ঝকঝকে ও আধুনিক রশীদ করীম by জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান শিল্পী রশীদ করীম সদ্যপ্রয়াত হয়েছেন। উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধে তার ধ্রুপদী সামর্থ্য কাল পেরিয়ে তাকে উজ্জ্বল রাখবে, এ কথা নিশ্চিত। রশীদ করীমের প্রতি'কালের খেয়া'র বিনম্র শ্রদ্ধা ...
ঔপন্যাসিক রশীদ করীমের মূল শক্তির জায়গা ছিল তার ভাষা। যে জীবনকে তিনি উপন্যাসের শিল্পিতরূপে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন সে জন্য উপযুক্ত ভাষাভঙ্গিও তৈরি করে নিয়েছেন, যা ঝকঝকে ও আধুনিক, শাণিত তরবারির মতো
ঔপন্যাসিক রশীদ করীমের মূল শক্তির জায়গা ছিল তার ভাষা। যে জীবনকে তিনি উপন্যাসের শিল্পিতরূপে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন সে জন্য উপযুক্ত ভাষাভঙ্গিও তৈরি করে নিয়েছেন, যা ঝকঝকে ও আধুনিক, শাণিত তরবারির মতো
প্রচলবদ্ধতার বৃত্ত ছিন্ন করে দেয়।রশীদ করীম চলে গেলেন ৮৬ বছর বয়সে। বয়সের দিক থেকে তিনি আমার তিন বছরের জ্যেষ্ঠ ছিলেন। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। শুরুটা অনেক আগের, ঠিক কতদিন আগের তা আজ স্পষ্ট করে বলতে পারছি না। তবে বেশ আগের। তখন তিনি একটি বিদেশি তেল কোম্পানির বড় কর্মকর্তা। যদ্দুর মনে পড়ে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছিল আমাদের দু'জনের বন্ধু সৈয়দ আলী কবিরের মধ্যস্থতায়। সৈয়দ আলী কবিরের সঙ্গে তার আত্মীয়তা ছিল। কলকাতায় তাদের দু'জনেরই শৈশব কেটেছিল। আলী কবির আমার বন্ধু ছিলেন এবং রশীদ করীম আমার বন্ধু হলেন।
দেশ ভাগের পর যখন তিনি এ দেশে আসেন, তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে তার সাহিত্যিক পরিচয় গড়ে ওঠেনি। কিন্তু তার প্রথম উপন্যাস 'উত্তম পুরুষ' আদমজী পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি সবার নজরে এলেন। দু'বছরের মাথায় তার আরও একটি উপন্যাস 'প্রসন্ন পাষাণ' প্রকাশিত হয়। দুটি উপন্যাসেরই মূল উপজীব্য হলো কলকাতা। বিশেষ করে কলকাতাবাসী মুসলিম সমাজ, যে সমাজ থেকে এসেছেন। এমন একটি পরিচয় তিনি তুলে ধরলেন সে সমাজের, যে কাজটি এর আগে বাংলা সাহিত্যে কেউ তেমনভাবে করতে পারেননি।
'উত্তম পুরুষ' আর 'প্রসন্ন পাষাণ' উপন্যাস দুটি রচনার পর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে, প্রায় ১০ বছর পর তিনি আরও একটি উপন্যাস রচনা করলেন। যার নাম 'আমার যত গ্গ্নানি'। এ উপন্যাসে ঢাকার নাগরিক সমাজ তার মূল উদ্দেশ্য। সমসাময়িকতার কারণে রাজনীতি এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে। সে সময় ও সমাজের কথা তার মতো আমাদের আর কোনো সাহিত্যিক তুলে ধরতে পারেননি। এরপর বিরতি দিয়ে দিয়ে তিনি আরও বেশ কয়েকটি উপন্যাস রচনা করলেন। সেগুলো হচ্ছে_ প্রেম একটি লাল গোলাপ, সাধারণ লোকের কাহিনী, একালের রূপকথা, সোনার পাথরবাটি, বড়ই নিঃসঙ্গ, মায়ের কাছে যাচ্ছি, চিনি না, পদতলে রক্ত ও লাঞ্চবক্স। প্রতিটি উপন্যাসই লিখেছেন দীর্ঘ সময় নিয়ে, উপলব্ধির গভীরে ডুব দিয়ে যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাস তুলে আনতে।
