অমরত্বের সুধা by মাহ্ফুজ রাহমান
মৃত্যু মানুষের এক অমোঘ নিয়তি, সত্যিই কি তাই? এটি জিনগত বৈশিষ্ট্য। এ কারণেই বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর প্রতিকার সম্ভব। সম্ভব হলেই মানুষ পেতে পারে অমরত্বের স্বাদ। যেহেতু জীবের প্রতিটি জৈবিক কার্যকলাপ জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেহেতু মৃত্যুর জন্য কোনো না কোনো জিন দায়ী। তাকে ইতিমধ্যে ল্যাথাল জিন বা মারণ জিন বলে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। ল্যাথাল জিন বিশেষ কোনো জিন নয়, খুব সাধারণ একটি জিন। এটি মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে।
ঘটায় মানব জীবনের রহস্যময় একটি ঘটনা। এ কারণেই একদল বিজ্ঞানী বলছেন, তারা পৃথিবীর নশ্বর মানুষকে অমরত্বের সুধা এনে দিতে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গবেষকরা বলছেন, ক্রোমোজমের প্রান্তদেশে অবস্থিত টেলোমিয়ার কোষ বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে। এক সময় কোষে টেলোমিয়ার নিঃশেষ হলে এর পুনরুৎপাদন হয় না। তখনই কোষ মারা যায়। তবে টেলোমেরাসি নামে একটি এনজাইম আছে। তা এ প্রক্রিয়াকে ঘুরিয়ে দেয়। একদল বয়স্ক ইঁদুরের শরীরে টেলোমেরাসি প্রয়োগ করে তাদের বয়সজনিত অসুস্থতা দূর করা সম্ভব হয়। দেখা গেছে, ইঁদুরগুলো শুধু সবলই হয়নি, তরুণও হয়ে গেছে। গবেষকদের দাবি, অদূর ভবিষ্যতে মানুষের ক্ষেত্রেও একই ফল পাওয়া সম্ভব। ধরা যাক পৃথিবীর মানুষ যদি অমরও হয়, তাহলে মানুষ সুখী হবে, নাকি ভোগ করবে অমর জীবনের তীব্র যন্ত্রণা?
অমরত্বেও যন্ত্রণা
অমরত্ব মানুষের চিরআরাধ্য হলেও এই অমরত্ব হয়ে উঠতে পারে চরম যন্ত্রণার। অনেক মনোবিজ্ঞানী এবং গবেষক বিশ্বাস করেন, বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক মানব সভ্যতার যাত্রা কেবল শুরু হয়েছে। এ মুহূর্তে মানুষ আসলে অমর হওয়ার জন্য যোগ্য নয়।
মানুষ যদি নির্দিষ্ট একটা সময় অমরও হয়, তাহলে তাকে আসতে হবে অনেক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। অনেকে বলছেন, মানুষ প্রকৃতপক্ষে অমর। এক্ষেত্রে তারা শক্তির অবিনশ্বরতার যুক্তি দেখান। শক্তির অবিনশ্বরতার সূত্রটি হলো, শক্তির ক্ষয় কিংবা বিনাশ হয় না। এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরিত হয় মাত্র।
তাদের মতে, এক হাজার বছর আগে যারা মারা গিয়েছেন, বিবর্তনের ধারায় মিশে গিয়ে তারা এখন বিচরণ করছেন পৃথিবীর আলো-বাতাসে। এ মতবাদে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীরা বলেন, এক মিলিয়ন বছর আগে যে মানুষেরা মারা গেছেন, তাদের শরীরের অণু-পরমাণুগুলো এখনও আমাদের শরীরে বিচরণ করছে। অর্থাৎ তারা মূলত আমাদের শরীরে বিচরণ করছেন। তাদের প্রশ্ন, মানুষ যদি অমরও হয় তাহলে বর্তমান সময়ের মানুষ আজ থেকে এক হাজার বছর পরের উপভোগ্য জিনিসগুলো একইভাবে উপভোগ করতে পারবে কি? আমরা কি এক হাজার বছর পর পরিবর্তনশীল ভাষার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারব? কিংবা