যুগের বাণী-পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন আইন কী পেলাম, কী পেলাম না by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
আজকের লেখাটির বিষয় কি পুরনো হয়ে গেছে? কিংবা আইনটি যা দেয়নি সেগুলো কী ভবিষ্যতে বদলাবে না? প্রশ্ন দুটির উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে, প্রিয় পাঠক আমরা যদি পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন আইনটি পর্যালোচনা করি। বাহাত্তরের সংবিধান প্রণীত হয়েছিল এই ঘোষণাটি দিয়ে : 'আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।' 'জাতীয় মুক্তি' শব্দগুচ্ছটির অর্থ বাংলাদেশ শুধু একটি স্বাধীন দেশ না হয়ে একটি মুক্ত স্বাধীন দেশ হবে_এই আকাঙ্ক্ষায় বাংলার জনগণের ঐতিহাসিক সংগ্রাম। স্বাধীন ও মুক্ত শব্দ দুটি সমার্থক নয়। কেন নয় তার উত্তর দিয়েছেন অমর্ত্য সেন : 'স্বাধীন ভারতবর্ষের যে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ রোজ রাতে ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে ঘুমোতে যায়, যাদের গোটা জীবনটাই কাটে নিরবচ্ছিন্ন অনটনের মধ্যে, তাদের জন্য ত্রাণের কোনো ব্যবস্থা নেই। যে ক্ষুধা হঠাৎ বা চরম নয়, কিন্তু সমাজব্যবস্থার মজ্জাগত, তার নীরব উপস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক বিক্ষোভ হয় না, ভারতীয় সংসদ তার সম্পর্কে উত্তাল হয়ে ওঠে না। সমাজব্যবস্থার অঙ্গ হিসেবে তা চলতে থাকে।' দেখা যাচ্ছে, একটি স্বাধীন দেশে অনাহার, অশিক্ষা, অচিকিৎসা, অবিচার থাকতেই পারে, কিন্তু একটি মুক্তিপ্রাপ্ত দেশে এগুলো থাকে না।
বাংলাদেশের সংবিধানে ওপরের ঘোষণায় 'ঐতিহাসিক সংগ্রাম' শব্দগুচ্ছটির অর্থ 'অত্যাচার-উৎপীড়ন, শোষণ-লুণ্ঠন প্রতিরোধে বাংলাদেশের জনগণের ১৭৬০ সাল থেকে ১৯৪৬ সালতক ঐতিহাসিক সংগ্রাম।' এই সংগ্রামগুলো পর্যালোচনা করলে দুটি বিষয় স্পষ্টত লক্ষ করা যায়। এক. কৃষক জনসাধারণের আপনাআপনি সংগঠিত হওয়া। যার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৮৭২-৭৩ সালে সিরাজগঞ্জের কৃষক বিদ্রোহের সময় সিরাজগঞ্জের ম্যাজিস্ট্রেট নোলান তাঁর রিপোর্টে বলেন, 'অত্যন্ত পশ্চাৎপদ অঞ্চলেও আন্দোলন বিস্তার লাভ করছে। শত শত গ্রামের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের উত্তেজনা এক বিরাট কৃষক সমিতির মধ্যে সংহত রূপ গ্রহণ করছে।' দুই. এই সংগ্রামগুলোর চরিত্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ অর্থাৎ লোকায়ত, যার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। তেভাগা আন্দোলনের সময় ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে নীলফামারী শহরে একটি কৃষক সমাবেশ ডাকা হয়। ডিমলা গ্রাম থেকে চাষিদের এক বিরাট মিছিল যাত্রাপথে ডোমারে উপস্থিত হয়। সেখানে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম ও আহারের ব্যবস্থা করা হয়। পাঁচ-ছয় হাজার লোকের প্রত্যেকের জন্য এক মুঠো খিচুড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে, একসঙ্গে রান্না হিন্দু ও মুসলমান খাবে কী করে। আয়োজকরা হতবাক, উপায় কী! হঠাৎ দিগন্ত কাঁপিয়ে স্লোগান উঠল_'দাড়ি টিকি ভাই ভাই, লড়াইয়ের ময়দানে জাতিভেদ নাই।'
১৯৭৮ সালের সামরিক আইন দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপন দ্বারা ওপরের ঘোষণাটির বিচ্যুতি ঘটানো হয়। 'জাতীয় মুক্তির জন্য' ঘোষণাটি পরিবর্তন করে 'জাতীয় স্বাধীনতার জন্য' শব্দগুলো এবং 'ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে' ঘোষণাটির পরিবর্তে 'ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে' শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হয়। এ ছিল এক ধূর্ত পরিবর্তন। যথা_এক. 'মুক্ত' শব্দটি বদলে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল অনাহার কিংবা অনটন হঠাৎ বা চরম নয়, সেটাকে সমাজব্যবস্থার মজ্জাগত করার চাতুরী। দুই. শুধু 'যুদ্ধ' হিসেবে উল্লেখ করে ১৯৭১ সালের সংগ্রামকে বাংলাদেশের জনগণের ২০০ বছরাধিক লোকায়ত সংগ্রামগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করার চাতুরী। পঞ্চদশ সংশোধন আমাদের আদি ঘোষণাগুলো ফিরিয়ে দিয়েছে।
