ইসলামে বিজয় ও যুদ্ধাপরাধ প্রসঙ্গ by মুফতি এনায়েতুল্লাহ
হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) আদর্শ থেকে আমরা জানি, তিনি জিহাদের সময় নারী, শিশু ও বৃদ্ধ, এমনকি ফলবান বৃক্ষ পর্যন্ত যেন আক্রান্ত না হয় সে ব্যাপারে সর্তক বাণী উচ্চারণ করেছেন। তাছাড়া যুদ্ধাবস্থা ছাড়া কারও ওপর আক্রমণ চালানো অবৈধ। ইসলামের দৃষ্টিতে তা কখনোই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না'শহীদ' আরবি শব্দ। অর্থ_ সত্য ও ন্যায়ের জন্য প্রাণদাতা, ইসলাম ধর্মের জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধে বিরোধী
পক্ষ কর্তৃক 'নিহত'কে বলা হয় শহীদ। তিনি আখেরাতের প্রতিটি মনজিল, কবর, হাসর, মিজান ও পুলসিরাত_ সর্বত্রই পাবেন সর্বোচ্চ মর্যাদা। তারা হবেন অসাধারণ সম্মানের অধিকারী। পরকালে তিনি হবেন আল্লাহতায়ালার বিশেষ মেহমান। এ প্রসঙ্গে কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, 'যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদের তোমরা মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত। কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারছ না।' সূরা বাকারা : ১৫৪
আল্লাহতায়ালা শহীদদের সম্পর্কে কোরআনের অন্যত্র পুনরায় ঘোষণা করেন, 'যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের কখনোই মৃত মনে করো না, বরং তারা জীবিত এবং তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে তারা জীবিকাপ্রাপ্ত হয়। আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের যা দিয়েছেন তাতে তারা পরিতৃপ্ত, পরিতুষ্ট এবং তাদের পেছনে যারা এখনও তাদের সঙ্গে মিলিত হয়নি তাদের জন্য আনন্দ প্রকাশ করে এ জন্য যে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না। আল্লাহর নিয়ামত এবং অনুগ্রহের জন্য তারা আনন্দ প্রকাশ করে এবং তা এ কারণে যে, আল্লাহ বিশ্ববাসীর (মুমিন) প্রতিদান বিনষ্ট করেন না।' সূরা আল ইমরান : ১৬৯-৭১
ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও আক্রোশ চরিতার্থে সংঘটিত সব ধরনের যুদ্ধকে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে ন্যায়সঙ্গত কারণে যে যুদ্ধের আয়োজন করা হয়, যে যুদ্ধ নিয়ন্ত্রিত হয় ইসলামী বিধিবিধান দ্বারা সে যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদ বলা হয়। জিহাদ ইসলামের এক অলঙ্ঘনীয় বিধান। জিহাদ অস্বীকারকারী কাফের।
হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) জীবদ্দশায় সংঘটিত তিন ধরনের যুদ্ধ সম্পর্কে জানা যায়। এক. প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ; দুই. শাস্তি প্রদানের জন্য যুদ্ধ এবং তিন. প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ। হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) যুগে সংঘটিত কোনো যুদ্ধই আক্রমণাত্মক ছিল না। ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়, রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে নবী কর্তৃক প্রেরিত একজন মুসলিম দূতকে হত্যা করা হয়। আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রদূত হত্যা জঘন্যতম অপরাধ। এটি যুদ্ধাপরাধের শামিল। তাই এর প্রতিকার ও বিচারের জন্য হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) রোমান সম্রাটকে মুসলিম দূত হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে পত্র মারফত সম্রাটকে তিনটি প্রস্তাব দেন। প্রথমত, ইসলাম গ্রহণ করার। দ্বিতীয়ত, ইসলাম গ্রহণ না করলে 'জিজিয়া' (কর) প্রদান করার। তৃতীয়ত, যুদ্ধের। উলি্লখিত পত্রালাপ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মখোমুখি করে শাস্তি প্রদান করা বৈধ। না হলে রাষ্ট্রদূত হত্যার প্রতিকার চেয়ে নবী করিম (সা.) সম্রাটের কাছে চিঠি লিখতেন না।