রশীদ করীমের প্রায় সব উপন্যাসের মূল বিষয় হচ্ছে প্রেম ও নারী-পুরুষের সম্পর্ক এবং মানবিক সম্পর্কের বির্বতন। নরনারীর সম্পর্কের আর্তি, আনন্দ-বেদনা, মোহ-বাসনা সবকিছু তিনি যে অন্তরঙ্গ কথকতার ভঙ্গিতে তুলে এনছেন তা একান্ত দুর্লভ। নির্মোহভাবে তিনি বিচার করেছেন ব্যক্তিসত্তার আলো-আঁধারির জটিল খেলা। তবে এসবের উপস্থাপনে তিনি সব সময় দেখিয়েছেন আশ্চর্য পরিমিতি ও শিল্পবোধ। উপন্যাসের চরিত্রগুলো তিনি আহরণ করতেন নিকটাত্মীয়- স্বজন ও ঘনিষ্ঠ মহল থেকে। তাদের জীবনযাপন, আচার-ব্যবহারকে তিনি ভিন্নমাত্রা দিয়েছেন উপন্যাসের মাঝে। তার উপন্যাসের বৃত্ত নাগরিক ও নাগরিক সমাজের মধ্য ও ওপর মহলের বাসিন্দাদের জীবন অভিজ্ঞতা। এ পরিসরটি তার একান্ত চেনা।
বিরলপ্রজ ঔপন্যাসিক রশীদ করীমের মূল শক্তির জায়গা ছিল তার ভাষা। যে জীবনকে তিনি উপন্যাসের শিল্পিতরূপে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন সে জন্য উপযুক্ত ভাষাভঙ্গিও তৈরি করে নিয়েছেন, যা ঝকঝকে ও আধুনিক, শাণিত তরবারির মতো প্রচলবদ্ধতার বৃত্ত ছিন্ন করে দেয়। ভাষা ও তার ব্যবহারে তিনি ছিলেন খুবই সংবেদনশীল। ভাষা নিয়ে কথায় কথায় তিনি একবার কলকাতার ঔপন্যাসিক সমরেশ বসুর কথা বলেছিলেন। তার মতে, সমরেশ বসু নিজস্ব ভাষা তৈরি করেছিলেন। যা পরবর্তী সময়ে বেশ আলোচিত হয়েছিল। বৈঠকী ঢঙে এমন ভাষারীতি আমাদের এখানে রশীদ করীমের হাতেই সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি নিজেও এ ব্যাপারে একমত ছিলেন।
কলকাতায় থাকাকালে তার সঙ্গে বেশ বিখ্যাত দু'জন সাহিত্যিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। তারা হলেন সৈয়দ আলী আহসান ও আবু সায়ীদ আইয়ুব। এ ছাড়া তার বড় ভাই আবু রুশদের সঙ্গে তৎকালীন কবি-সাহিত্যিকদের যোগাযোগ ছিল। সেই সুবাদে অনেকের আসা-যাওয়া ছিল তার বাসায়। তাদের মধ্যে আছেন শওকত ওসমান, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদসহ বিখ্যাত আরও অনেকেই। খ্যাত-অখ্যাত এসব মানুষের সাহচর্য ও তাদের সানি্নধ্য তার জীবন-দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
চাকরির সুবাদে সমাজের ওপর মহলের সদস্যদের সঙ্গে রশীদ করীমের সম্পর্ক ছিল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেকেই ছিলেন দলে। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে তিনি তাদের জীবনাচরণ লক্ষ্য করতেন গভীরভাবে। এবং সেসব ঘটনা তুলে আনতেন নিজের লেখালেখিতে। তার রচনা জীবন-ঘনিষ্ঠ, এ কথা বলা যায় স্পষ্টভাবে।