ধরা যাক, যদি এমন হয়_ এক মিলিয়ন বছর আগে মানুষ যদি অমর হতো তাহলে সেই গুহাবাসী মানুষ কি আজকের সভ্যতার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারত? তাদের আরও প্রশ্ন, মানুষ অমর হলে থেমে যাবে কি মানব সভ্যতার বিবর্তন? এ পক্ষের যুক্তিবাদীদের দাবি, মানুষের এক প্রজন্ম প্রাকৃতিকভাবে কখনোই নিজেদের বিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে পারে না। কারণ এটি সম্পূর্ণভাবে একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার। নিজেদের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়ে আরেকটি প্রজাতি তৈরি করা কিংবা নিজেদের গুণগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা শুধু মানুষ কেন, জীবজগতের কোনো প্রজাতির পক্ষেই সম্ভব নয়। এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক একটি প্রক্রিয়া। এ ছাড়া একবার ভাবুন তো, মানুষ যদি অমরও হয় তাহলে পৃথিবীতে প্রাণী প্রজাতির বিবর্তন থেমে থাকবে না। বিবর্তিত সেই প্রাণী প্রজাতির সঙ্গে অমর মানুষ কি তাদের মানিয়ে নিতে পারবে? কিংবা মানুষ কি সহ্য করতে পারবে তার মৃত্যু কিংবা বিবর্তন বলে কিছুই নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে বর্তমান প্রজন্মের অমর মানুষকে চিড়িয়াখানায় দর্শনীয় বস্তু হিসেবে আবদ্ধ করে রাখবে না তার নিশ্চয়তাই বা কোথায়?
সমস্যা আছে আরও। বয়স বাড়বে না। তবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত_ মানুষের মস্তিষ্ক ক্রমেই কর্মশুণ্য হয়ে পড়ে। একটি নির্দিষ্ট বয়সে এসে মানুষ মনে রাখতে পারে না কোনো কিছু। ধরা যাক, প্রতি সপ্তাহে আপনার মোবাইল ফোন নম্বর পরিবর্তন করেন। প্রতিটি নতুন নম্বর আপনাকে মনে রাখতে হয়। তাহলে পাঁচ থেকে ছয়বার নম্বর পরিবর্তনের পর প্রথম নম্বরটি সম্ভবত আর মনে পড়বে না আপনার। কিংবা মনে রাখাটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। এখন মানুষ যদি অমর হয়, তাহলে এক হাজার বছর আগের কিংবা শৈশবের বিশেষ কোনো স্মৃতি আর মনে রাখতে পারবে না মানব মস্তিষ্ক। একজন মরণশীল মানুষের মস্তিষ্ক কখনোই একজন অমর মানুষের মস্তিষ্কের ভার বহন করতে পারবে না। কারণ একটাই, মানুষের মস্তিষ্ক বৃদ্ধ হয়। কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। মানুষ অমর হলে যতই সময় যাবে ততই একটি স্মৃতিস্তরের নিচে চাপা পড়বে আরেকটি স্মৃতি। তৈরি হবে স্মৃতির পাহাড়।
আবার এমনও হতে পারে, নিজেকে বোঝা হিসেবে মনে করবেন আপনি। সময় যতই পেরিয়ে যাবে ততই জীবনটা ছোট মনে হবে আপনার কাছে। ধরা যাক, আপনার জন্মদিনে আপনাকে কেউ এক বাক্স উপহার পাঠাল। আপনি চমৎকৃত হবেন। বিস্ময়াভিভূত হবেন। কিন্তু একই পরিমাণ উপহার যদি বিল গেটসের কাছে পাঠানো হয়, তাহলে বিষয়টি তার জন্য মামুলি হবে। এ কারণে সময় যতই যাবে ততই দীর্ঘ জীবন আপনার কাছে উপভোগহীন মনে হবে। অর্থহীন হয়ে পড়বে।
