এনে পরিচর্চা শুরু করলাম। বনসাই চর্চার পাঁচ বছর পর চাকরি ও বিয়ে একই বছর হলে, তারও পাঁচ বছরের মাথায় অনেক চেষ্টার পর সন্তান পেটে এল, ৫+৫=১০ বছরের সাধনার সম্পদ বনসাইকে হত্যা করেছিলাম নিজের স্বার্থের কারণে। স্বার্থ বলছি, কারণ যদি এমনটা না করতাম তাহলে আমার পেটের সন্তান নাকি বনসাইয়ের মতো হতো! হত্যা বলছি, কারণ আমি গাছটি উপড়ে ফেলেছিলাম। সেদিনের পর অনেক দিন নিজের বিবেকের তাড়নায় পরপর কয়েক রাত ঘুমাতে পারতাম না। স্বপ্নে দেখতাম, আমার পেটে একটি বনসাই বেড়ে উঠছে, যার হাত-পা ছোট ছোট, দেখতে একেবারে আমার বনসাইটির মতো। আমি বিস্ময় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকি, দেখি কী সুন্দর চোখ দিয়ে সে আমাকে দেখছে! আমার চোখের কোণ ভিজে ওঠে... একসময় মা কেঁদো না বলে তার হাতের মতো ডাল দিয়ে জড়িয়ে ধরলে আবেশে আমার সারা শরীর অবশ হয়ে যায়। একসময় তার মুখ থেকে স্পষ্ট কথা বের হয়। বলে, চল মা গাছ হয়ে যাই... মানুষ হয়ে জন্মাতে আমার ভালো লাগে না...। কোনো কিছু বোঝার আগেই অনুভব করি আমার পা থেকে শিকড় বেরিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরছে। চোখের সামনে সব ঘটছে অথচ শত চেষ্টা করেও এক চুল পরিমাণ নড়তে পারছিলাম না। মা... মা... বলে জোরে জোরে চিৎকার করলে সেও মা... মা.., করছিল। সবাই আমার পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ কেউ আমার কথা শুনছে না। বনসাই সন্তানটি মা... মা... বলে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেই যাচ্ছে, মা ভয় পেয়ো না, দেখবে গাছের জীবন কত পরম আনন্দের, কত চরম নিঃস্বার্থের! ...আমি নীরবে শরীরের সব শক্তি দিয়ে মাটি থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য প্রেশার দিলে দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো...। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, বিছানা ঘামে জবুথবু... চিৎকার করে সবাইকে জড়ো করলে দেখি, রক্তের চাপ বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। বিষয়টা নিয়ে সবাই বলাবলি করছিল, হিতে বিপরীত হলো না তো! বনসাইটা থাকলে কী এমন অসুবিধা হতো! এখন তো দেখি দুজনের প্রাণ নিয়ে টানাটানি!' যাই হোক, সেই যাত্রায় কোনো রকমে রক্ষা পেয়েছিলাম আর্লি অপারেশন করিয়ে। জন্মের পর কাইফকে দেখার জন্য উদগ্রীব হলে সবাই বলে, দেখো কী সুন্দর বাচ্চা! তবে নাকটা একেবারে পিনাকিউর মতো গাছের ডালের মতো লম্বা, তাই না! আমার বুকটা ধক করে ওঠে। দ্রুত কোলে নিয়ে খুঁটে খুঁটে দেখি, কোথাও স্বপ্নের সঙ্গে মিল আছে কি না। নাহ্! স্বস্তির নিঃশ্বাসে সেদিন পুরো হাসপাতাল কেঁপে উঠেছিল। কাইফের পঞ্চম জন্মদিনে শায়লা ভাবির বলা কথাগুলোর কয়েক দিন পর আবার অনেক প্রাণ একসঙ্গে হত্যা করতে হবে ভেবে কাজের মেয়েটাকে দিয়ে ক্যাকটাসের টবগুলো ছাদে পাঠিয়ে দিলাম? ভাবলাম, ফ্ল্যাটের ছাদে অযত্নে-অনাদরে গাছগুলো একসময় মরে যাবে। যদিও ক্যাকটাসে বেশি পানি না লাগলেও অতিরিক্ত পানিতে এবং অতিরিক্ত তাপে একসময় মরে যাবে ভাবতেই মনটা কেঁপে ওঠে? ৪০ বছর জীবনে গাছ নিয়ে আমাকে অনেক বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে_শুধু