জলবায়ু সম্মেলন-বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের গ্রিন ফান্ড গঠনের পথে বিশ্বনেতারা by আলতাব হোসেন
ডারবান জলবায়ু সম্মেলনের চতুর্থ দিনেও কিয়োটো প্রটোকল নিয়ে কোনো সুখবর নেই। বরং আশঙ্কার মধ্যে পড়েছে কার্বন নির্গমন রোধের একমাত্র আইনগত ভিত্তি এ চুক্তিটির ভবিষ্যৎ। তবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য গঠিত গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের বিষয়ে বড় অগ্রগতি হয়েছে। শিল্পোন্নতদেশগুলো ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১শ' বিলিয়ন ডলার গ্রিন ফান্ডে জমা দিতে রাজি হয়েছে। কোন দেশ কী পরিমাণ অর্থ পাবে ও কারা কী পরিমাণ অর্থ ফান্ডে জমা দেবে, সে
সিদ্ধান্ত ডারবান সম্মেলনেই চূড়ান্ত হবে বলে আশা করছেন জলবায়ু কূটনীতিকরা। এর আগে মেক্সিকোর কানকুন সম্মেলনে শিল্পোন্নত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা করতে এ ফান্ড গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
গতকাল বৃহস্পতিবার দিনভর গ্রিন ফান্ড ও কিয়োটো প্রটোকল নিয়ে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের সপ্তদশ আসরে আলোচনার টেবিলে ঝড় উঠে। সম্মেলন কক্ষে চলে রীতিমতো বাকযুদ্ধ। আর তাতে স্পষ্টতই দুটি ভাগ। উন্নত দেশের জোট আর স্বল্পোন্নত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জোট। দু'পক্ষের যুক্তি-পাল্টা যুক্তির পরও কার্বন নির্গমন কমানোর আইনি চুক্তি কিয়োটো প্রটোকলের ভবিষ্যৎ যখন নড়বড়ে, তখন ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো অধিকতর মনোযোগী হয়ে উঠেছে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ইস্যুতে। গ্রিন ফান্ডের ইস্যুটি ডারবান আলোচনার তালিকায় আট নম্বরে উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র ফান্ডের ব্যবস্থাপনা নিয়ে মৃদু আপত্তি জানালেও জি-৭৭ চায়না, আফ্রিকান গ্রুপ, বেসিক কান্ট্রিসহ অন্যান্য গ্রুপ ফান্ডের বিষয়ে একমত হয়েছে। বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে থাকায় বেশি পরিমাণ অর্থ পাবে বলে মনে করছেন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব মেসবাউল আলম ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আনসারুল করিম। তারা জানান, বাংলাদেশ ভালনার্যাবল কান্ট্রির তালিকাসহ প্রায় সব'কটি জরিপে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় পাঁচের মধ্যে আছে। তবে বাংলাদেশের জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ প্রথম পর্বের ফান্ডের অর্থায়নে তেমন অর্থ আদায় করতে পারেনি। বাংলাদেশের চেয়ে দ্বীপরাষ্ট্র, এমনকি নেপাল পর্যন্ত বেশি অর্থ পেয়েছে। গ্রিন ফান্ডের বিষয়ে শুরু থেকেই জোরালো অবস্থান স্পষ্ট না করলে বাংলাদেশ খুব বেশি লাভবান হবে না।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আনসারুল করিম সমকালকে বলেন, গ্রিন ফান্ড নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা চলছে। গত দু'দিনের আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র ফান্ডের ব্যবস্থাপনার দু'একটি বিষয়ে আপত্তি জানালেও আফ্রিকান গ্রুপ, জি-৭৭ চায়না ও অন্যান্য গ্রুপ বছরে ১শ' বিলিয়ন গ্রিন ফান্ডের বিষয়ে একমত হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এ বিষয়ে সমঝোতার দ্বারপ্রান্তে পেঁৗছেছে বিশ্ব।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আইনুন নিশাত সমকালকে বলেন, অনুন্নত দেশগুলোর জন্য আর্থিক সাহায্যের ক্ষেত্রে সাফল্যের সম্ভাবনা এবার বেশ উজ্জ্বল। বছরে ১শ' বিলিয়ন ডলার অর্থের বিষয়টি এবার বেশ জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সম্মেলনে অর্থ ব্যয়ের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তনের আভাস মিলেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়টিরও একটা নিষ্পত্তি হবে বলে তিনি ধারণা করছেন। তবে ২০১২ সালের মধ্যে জলবায়ুর পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে উন্নত দেশগুলোর। এই তহবিলের অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে দাতা দেশগুলো সরাসরি জোগান দেবে অনুদান হিসেবে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ পেয়েছে ১২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই অর্থ তহবিলের তুলনায় অনেক কম বলে মনে করেন বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম সমঝোতাকারী ড. আইনুন নিশাত।
বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ : জলবায়ু তহবিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থেকে বিশ্বব্যাংককে প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ডারবানে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। আইসিসি সেন্টারের সামনের রাস্তায় এ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেন বিশ্বের নানা দেশের বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা। জুবিলি সাউথ নামে একটি সংগঠন এর আয়োজন করে। বিক্ষোভে বাংলাদেশের ইকুইটি বিডি, সিএসআরএল ও পবার কর্মীরা অংশ নেন। বিক্ষোভকারীরা ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে 'জলবায়ু তহবিলে বিশ্বব্যাংককে চাই না', 'পৃথিবী ধ্বংস করছে বিশ্বব্যাংক, কার্বন নিঃসরণ কমাও' স্লোগান দেয়। বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা জলবায়ু তহবিলের ব্যবস্থাপনায় বিশ্বব্যাংককে রাখার বিষয়ে উন্নত দেশগুলোর চেষ্টার প্রতি নিন্দা জানান। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের ইকুইটি বিডির প্রধান সঞ্চালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বিশ্বব্যাংকের ঋণের ফাঁদ, ঋণের অর্থায়ন করা প্রকল্প, বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনের অভিজ্ঞতা কোনো দেশের জন্য সুখকর নয়। তাই জলবায়ু তহবিলের অর্থায়নে এ বহুজাতিক ঋণ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা মেনে নেওয়া যায় না।
দুর্নামের অ্যাওয়ার্ড : ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (ক্যান) নামে একটি সংগঠন সম্মেলনে প্রতিদিন সন্ধ্যায় দুটি দেশকে ফসিল অ্যাওয়ার্ড প্রদান করছে। যারা অগ্রগতির ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তারাই পাচ্ছে এই অ্যাওয়ার্ড। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও পোলান্ড এখন পর্যন্ত এই দুর্নামের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে বেশ কয়েকবার।
কার্বন নিঃসরণ কমানোর আলোচনায় গতি নেই : ২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে উষ্ণায়নের মাত্রা শিল্পায়নপূর্ব সময়ের চেয়ে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছিল। তবে সেই লক্ষ্যমাত্রা কতদিনের মধ্যে অর্জন করতে হবে তার কোনো সময়সীমা ঠিক করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে আলোচনাও গতি পাচ্ছে না। এর ফলাফলে তারা বলছেন, ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বের উষ্ণতা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা ৬০ শতাংশেরও বেশি। তবে এর জন্য ২০২০ সালের মধ্যে বার্ষিক কার্বন নির্গমনের পরিমাণ ৪৪ বিলিয়ন টন তথা ৪৪ গিগাটনের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। অথচ ২০১০ সালে বিশ্বে কার্বন নির্গমনের পরিমাণ ছিল ৪৮ গিগাটন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার প্রশ্নে শুরু থেকেই শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে একটা বিভাজনরেখা টানা আছে। ডারবান সম্মেলনের অগ্রগতির পথে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সৌদি আরব ও ইরান বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে। তবে সবার প্রত্যাশা, ডারবান থেকেই আসবে আইনভিত্তিক কোনো চুক্তি, যা রক্ষা করবে ভবিষ্যতের পৃথিবী।
No comments