মৃত্যু অনেক সময় হয়ে ওঠে যন্ত্রণার মুক্তিদাতা। ধরুন, আপনি অমর। একজন অমর সুখী মানুষ হিসেবে আপনি নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরা করেন। ধরুন, কোনো এক সময় দুর্ঘটনায় আপনি গুরুতরভাবে আহত হলেন। দীর্ঘকাল শুয়ে আছেন হাসপাতালের বিছানায়। জীবনের প্রতি বিরক্ত। আর ঠিক তখনই বুঝবেন অমরত্বের ফাঁদে আটকা পড়েছেন আপনি। চাইলেও আর মরা যাবে না। ধরা যাক, একটি ভূমিকম্প হলো। আপনি চাপা পড়লেন কোনো ভেঙেপড়া ভবনের নিচে। একাকিত্ব ও অনাহারে কষ্ট পাবেন আপনি। আপনার শুধু একটি কাজ করার আছে। তা হলো উদ্ধারের অপেক্ষা। তাতে যত সময়ই লাগুক। তখনই আপনার কাছে মনে হবে অমরত্ব লাভ করে কোনো ফাঁদে আটকা পড়েছেন আপনি।
ডেডলাইন ২০৪৫
এ বছর ফ্রেব্রুয়ারিতে টাইমস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন পড়ে চমকে উঠেছিল বিশ্ববাসী। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আগামী ২০৪৫ সালের মধ্যে অমর হতে যাচ্ছে মানুষ। অবশ্য এতে প্রযুক্তিগতভাবে ভার্চুয়াল জগৎ তৈরি করে মানুষকে অমর করার যুক্তি দেখানো হয়েছিল।
এতে বলা হয়, আধুনিক প্রযুক্তি ও কম্পিউটার ২০৪৫ সালেই মানুষের হাতে তুলে দেবে অমরত্বের মহৌষধ। এখানে একটি বিপ্লবের কথা বলা হয়েছে। তার নাম দেওয়া হয়েছে 'সিঙ্গুলারিটি বিপ্লব'। সিঙ্গুলারিটি বিপ্লবের অর্থ একত্র করা হবে যন্ত্র এবং মানুষকে। এতে বলা হয়, মানুষ ও যন্ত্র এখন একে অন্যের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পথে। গবেষকদের দাবি, এর প্রথম ধাপ শুরু হয়েছিল কৃষি বিপ্লব থেকে। কৃষি বিপ্লবের আট হাজার বছর পর শুরু হয় শিল্প বিপ্লব। শিল্প বিপ্লবের ১২০ বছর পর বিজলি বাতি আবিষ্কৃত হয়। এর মাত্র ৯০ বছরের ভেতরে মানুষ তার কল্পবিলাসের চূড়ান্তে পেঁৗছে যায়। পা রাখে চাঁদের মাটিতে। তার ২২ বছর পর পুরো পৃথিবী একটি একক গ্রামে পরিণত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। আবির্ভাব ঘটে 'ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েব'-এর। ইন্টারনেটের জালে পুরো বিশ্ব আবৃত করার মাত্র ৯ বছরের মাথায় মানুষের জিন মানচিত্র তৈরি হয়ে যায়। টাইম জানিয়েছে, পরিবর্তনের এ ত্বরণের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিকটি হলো কম্পিউটিং শক্তিমত্তা। এটি এমন গতিতে এগোচ্ছে যা সব ধরনের আপাত অসম্ভব কল্পবিজ্ঞানকেও সম্ভব করে তুলছে। তার লেখচিত্র আমাদের সেই বছরের দিকে ইঙ্গিত করে যখন যন্ত্র আর মানুষ একে অন্যের পরিপূরক হয়ে ওঠার সন্ধিক্ষণ ঘটবে। এ বছরটি হলো ২০৪৫। তখন এ জগতের নেতৃত্বের লাগাম তুলে নেবে সিঙ্গুলারিটি। এ সিঙ্গুলারিটি বিপ্লবই একপর্যায়ে 'হিউম্যানকাইন্ড'কে সরিয়ে 'মেশিনকাইন্ড'-এর যুগের সূচনা করবে।