প্রত্যেক মানুষেরই মার্জিতভাবে সুষ্ঠু বিবেকের রায় অনুসারে চলার স্বাধীনতা রয়েছে। এরই নাম মানবাধিকার। এ অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) জিহাদের প্রধান লক্ষ্য। ইসলাম, মুসলমান ও ইমানের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য হতে হবে জিহাদ। মুসলমানদের জন্য এ অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাই হলো প্রকৃত জিহাদ। স্বার্থসিদ্ধি, শোষণ, নিপীড়ন ও কর্তৃত্বমূলক মনোভাব নিয়ে এ যুদ্ধ করা যাবে না। মনে রাখা যাবে না নিজের স্বার্থের কথা।
যুদ্ধে সাধারণত দুটি পক্ষ থাকে। একপক্ষ অত্যাচারিত, দ্বিতীয় পক্ষ অত্যাচারী। যুগে যুগে সংঘটিত সব যুদ্ধেই এ দৃশ্য দেখা গেছে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কার মুশরেকদের দ্বারা নিযার্তিত হয়ে মদিনায় হিজরত করেন। তিনি নিজ আদর্শ, ব্যক্তিত্ব ও দাওয়াতের মাধ্যমে সমগ্র আরবে ইসলাম প্রচারান্তে মক্কা অভিমুখে রওনা হন। মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সব রক্তপাত নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও বেশ কয়েকজনকে যুদ্ধাপরাধী বলে ঘোষণা দিয়ে তাদের কোনো ক্ষমা নেই বললেন। সীরাতে মুগলতাঈর মতে এদের সংখ্যা ১৫, ইবনে ইসহাকের মতে ৮, আবু দাউদের মতে ৬ ও ইমাম বুখারির মতে একজন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আবদুল্লাহ ইবনে খাত্তাল, মাকিস ও আবদুল্লাহ ইবনে খাত্তালের দাসী রোকাইবা। এরা বিভিন্ন সময় নিরপরাধ মুসলমানকে বিনা কারণে হত্যা করেছিল। আর রোকাইবা হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) নামে অশ্লীল গান রচনা করে তা মক্কায় গেয়ে বেড়াত। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের হত্যার আদেশ দেন। মসজিদে হারামের চত্বরে সব রক্তপাত নিষিদ্ধ হলেও ইবনে খাত্তালকে হত্যা করা হয় মাকামে ইব্রাহিম ও যমযম কূপের মধ্যবর্তী স্থানে। তাদের হত্যার মাধ্যমে বিচার করা হয় যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী ও অশ্লীল জঘন্য সব কর্মকাণ্ডের।
শহীদ হওয়ার কিছু অবস্থা বা উপলক্ষ রয়েছে। যদি কেউ জালেম ব্যক্তি কর্তৃক, দস্যুর কবলে, হিংস্র জন্তু-জানোয়ার কর্তৃর্ক, বজ্রাঘাতে, জীবন্ত প্রোথিত হয়ে, অগি্নদগ্ধ হয়ে, বিষক্রিয়ায়, পানিতে ডুবে, পিপাসা, অনাহার, প্লেগ অথবা পাকস্থলীর পীড়া, যে মাতা সূতিকা শয্যায়, যে ব্যক্তি কোনো মহৎ কাজ করতে গিয়ে যেমন_ হজযাত্রা বা আত্মীয়স্বজন-বন্ধুহীন প্রবাসে অথবা প্রার্থনারত অবস্থায় কিংবা অবিরাম অজু করার ফলে, শুক্রবার রাতে কিংবা আল্লাহর পথে জ্ঞান অর্জনকালে, জুলুমের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের সমর্থনে, অপঘাতে, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, তাদের শহীদ বলে বিবেচনা করা হয়। এমনকি নিজের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মারা গেলেও শহীদ বলে গণ্য। একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানি জালিমশাহির বিরুদ্ধে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অধিকারবঞ্চিত বাঙালির ন্যায়যুদ্ধ। সুতরাং এ যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছেন তারা শহীদ। বিজয়ের ৪০ বছরের এ মাহেন্দ্রক্ষণে একাত্তরের সেই বীর শহীদদের প্রতি হাজার সালাম ও দোয়া।
