মওলানা ভাসানীর কথাও বলুন by শাহ আহমদ রেজা
আওয়ামী লীগ সরকার প্রচণ্ড দাপটের সঙ্গেই জাতিকে স্বাধীনতার ‘সঠিক’ ইতিহাস শিখিয়ে চলেছে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, ইতিহাস শেখানোর এই কর্মকাণ্ডে সরকার দেশের সর্বোচ্চ আদালতকেও জড়িয়ে ফেলেছে। আদালতের রায়কে ব্যবহার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ ইতিহাস তথ্য ও প্রমাণভিত্তিক গবেষণার বিষয়, রায়ের বিষয় নয়।
আদালতের রায় দিয়ে কখনও ইতিহাস নির্ধারণ করা যায় না। পৃথিবীর কোনো দেশেই এরকম উদ্ভট নজির নেই। লক্ষণীয় দ্বিতীয় বিষয় হলো, সরকারের এই ‘সঠিক’ ইতিহাসের সবটুকু স্থান চলে গেছে একজন মাত্র নেতার দখলে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বাবা শেখ মুজিবুর রহমান। সরকার চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে শেখ মুজিব ছাড়া অন্য কোনো নেতারই ইতিহাসে কোনো স্থান বা স্বীকৃতি না জোটে। যাতে দল হিসেবেও শুধু আওয়ামী লীগের অবদানই প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে ‘সঠিক’ ইতিহাস কিন্তু সরকারের উদ্ভট এ চেষ্টাকে বাতিল করে দেয়। একটি উদাহরণ হিসেবে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করা যায়। কারণ, স্বায়ত্তশাসনের প্রাথমিক আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে তার ছিল বলিষ্ঠ ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাকও তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের যে পর্যায়ক্রমিক আন্দোলন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল, মওলানা ভাসানী ছিলেন তার প্রধান নির্মাতা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর আজকের বাংলাদেশ তথা তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি শোষণ, বঞ্চনা ও অবিচারের সূচনা হলে প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে এবং পরে নিজের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে গঠিত আওয়ামী লীগের মাধ্যমে তিনি স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে ক্রমাগত তীব্রতর করেছিলেন। মওলানা ভাসানী স্বায়ত্তশাসন চাইতেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ভিত্তি ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের মতো প্রতিটি প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যের জন্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি ঘোষিত হয়েছিল।
স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প হিসেবে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা চালানো ও জনমত সংগঠিত করা ছিল মওলানা ভাসানী পরিচালিত আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। স্বায়ত্তশাসনসহ প্রদেশের বিভিন্ন দাবি সংবলিত ২১ দফার ভিত্তিতে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে মওলানা ভাসানী একজন প্রধান নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করা সত্ত্বেও মূলত নেতৃত্বের কোন্দলে স্বায়ত্তশাসন পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। এসময় থেকেই মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার কথা বলতে শুরু করেছিলেন। ১৯৫৫ সালের ১৭ জুন এবং ১৯৫৬ সালের ৭ ও ১৫ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত তিনটি জনসভায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, স্বায়ত্তশাসন না দেয়া হলে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতার কথা চিন্তা করবে। বলা দরকার, ওই দিনগুলোতে স্বাধীনতার কথা বলা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ। কিন্তু দুর্দান্ত সাহসী নেতা মওলানা ভাসানী কোনো কিছুকে পরোয়া করেননি। সে কারণে পাকিস্তানিরা, এমনকি নিজের দলের অনেকেই মওলানা ভাসানীকে ‘হিন্দুস্থানের দালাল’ বানিয়ে ছেড়েছিল।
অন্যদিকে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন না দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হিসেবে আয়োজিত ‘কাগমারী সম্মেলনে’ মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ তথা বিদায় জানানোর এবং পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার আগাম ঘোষণা দিয়েছিলেন। বিষয়টি সাধারণ ছিল না। কারণ, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তখন কেন্দ্রে ও প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল। প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এদিকে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য নেতারা। তাদের প্রত্যেকেই সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানানোয় মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। পরিণতিতে মওলানা ভাসানীকে তার নিজের হাতে গড়া আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল; তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে নতুন একটি দল গঠন করেছিলেন (জুলাই, ১৯৫৭)। এরপর মওলানা ভাসানী ন্যাপের মাধ্যমে তার স্বাধীনতামুখী স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছেন।