হতে পারে, একদিন মানুষ কম্পিউটারের সঙ্গে সুপার ইন্টেলিজেন্স সাইবার হিসেবে আবির্ভূত হবে। হতে পারে, এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই আমাদের অনির্দিষ্টকালের জন্য জীবন দান করবে। এক্ষেত্রে হয়তো আমাদের চেতনা স্ক্যান করে কম্পিউটারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। এরপর ভার্চুয়ালি বা কৃত্রিমভাবে আমরা একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে অমর হয়ে যাব। তখন কম্পিউটার হয়ে উঠবে অবিকল মানুষ। কম্পিউটারই রূপ নেবে মানবিকতায়। তখন আমাদের বিলুপ্তি ঘটবে। বিজ্ঞানের ভাষায়_ এমন পরিবর্তনকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি। সিঙ্গুলারিটি মূলত বিবর্তনবাদী একটা সময় ও স্থানকে নির্দেশ করে। তবে সেখানে পদার্থ বিজ্ঞানের অনেক সাধারণ নিয়মই খাটে না। ঠিক যেমন খাটে না বল্গ্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরের ক্ষেত্রে। যখন সিঙ্গুলারিটির কথা বলা হবে তখন মনে হতে পারে, এটি কোনো গল্প। হয়তো কোনো সায়েন্স ফিকশনের কথা বলা হচ্ছে। তবে এটি মোটেও হালকা কোনো বিষয় নয়। সিঙ্গুলারিটি আগামী পৃথিবীর জীবনধারার একটি অনুপম পূর্বাভাস। অবশ্য সায়েন্স ফিকশনে এর বাইরে অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক তত্ত্ব আছে। কিন্তু সিঙ্গুলারিটি সেসব তত্ত্বের চেয়ে একেবারেই আলাদা। এটি এমন একটি তত্ত্ব, বিবর্তনকে নির্দেশ করে যা বিশ্বজুড়েই এখন বিভিন্নভাবে সমাদৃত। নাসাও এ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা এবং এ সংক্রান্ত গবেষণায় জড়িত। বছর তিনেক আগে নাসা প্রতিষ্ঠা করেছে সিঙ্গুলারিটি ইউনিভার্সিটি। সেখানে গ্র্যাজুয়েট ও নির্বাহীদের ইন্টারডিসিপ্লিনারি কোর্স পড়ানো হয়। মূলত এ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই মানুষের অমরত্বের কথা তুলে ধরেছে টাইম। তবে সত্যি এ রকম কিছু ঘটবে কি-না বা আদৌ কম্পিউটারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা সিঙ্গুলারিটির প্রভাবে সেই দিন দেখা যাবে কি-না তা সময়ই বলে দেবে।
আধুনিক প্রযুক্তি ক্রমেই ছুটছে অকল্পনীয় গতিতে। অচিরেই প্রতি ঘণ্টার বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি হবে অতীতের এক শতাব্দীর সমান সময়ের। অসীম জীবন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এবার ভাবুন, শত জনমের আরাধ্য অমরত্বের পানীয় আপনার হাতে। আপনি চাইলেই হয়ে উঠতে পারেন অমর মানুষ। আপনি কী করবেন? পান করে অমরত্বের যন্ত্রণাদায়ক জীবনে যাবেন, নাকি উপভোগ করবেন উপভোগ্য নশ্বর ক্ষণস্থায়ী জীবন? া
গবেষকরা বলছেন, ক্রোমোজমের প্রান্তদেশে অবস্থিত টেলোমিয়ার কোষ বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে। এক সময় কোষে টেলোমিয়ার নিঃশেষ হলে এর পুনরুৎপাদন হয় না। তখনই কোষ মারা যায়। তবে টেলোমেরাসি নামে একটি এনজাইম আছে। তা এ প্রক্রিয়াকে ঘুরিয়ে দেয়। একদল বয়স্ক ইঁদুরের শরীরে টেলোমেরাসি প্রয়োগ করে তাদের বয়সজনিত অসুস্থতা দূর করা সম্ভব হয়। দেখা গেছে, ইঁদুরগুলো শুধু সবলই হয়নি, তরুণও হয়ে গেছে। গবেষকদের দাবি, অদূর ভবিষ্যতে মানুষের ক্ষেত্রেও একই ফল পাওয়া সম্ভব। ধরা যাক পৃথিবীর মানুষ যদি অমরও হয়, তাহলে মানুষ সুখী হবে, নাকি ভোগ করবে অমর জীবনের তীব্র যন্ত্রণা?