রশীদ করীম তার সাহিত্যিক জীবনে বেশকিছু ছোটগল্প লিখেছেন। তার গল্পগুলো সম্পর্কে আমরা সে সময় তেমনভাবে জানতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে 'প্রথম প্রেম' শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি আমরা রশীদ করীমের কাছ থেকে অনেক প্রবন্ধও পেয়েছি। তিনটি প্রবন্ধ গ্রন্থ এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে_ আরেক দৃষ্টিকোণ, অতীত হয় নূতন পুনরায় ও মনের গহনে তোমার মূরতিখানি। তার উপন্যাসের মতো প্রবন্ধ নিয়েও অনেক কথা বলা যায়। তার প্রবন্ধগুলো একাডেমিক প্রবন্ধকারদের চেয়ে আলাদা। প্রবন্ধের দ্বারা তিনি বড় কথা বলেছেন ছোট গলায়। সব কথাই তিনি আনতে পারতেন কিন্তু কাউকে বুঝতে দিতেন না। নিজের মতো করে যা বুঝেছেন তা-ই লিখতেন সহজ ভাষায়। যার কিছুই ফেলে দেওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথের শ্যামা গীতিনাট্য নিয়ে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যেখানে আমরা দেখেছিলাম, তিনি আবু সায়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছেন। রশীদ করীম কাগজে বেশকিছু কলামও লিখেছেন। চলতি ঘটনার বিশ্লেষণ করেছেন নিজের মতো করে।
ব্যক্তিগত জীবনে রশীদ করীম ছিলেন স্পষ্টভাষী এবং বন্ধুবৎসল। সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং ১৯৮৪ সালে একুশে পদক লাভ করেন। পুরস্কারের ব্যাপারেও তার ছিল ভিন্নমত। কেউ সম্মান দিয়ে পুরস্কৃত করলে তা গ্রহণ করতেন নিদ্বর্িধায়। কিন্তু পুরস্কার লাভের আশায় কখনোই তাকে কারও কাছে ধরনা দিতে দেখিনি।
১৯৯২ সালে রশীদ করীম পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে আর নিয়মিত লিখতে পারেননি। সে অবস্থায় থেকেও তিনি 'জীবন মরণ' নামে একটি স্মৃতিকথা লিখলেন। অদ্ভুত ভালো লাগার মতো তার এই গ্রন্থটি। জীবনের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ফিরে তাকিয়েছেন তার বাল্য, কৈশোর ও প্রথম যৌবনের দিনগুলোর দিকে। দিনলিপি নয়, সমাজেতিহাস নয় বরং তিনি বলতে চেয়েছেন কিছু মানুষের কথা, তার আপনজন, বাল্যসখী, ভাই-বন্ধু-আত্মীয়দের কথা। সেই সূত্র ধরে চলি্লশের দশকের কলকাতার বিকাশশীল মুসলিম মধ্যবিত্ত ও অভিজাতজনের কথা। 'জীবন মরণ' গ্রন্থটিকে তিনি বলেছেন তার সোয়ান-সঙ্, বিষণ্নতার রেশ বহন করা শেষ জীবনের গান। যার মাধ্যমে এক হারিয়ে যাওয়া যুগের রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধময় পরিচয় লাভ করি।
আমি, রশীদ করীম আর শামসুর রাহমান তিনজন ছিলাম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমাদের অনেক স্মৃতি আর কথাবার্তা মনে পড়ছে আজ। বহু দিনের আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো আর আলোচনার মাঝে কেটে গেছে আমাদের অজস্র দিন। আমার লেখালেখিতে তিনি উৎসাহ জুগিয়েছেন অনেক। ভালো সমালোচক হিসেবে আমি পেয়েছি তাকে বহুবার। যেটা ভালো সেটার প্রশংসা করতেন। আবার যেটা তার কাছে ভালো লাগত না বা পছন্দ হতো না_ সে লেখার সমালোচনা করতেও কুণ্ঠা করতেন না।
অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আমি প্রায় তার বাসায় যেতাম। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের মাঝে আলোচনা হতো। মৃত্যুর আগের দিনও আমি তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তাকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে, সে খবরও আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই যে তিনি চলে যাবেন তা ভাবতে পারিনি।
আমাদের তিনজনের মাঝে শামসুর রাহমান চলে গেলেন সবার আগে। এরপর রশীদ করীম। আমি আর কতদিন থাকব জানি না। কিন্তু সাহিত্যের যারা একনিষ্ঠ পাঠক তারা রশীদ করীমের মর্যাদা দেবেন। তার যে বিশিষ্টতা সে কারণে তিনি আগামী দিনগুলোতেও আলো ছড়িয়ে যাবেন। তার মৃত্যুতে দেশ হারিছে একজন সেরা ঔপন্যাসিককে। আমি হারালাম একজন কাছের বন্ধুকে। যার শূন্যতা পূরণ হবে কি-না এ নিয়ে আমি সংশয়ে ভুগছি। া
দেশ ভাগের পর যখন তিনি এ দেশে আসেন, তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে তার সাহিত্যিক পরিচয় গড়ে ওঠেনি। কিন্তু তার প্রথম উপন্যাস 'উত্তম পুরুষ' আদমজী পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি সবার নজরে এলেন। দু'বছরের মাথায় তার আরও একটি উপন্যাস 'প্রসন্ন পাষাণ' প্রকাশিত হয়। দুটি উপন্যাসেরই মূল উপজীব্য হলো কলকাতা। বিশেষ করে কলকাতাবাসী মুসলিম সমাজ, যে সমাজ থেকে এসেছেন। এমন একটি পরিচয় তিনি তুলে ধরলেন সে সমাজের, যে কাজটি এর আগে বাংলা সাহিত্যে কেউ তেমনভাবে করতে পারেননি।
'উত্তম পুরুষ' আর 'প্রসন্ন পাষাণ' উপন্যাস দুটি রচনার পর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে, প্রায় ১০ বছর পর তিনি আরও একটি উপন্যাস রচনা করলেন। যার নাম 'আমার যত গ্গ্নানি'। এ উপন্যাসে ঢাকার নাগরিক সমাজ তার মূল উদ্দেশ্য। সমসাময়িকতার কারণে রাজনীতি এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে। সে সময় ও সমাজের কথা তার মতো আমাদের আর কোনো সাহিত্যিক তুলে ধরতে পারেননি। এরপর বিরতি দিয়ে দিয়ে তিনি আরও বেশ কয়েকটি উপন্যাস রচনা করলেন। সেগুলো হচ্ছে_ প্রেম একটি লাল গোলাপ, সাধারণ লোকের কাহিনী, একালের রূপকথা, সোনার পাথরবাটি, বড়ই নিঃসঙ্গ, মায়ের কাছে যাচ্ছি, চিনি না, পদতলে রক্ত ও লাঞ্চবক্স। প্রতিটি উপন্যাসই লিখেছেন দীর্ঘ সময় নিয়ে, উপলব্ধির গভীরে ডুব দিয়ে যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাস তুলে আনতে।
রশীদ করীমের প্রায় সব উপন্যাসের মূল বিষয় হচ্ছে প্রেম ও নারী-পুরুষের সম্পর্ক এবং মানবিক সম্পর্কের বির্বতন। নরনারীর সম্পর্কের আর্তি, আনন্দ-বেদনা, মোহ-বাসনা সবকিছু তিনি যে অন্তরঙ্গ কথকতার ভঙ্গিতে তুলে এনছেন তা একান্ত দুর্লভ। নির্মোহভাবে তিনি বিচার করেছেন ব্যক্তিসত্তার আলো-আঁধারির জটিল খেলা। তবে এসবের উপস্থাপনে তিনি সব সময় দেখিয়েছেন আশ্চর্য পরিমিতি ও শিল্পবোধ। উপন্যাসের চরিত্রগুলো তিনি আহরণ করতেন নিকটাত্মীয়- স্বজন ও ঘনিষ্ঠ মহল থেকে। তাদের জীবনযাপন, আচার-ব্যবহারকে তিনি ভিন্নমাত্রা দিয়েছেন উপন্যাসের মাঝে। তার উপন্যাসের বৃত্ত নাগরিক ও নাগরিক সমাজের মধ্য ও ওপর মহলের বাসিন্দাদের জীবন অভিজ্ঞতা। এ পরিসরটি তার একান্ত চেনা।
