স্মরণ-রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই
কিছু লেখক আছেন, যাঁদের লেখার সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু তাঁদের কালোত্তীর্ণ করে রেখেছে স্বল্প লেখাই। এমন বিরল সৌভাগ্যবান লেখকদের অন্যতম রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই। তাঁর লেখা 'বাক্ বাক্বাকুম পায়রা/মাথায় দিয়ে টায়রা/বউ সাজবে কাল কি/চড়বে সোনার পাল্কি।'কে পড়েনি এই ছড়া? এমন একটি ছড়া দিয়েই তো একজন লেখক অমর হয়ে থাকতে পারেন। অথচ দাদাভাইয়ের হাত দিয়ে একাধিক এমন কালোত্তীর্ণ ছড়া সৃষ্টি হয়েছে।
আবার কচি-কাঁচার মেলার কথা যদি বলা হয়, তাও যে কেউ বলবে দাদাভাইয়ের কথা। সন্তানের দাদাভাই, বাবা কিংবা মায়েরও দাদাভাই। বিশাল মাপের এই মানুষটির সাংবাদিকতা, সাহিত্যচর্চা ও শিশুসংগঠন প্রতিষ্ঠার পেছনে সর্বত্রই ছিল প্রধানত একটি উদ্দেশ্য। তিনি বলতেন এবং মানতেন_দেশ হচ্ছে মানুষের মূল ঠিকানা। নিজে ভালো থাকতে চাইলে, প্রজন্মের ভালো চাইলে সর্বাগ্রে দেশটাকে ভালোবাসতে হবে। পেশাগত জীবনেও তিনি তাই শিশুদেরই বেছে নিলেন। দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় ১৯৪৭ সালে যোগ দেওয়ার সময় তিনি 'মিতালী মজলিশে'র দায়িত্ব নিলেন। মিল্লাতে যোগ দিয়ে চালু করলেন 'কিশোর দুনিয়া' আর ১৯৫৫ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দিলেন কচি-কাঁচার আসরের পরিচালক হিসেবে। তার সঙ্গে যুক্ত হলো কচি-কাঁচার মেলা নামক সংগঠন। জাতীয়ভাবে শিশু-কিশোরদের সংঘবদ্ধ করতে বিশাল সাফল্য অর্জন করেন এই সংগঠনের মাধ্যমে। কচি-কাঁচার আসর শুরু হওয়ার বছরখানেকের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় কচি-কাঁচার মেলা। বেগম সুফিয়া কামাল, আবদুল্লাহ আল মুতী, শিল্পী জয়নুল আবেদিনের মতো মহান ব্যক্তিদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ছিল এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। একসময় দেশের প্রগতিশীল লেখক, শিল্পী ও সাংস্কৃতিককর্মীদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে কচি-কাঁচার মেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন। শিশুদের মননশীল করে গড়ে তোলার জন্য কচি-কাঁচার মেলায় বিভিন্ন শিক্ষামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। বিশেষ করে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য তাদের উদ্বুদ্ধকরণ, চিত্রাঙ্কন শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের সৃজনশীল করে তোলা, সংগীত ও নৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে উদার মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথ প্রদর্শন করার মতো পরিকল্পনাগুলোকে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। প্রতিটি কর্মসূচির পেছনেই ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র। বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের জন্য প্রেরণাদায়ক কর্মসূচি নিয়ে কচি-কাঁচার মেলা পরিচালিত হয়েছে বলেই এই সংগঠনের সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেখা গেছে। রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই তাঁর সংগঠনের শিশু-কিশোরদের নিয়ে তাই সব সময়ই গর্ব করতেন। বলতেন, কচি-কাঁচার মেলার কোনো সদস্যই রাজাকার কিংবা শান্তিকমিটির সদস্য হয়নি। ১৯৫৬ সাল থেকে পরিচালিত প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ারই প্রস্তুতি যেন। বিখ্যাত এই ছড়াকার ও শিশু সংগঠক বাংলা একাডেমী পুরস্কার, শিশু একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক, জসীমউদ্দীন স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেন।
মোস্তফা হোসেইন
মোস্তফা হোসেইন
No comments