অমরত্বেও যন্ত্রণা
অমরত্ব মানুষের চিরআরাধ্য হলেও এই অমরত্ব হয়ে উঠতে পারে চরম যন্ত্রণার। অনেক মনোবিজ্ঞানী এবং গবেষক বিশ্বাস করেন, বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক মানব সভ্যতার যাত্রা কেবল শুরু হয়েছে। এ মুহূর্তে মানুষ আসলে অমর হওয়ার জন্য যোগ্য নয়।
মানুষ যদি নির্দিষ্ট একটা সময় অমরও হয়, তাহলে তাকে আসতে হবে অনেক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। অনেকে বলছেন, মানুষ প্রকৃতপক্ষে অমর। এক্ষেত্রে তারা শক্তির অবিনশ্বরতার যুক্তি দেখান। শক্তির অবিনশ্বরতার সূত্রটি হলো, শক্তির ক্ষয় কিংবা বিনাশ হয় না। এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরিত হয় মাত্র।
তাদের মতে, এক হাজার বছর আগে যারা মারা গিয়েছেন, বিবর্তনের ধারায় মিশে গিয়ে তারা এখন বিচরণ করছেন পৃথিবীর আলো-বাতাসে। এ মতবাদে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীরা বলেন, এক মিলিয়ন বছর আগে যে মানুষেরা মারা গেছেন, তাদের শরীরের অণু-পরমাণুগুলো এখনও আমাদের শরীরে বিচরণ করছে। অর্থাৎ তারা মূলত আমাদের শরীরে বিচরণ করছেন। তাদের প্রশ্ন, মানুষ যদি অমরও হয় তাহলে বর্তমান সময়ের মানুষ আজ থেকে এক হাজার বছর পরের উপভোগ্য জিনিসগুলো একইভাবে উপভোগ করতে পারবে কি? আমরা কি এক হাজার বছর পর পরিবর্তনশীল ভাষার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারব? কিংবা ধরা যাক, যদি এমন হয়_ এক মিলিয়ন বছর আগে মানুষ যদি অমর হতো তাহলে সেই গুহাবাসী মানুষ কি আজকের সভ্যতার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারত? তাদের আরও প্রশ্ন, মানুষ অমর হলে থেমে যাবে কি মানব সভ্যতার বিবর্তন? এ পক্ষের যুক্তিবাদীদের দাবি, মানুষের এক প্রজন্ম প্রাকৃতিকভাবে কখনোই নিজেদের বিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে পারে না। কারণ এটি সম্পূর্ণভাবে একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার। নিজেদের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়ে আরেকটি প্রজাতি তৈরি করা কিংবা নিজেদের গুণগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা শুধু মানুষ কেন, জীবজগতের কোনো প্রজাতির পক্ষেই সম্ভব নয়। এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক একটি প্রক্রিয়া। এ ছাড়া একবার ভাবুন তো, মানুষ যদি অমরও হয় তাহলে পৃথিবীতে প্রাণী প্রজাতির বিবর্তন থেমে থাকবে না। বিবর্তিত সেই প্রাণী প্রজাতির সঙ্গে অমর মানুষ কি তাদের মানিয়ে নিতে পারবে? কিংবা মানুষ কি সহ্য করতে পারবে তার মৃত্যু কিংবা বিবর্তন বলে কিছুই নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে বর্তমান প্রজন্মের অমর মানুষকে চিড়িয়াখানায় দর্শনীয় বস্তু হিসেবে আবদ্ধ করে রাখবে না তার নিশ্চয়তাই বা কোথায়?
