চিলেকোঠার রাতপ্রহরী by ঝর্ণা রহমান
মতিয়ারকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো সাত্তার মিয়া। লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলে, ম্ মতি ভাই, ত্ তুমি? ত্ তুমি ক্ কইত্থেইকা ক্ কেমনে.... তোতলাতে থাকে সাত্তার মিয়া। কিন্তু মতি সাত্তার মিয়ার কথার উত্তর না দিয়ে বলে, সাত্তার ভাই, ঘরে দাও আছে? গাছ কাটা দাও?
মতি মাথাটা অস্থিরভাবে এদিক ওদিক ঘোরায়Ñ যেন ঘরের দেয়ালে একটা গাছকাটা দা ঝুলে থাকবার কথা। ছাদের ওপর দুটো বাঁশের সাথে ঝোলানো তারের মধ্যে একটা ষাট পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। খোলা দরজা দিয়ে সেই আলো এসে ঢুকেছে ঘরের ভেতরে। তাতে হাল্কা একটা আলো আঁধারী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দরজা জুড়ে দাঁড়ানো মতিয়ারকে দেখে সাত্তার কী বলবে বুঝতে পারে না।
সে বারবার আড় চোখে ঘরের ভেতরের একমাত্র আসবাবÑ কাঁঠাল কাঠের চৌকিটিতে পেতে রাখা বিছানাটা দেখে, যেখানে চাদর মুড়ি দিয়ে আর একজন মতিয়ার এতক্ষণ তার পাশে শুয়ে ঘুমিয়েছে এবং এখনও ঘুমোচ্ছে। দরজায় দাঁড়ানো মতিয়ারের চোখ কেমন জ্বলজ্বল করছে। বড় বড় মনি দুটো অস্বাভাবিকভাবে ঘুরছে। এ কে?
সাত্তার মিয়া দিশাহারা হয়ে ঘুমন্ত মতিয়ারকে একটা ঠেলা দিয়ে ফিসফিস করে বলে, মতি ভাই, মতিয়ার ভাই, অ মতি ভাই...।
মতিয়ার কম্বলের তলা থেকে অস্পষ্ট একটা ঘুম জড়ানো গোঙানি দিয়ে আবার চুপ মেরে যায়।
দরজায় দাঁড়ানো মতিয়ার তখন আধখোলা পাল্লাটা দু’পাশে হাট করে ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়েছে। সাত্তার ভালো করে দেখে মতিয়ারের গায়ে গত রাতের সেই নীল ফতুয়া। গালে মুখে কদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কদিন ধরেই তো মতিয়ার অসুস্থ। দাড়ি কামাবে কী! সবই তো ঠিক আছে! তাহলে?
সাত্তার ভয়ার্ত চোখ ঘুরিয়ে দুই মতিয়ারকে দেখে। বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে অসুস্থ মতিয়ার আর সাত্তার মিয়ার পাঁচ বছরের সহকর্মী, তার প্রতিদিনের চেনা সঙ্গী সেই মতিয়ারই এখন ঘরের দেয়ালে বড় বড় ছায়া ফেলে গাছ কাটা দা খুঁজে বেড়াচ্ছে।
সাত্তার মিয়া কি স্বপ্ন দেখছে? চোখ ডলে ঘরের চারদিকে তাকায় সে।