১৯৬৯-এর যে গণঅভ্যুত্থান পাকিস্তান সরকারকে স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করে নিতে বাধ্য করেছিল, সে গণঅভ্যুত্থানের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন মওলানা ভাসানী। সেটা এমন এক সময় যখন শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে ছিলেন (১৯৬৬ সালের মে থেকে বন্দি শেখ মুজিবের পক্ষে চাইলেও কোনো ভূমিকা পালন করা সম্ভব ছিল না)। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে মওলানা ভাসানী ‘ঘেরাও’ নামের এক নতুন ধরনের আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ৪ ডিসেম্বর তার নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করেছিল। এই ঘেরাও আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত হয়েছিল ছাত্রসমাজের ১১ দফা আর ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানেই মুক্তি পেয়েছিলেন শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক বন্দিরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন ষড়যন্ত্রে এবং এদেশেরই কোনো কোনো নেতার প্রশ্নসাপেক্ষ ভূমিকায় স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন সাময়িককালের জন্য বিভ্রান্ত ও স্তিমিত হয়ে পড়লেও মওলানা ভাসানী পরিস্থিতিকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যখন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তখন স্বাধীনতার দাবি এসে গিয়েছিল মানুষের মুখে মুখে। স্বাধীনতামুখী এই অবস্থান থেকে জনগণকে আর কখনও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বস্তুত ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল সরাসরি পাকিস্তানবিরোধী সফল অভ্যুত্থান এবং তার প্রধান নির্মাতা ছিলেন মওলানা ভাসানী।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে ১২ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার যথারীতি এতে চরম উপেক্ষা দেখিয়েছে, এদেশের সব নেতাও তখন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী নিয়েছিলেন দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতার অবস্থান। হাসপাতালের বিছানা থেকে তিনি ছুটে গেছেন উপদ্রুত অঞ্চলে। ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ ভাসানী এরপরই সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ৩০ নভেম্বর এক প্রচারপত্রের মাধ্যমে আহ্বান জানানোর পরপর ৪ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে পবিত্র কোরআনের সূরা ‘কাফেরুন’ থেকে আয়াত উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘লাকুম দিনুকুম ওয়া লিয়াদিন’ (তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম আর আমাদের জন্য আমাদের ধর্ম)। অর্থাত্ তোমার রাস্তায় তুমি যাও, আমাকে আমার রাস্তায় চলতে দাও। এটা ছিল প্রকারান্তরে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা। এর ভিত্তিতেই মওলানা ভাসানীর ন্যাপ ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচন বর্জন করেছিল। প্রমাণিত হয়েছে, ন্যাপ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলেই আওয়ামী লীগের পক্ষে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করা এবং শেখ মুজিবের পক্ষে প্রধান নেতায় পরিণত হওয়া সম্ভব হয়েছিল।
নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালের ৭ জানুয়ারি মওলানা ভাসানী স্বাধীনতা সংগ্রামের পাঁচ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের পন্থা নির্ধারণের জন্য ৯ জানুয়ারি তার উদ্যোগে সন্তোষে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় সম্মেলন। ওই সম্মেলন থেকে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। ৩ মার্চ থেকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে আরও একবার স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বানে সোচ্চার হয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। ৪ মার্চ এক বিবৃতিতে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার ডাক দিয়েছিলেন। ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি ২৫ মার্চের মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ১৭ মার্চ চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইয়াহিয়ার উচিত এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা, যার কাজ হবে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রাপ্য সম্পদ পূর্ব পাকিস্তানকে বুঝিয়ে দেয়া। শেখ মুজিবের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ইয়াহিয়ার সঙ্গে সমঝোতা বৈঠক করার পরিবর্তে তার উচিত বাংলার সংগ্রামী নেতার ভূমিকা পালন করা। সর্বশেষ এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী ২৩ মার্চকে ‘লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন—যার অর্থ, ওইদিন থেকে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার অভিযান শুরু হয়েছিল, ৩ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী সন্তোষে মওলানা ভাসানীর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তিনি আসামের ফুলবাড়ি হয়ে ১৫ এপ্রিল ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। ভারতবিরোধী পরিচিতি থাকায় ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকার তাকে অঘোষিতভাবে নজরবন্দি অবস্থায় রেখেছিল। কিন্তু নিজের স্বাধীনতা হারিয়েও মওলানা ভাসানী দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে একজন প্রধান দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিবৃতি ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে তিনি জনগণের প্রতি স্বাধীনতা যুদ্ধ এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের কাছে বাংলাদেশকে সমর্থন ও স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তারবার্তা পাঠিয়েছেন। কলকাতায় গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো এবং ওই সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের একটি অংশের ও তত্কালীন মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্র নস্যাত্ করে দেয়া ছিল মওলানা ভাসানীর বিশেষ অবদান। মুজিবনগর সরকার তাকে উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি বানিয়েছিল এবং সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত পরিষদের একমাত্র সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন।