সমস্যা আছে আরও। বয়স বাড়বে না। তবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত_ মানুষের মস্তিষ্ক ক্রমেই কর্মশুণ্য হয়ে পড়ে। একটি নির্দিষ্ট বয়সে এসে মানুষ মনে রাখতে পারে না কোনো কিছু। ধরা যাক, প্রতি সপ্তাহে আপনার মোবাইল ফোন নম্বর পরিবর্তন করেন। প্রতিটি নতুন নম্বর আপনাকে মনে রাখতে হয়। তাহলে পাঁচ থেকে ছয়বার নম্বর পরিবর্তনের পর প্রথম নম্বরটি সম্ভবত আর মনে পড়বে না আপনার। কিংবা মনে রাখাটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। এখন মানুষ যদি অমর হয়, তাহলে এক হাজার বছর আগের কিংবা শৈশবের বিশেষ কোনো স্মৃতি আর মনে রাখতে পারবে না মানব মস্তিষ্ক। একজন মরণশীল মানুষের মস্তিষ্ক কখনোই একজন অমর মানুষের মস্তিষ্কের ভার বহন করতে পারবে না। কারণ একটাই, মানুষের মস্তিষ্ক বৃদ্ধ হয়। কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। মানুষ অমর হলে যতই সময় যাবে ততই একটি স্মৃতিস্তরের নিচে চাপা পড়বে আরেকটি স্মৃতি। তৈরি হবে স্মৃতির পাহাড়।
আবার এমনও হতে পারে, নিজেকে বোঝা হিসেবে মনে করবেন আপনি। সময় যতই পেরিয়ে যাবে ততই জীবনটা ছোট মনে হবে আপনার কাছে। ধরা যাক, আপনার জন্মদিনে আপনাকে কেউ এক বাক্স উপহার পাঠাল। আপনি চমৎকৃত হবেন। বিস্ময়াভিভূত হবেন। কিন্তু একই পরিমাণ উপহার যদি বিল গেটসের কাছে পাঠানো হয়, তাহলে বিষয়টি তার জন্য মামুলি হবে। এ কারণে সময় যতই যাবে ততই দীর্ঘ জীবন আপনার কাছে উপভোগহীন মনে হবে। অর্থহীন হয়ে পড়বে।
মৃত্যু অনেক সময় হয়ে ওঠে যন্ত্রণার মুক্তিদাতা। ধরুন, আপনি অমর। একজন অমর সুখী মানুষ হিসেবে আপনি নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরা করেন। ধরুন, কোনো এক সময় দুর্ঘটনায় আপনি গুরুতরভাবে আহত হলেন। দীর্ঘকাল শুয়ে আছেন হাসপাতালের বিছানায়। জীবনের প্রতি বিরক্ত। আর ঠিক তখনই বুঝবেন অমরত্বের ফাঁদে আটকা পড়েছেন আপনি। চাইলেও আর মরা যাবে না। ধরা যাক, একটি ভূমিকম্প হলো। আপনি চাপা পড়লেন কোনো ভেঙেপড়া ভবনের নিচে। একাকিত্ব ও অনাহারে কষ্ট পাবেন আপনি। আপনার শুধু একটি কাজ করার আছে। তা হলো উদ্ধারের অপেক্ষা। তাতে যত সময়ই লাগুক। তখনই আপনার কাছে মনে হবে অমরত্ব লাভ করে কোনো ফাঁদে আটকা পড়েছেন আপনি।
ডেডলাইন ২০৪৫
এ বছর ফ্রেব্রুয়ারিতে টাইমস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন পড়ে চমকে উঠেছিল বিশ্ববাসী। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আগামী ২০৪৫ সালের মধ্যে অমর হতে যাচ্ছে মানুষ। অবশ্য এতে প্রযুক্তিগতভাবে ভার্চুয়াল জগৎ তৈরি করে মানুষকে অমর করার যুক্তি দেখানো হয়েছিল।
এতে বলা হয়, আধুনিক প্রযুক্তি ও কম্পিউটার ২০৪৫ সালেই মানুষের হাতে তুলে দেবে অমরত্বের মহৌষধ। এখানে একটি বিপ্লবের কথা বলা হয়েছে। তার নাম দেওয়া হয়েছে 'সিঙ্গুলারিটি বিপ্লব'। সিঙ্গুলারিটি বিপ্লবের অর্থ একত্র করা হবে যন্ত্র এবং মানুষকে। এতে বলা হয়, মানুষ ও যন্ত্র এখন একে অন্যের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পথে। গবেষকদের দাবি, এর প্রথম ধাপ শুরু হয়েছিল কৃষি বিপ্লব থেকে। কৃষি বিপ্লবের আট হাজার বছর পর শুরু হয় শিল্প বিপ্লব। শিল্প বিপ্লবের ১২০ বছর পর বিজলি বাতি আবিষ্কৃত হয়। এর মাত্র ৯০ বছরের ভেতরে মানুষ তার কল্পবিলাসের চূড়ান্তে পেঁৗছে যায়। পা রাখে চাঁদের মাটিতে। তার ২২ বছর পর পুরো পৃথিবী একটি একক গ্রামে পরিণত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। আবির্ভাব