গোয়েন্দা প্রতিবেদন-ঢাকা বিভক্তি নিয়ে নানা অঘটনের পরিকল্পনা by মাসুদুল আলম তুষার

ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির আন্দোলন সহিংস রূপ নিতে পারে, পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হতে পারে অঘটন। বাতি নিভিয়ে, ময়লার স্তূপ জমিয়ে ও নাগরিক সেবায় বিঘ্ন ঘটিয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কাও রয়েছে। নগর বিভক্তির বিরোধিতাকারীরা প্রধান বিরোধী দলের সমর্থনে ভবিষ্যতে হয়ে উঠতে পারে আরো বেপরোয়া। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে গোয়েন্দারা এ রকম নানা আশঙ্কার কথা জানিয়েছে।


গোয়েন্দা সংস্থা ও র‌্যাব-পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিট বর্তমানে নগর বিভক্তির আন্দোলন সতর্ক পর্যালোচনা করছে। এরই মধ্যে গোয়েন্দারা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে নানা আশঙ্কাসহ আন্দোলনকারীদের গতিবিধি-সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাতে আন্দোলনে জড়িত ৩০ জন নাগরিকের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকা নাগরিকদের মধ্যে অরাজনৈতিক ব্যক্তিরাও রয়েছেন। তবে ডিসিসির সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকাসহ বেশির ভাগই সক্রিয় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সন্দেহ রয়েছে আওয়ামী লীগের কয়েকজন সাবেক কাউন্সিলরকে ঘিরেও। পরিস্থিতি সামলাতে বিভক্তির পক্ষে প্রচারণা বাড়ানো এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার সুপারিশ করেছেন গোয়েন্দা সদস্যরা।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিভক্তির প্রতিবাদে শুরু করা আন্দোলনকে ভিন্নদিকে নেয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। নাগরিক সুবিধা ও সেবা বাড়াতে সরকারের গ্রহণ করা উদ্যোগের সমালোচনাকারীদের নানাভাবে ইন্ধন দেওয়া হচ্ছে আলোচনার টেবিল ছেড়ে রাস্তায় নামতে। একই সঙ্গে এটিকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ দিতে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। আন্দোলনের নেপথ্যে থেকে সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এবং বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে অস্থির পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছেন, যা সহিংসতার দিকে গড়াতে পারে। এ ইস্যুতে বিএনপির ডাকা হরতালসহ প্রতিবাদ কর্মসূচি আন্দোলনকারীদের চাঙ্গা রাখতে দেওয়া হচ্ছে। রাজধানীর জীবনযাত্রা অস্থিতিশীল করতে বেশ কিছু কৌশলও নেওয়া হয়েছে। যার অন্যতম হলো কর্মবিরতির নামে নগরের সেবাখাতগুলোতে অচলাবস্থা সৃষ্টি করা। ডিসিসি বিভক্তির সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হলে রাজধানীতে সব ময়লা উত্তোলন থেকে বিরত থাকা, ড্রেন ও ময়লার মেইন হোল বন্ধ রেখে দুর্গন্ধময় পরিবেশ সৃষ্টি, ডিসিসির আওতাধীন সব বৈদ্যুতিক বাতি বন্ধ রেখে রাজধানীকে অন্ধকার শহরে পরিণত করাসহ নানা পরিকল্পনা রয়েছে অন্দোলনকারীদের।
সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে পাঠানো গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তুলে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারীর নাম। তাঁদেরকে 'শীর্ষ পর্যায়ের ইন্ধনদাতা' হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছেন বিদায়ী মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসসহ বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম। ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ডিসিসির কর্মকর্তা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নেতাদের নামও রয়েছে তালিকায়।
ডিসিসির সাবেক কাউন্সিলর আ. লতিফ, হারুন উর রশিদ, হুমায়ুন কবির, হাজি লিয়াকত আলী, খন্দকার আ. রউফ, মকবুল আহমেদ, কাজী আবুল বাশার, জসিম উদ্দিন ও সাজ্জাদ জহিরের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে গোয়েন্দারা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সিটি করপোরেশনের কারওয়ানবাজার অফিসের প্রকৌশলী মেজবাউল করিম, পরিবহন চালক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি আক্তার হোসেন দেওয়ান, পরিবহনকর্মীদের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, ক্লিনার স্ক্যাভেঞ্জার্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্সের সভাপতি আবদুস সাত্তার ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল লতিফ, সাইনবোর্ড শাখার শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম, সিটি করপোরেশনের উত্তরা অফিসের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি আহম্মেদ হোসেন, ইন্সপেক্টর (রোড), স্বাস্থ্য বিভাগের এক সুপারভাইজার, সিটি পৌর কর্মচারী ফেডারেশনের মহাসচিব, ক্লিনার বিভাগের সাবেক সভাপতি খালেক, গাড়িচালক আবুল কালাম পাটোয়ারী ও মোশাররফ হোসেন মিলন এবং লাইসেন্স ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ হোসেন রাজাকে ইন্ধনদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গোয়েন্দাদের দাবি অনুযায়ী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বকারীদের মধ্যে সাবেক বিচারপতি আবদুর রউফ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ, সাবেক প্রো-ভিসি ইউসুফ হায়দার, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম এ মাজেদ, সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ এবং সুজনের কর্মকর্তা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ বিরোধী দলের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছেন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্ত করার ঘটনাকে ইস্যু বানিয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে বিএনপি। তারা পরিকল্পিতভাবে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সেবামূলক খাতগুলোকে অসহযোগিতা করে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানোয় বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করবে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় ও ততৃীয় শ্রেণীর কর্মচারীরা বর্তমানে সূত্রাপুর, ধলপুর, ইসলামবাগ, লালবাগে অবস্থিত কোয়ার্টারে বসবাস করে। তাদের অনেকেই সিটি করপোরেশনের কাজের অবসরে ক্ষুদ্র ব্যবসা করে এবং তাদের সন্তানরা সূত্রাপুর, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, সবুজবাগ, মতিঝিল, আজিমপুর এলাকার স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করে। ডিসিসির বিভক্তিতে কর্মচারীদের অন্যত্র বদলি এবং সন্তানদের লেখাপড়া বিঘি্নত হতে পারে বলে প্রচারণা চালিয়ে তাদের অন্দোলনে সামিল করার চেষ্টা চলছে। আরবান লজিস্টিক অফিসার, ইউনুস আলী মৃধা, পরিবহন সমিতির সভাপতি হুমায়ুন আহম্মেদ, ড্রাইভার সমিতির সভাপতি আকতার দেওয়ান, ক্লিনার সমিতির সভাপতি লতিফ সিদ্দিকীসহ বেশ কয়েকজন তাঁদের প্রভাব ও নেতৃত্ব খর্বের ভয়ে কর্মচারীদের আন্দোলন উসকে দিচ্ছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.