মঞ্চ নাটক-মহাকালের দাবি মেটাতে কালের যাত্রা by মাসিদ বিন মোস্তফা রণ
ওদের কোনো বাধা না দেওয়াই হচ্ছে সৎ পরামর্শ। বাধা দিলে শক্তি, আপনাকে আপনি চিনতে পারে। সেই চিনতে দিলেই আর রক্ষা নেই।' এই কথার সত্যতা আমরা ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখতে পাই। চলমান পৃথিবীতে আজন্ম থেকেই এক জাত অত্যাচারী আর এক জাত অত্যাচারিত। এই দ্বি-বিভক্তির জন্যই দক্ষিণ আফ্রিকার কালো জাত শ্বেতাঙ্গদের হাত থেকে, পাক-ভারত ব্রিটিশদের কাছ থেকে আর বাঙালি জাতি বর্বর পাকিস্তানিদের আবদ্ধ শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত গগনে
মুক্ত বিহঙ্গের স্বাদ পেয়েছিল। এটা তো গেল সামাজিক, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা; কিন্তু ধর্মের মতো আরাধ্য সত্যের প্রাঙ্গণেও যে এই জাতিবিভেদ হতে পারে, এটা কি ভ্রম ছাড়া আর কিছু?
এই বাণীই বিশ্বকবি তাঁর রচিত কালের যাত্রা সমাজনাট্যে জোরালোভাবে উপস্থাপন করার প্রয়াস চালিয়ে সফল হয়েছেন। কেননা এই বাণীর মমার্থ এখনো আমাদের সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ধর্মের প্রতি মানুষের ভক্তিরসই যার মূল হাতিয়ার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রতিটি রচনায়ই একটি বা একাধিক সংবেদনশীল বর্ণনা তুলে ধরেছেন। 'কালের যাত্রা' নাট্যসূচিও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। এই নাট্যপ্রয়াসে কবি চমৎকার রচনাশৈলীর মাধ্যমে তখনকার সময়ে হিন্দু ধর্মের রীতিগত বা ভ্রমরীতির ঘোর বিরোধিতা করেছেন। এই প্রয়াস চালানোর জন্য তিনি প্রখর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে হিন্দুদের রথচালনাকে বিষয়বস্তু হিসেবে উপস্থাপনের আশ্রয় নিয়েছেন। এ নাটকের কাহিনীতে দেখা যায়, রথযাত্রার সময় যথারীতি এল, প্রতিবারের মতো নিয়ম করে পুরোহিত তাঁর ধর্মীয় মন্ত্রবলে রথ চালাতে গেলেন; কিন্তু রথ চলল না। পর্যায়ক্রমে রাজা, সেনাপতি, রাজ্যপরিষদ, সৈন্য-সামন্ত_সবাই চেষ্টার ত্রুটি করল না; কিন্তু রথ তবুও অনড় হয়ে রইল। এ নিয়ে সারা এলাকায় কলরব। নাগরিকরা, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মহিলারা তাদের মতো করে চেষ্টা করল। সন্ন্যাসী তাঁর স্বভাবসুলভ আচরণের দ্বারা কঠিনতর বাস্তব কিছু কথা বলে গেলেন, বিশিষ্ট ধর্মযোদ্ধারাও চেষ্টায় চেষ্টায় দাঁত সিটকে পড়লেন, তবুও রথ চলার লক্ষণমাত্র দেখা গেল না। এই অকালে, শাপে বর হয়ে এল সর্বনিচু জাতি বলে চিহ্নিত শূদ্ররা। এবং তারাই রথ চালাল। আর কবি এসে তাঁর জ্ঞানগর্ভ মর্মস্পর্শী সংলাপ বলে গেলেন নেচে-গেয়ে ও ছন্দে। কবির ভাষ্যমতে_দেখ, শূদ্ররাও কাল থেকেই চেঁচাতে আরম্ভ করবে ওরাই সব কিছুর হর্তাকর্তা। তাদের পক্ষেও যেদিন পাপ ভারী হয়ে যাবে ওই দিন আবার উল্টো রথের আসর বসবে। কবি এভাবেই মহাকালের জয়গান গাইলেন।