এভাবে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জন পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে মওলানা ভাসানী আপসহীন ও অগ্রবর্তী অবস্থানে থেকেছেন। সরকারের নির্যাতন, দলের ভাঙন ও সহকর্মীদের পক্ষত্যাগের মতো কোনো বাধা বা প্রতিকূলতাই তাকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। স্বাধীনতার পরও তার সেই দেশপ্রেমিক ভূমিকা অব্যাহত ছিল। প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের শোষণ, লুণ্ঠন এবং ভারতমুখী নীতি ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তিনিই প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ভারতের সম্প্রসারণবাদী হস্তক্ষেপ ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার থেকেছেন এবং মৃত্যুর মাত্র ছয় মাস আগে প্রায় ৯৬ বছর বয়সেও ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন (১৬ মে, ১৯৭৬)। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, কৃতজ্ঞতা জানানো দূরে থাকুক, এমন একজন সংগ্রামী জাতীয় নেতার নাম আজকাল যথাযথ সম্মানের সঙ্গে স্মরণও করা হয় না। সব মিলিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মকে বরং একথাই শোনানো হচ্ছে যেন নেতা ছিলেন মাত্র একজন এবং তিনি একাই সবকিছু করে গেছেন! এই দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার নাম বদলের কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়েও মওলানা ভাসানীর প্রতি চরম অবমাননা দেখিয়েছে। নভোথিয়েটারের নামে ‘ভাসানীর’ স্থলে ‘বঙ্গবন্ধ’ু জুড়ে দিয়েছে। অথচ ঐতিহাসিক সত্য হলো, মওলানা ভাসানী শুধু দেশ ও জাতির স্বার্থে আজীবন সংগ্রামই করে যাননি, তিনি শেখ মুজিবেরও প্রত্যক্ষ নেতা ছিলেন। জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্তও দু’জনের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের মতো। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালেও শেখ মুজিব প্রকাশ্যে মওলানা ভাসানীকে যথাযথ সম্মান দেখিয়েছেন, পরামর্শের জন্য একাকী গিয়ে হাজির হয়েছেন সন্তোষে। অথচ শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনাই মওলানা ভাসানীর নাম বাদ দিয়ে সেখানে নিজের বাবার নাম যুক্ত করেছেন। কাজটি করার আগে মওলানা ভাসানীর অবদান এবং দু’জনের সম্পর্কের কথাটাও চিন্তা করে দেখেননি!
সবশেষে বলা দরকার, একজন সংগ্রামী রাজনীতিক ও স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান নেতা হলেও শেখ মুজিব একাই সবকিছু করে যাননি। ‘সঠিক’ ইতিহাসে অন্য অনেকেরও অবদান রয়েছে, বিশেষ করে মওলানা ভাসানীর তো বটেই। মওলানা ভাসানীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে অন্য দলগুলোও সুবিচার করতে পারেনি, যার জন্য কোনো কোনো দলকে ১৯৭৫-পূর্ব ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়, প্রতিপক্ষের সামনে মাথানত করতে হয়। কারণ, স্বাধীনতামুখী দীর্ঘ সংগ্রামে দলগতভাবে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। কোনো কোনো দলের তখন অস্তিত্বও ছিল না। সে ইতিহাসে মওলানা ভাসানীর কিন্তু বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামী ভূমিকা রয়েছে। আসলেও একজন প্রধান জাতীয় নেতার ভূমিকা পালন করে গেছেন তিনি।
লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com
স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প হিসেবে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা চালানো ও জনমত সংগঠিত করা ছিল মওলানা ভাসানী পরিচালিত আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। স্বায়ত্তশাসনসহ প্রদেশের বিভিন্ন দাবি সংবলিত ২১ দফার ভিত্তিতে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে মওলানা ভাসানী একজন প্রধান নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করা সত্ত্বেও মূলত নেতৃত্বের কোন্দলে স্বায়ত্তশাসন পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। এসময় থেকেই মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার কথা বলতে শুরু করেছিলেন। ১৯৫৫ সালের ১৭ জুন এবং ১৯৫৬ সালের ৭ ও ১৫ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত তিনটি জনসভায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, স্বায়ত্তশাসন না দেয়া হলে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতার কথা চিন্তা করবে। বলা দরকার, ওই দিনগুলোতে স্বাধীনতার কথা বলা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ। কিন্তু দুর্দান্ত সাহসী নেতা মওলানা ভাসানী কোনো কিছুকে পরোয়া করেননি। সে কারণে পাকিস্তানিরা, এমনকি নিজের দলের অনেকেই মওলানা ভাসানীকে ‘হিন্দুস্থানের দালাল’ বানিয়ে ছেড়েছিল।