বিরলপ্রজ ঔপন্যাসিক রশীদ করীমের মূল শক্তির জায়গা ছিল তার ভাষা। যে জীবনকে তিনি উপন্যাসের শিল্পিতরূপে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন সে জন্য উপযুক্ত ভাষাভঙ্গিও তৈরি করে নিয়েছেন, যা ঝকঝকে ও আধুনিক, শাণিত তরবারির মতো প্রচলবদ্ধতার বৃত্ত ছিন্ন করে দেয়। ভাষা ও তার ব্যবহারে তিনি ছিলেন খুবই সংবেদনশীল। ভাষা নিয়ে কথায় কথায় তিনি একবার কলকাতার ঔপন্যাসিক সমরেশ বসুর কথা বলেছিলেন। তার মতে, সমরেশ বসু নিজস্ব ভাষা তৈরি করেছিলেন। যা পরবর্তী সময়ে বেশ আলোচিত হয়েছিল। বৈঠকী ঢঙে এমন ভাষারীতি আমাদের এখানে রশীদ করীমের হাতেই সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি নিজেও এ ব্যাপারে একমত ছিলেন।
কলকাতায় থাকাকালে তার সঙ্গে বেশ বিখ্যাত দু'জন সাহিত্যিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। তারা হলেন সৈয়দ আলী আহসান ও আবু সায়ীদ আইয়ুব। এ ছাড়া তার বড় ভাই আবু রুশদের সঙ্গে তৎকালীন কবি-সাহিত্যিকদের যোগাযোগ ছিল। সেই সুবাদে অনেকের আসা-যাওয়া ছিল তার বাসায়। তাদের মধ্যে আছেন শওকত ওসমান, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদসহ বিখ্যাত আরও অনেকেই। খ্যাত-অখ্যাত এসব মানুষের সাহচর্য ও তাদের সানি্নধ্য তার জীবন-দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
চাকরির সুবাদে সমাজের ওপর মহলের সদস্যদের সঙ্গে রশীদ করীমের সম্পর্ক ছিল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেকেই ছিলেন দলে। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে তিনি তাদের জীবনাচরণ লক্ষ্য করতেন গভীরভাবে। এবং সেসব ঘটনা তুলে আনতেন নিজের লেখালেখিতে। তার রচনা জীবন-ঘনিষ্ঠ, এ কথা বলা যায় স্পষ্টভাবে।
রশীদ করীম তার সাহিত্যিক জীবনে বেশকিছু ছোটগল্প লিখেছেন। তার গল্পগুলো সম্পর্কে আমরা সে সময় তেমনভাবে জানতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে 'প্রথম প্রেম' শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি আমরা রশীদ করীমের কাছ থেকে অনেক প্রবন্ধও পেয়েছি। তিনটি প্রবন্ধ গ্রন্থ এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে_ আরেক দৃষ্টিকোণ, অতীত হয় নূতন পুনরায় ও মনের গহনে তোমার মূরতিখানি। তার উপন্যাসের মতো প্রবন্ধ নিয়েও অনেক কথা বলা যায়। তার প্রবন্ধগুলো একাডেমিক প্রবন্ধকারদের চেয়ে আলাদা। প্রবন্ধের দ্বারা তিনি বড় কথা বলেছেন ছোট গলায়। সব কথাই তিনি আনতে পারতেন কিন্তু কাউকে বুঝতে দিতেন না। নিজের মতো করে যা বুঝেছেন তা-ই লিখতেন সহজ ভাষায়। যার কিছুই ফেলে দেওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথের শ্যামা গীতিনাট্য নিয়ে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যেখানে আমরা দেখেছিলাম, তিনি আবু সায়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছেন। রশীদ করীম কাগজে বেশকিছু কলামও লিখেছেন। চলতি ঘটনার বিশ্লেষণ করেছেন নিজের মতো করে।