এই একই বিষয়বস্তুকে আশ্রয় করে কবি দুটি ঢং অর্থাৎ কাব্য ও গদ্যরীতিতে দুটি নাট্য রচনা করেছেন। এই প্রয়াস তিনি চালিয়েছেন তাঁর স্নেহাস্পদ ছাত্র শ্রীমান প্রমথনাথ বিশীর একটি রচনার ভাবনাকে কেন্দ্র করে। আমাদের দেশে এই কাহিনী নিয়ে কয়েকটি নাট্যদল নাটক মঞ্চে এনেছে। সে ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে তারা সবাই কাব্য ঢংকে প্রাধান্য দিয়ে 'রথের রশি' নামক নাটক তৈরি করেছে। কিন্তু এই প্রথম দেখা গেল গোলাম সারোয়ার 'পদাতিক নাট্য সংসদ, টিএসসি'র হয়ে যে নাটকটি মঞ্চস্থ করেছেন, সেটি রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও গদ্য ঢংয়ের মিশেলে তৈরি। এ জন্যই বোধ করি নির্দেশক রথের রশি ও রথযাত্রাকে সমন্বয় করে তাঁর নাট্য প্রয়াসের নামকরণ করেছেন 'কালের যাত্রা'। রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সঙ্গে এ নামটি অন্যগুলো থেকে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনায় মহাকালের দাবিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, নির্দেশকের ভাবনার জায়গাটি বেশ সমৃদ্ধ। এই ব্যতিক্রমী ভাবনাটি নাটকের বক্তব্যকে সমাজের কাছে তুলে ধরতে অনেক সহজ আর সাবলীল করে দিয়েছে। কিন্তু একটি নাট্যপ্রয়াস তখনই সফল হয়, যখন ওই নাটকের বক্তব্য, আবহ, পাত্রপাত্রীদের পরিবেশ উপযোগী অভিনয়শৈলী, ব্যবহার্য উপকরণ, সেট_সব কিছু সাবলীল হয়। এ ক্ষেত্রে পাত্রপাত্রীদের অভিনয়ে সাবলীলতার অভাব চরমে গিয়ে ঠেকেছে। পাত্রপাত্রীদের মঞ্চ ও সেট ব্যবহারে আরো সাবলীল হওয়া একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজনের বিষয় আরো আছে_যেমন পাত্রপাত্রীদের উচ্চারণ ও কণ্ঠশৈলীর ওপর জোর দিতে হবে। তাহলে দর্শকদের একঘেয়ে ভাব থেকে সংশ্লিষ্টরা মুক্তি পাবেন। অন্যান্য উপকরণ_যাকে নাটকের ভাষায় প্রপস বলে, তা প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যবহার করলে দর্শকের চোখে দৃষ্টিনন্দন লাগবে। পোশাক ডিজাইন ভালো, কিন্তু সব পাত্রপাত্রীর পোশাকে সিল্কের কাপড়ের ব্যবহার চোখে লেগেছে। কোরিওগ্রাফিতে পরিচ্ছন্নতার অভাব রয়েছে। আবহ সংগীত নির্বাচন প্রশংসনীয়, কিন্তু সুর ও সংগীতায়োজনে আধুনিক সংগীতের ঢং বর্জন করলে নাটকের আবহ আরো রুচিশীল হবে। লাইটের ব্যবহার তেমন ছিল না, তবুও সাধারণ আলোতেই দিনের আবহ্ ভালোমতো বোঝা গেছে। মঞ্চসজ্জায় বাহুল্য-দোষ ছিল না, ফলে মঞ্চসজ্জা ছিল সাবলীল। নাটকের বিভিন্ন পর্বে একাধিকবার পাত্রপাত্রীর অনুভূতিহীন অনুশোচনার দৃশ্য বেমানান। কমেডিয়ান বেশি করে কমেডি মুভি দেখলে ভালো ফল পাবেন। এ রকম ছোট ছোট বিষয়ের প্রতি খেয়াল করলে নাটকটি দর্শকনন্দিত ও সফল নাট্যপ্রয়াস বলে বিবেচিত হবে। কারণ নাটকটির গল্প বলার ধরন, সংলাপের ধারাবাহিকতা ও মাধুর্য মুগ্ধ করার মতো। যদিও কয়েকটি সংলাপ একাধিকবার প্রয়োগ করা হয়েছে। রূপসজ্জা এবং অঙ্গসজ্জায় যুগোপযোগিতা ও আধুনিকতা দাবি করছি।