রাতের অন্ধকারে নিরীহ, নিরপরাধ, নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করা কি কোনো মানুষের কাজ? হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনসহ বহুবিধ মানবতাবিরোধী কাজের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন ও তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো মুক্তিকামী প্রত্যেক মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে বন্দুকের নলের মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা ইসলাম সমর্থন করে না। এ অবৈধ ক্ষমতার দখলদারের বিরুদ্ধে কারবালার ময়দানে অস্ত্র হাতে লড়ে শহীদ হয়েছেন নবীর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)। এখন চলছে সেই পবিত্র মহররম মাস। এর সঙ্গে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। মহররম ও ডিসেম্বর মাসের ঘটনাবলি বাঙালিসহ সমগ্র মুসলিম জাতিকে অন্যায়ভাবে ক্ষমতালিপ্সুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি জোগায়। গণতন্ত্র মনোভাবাপন্ন হতে সাহায্য করে। এ সম্পর্কে কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, 'তোমরা পরস্পরে কার্যসমাধা করো পরামর্শের ভিত্তিতে।' জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ ও সমর্থন ওই পরামর্শেরই অংশবিশেষ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন উলামায়ে কেরাম।
হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) আদর্শ থেকে আমরা জানি, তিনি জিহাদের সময় নারী, শিশু ও বৃদ্ধ, এমনকি ফলবান বৃক্ষ পর্যন্ত যেন আক্রান্ত না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছেন। তাছাড়া যুদ্ধাবস্থা ছাড়া কারও ওপর আক্রমণ চালানো অবৈধ। ইসলামের দৃষ্টিতে তা কখনোই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এ অপরাধেই হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে ওইসব যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা না করে শাস্তির মুখোমুখি করেছিলেন। সে হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের শাস্তি পাওয়াও আবশ্যক। এ বিচার হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) দেখানো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বিচার ব্যবস্থাতেই আছে।
বিজয়ের এ মাসে স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মউৎসর্গকারী শহীদদের স্মরণ করি পরম শ্রদ্ধায়, অসীম ভালোবাসায়।
muftianaet@gmail.com
আল্লাহতায়ালা শহীদদের সম্পর্কে কোরআনের অন্যত্র পুনরায় ঘোষণা করেন, 'যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের কখনোই মৃত মনে করো না, বরং তারা জীবিত এবং তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে তারা জীবিকাপ্রাপ্ত হয়। আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের যা দিয়েছেন তাতে তারা পরিতৃপ্ত, পরিতুষ্ট এবং তাদের পেছনে যারা এখনও তাদের সঙ্গে মিলিত হয়নি তাদের জন্য আনন্দ প্রকাশ করে এ জন্য যে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না। আল্লাহর নিয়ামত এবং অনুগ্রহের জন্য তারা আনন্দ প্রকাশ করে এবং তা এ কারণে যে, আল্লাহ বিশ্ববাসীর (মুমিন) প্রতিদান বিনষ্ট করেন না।' সূরা আল ইমরান : ১৬৯-৭১
ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও আক্রোশ চরিতার্থে সংঘটিত সব ধরনের যুদ্ধকে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে ন্যায়সঙ্গত কারণে যে যুদ্ধের আয়োজন করা হয়, যে যুদ্ধ নিয়ন্ত্রিত হয় ইসলামী বিধিবিধান দ্বারা সে যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদ বলা হয়। জিহাদ ইসলামের এক অলঙ্ঘনীয় বিধান। জিহাদ অস্বীকারকারী কাফের।
হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) জীবদ্দশায় সংঘটিত তিন ধরনের যুদ্ধ সম্পর্কে জানা যায়। এক. প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ; দুই. শাস্তি প্রদানের জন্য যুদ্ধ এবং তিন. প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ। হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) যুগে সংঘটিত কোনো যুদ্ধই আক্রমণাত্মক ছিল না। ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়, রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে নবী কর্তৃক প্রেরিত একজন মুসলিম দূতকে হত্যা করা হয়। আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রদূত হত্যা জঘন্যতম অপরাধ। এটি যুদ্ধাপরাধের শামিল। তাই এর প্রতিকার ও বিচারের জন্য হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) রোমান সম্রাটকে মুসলিম দূত হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে পত্র মারফত সম্রাটকে তিনটি প্রস্তাব দেন। প্রথমত, ইসলাম গ্রহণ করার। দ্বিতীয়ত, ইসলাম গ্রহণ না করলে 'জিজিয়া' (কর) প্রদান করার। তৃতীয়ত, যুদ্ধের। উলি্লখিত পত্রালাপ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মখোমুখি করে শাস্তি প্রদান করা বৈধ। না হলে রাষ্ট্রদূত হত্যার প্রতিকার চেয়ে নবী করিম (সা.) সম্রাটের কাছে চিঠি লিখতেন না।
প্রত্যেক মানুষেরই মার্জিতভাবে সুষ্ঠু বিবেকের রায় অনুসারে চলার স্বাধীনতা রয়েছে। এরই নাম মানবাধিকার। এ অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) জিহাদের প্রধান লক্ষ্য। ইসলাম, মুসলমান ও ইমানের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য হতে হবে জিহাদ। মুসলমানদের জন্য এ অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাই হলো প্রকৃত জিহাদ। স্বার্থসিদ্ধি, শোষণ, নিপীড়ন ও কর্তৃত্বমূলক মনোভাব নিয়ে এ যুদ্ধ করা যাবে না। মনে রাখা যাবে না নিজের স্বার্থের কথা।
যুদ্ধে সাধারণত দুটি পক্ষ থাকে। একপক্ষ অত্যাচারিত, দ্বিতীয় পক্ষ অত্যাচারী। যুগে যুগে সংঘটিত সব যুদ্ধেই এ দৃশ্য দেখা গেছে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কার মুশরেকদের দ্বারা নিযার্তিত হয়ে মদিনায় হিজরত করেন। তিনি নিজ আদর্শ, ব্যক্তিত্ব ও দাওয়াতের মাধ্যমে সমগ্র আরবে ইসলাম প্রচারান্তে মক্কা অভিমুখে রওনা হন। মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সব রক্তপাত নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও বেশ কয়েকজনকে যুদ্ধাপরাধী বলে ঘোষণা দিয়ে তাদের কোনো ক্ষমা নেই বললেন। সীরাতে মুগলতাঈর মতে এদের সংখ্যা ১৫, ইবনে ইসহাকের মতে ৮, আবু দাউদের মতে ৬ ও ইমাম বুখারির মতে একজন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আবদুল্লাহ ইবনে খাত্তাল, মাকিস ও আবদুল্লাহ ইবনে খাত্তালের দাসী রোকাইবা। এরা বিভিন্ন সময় নিরপরাধ মুসলমানকে বিনা কারণে হত্যা করেছিল। আর রোকাইবা হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) নামে অশ্লীল গান রচনা করে তা মক্কায় গেয়ে বেড়াত। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের হত্যার আদেশ দেন। মসজিদে হারামের চত্বরে সব রক্তপাত নিষিদ্ধ হলেও ইবনে খাত্তালকে হত্যা করা হয় মাকামে ইব্রাহিম ও যমযম কূপের মধ্যবর্তী স্থানে। তাদের হত্যার মাধ্যমে বিচার করা হয় যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী ও অশ্লীল জঘন্য সব কর্মকাণ্ডের।