ব্যক্তিগত জীবনে রশীদ করীম ছিলেন স্পষ্টভাষী এবং বন্ধুবৎসল। সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং ১৯৮৪ সালে একুশে পদক লাভ করেন। পুরস্কারের ব্যাপারেও তার ছিল ভিন্নমত। কেউ সম্মান দিয়ে পুরস্কৃত করলে তা গ্রহণ করতেন নিদ্বর্িধায়। কিন্তু পুরস্কার লাভের আশায় কখনোই তাকে কারও কাছে ধরনা দিতে দেখিনি।
১৯৯২ সালে রশীদ করীম পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে আর নিয়মিত লিখতে পারেননি। সে অবস্থায় থেকেও তিনি 'জীবন মরণ' নামে একটি স্মৃতিকথা লিখলেন। অদ্ভুত ভালো লাগার মতো তার এই গ্রন্থটি। জীবনের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ফিরে তাকিয়েছেন তার বাল্য, কৈশোর ও প্রথম যৌবনের দিনগুলোর দিকে। দিনলিপি নয়, সমাজেতিহাস নয় বরং তিনি বলতে চেয়েছেন কিছু মানুষের কথা, তার আপনজন, বাল্যসখী, ভাই-বন্ধু-আত্মীয়দের কথা। সেই সূত্র ধরে চলি্লশের দশকের কলকাতার বিকাশশীল মুসলিম মধ্যবিত্ত ও অভিজাতজনের কথা। 'জীবন মরণ' গ্রন্থটিকে তিনি বলেছেন তার সোয়ান-সঙ্, বিষণ্নতার রেশ বহন করা শেষ জীবনের গান। যার মাধ্যমে এক হারিয়ে যাওয়া যুগের রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধময় পরিচয় লাভ করি।
আমি, রশীদ করীম আর শামসুর রাহমান তিনজন ছিলাম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমাদের অনেক স্মৃতি আর কথাবার্তা মনে পড়ছে আজ। বহু দিনের আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো আর আলোচনার মাঝে কেটে গেছে আমাদের অজস্র দিন। আমার লেখালেখিতে তিনি উৎসাহ জুগিয়েছেন অনেক। ভালো সমালোচক হিসেবে আমি পেয়েছি তাকে বহুবার। যেটা ভালো সেটার প্রশংসা করতেন। আবার যেটা তার কাছে ভালো লাগত না বা পছন্দ হতো না_ সে লেখার সমালোচনা করতেও কুণ্ঠা করতেন না।
অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আমি প্রায় তার বাসায় যেতাম। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের মাঝে আলোচনা হতো। মৃত্যুর আগের দিনও আমি তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তাকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে, সে খবরও আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই যে তিনি চলে যাবেন তা ভাবতে পারিনি।
আমাদের তিনজনের মাঝে শামসুর রাহমান চলে গেলেন সবার আগে। এরপর রশীদ করীম। আমি আর কতদিন থাকব জানি না। কিন্তু সাহিত্যের যারা একনিষ্ঠ পাঠক তারা রশীদ করীমের মর্যাদা দেবেন। তার যে বিশিষ্টতা সে কারণে তিনি আগামী দিনগুলোতেও আলো ছড়িয়ে যাবেন। তার মৃত্যুতে দেশ হারিছে একজন সেরা ঔপন্যাসিককে। আমি হারালাম একজন কাছের বন্ধুকে। যার শূন্যতা পূরণ হবে কি-না এ নিয়ে আমি সংশয়ে ভুগছি। া
No comments