'কালের যাত্রা' নাটকটি বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃত মন্ত্রণালয় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে অনুদানপ্রাপ্ত নাটক। সংগত কারণে অনুদানপ্রাপ্ত প্রতিটি দলই নাটক মঞ্চে আনার জন্য সময় খুব কম পেয়েছে। এই বিষয় বিবেচনা করে 'কালের যাত্রা' নাটকটির সাফল্য কামনা করা যায়, ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্টদের রুচিশীল নাট্য পরিবেশনার কামনায়।
এই বাণীই বিশ্বকবি তাঁর রচিত কালের যাত্রা সমাজনাট্যে জোরালোভাবে উপস্থাপন করার প্রয়াস চালিয়ে সফল হয়েছেন। কেননা এই বাণীর মমার্থ এখনো আমাদের সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ধর্মের প্রতি মানুষের ভক্তিরসই যার মূল হাতিয়ার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রতিটি রচনায়ই একটি বা একাধিক সংবেদনশীল বর্ণনা তুলে ধরেছেন। 'কালের যাত্রা' নাট্যসূচিও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। এই নাট্যপ্রয়াসে কবি চমৎকার রচনাশৈলীর মাধ্যমে তখনকার সময়ে হিন্দু ধর্মের রীতিগত বা ভ্রমরীতির ঘোর বিরোধিতা করেছেন। এই প্রয়াস চালানোর জন্য তিনি প্রখর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে হিন্দুদের রথচালনাকে বিষয়বস্তু হিসেবে উপস্থাপনের আশ্রয় নিয়েছেন। এ নাটকের কাহিনীতে দেখা যায়, রথযাত্রার সময় যথারীতি এল, প্রতিবারের মতো নিয়ম করে পুরোহিত তাঁর ধর্মীয় মন্ত্রবলে রথ চালাতে গেলেন; কিন্তু রথ চলল না। পর্যায়ক্রমে রাজা, সেনাপতি, রাজ্যপরিষদ, সৈন্য-সামন্ত_সবাই চেষ্টার ত্রুটি করল না; কিন্তু রথ তবুও অনড় হয়ে রইল। এ নিয়ে সারা এলাকায় কলরব। নাগরিকরা, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মহিলারা তাদের মতো করে চেষ্টা করল। সন্ন্যাসী তাঁর স্বভাবসুলভ আচরণের দ্বারা কঠিনতর বাস্তব কিছু কথা বলে গেলেন, বিশিষ্ট ধর্মযোদ্ধারাও চেষ্টায় চেষ্টায় দাঁত সিটকে পড়লেন, তবুও রথ চলার লক্ষণমাত্র দেখা গেল না। এই অকালে, শাপে বর হয়ে এল সর্বনিচু জাতি বলে চিহ্নিত শূদ্ররা। এবং তারাই রথ চালাল। আর কবি এসে তাঁর জ্ঞানগর্ভ মর্মস্পর্শী সংলাপ বলে গেলেন নেচে-গেয়ে ও ছন্দে। কবির ভাষ্যমতে_দেখ, শূদ্ররাও কাল থেকেই চেঁচাতে আরম্ভ করবে ওরাই সব কিছুর হর্তাকর্তা। তাদের পক্ষেও যেদিন পাপ ভারী হয়ে যাবে ওই দিন আবার উল্টো রথের আসর বসবে। কবি এভাবেই মহাকালের জয়গান গাইলেন।
এই একই বিষয়বস্তুকে আশ্রয় করে কবি দুটি ঢং অর্থাৎ কাব্য ও গদ্যরীতিতে দুটি নাট্য রচনা করেছেন। এই প্রয়াস তিনি চালিয়েছেন তাঁর স্নেহাস্পদ ছাত্র শ্রীমান প্রমথনাথ বিশীর একটি রচনার ভাবনাকে কেন্দ্র করে। আমাদের দেশে এই কাহিনী নিয়ে কয়েকটি নাট্যদল নাটক মঞ্চে এনেছে। সে ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে তারা সবাই কাব্য ঢংকে প্রাধান্য দিয়ে 'রথের রশি' নামক নাটক তৈরি করেছে। কিন্তু এই প্রথম দেখা গেল গোলাম সারোয়ার 'পদাতিক