হ্যাঁ, এই তো তাদের থাকার ঘর! দশ ফিট বাই দশ ফিটের দেয়াল ঘেরা একটা ছোট্ট কোঠা। দেয়ালে প্লাস্টার দেয়া হয়নি এখনও। পশ্চিম দিকে ছোট্ট একটা গ্রিলের জানালা বসানো। সেখান দিয়ে হাতির ঘাটের বড় মসজিদের উঁচু মিনারের চূড়াটা দেখা যাচ্ছে। মিনারের চারপাশে মিশমিশে কালো আকাশ ঝিম মেরে আছে। ছাদের দিকে বের হবার জন্য একটা দরজা। যে দরজাটা সাত্তার মিয়া আজ রাত চারটায় নিজের হাতে ভালো করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে তারপর শুতে এসেছে। সেই দরজার দুই পাল্লা এখন হাট করে খোলা। সেই খোলা দরজা দিয়ে দ্বিতীয় আর একজন মতিয়ার ঘরে ঢুকে দাও খুঁজছে। অবশ্য কোনটা যে প্রথম আর কোনটা দ্বিতীয় মতিয়ার তা সাত্তার মিয়া বুঝতে পারে না। তবু মনে হয় চৌকির ওপর এখনো নিঝুম শুয়ে আছে যে মতিয়ার, তাকেই রাতে শোবার আগে এক গেলাশ গ্লুকোজে গোলানো শরবত খাইয়ে দিয়েছিলো সাত্তার। কাজেই দাও-খুঁজন্তি মতিয়ারই দ্বিতীয়। কিন্তু নীল ফতুয়া? যে মতিয়ার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে তার গায়ে যদি অন্য কোনো জামা থাকে? যা কোনোদিন সাত্তার দেখেনি! তা হলে সে কি আসল মতিয়ার হবে না ভুয়া? সাত্তারের শীত লাগতে থাকে। ঘরটা যেন সাত্তারকেসহ দুই মতিয়ার দুদিক থেকে ধরে ঝাঁকাতে লেগেছে। কাঁপুনিও লাগে।
সাত্তারদের থাকার এই ঘরটা হলো সাত তলার ওপরের সিঁড়িঘর। দি ইউনিক ইন্টারন্যাশনাল কলেজের মাল্টিপারপাস ভবনের এই সিঁড়িটি অপরিসর। মূলত: ওঠানামার জন্য এ ভবনে থাকবে লিফট। ভবনটির নির্মাণকাজ সবেমাত্র শেষ হয়েছে। তবে ক্লাস ল্যাবরেটরি, কমনরুম টিচার্সরুম ইত্যাদি চালু হলেও লিফট এখনও লাগেনি। তাই আপাতত সিঁড়িই ভরসা।
মতিয়ার আর সাত্তার মিয়া এই কলেজের রাতপ্রহরী। মাল্টিপারপাস ভবনের অপরিসর চিলেকোঠায় তাদের দু’জনের সংসার। দু’জন পুরুষ মানুষের তো আর স্ত্রীপুত্রকন্যা মিলিয়ে যে সংসার তা হয় না! তবে তাদের দু’জনেরই পরিবারপরিজন থাকে গ্রামে। সাত্তার মিয়ার বাড়ি নোয়াখালীর ছাগলনাইয়াতে। সেখানে তার বউ আর দুটো ছেলে মেয়ে আছে। ছেলের বয়স বারো, স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়ে। থাকেও সেখানে। মেয়ের বয়স সাত। তাকে একটা এনজিও স্কুলে ভরতি করিয়ে দিয়েছে। সাত্তার মিয়ার মোবাইলে তার মেয়ে হাস্নাহেনার একটা হাসিমুখের ছবি আছে। মাথার চুলে একটা লাল প্রজাপতি ক্লিপ বসানো। সাত্তার সময় পেলেই মোবাইলে আলো জ্বালিয়ে মেয়ের ছবি দেখে। মতিয়ারের বাড়ি পটুয়াখালীর আমতলিতে। মতিয়ারের বউ বাক প্রতিবন্ধী। কথা বলতে পারে না। তবে মতিয়ার বউকে খুব ভালোবাসে। মতিয়ারের বাড়ির সমস্ত কাজ তার বউ করে। গাই পালে। খেত কোপায়। তরিতরকারি ফলায়। ঘরের বেড়া বাঁধে। মতিয়ারের মা নেই। তিনজন ছোট ছোট ভাই-বোন আছে। দেবর ননদদের মতিয়ারের বউই রেঁধেবেড়ে দেয়। তারও দুটি সন্তান। চার আর ছয় বছরের দুটি মেয়ে। মেয়েরা কেউ বোবা না। মাঝে মাঝে মতিয়ার মোবাইল করে ছোট মেয়ে প্রিয়ার সাথে কথা বলে। হিন্দি ফিল্ম দেখে মতিয়ার তার মেয়েদের নাম রেখেছে প্রীতি আর প্রিয়া। মতিয়ারের ইচ্ছা দু’ মেয়েকে সে লেখাপড়া শেখাবে। কিন্তু নিজের কাছে পরিবারকে এনে রাখতে না পারলে তো ছেলেমেয়ের লেখাপড়া হবে না।