অন্যদিকে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন না দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হিসেবে আয়োজিত ‘কাগমারী সম্মেলনে’ মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ তথা বিদায় জানানোর এবং পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার আগাম ঘোষণা দিয়েছিলেন। বিষয়টি সাধারণ ছিল না। কারণ, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তখন কেন্দ্রে ও প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল। প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এদিকে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য নেতারা। তাদের প্রত্যেকেই সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানানোয় মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। পরিণতিতে মওলানা ভাসানীকে তার নিজের হাতে গড়া আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল; তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে নতুন একটি দল গঠন করেছিলেন (জুলাই, ১৯৫৭)। এরপর মওলানা ভাসানী ন্যাপের মাধ্যমে তার স্বাধীনতামুখী স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছেন।
১৯৬৯-এর যে গণঅভ্যুত্থান পাকিস্তান সরকারকে স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করে নিতে বাধ্য করেছিল, সে গণঅভ্যুত্থানের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন মওলানা ভাসানী। সেটা এমন এক সময় যখন শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে ছিলেন (১৯৬৬ সালের মে থেকে বন্দি শেখ মুজিবের পক্ষে চাইলেও কোনো ভূমিকা পালন করা সম্ভব ছিল না)। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে মওলানা ভাসানী ‘ঘেরাও’ নামের এক নতুন ধরনের আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ৪ ডিসেম্বর তার নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করেছিল। এই ঘেরাও আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত হয়েছিল ছাত্রসমাজের ১১ দফা আর ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানেই মুক্তি পেয়েছিলেন শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক বন্দিরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন ষড়যন্ত্রে এবং এদেশেরই কোনো কোনো নেতার প্রশ্নসাপেক্ষ ভূমিকায় স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন সাময়িককালের জন্য বিভ্রান্ত ও স্তিমিত হয়ে পড়লেও মওলানা ভাসানী পরিস্থিতিকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যখন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তখন স্বাধীনতার দাবি এসে গিয়েছিল মানুষের মুখে মুখে। স্বাধীনতামুখী এই অবস্থান থেকে জনগণকে আর কখনও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বস্তুত ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল সরাসরি পাকিস্তানবিরোধী সফল অভ্যুত্থান এবং তার প্রধান নির্মাতা ছিলেন মওলানা ভাসানী।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে ১২ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার যথারীতি এতে চরম উপেক্ষা দেখিয়েছে, এদেশের সব নেতাও তখন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী নিয়েছিলেন দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতার অবস্থান। হাসপাতালের বিছানা থেকে তিনি ছুটে গেছেন উপদ্রুত অঞ্চলে। ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ ভাসানী এরপরই সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ৩০ নভেম্বর এক প্রচারপত্রের মাধ্যমে আহ্বান জানানোর পরপর ৪ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে পবিত্র কোরআনের সূরা ‘কাফেরুন’ থেকে আয়াত উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘লাকুম দিনুকুম ওয়া লিয়াদিন’ (তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম আর আমাদের জন্য আমাদের ধর্ম)। অর্থাত্ তোমার রাস্তায় তুমি যাও, আমাকে আমার রাস্তায় চলতে দাও। এটা ছিল প্রকারান্তরে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা। এর ভিত্তিতেই মওলানা ভাসানীর ন্যাপ ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচন বর্জন করেছিল। প্রমাণিত হয়েছে, ন্যাপ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলেই আওয়ামী লীগের পক্ষে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করা এবং শেখ মুজিবের পক্ষে প্রধান নেতায় পরিণত হওয়া সম্ভব হয়েছিল।
নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালের ৭ জানুয়ারি মওলানা ভাসানী স্বাধীনতা সংগ্রামের পাঁচ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের পন্থা নির্ধারণের জন্য ৯ জানুয়ারি তার উদ্যোগে সন্তোষে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় সম্মেলন। ওই সম্মেলন থেকে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। ৩ মার্চ থেকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে আরও একবার স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বানে সোচ্চার হয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। ৪ মার্চ এক বিবৃতিতে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার ডাক দিয়েছিলেন। ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি ২৫ মার্চের মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ১৭ মার্চ চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইয়াহিয়ার উচিত এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা, যার কাজ হবে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রাপ্য সম্পদ পূর্ব পাকিস্তানকে বুঝিয়ে দেয়া। শেখ মুজিবের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ইয়াহিয়ার সঙ্গে সমঝোতা বৈঠক করার পরিবর্তে তার উচিত বাংলার সংগ্রামী নেতার ভূমিকা পালন করা। সর্বশেষ এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী ২৩ মার্চকে ‘লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন—যার অর্থ, ওইদিন থেকে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার অভিযান শুরু হয়েছিল, ৩ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী সন্তোষে মওলানা ভাসানীর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তিনি আসামের ফুলবাড়ি হয়ে ১৫ এপ্রিল ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। ভারতবিরোধী পরিচিতি থাকায় ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকার তাকে অঘোষিতভাবে নজরবন্দি অবস্থায় রেখেছিল। কিন্তু নিজের স্বাধীনতা হারিয়েও মওলানা ভাসানী দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে একজন প্রধান দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিবৃতি ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে তিনি জনগণের প্রতি স্বাধীনতা যুদ্ধ এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের কাছে বাংলাদেশকে সমর্থন ও স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তারবার্তা পাঠিয়েছেন। কলকাতায় গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো এবং ওই সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের একটি অংশের ও তত্কালীন মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্র নস্যাত্ করে দেয়া ছিল মওলানা ভাসানীর বিশেষ অবদান। মুজিবনগর সরকার তাকে উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি বানিয়েছিল এবং সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত পরিষদের একমাত্র সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন।
এভাবে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জন পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে মওলানা ভাসানী আপসহীন ও অগ্রবর্তী অবস্থানে থেকেছেন। সরকারের নির্যাতন, দলের ভাঙন ও সহকর্মীদের পক্ষত্যাগের মতো কোনো বাধা বা প্রতিকূলতাই তাকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। স্বাধীনতার পরও তার সেই দেশপ্রেমিক ভূমিকা অব্যাহত ছিল। প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের শোষণ, লুণ্ঠন এবং ভারতমুখী নীতি ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তিনিই প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ভারতের সম্প্রসারণবাদী হস্তক্ষেপ ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার থেকেছেন এবং মৃত্যুর মাত্র ছয় মাস আগে প্রায় ৯৬ বছর বয়সেও ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন (১৬ মে, ১৯৭৬)। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, কৃতজ্ঞতা জানানো দূরে থাকুক, এমন একজন সংগ্রামী জাতীয় নেতার নাম আজকাল যথাযথ সম্মানের সঙ্গে স্মরণও করা হয় না। সব মিলিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মকে বরং একথাই শোনানো হচ্ছে যেন নেতা ছিলেন মাত্র একজন এবং তিনি একাই সবকিছু করে গেছেন! এই দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার নাম বদলের কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়েও মওলানা ভাসানীর প্রতি চরম অবমাননা দেখিয়েছে। নভোথিয়েটারের নামে ‘ভাসানীর’ স্থলে ‘বঙ্গবন্ধ’ু জুড়ে দিয়েছে। অথচ ঐতিহাসিক সত্য হলো, মওলানা ভাসানী শুধু দেশ ও জাতির স্বার্থে আজীবন সংগ্রামই করে যাননি, তিনি শেখ মুজিবেরও প্রত্যক্ষ নেতা ছিলেন। জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্তও দু’জনের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের মতো। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালেও শেখ মুজিব প্রকাশ্যে মওলানা ভাসানীকে যথাযথ সম্মান দেখিয়েছেন, পরামর্শের জন্য একাকী গিয়ে হাজির হয়েছেন সন্তোষে। অথচ শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনাই মওলানা ভাসানীর নাম বাদ দিয়ে সেখানে নিজের বাবার নাম যুক্ত করেছেন। কাজটি করার আগে মওলানা ভাসানীর অবদান এবং দু’জনের সম্পর্কের কথাটাও চিন্তা করে দেখেননি!
সবশেষে বলা দরকার, একজন সংগ্রামী রাজনীতিক ও স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান নেতা হলেও শেখ মুজিব একাই সবকিছু করে যাননি। ‘সঠিক’ ইতিহাসে অন্য অনেকেরও অবদান রয়েছে, বিশেষ করে মওলানা ভাসানীর তো বটেই। মওলানা ভাসানীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে অন্য দলগুলোও সুবিচার করতে পারেনি, যার জন্য কোনো কোনো দলকে ১৯৭৫-পূর্ব ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়, প্রতিপক্ষের সামনে মাথানত করতে হয়। কারণ, স্বাধীনতামুখী দীর্ঘ সংগ্রামে দলগতভাবে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। কোনো কোনো দলের তখন অস্তিত্বও ছিল না। সে ইতিহাসে মওলানা ভাসানীর কিন্তু বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামী ভূমিকা রয়েছে। আসলেও একজন প্রধান জাতীয় নেতার ভূমিকা পালন করে গেছেন তিনি।
লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com
No comments