নাট্য সংসদ, টিএসসি'র হয়ে যে নাটকটি মঞ্চস্থ করেছেন, সেটি রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও গদ্য ঢংয়ের মিশেলে তৈরি। এ জন্যই বোধ করি নির্দেশক রথের রশি ও রথযাত্রাকে সমন্বয় করে তাঁর নাট্য প্রয়াসের নামকরণ করেছেন 'কালের যাত্রা'। রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সঙ্গে এ নামটি অন্যগুলো থেকে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনায় মহাকালের দাবিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, নির্দেশকের ভাবনার জায়গাটি বেশ সমৃদ্ধ। এই ব্যতিক্রমী ভাবনাটি নাটকের বক্তব্যকে সমাজের কাছে তুলে ধরতে অনেক সহজ আর সাবলীল করে দিয়েছে। কিন্তু একটি নাট্যপ্রয়াস তখনই সফল হয়, যখন ওই নাটকের বক্তব্য, আবহ, পাত্রপাত্রীদের পরিবেশ উপযোগী অভিনয়শৈলী, ব্যবহার্য উপকরণ, সেট_সব কিছু সাবলীল হয়। এ ক্ষেত্রে পাত্রপাত্রীদের অভিনয়ে সাবলীলতার অভাব চরমে গিয়ে ঠেকেছে। পাত্রপাত্রীদের মঞ্চ ও সেট ব্যবহারে আরো সাবলীল হওয়া একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজনের বিষয় আরো আছে_যেমন পাত্রপাত্রীদের উচ্চারণ ও কণ্ঠশৈলীর ওপর জোর দিতে হবে। তাহলে দর্শকদের একঘেয়ে ভাব থেকে সংশ্লিষ্টরা মুক্তি পাবেন। অন্যান্য উপকরণ_যাকে নাটকের ভাষায় প্রপস বলে, তা প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যবহার করলে দর্শকের চোখে দৃষ্টিনন্দন লাগবে। পোশাক ডিজাইন ভালো, কিন্তু সব পাত্রপাত্রীর পোশাকে সিল্কের কাপড়ের ব্যবহার চোখে লেগেছে। কোরিওগ্রাফিতে পরিচ্ছন্নতার অভাব রয়েছে। আবহ সংগীত নির্বাচন প্রশংসনীয়, কিন্তু সুর ও সংগীতায়োজনে আধুনিক সংগীতের ঢং বর্জন করলে নাটকের আবহ আরো রুচিশীল হবে। লাইটের ব্যবহার তেমন ছিল না, তবুও সাধারণ আলোতেই দিনের আবহ্ ভালোমতো বোঝা গেছে। মঞ্চসজ্জায় বাহুল্য-দোষ ছিল না, ফলে মঞ্চসজ্জা ছিল সাবলীল। নাটকের বিভিন্ন পর্বে একাধিকবার পাত্রপাত্রীর অনুভূতিহীন অনুশোচনার দৃশ্য বেমানান। কমেডিয়ান বেশি করে কমেডি মুভি দেখলে ভালো ফল পাবেন। এ রকম ছোট ছোট বিষয়ের প্রতি খেয়াল করলে নাটকটি দর্শকনন্দিত ও সফল নাট্যপ্রয়াস বলে বিবেচিত হবে। কারণ নাটকটির গল্প বলার ধরন, সংলাপের ধারাবাহিকতা ও মাধুর্য মুগ্ধ করার মতো। যদিও কয়েকটি সংলাপ একাধিকবার প্রয়োগ করা হয়েছে। রূপসজ্জা এবং অঙ্গসজ্জায় যুগোপযোগিতা ও আধুনিকতা দাবি করছি।
'কালের যাত্রা' নাটকটি বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃত মন্ত্রণালয় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে অনুদানপ্রাপ্ত নাটক। সংগত কারণে অনুদানপ্রাপ্ত প্রতিটি দলই নাটক মঞ্চে আনার জন্য সময় খুব কম পেয়েছে। এই বিষয় বিবেচনা করে 'কালের যাত্রা' নাটকটির সাফল্য কামনা করা যায়, ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্টদের রুচিশীল নাট্য পরিবেশনার কামনায়।
No comments