নগরজীবন-ভূমিকম্প ও মহাদূষণের মুখোমুখি ঢাকা by আসিফ

শহরের অবকাঠামো যেভাবে গড়ে উঠেছে তাতে ভূমিকম্প হলে এর উদ্ধার কাজ অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর সে ধরনের দক্ষ মানবশক্তি ও টেকনিক্যাল সাপোর্টের ব্যবস্থাএকদম এখানে নেইট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিল। সুন্দরী হেলেন চুরির অপরাধে নয়, ভূমিকম্পে। সেও প্রায় দশম শতাব্দীর আগের কথা। খ্রিস্টপূর্ব ৭৯ সালে পম্পেই নগরী ধ্বংস হয়েছিল আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে নিনেভ শহর ধ্বংস হয় রাজ্য পরিচালনা ও যুদ্ধের


কারণে। ইনকা সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল দুই ভাইয়ের ক্ষমতার লোভে। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের রোম ছিল অস্থির। শুধু ক্ষমতার পালাবদল চলেছে। রোমের একেকটা এলাকা পাঁচ-ছয়তলা ভবনের শহরে পরিণত হয়েছিল। আর রাস্তাগুলো এতটাই সংকীর্ণ যে, সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারত না। গরিবরা চিলেকোঠায়, মাটির তলার ঘরে ঠাসাঠাসি করে বাস করত। এসব ঘরের ভেতর ভালো ছিল না। ফলে প্রায়ই ভেঙে পড়ত। আর আগুন লেগে ধ্বংস হতো একেকটি ভবন। এটা ঘটত ঘন ঘন। ফলে ভূমিধস আর আগুনে ক্ষয়ে যেতে থাকে রোমের সর্বশক্তি। এভাবেই ক্ষয়ে যাচ্ছে ঢাকা।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর রোববার রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের আঘাত এ কথাই বলছে, কত পলকা আমাদের অবস্থান। বঙ্গোপসাগরের আড়াই হাজার কিলোমিটারের ফাটল আরও মারাত্মক করছে সংকটকে। সে সঙ্গে তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায় বহুতল ভবনের পাইলিংয়ের সময় ধসেপড়া আশপাশের চারটি ভবন, দুটি পাঁচতলাসহ ১২টি ভবনে ফাটল দেখা দেওয়া তারই জানান দিচ্ছে। ফাটলের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সামনের রাস্তাঘাট। এ রকম ঘটনা ক্রমে বেড়েই চলেছে : বেগুনবাড়ীতে ৭ তলা ধসে ২৫ জনের মৃত্যু, শান্তিনগরের ২২ তলা কনকর্ড ভবনে ফাটল, অগি্নদগ্ধ স্পেকট্রাম এবং নিমতলীতে অগি্নকাণ্ডে ১১৯ জন নিহত। এ ঘটনাগুলো বলছে, মৃত্যু আমাদের সনি্নকটে।
ধারণা করা হয়, ইন্দাস নদীর গতিপথ পরিবর্তন, সরস্বতী বা ঘাগর-হাকরা নদীর জল শুকিয়ে যাওয়াই ৫ হাজার বছরের প্রাচীন মহেঞ্জোদারোর মহামৃত্যুর কারণ। সম্ভবত পয়ঃপ্রণালী নিষ্কাশনে ব্যাঘাত ঘটেছিল। ৩০ হাজার মানুষের মহেঞ্জোদারো ধ্বংস হয়েছিল এভাবে। অভিধানে মহেঞ্জোদারোর মানে কী? কম্পিত কণ্ঠে বলি, মরা মানুষের হিমালয় (মাউন্ট অব ডেথ)। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর শহর হরপ্পাও ধ্বংস হয়েছিল নদীর গতিপথ পাল্টে। এর অধিবাসীরা আমাদের মতোই প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংস করে ফেলে। ঢাকাও এ রকম একটি শহর, যা গত ৪০ বছরে ৩৪ খাল ও ৭টি নদী ভরাট ও স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানী ড. আলী আসগর বলেন, 'এ রকম একটি শহরের টিকে থাকাই কঠিন। সে ক্ষেত্রে ঢাকা ভাগ্যবান।' এদিকে ঢাকা শহরে এখন প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বসবাস করে। আরও ৬৫ লাখ লোক এখানে কাজকর্ম সেরে আবার ফিরে যায়। পয়ঃপ্রণালী নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে মাত্র ২০ লাখ মানুষের। তাহলে বাকি অংশ যায় কোথায়? এসব তথ্য ইঙ্গিত দেয় :যে কোনো সময় অশনাক্ত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়তে পারে। ঘটিয়ে দিতে পারে মহামারী।
সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের সিকিম প্রদেশ। এখনও সিকিমে ভূমিধস হচ্ছে। পাহাড় ধসে পড়ছে। মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯০। ৬ দশমিক ৮ মাত্রার রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পের ঝাপটায় বাংলাদেশ দুলে উঠেছিল। ১ মিনিট স্থায়ী ছিল এ কম্পনটি। পাহাড়ি এলাকার সিকিমে স্বল্প জনবসতি। তাই ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি কেন? যদিও এ ঘটনায় দেশের নানা জায়গায় ভবন হেলে পড়ে ফাটল ধরার সংবাদ পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর উৎপত্তিস্থল ৪৯৫ কিলোমিটার দূরে, মাটির ২০ কিলোমিটার গভীরে। তাই এত দূরে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটাতে পারেনি। আবার অনেকে বলছেন, ঢাকা বালি ও পলিমাটির কারণে অনেক ভাগ্যবান। নয়তো ভূমিকম্প ছাড়া এর নির্মাণ সামগ্রী এবং প্রক্রিয়ার কারণে আরও অনেক বাড়ি দেবে যাওয়া বা ফাটলজনিত কারণে ধসে যেত। ভূতাত্তি্বকরা বলছেন, আসাম-সিকিম ফল্টে যে ভূমিকম্প হচ্ছে তা ঢাকার জন্য ততটা বিপজ্জনক নয়, যতটা বিপজ্জনক মধুপুর, ডাউকি, সীতাকুণ্ড মিয়ানমার-টেকনাফ সাবডাকশন ফল্ট, সিলেট ও বগুড়া ফল্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতারের মতে, ডাউকি ফল্টে ভূকম্পনের পর অতিবাহিত হয়েছে ১১২ বছর; মধুপুর ফল্টে ১২৪ বছর এবং টেকনাফ সাবডাকশন ফল্টে ২৪৭ বছর। একই জায়গায় আবার একটি বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে সময় লাগে গড় হিসাবে ১০০ থেকে ৫০০ বছর। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে। মূলত হিমালয় নড়ে ওঠার কারণেই এই অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ১৯৭৬ সাল থেকে এই অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সম্প্রতি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, ভূমিকম্পের জন্য বর্তমানে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকা মৃত নগরীতে পরিণত হবে।
এ শহরে ইতিমধ্যে যে পরিমাণ ভবন থাকা প্রয়োজন তার চেয়ে ছয়গুণ বেশি আছে। ১১ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে অবিরামভাবে। বিখ্যাত হাইড্রোলজিস্ট ড. কাজী মতিনের মতে, সরকার ১৯৯৭ সালে প্রস্তাবিত বিল্ডিং কোড বিধিমালা আইন পাস করে ২০০৬ সালে। কিন্তু ভূমিকম্পন ডাটা ও প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই বিধিমালা প্রয়োগ করা হয়নি। ২০ বছরের মধ্যে যেসব স্থাপনা বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হয়েছে তাও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। কারণ মাটির অভ্যন্তরে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় একদিকে যেমন মারাত্মক আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত মানুষ, অন্যদিকে মাটির গুণাগুণ পরিবর্তনে ইঞ্জিনিয়ারিং প্যারামিটারগুলো বদলে যাচ্ছে। ফলে সেগুলোও ঝুঁঁকির মধ্যে পড়ে গেছে।
এ শহরের অবকাঠামো যেভাবে গড়ে উঠেছে তাতে ভূমিকম্প হলে এর উদ্ধার কাজ অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর সে ধরনের দক্ষ মানবশক্তি ও টেকনিক্যাল সাপোর্টের ব্যবস্থা একদম এখানে নেই। একটা বিল্ডিং ধসে পড়লে, আগুন লেগে গেলে, লঞ্চ ডুবে গেলেও তা উদ্ধারে দিনের পর দিন লাগে। সম্প্রতি ৬২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তৈরির কথা সরকার বলছে, কিন্তু তার গতি খুবই নৈরাশ্যজনক। উল্লেখ্য, ১৩ জানুয়ারি ২০১০-এ ৭ দশমিক ২ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের আঘাতে হাইতির পুরো রাজধানী ধুলো আর ধোঁয়ায় ঢেকে যায় এবং একেবারে লণ্ডভণ্ড অবস্থার সৃষ্টি হয়। টেলিফোন সংযোগ, যোগাযোগ এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এই ধ্বংসযজ্ঞে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় লক্ষাধিক লোকের। আড়াই লাখ মানুষ নিখোঁজ হয়। দেশটির প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনায় গোটা ব্যবস্থার অসঙ্গতি ও দুর্নীতি যে কত গভীর ছিল তা সহজেই বোঝা যায়। মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে, হাইতির কর্ণধারদের ২০০৮ সালের মার্চেই বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পের আঘাত হানার যে ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে সতর্ক করেছিলেন, প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেনি। বাংলাদেশেও গত ৪০ বছরের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা, ভূমিদস্যুতা, দ্রুত ধনী হওয়ার প্রক্রিয়ার কারণে সে রকম পরিস্থি্থতির মধ্যে চলে গেছে ঢাকা। এক রাতের বৃষ্টির পানি জমার পরিমাণ আর নিয়মিত যানজট বলে দিচ্ছে, ঢাকার প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ কত দুর্বল হয়ে পড়েছে!
জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত ঢাকা বাঁচবে কেমন করে? বিখ্যাত প্রকৃতিবিদ ও সমাজতাত্তি্বক দ্বিজেন শর্মা বলেছেন, বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া উপায় নেই। দেশব্যাপী কর্মক্ষেত্রকে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে ক্ষতি কম হতে পারে। কিন্তু এটা রাজনৈতিক সরকার করবে, না মারাত্মক লোকক্ষয়ের মধ্য দিয়ে ভূমিকম্প নিজেই সে পথ করে নেবে_ তা সময়ই বলে দেবে।

আসিফ : সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.