দুর্গাপূজা-সম্প্রীতির সর্বজনীন উৎসব
আজ বাঙালি হিন্দুর সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব_ দুর্গাপূজার সূচনা। মহালয়া থেকেই দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিক আরম্ভ হলেও মূল উৎসব শুরু হয় ষষ্ঠীতে। পঞ্জিকামতে আজ ষষ্ঠী। পাঁচ দিনব্যাপী উৎসবের শুরুর দিন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতে উৎসবের যাবতীয় আয়োজন শেষ। পূজার সাজে সেজে উঠেছে আমাদের প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামসহ বিভিন্ন রাজ্য। শুধু ভারত ও বাংলাদেশেই নয়, প্রবাসী ও অনাবাসী বাঙালিদের
মধ্যেও বেজে উঠেছে উৎসবের ঢাক। সুদূর নিউইয়র্ক-লন্ডনেও বসেছে মণ্ডপ। দুর্গা সর্বভারতীয় দেবী হলেও, দুর্গাপূজা বাংলার বাইরে এত আড়ম্বর সহকারে উদযাপিত হয় না। ফলে দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুর উৎসব হিসেবেই খ্যাত। আর কালের পরিক্রমায় পূজা শুধু বাঙালি হিন্দুর প্রধান উৎসব হিসেবে নয়, বাঙালি মাত্রেরই উৎসবে পরিণত হয়েছে। শরৎকালে নদীর ধারে যখন কাশফুলের শুভ্র সমারোহ, আকাশে যখন পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টির আভাস_ তখনই দূর গ্রামে ঢাকের আওয়াজে বাঙালি মাত্রেরই বুকে এক গভীর দ্যোতনা সৃষ্টি করে। বছর ঘুরে আবারও সেই ঢাক বেজে উঠেছে, কুমারপাড়ায় প্রতিমা শিল্পীরা কাজ শেষ করে দেবীর প্রতিমূর্তি স্থাপন করেছেন মণ্ডপে মণ্ডপে। কোথাও ব্যক্তিগত আয়োজনে বনেদি বাড়ির পূজা, কোথাও-বা বারোয়ারি পূজার আয়োজনে মুখরিত হয়ে উঠেছে লোকালয়। ইতিমধ্যে উৎসবের জন্য শহর ছেড়ে অনেকেই ফিরেছেন মাটির টানে। অবশ্য শহরেও আয়োজনের কমতি নেই। ষষ্ঠী থেকে ক্রমে মণ্ডপগুলো জমে উঠবে। ষষ্ঠীতে বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস, সপ্তমীতে দেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ। এভাবে অষ্টমী-নবমীর আচার শেষে দশমীতে দেবীর বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পূজার আনুষ্ঠানিকতা। ধর্মীয় মতে, এবার দেবীর গজে আগমন, আর দোলায় গমন। গজে আগমনের তাৎপর্য হলো, দেবীর আশীর্বাদে বসুন্ধরা শস্যে পূর্ণ হয়ে উঠবে। পূজারি ও ধার্মিকরা দেবীর কাছে সমৃদ্ধি ও সুখের প্রার্থনা জানাবেন, দেশ ও দশের কল্যাণ কামনা করবেন। দেবীর আগমন ও প্রত্যাবর্তনের এই উৎসবের মধ্য দিয়ে ভক্তদের মধ্যে যেমন ধর্মভাব জাগবে, তেমনি নতুন চৈতন্যোদয় ঘটবে। এই পূজা উৎসবে কল্যাণ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও সৌহার্দ্যের বারতা ছড়িয়ে যাবে দিকে দিকে। পূজারিরা বিশ্বাস করেন, দুর্গা মাতৃরূপিণী- জননী ও জন্মভূমির প্রতীক। তিনি স্বাধীনতা ও বিজয়েরও প্রতীক। বিশ্বাস করা হয়, তার আগমনের মধ্য দিয়ে ফুল ও ফসলের সমৃদ্ধি যেমন ঘটে তেমনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, অপশক্তির বিরুদ্ধে সততার, নেতির বিরুদ্ধে ইতির বিজয় ঘোষিত হয়। জরা-ক্লান্তি-পাপ-তাপবিদ্ধ পৃথিবীতে নতুন প্রাণের প্রণোদনা জাগিয়ে, মুক্তির বারতা বয়ে আনেন দেবী দুর্গা। তার অকালবোধন সংসার-সমাজ-প্রকৃতিতে নতুন প্রাণের উদ্বোধন ঘটায়। ফলে এ পূজার মধ্য দিয়ে ভক্তদের মধ্যে শিক্ষা, সচেতনতা, কর্মোদ্দীপনা, দেশমাতৃকার প্রতি নতুন ভালোবাসা জন্মে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের চেতনা শানিত হয়। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সমাজে শুভ ও শান্তির নবোত্থান ঘটুক, সেটাই প্রত্যাশা। যুগ যুগ ধরে যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের পরিবেশে এ দেশে দূর্গাপূজা পালিত হয়ে আসছে এবারও তার ব্যত্যয় ঘটবে না বলেই আমাদের চাওয়া। এবারও ধর্ম-বর্ণ-দলমত নির্বিশেষে সকলে উৎসবে মেতে উঠবেন। প্রতিবেশীর সঙ্গে ভাগ করে নেবেন আনন্দ। কোনোভাবেই যেন ধর্মীয় উৎসবের শান্তি বিঘ্ন না ঘটে সে জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর থাকবে বলেই আমরা আশা করি।
No comments