ঘটে 'ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েব'-এর। ইন্টারনেটের জালে পুরো বিশ্ব আবৃত করার মাত্র ৯ বছরের মাথায় মানুষের জিন মানচিত্র তৈরি হয়ে যায়। টাইম জানিয়েছে, পরিবর্তনের এ ত্বরণের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিকটি হলো কম্পিউটিং শক্তিমত্তা। এটি এমন গতিতে এগোচ্ছে যা সব ধরনের আপাত অসম্ভব কল্পবিজ্ঞানকেও সম্ভব করে তুলছে। তার লেখচিত্র আমাদের সেই বছরের দিকে ইঙ্গিত করে যখন যন্ত্র আর মানুষ একে অন্যের পরিপূরক হয়ে ওঠার সন্ধিক্ষণ ঘটবে। এ বছরটি হলো ২০৪৫। তখন এ জগতের নেতৃত্বের লাগাম তুলে নেবে সিঙ্গুলারিটি। এ সিঙ্গুলারিটি বিপ্লবই একপর্যায়ে 'হিউম্যানকাইন্ড'কে সরিয়ে 'মেশিনকাইন্ড'-এর যুগের সূচনা করবে।
হতে পারে, একদিন মানুষ কম্পিউটারের সঙ্গে সুপার ইন্টেলিজেন্স সাইবার হিসেবে আবির্ভূত হবে। হতে পারে, এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই আমাদের অনির্দিষ্টকালের জন্য জীবন দান করবে। এক্ষেত্রে হয়তো আমাদের চেতনা স্ক্যান করে কম্পিউটারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। এরপর ভার্চুয়ালি বা কৃত্রিমভাবে আমরা একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে অমর হয়ে যাব। তখন কম্পিউটার হয়ে উঠবে অবিকল মানুষ। কম্পিউটারই রূপ নেবে মানবিকতায়। তখন আমাদের বিলুপ্তি ঘটবে। বিজ্ঞানের ভাষায়_ এমন পরিবর্তনকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি। সিঙ্গুলারিটি মূলত বিবর্তনবাদী একটা সময় ও স্থানকে নির্দেশ করে। তবে সেখানে পদার্থ বিজ্ঞানের অনেক সাধারণ নিয়মই খাটে না। ঠিক যেমন খাটে না বল্গ্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরের ক্ষেত্রে। যখন সিঙ্গুলারিটির কথা বলা হবে তখন মনে হতে পারে, এটি কোনো গল্প। হয়তো কোনো সায়েন্স ফিকশনের কথা বলা হচ্ছে। তবে এটি মোটেও হালকা কোনো বিষয় নয়। সিঙ্গুলারিটি আগামী পৃথিবীর জীবনধারার একটি অনুপম পূর্বাভাস। অবশ্য সায়েন্স ফিকশনে এর বাইরে অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক তত্ত্ব আছে। কিন্তু সিঙ্গুলারিটি সেসব তত্ত্বের চেয়ে একেবারেই আলাদা। এটি এমন একটি তত্ত্ব, বিবর্তনকে নির্দেশ করে যা বিশ্বজুড়েই এখন বিভিন্নভাবে সমাদৃত। নাসাও এ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা এবং এ সংক্রান্ত গবেষণায় জড়িত। বছর তিনেক আগে নাসা প্রতিষ্ঠা করেছে সিঙ্গুলারিটি ইউনিভার্সিটি। সেখানে গ্র্যাজুয়েট ও নির্বাহীদের ইন্টারডিসিপ্লিনারি কোর্স পড়ানো হয়। মূলত এ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই মানুষের অমরত্বের কথা তুলে ধরেছে টাইম। তবে সত্যি এ রকম কিছু ঘটবে কি-না বা আদৌ কম্পিউটারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা সিঙ্গুলারিটির প্রভাবে সেই দিন দেখা যাবে কি-না তা সময়ই বলে দেবে।
আধুনিক প্রযুক্তি ক্রমেই ছুটছে অকল্পনীয় গতিতে। অচিরেই প্রতি ঘণ্টার বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি হবে অতীতের এক শতাব্দীর সমান সময়ের। অসীম জীবন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এবার ভাবুন, শত জনমের আরাধ্য অমরত্বের পানীয় আপনার হাতে। আপনি চাইলেই হয়ে উঠতে পারেন অমর মানুষ। আপনি কী করবেন? পান করে অমরত্বের যন্ত্রণাদায়ক জীবনে যাবেন, নাকি উপভোগ করবেন উপভোগ্য নশ্বর ক্ষণস্থায়ী জীবন? া
No comments