বাহাত্তরের সংবিধানের 'রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি' শিরোনামযুক্ত দ্বিতীয় ভাগে সুনির্দিষ্ট ছিল যে 'জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা' রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে 'সমাজতন্ত্র' ব্যাপক অর্থে সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছিল। সেটাকে ওই সামরিক আইন প্রজ্ঞাপন কর্তৃক প্রতিস্থাপিত অনুচ্ছেদে সংকীর্ণ ও নির্দিষ্ট করা হয় এইরূপ: 'সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার।' শুধু তাই-ই নয়, সংবিধানের ১০ অনুচ্ছেদটি বাদ দেওয়া হয় যার উদ্ধৃতি এই : 'সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি। মানুষের ওপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে। পঞ্চদশ সংশোধন সমাজতন্ত্রের আদি চরিত্র ও ১০ অনুচ্ছেদটি ফেরত এনেছে।'
বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার একটি মূলনীতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে দেওয়া ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা, যার উদ্ধৃতি এই : 'ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাঁহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।' সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদটির বাধ্যবাধকতায় সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে দেওয়া দল গঠনের মৌলিক অধিকারে শর্ত দেওয়া ছিল যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করার কিংবা তার সদস্য হওয়ার অধিকার থাকবে না। ওই সামরিক আইন প্রজ্ঞাপন দ্বারা বাংলাদেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটির সর্বনাশ করা হয়। যথা_এক. সংবিধানের প্রারম্ভে প্রস্তাবনার আগে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে)' বাক্য দুটি সনি্নবেশিত করা হয়। দুই. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি থেকে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' বাদ দেওয়া হয়। তিন. ১২ অনুচ্ছেদটি বিলুপ্ত করা হয়। চার. ৩৮ অনুচ্ছেদের উপরিউক্ত শর্তটি যা দ্বারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, সেটা বাদ দেওয়া হয়। পাঁচ. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ভাগে শেষ অনুচ্ছেদের আদিটিকে এক দফা করে দুই দফা যোগ করা হয়, যার উদ্ধৃতি এই : 'রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।' অতঃপর উপরিউক্ত বিচ্যুতির ছত্রচ্ছায়ায় পরবর্তী সামরিক শাসক সংবিধানে অতিরিক্ত একটি অর্থহীন বিচ্যুতি করলেন সংবিধানে নতুন ২ক অনুচ্ছেদ যুক্ত করে, যার উদ্ধৃতি এই : 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।'
১৯৩৮ সালে 'মুত্তাহিদা কওমিয়াত আউর ইসলাম' (সম্মিলিত জাতীয়তা এবং ইসলাম) শিরোনামে উর্দু ভাষায় প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রধান মওলানা হুসেন আহমদ মাদানী লিখেছিলেন, 'একটি জাতি গঠনে ধর্ম অপরিহার্য উপাদান নয়। কারণ কোরআনের সব জায়গায় মুসলমানদের একই মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কখনো একই কওমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আরবি ভাষায়, বিশেষ করে কোরআনে, 'মিল্লাত' শব্দটি আইন ও ধর্ম অর্থে এবং 'কওম' জাতি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। শব্দ দুটির মধ্যে রয়েছে দুনিয়ার ব্যবধান। জাতিকে যদি তুলনা করা হয় জমিনের সাথে, তাহলে মিল্লাত হচ্ছে আসমানের মতো।'
পঞ্চদশ সংশোধন আইনটি সংবিধানের আদি খাঁটি নির্ভেজাল ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটি ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ১২ অনুচ্ছেদটি পুনঃস্থাপিত হয়েছে, কিন্তু বিলুপ্ত হয়নি প্রস্তাবনার আগে সনি্নবেশিত ধর্মীয় উচ্চারণ কিংবা ২ক অনুচ্ছেদটি এবং পুনঃস্থাপিত হয়নি ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তটি। সুতরাং যে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির আকাঙ্ক্ষায় হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের জনগণ সংগ্রাম করে চলেছেন, তার বাস্তবায়নের জন্য আবার ভোটবিপ্লব না জনবিপ্লব প্রয়োজন, তার উত্তর একমাত্র আগামীকালের ইতিহাসই দিতে পারে।
'ইতিহাস পর্যালোচনায় সর্বজনীন দুটি সত্য উঠে আসে। একটি হচ্ছে, ঘটনাগুলো পাল্টানোর গতি খুবই বেশি এবং খুবই দ্রুতলয়ে হয়, যা কেউ ভাবেন না। অন্যটি হচ্ছে, সেগুলো পাল্টানোর গতি খুবই কম এবং খুবই ধীরলয়ে হয়, এমনটি যা কেউ ভাবেন না। উভয় সত্যেরই ব্যাখ্যা দেওয়া যায় সমসাময়িক বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। ভালো হোক কিংবা মন্দ হোক, আমরা সব সময় দেখি যা ঘটে, সেটা খানিকটা অপ্রত্যাশিত।' (জে. এম. রবার্টস, পেনগুইন হিস্টরি অব দি ওয়ার্ল্ড)
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ
সুপ্রিম কোর্ট
No comments