বনসাই আর ক্যাকটাস না, জায়গার অভাবে আম্রপালি ও ভাসুরের হজ থেকে নিয়ে আসা খেজুরের বিচি থেকে জন্ম নেওয়া সৌদি আরবের খেজুরের গাছকে চোখের সামনে মরে যেতে দেখেছি? আম্রপালি আমগাছের শখ ছিল বাবার, তাই আমটি খেয়ে আঁটিটি আলগোছে একটি টবে রেখেছিলাম চারা করে বাবাকে দেব বলে। কিছুদিন পর আঁটি ফেটে চারা বের হলে আমার সন্তান জন্ম দেওয়ার চেয়ে বেশি আনন্দ হতে থাকে? দেখতে দেখতে চোখের সামনে গাছটি বড় হতে থাকলে ব্যস্ত হয়ে পড়ি গাছটির ভবিষ্যৎ নিয়ে। তার জন্য একখণ্ড মাটি কোথায়, মাটি! ঢাকা শহরে সেটা আদৌ সম্ভব! বাবাকে বলি, এই নাও তোমার আমগাছ।'
বাবা হাঁ হয়ে বলে, এটা দিয়ে এখন কী করব!' কেননা বাবার বাড়ি ততদিনে বিল্ডার্সদের দয়ায় বিশাল আটতলা ফ্ল্যাট? এক ইঞ্চি জায়গাও চারদিকে ফাঁকা নেই। গ্রামের বাড়িতেও একখণ্ড মাটি নেই, সব বাপ-চাচার বংশধর আর কাঠগাছের দখলে। নিজের ফ্ল্যাটের টবে পড়ে থাকতে থাকতে পাতা লাল হয়ে কুঁকড়ে মরে গেল। তেমনিভাবে খেজুরগাছটিও। এদিকে ক্যাকটাসগুলো ঘর থেকে বের করে দেওয়ার পর কাকতালীয়ভাবে আমার সংসারে ম্যালা উন্নতি হতে থাকে স্বামীর প্রমোশন, আমার উত্তরা ব্রাঞ্চে পোস্টিং, নতুন গাড়ি, এমনকি আমার পুনরায় কনসেপ করা, যেটার জন্য আমি অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম? ভাবছিলাম, এবার একটা মেয়ে হলে মন্দ হয় না। ছেলে হোক মেয়ে হোক একটি সন্তানই যথেষ্ট_সরকারের এই স্লোগান বদলে দেওয়ার জন্য নতুন উদ্যমে মাঠে নামলাম। সফলও হলাম, সাড়ে তিন মাস কোনো রকম প্রবলেম ছাড়া কেরি করছিলাম... এত কিছুর পরও মনটা তৃপ্তি পেত না, যখন ঘরের ক্যাকটাসশূন্য জায়গাগুলোতে দৃষ্টি যেত। মনটা বিষাদে ভরে যেত, মনে হতো সব আছে তবুও কী যেন নেই! তখনই বৃক্ষ মেলা থেকে লাল-সবুজ-হলুদ ক্যাপসিকামের চারাগুলো এনেছিলাম। গাছগুলোকে নতুনভাবে পেয়ে আমার উচ্ছ্বাস দেখে রেহানও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
সেদিন সকালে বারান্দায় প্রতিদিন রুটিন অনুযায়ী ক্যাপসিকাম গাছগুলোর পাশাপাশি মানিপ্লান্ট গাছে পানি দিতে গিয়ে টাইলসে ডিসেম্বরের রাতে জমে থাকা শিশিরে পা পিছলে গেলে ধপ করে ফ্লোরে পড়ে যাই; কোমর প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে অজানা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে সারা দিন, একটু একটু ব্যথা থাকলেও বিকেলের রোদ রাতের গহ্বরে প্রবেশ করলে সেটা প্রচণ্ড রূপ নেয়। পেট ব্যথ্যা বাড়ে অসহনীয়ভাবে? রাতেই অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতাল, রাতেই ডিএনসি, শাশুড়ি-মা-স্বামী সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে কিভাবে তিন-চারদিন কাটিয়ে দিলাম বুঝতে পারলাম না, পঞ্চম দিন শীতের সকালে বারান্দায় কুয়াশায় ঘোলা হয়ে যাওয়া স্লাইডিং ডোরটা খুলে আমার বুকটা চমকে ওঠে...। মুহূর্তে মনে হল চিত হয়ে শুয়ে চাতক পাখির মতো গলা ফাটিয়ে আকাশটা নামিয়ে ফেলি। সারা শরীর ঘামে জবজব, রক্তশূন্য আমার সাদা চোখের পাতা বন্ধ হওয়ার আগে দেখি_কাত হয়ে পড়া টবের পাশে, গোড়াসহ তুলে ফেলা শুকনো গাছ আঁকড়ে শুয়ে আছে লাল ক্যাপসিকামটি।
No comments