শহীদ হওয়ার কিছু অবস্থা বা উপলক্ষ রয়েছে। যদি কেউ জালেম ব্যক্তি কর্তৃক, দস্যুর কবলে, হিংস্র জন্তু-জানোয়ার কর্তৃর্ক, বজ্রাঘাতে, জীবন্ত প্রোথিত হয়ে, অগি্নদগ্ধ হয়ে, বিষক্রিয়ায়, পানিতে ডুবে, পিপাসা, অনাহার, প্লেগ অথবা পাকস্থলীর পীড়া, যে মাতা সূতিকা শয্যায়, যে ব্যক্তি কোনো মহৎ কাজ করতে গিয়ে যেমন_ হজযাত্রা বা আত্মীয়স্বজন-বন্ধুহীন প্রবাসে অথবা প্রার্থনারত অবস্থায় কিংবা অবিরাম অজু করার ফলে, শুক্রবার রাতে কিংবা আল্লাহর পথে জ্ঞান অর্জনকালে, জুলুমের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের সমর্থনে, অপঘাতে, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, তাদের শহীদ বলে বিবেচনা করা হয়। এমনকি নিজের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মারা গেলেও শহীদ বলে গণ্য। একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানি জালিমশাহির বিরুদ্ধে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অধিকারবঞ্চিত বাঙালির ন্যায়যুদ্ধ। সুতরাং এ যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছেন তারা শহীদ। বিজয়ের ৪০ বছরের এ মাহেন্দ্রক্ষণে একাত্তরের সেই বীর শহীদদের প্রতি হাজার সালাম ও দোয়া।
রাতের অন্ধকারে নিরীহ, নিরপরাধ, নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করা কি কোনো মানুষের কাজ? হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনসহ বহুবিধ মানবতাবিরোধী কাজের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন ও তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো মুক্তিকামী প্রত্যেক মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে বন্দুকের নলের মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা ইসলাম সমর্থন করে না। এ অবৈধ ক্ষমতার দখলদারের বিরুদ্ধে কারবালার ময়দানে অস্ত্র হাতে লড়ে শহীদ হয়েছেন নবীর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)। এখন চলছে সেই পবিত্র মহররম মাস। এর সঙ্গে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। মহররম ও ডিসেম্বর মাসের ঘটনাবলি বাঙালিসহ সমগ্র মুসলিম জাতিকে অন্যায়ভাবে ক্ষমতালিপ্সুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি জোগায়। গণতন্ত্র মনোভাবাপন্ন হতে সাহায্য করে। এ সম্পর্কে কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, 'তোমরা পরস্পরে কার্যসমাধা করো পরামর্শের ভিত্তিতে।' জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ ও সমর্থন ওই পরামর্শেরই অংশবিশেষ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন উলামায়ে কেরাম।
হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) আদর্শ থেকে আমরা জানি, তিনি জিহাদের সময় নারী, শিশু ও বৃদ্ধ, এমনকি ফলবান বৃক্ষ পর্যন্ত যেন আক্রান্ত না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছেন। তাছাড়া যুদ্ধাবস্থা ছাড়া কারও ওপর আক্রমণ চালানো অবৈধ। ইসলামের দৃষ্টিতে তা কখনোই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এ অপরাধেই হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে ওইসব যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা না করে শাস্তির মুখোমুখি করেছিলেন। সে হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের শাস্তি পাওয়াও আবশ্যক। এ বিচার হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) দেখানো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বিচার ব্যবস্থাতেই আছে।
বিজয়ের এ মাসে স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মউৎসর্গকারী শহীদদের স্মরণ করি পরম শ্রদ্ধায়, অসীম ভালোবাসায়।
muftianaet@gmail.com
No comments