দূরদূরান্তে নিজেদের পরিবার থাকাতে সাত্তার মিয়া আর মতিয়ার নিজেদের মধ্যে এক ধরনের সুখদুঃখের মিল খুঁজে পেয়েছে। কাজও তাদের একই। নাইট গার্ড। পাঁচতলা ছয়তলা সাততলা তিনদিকে তিনটি ভবন, মাঝখানে বিশাল এক মাঠ, পশ্চিমে একটা বাঁধানো ঝিল, তার পেছনে কলেজের অধ্যক্ষের কোয়ার্টারÑ এইসব মিলিয়ে কলেজটির বিশাল ক্যাম্পাস। তাতে দু’জন নাইট গার্ড তো বটেই তিনজন হলে আরও ভালো হয়। তবে মতিয়ার আর সাত্তার মনে করে আর কোনো নাইট গার্ড না আসাই ভালো। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। আর একজন এসে হয়তো তাদের দু’জনের মধ্যে সুঁই হয়ে ঢুকবে ফাল হয়ে বেরুবে। তাদের দোস্তি দেখে চোখ টাটাবে আর নানাভাবে ঝামেলা ঘটাতে চেষ্টা করবে। তার চেয়ে দু’জনই ভালো। ক্যাম্পাসটাকে দু’ভাগ করে তারা দু’জন পাহারা দেয়। মাঠের উত্তর দিকে পাঁচতলা আর ছয়তলা ভবন, দক্ষিণ দিকে সাততলা ভবন, গ্যারেজ, অধ্যক্ষের কোয়ার্টার, ঝিল ইত্যাদি। রাত একটা থেকে পাঁচটার মধ্যে ঘণ্টাখানেক পালা করে ঘুমিয়েও নেয় তারা। এক ধাপে মতিয়ার ঘুমায় সাত্তার জাগে আর এক ধাপে সাত্তার ঘুমায় মতিয়ার জাগে।
আজ অবশ্য মতিয়ার বারটার আগেই ঘুমিয়েছে। সাত্তার একলাই ডিউটি দিয়েছে।
কদিন ধরে মতিয়ারের গা ঘুষঘুষে জ্বর। মুখে রুচি নেই। সব কিছুতে গন্ধ লাগছে। গত রাতে ডালের সাথে একটুকরো এলাচি লেবু ডলে নিয়ে কয়েক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে আবার তা বমি করে ফেলে দিয়েছে। সাত্তারের ধারণা, মতিয়ারের জন্ডিস হয়েছে। সাত্তার মিয়া মতিয়ারের চোখের পাতা টেনে দেখেছে ভেতরে সাদা অংশ হলুদ হয়েছে কি না। হাতের পাতা মেলে নখগুলো পরীক্ষা করেছে, কোনো রঙ বদল হলো কি না। যদিও কিছুই বুঝতে পারেনি, তবুও মতিয়ারকে ডাক্তারের কাছে যেতে আর সাবধানে থাকতে পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু এখন মাসের শেষ। বেতন পাওয়ার আগে মতিয়ারের ডাক্তার দেখাবার উপায় নেই। গতকাল থেকে মতিয়ারের জ্বরও বাড়তির দিকে। জন্ডিসের একমাত্র ঔষধ বিশ্রাম Ñ সাত্তার তা জানে। তাই গত দু’ তিন রাত ধরে সাত্তার একাই ডিউটি দিচ্ছে। শুধু ডিউটিই না, মতিয়ারকে দেখাশোনাও সে-ই করেছে। প্যারাসিটামল কিনে দিয়েছে। পুরোনো পাঁচতলা বিল্ডিঙের ছাদে পানির ট্যাংকির চারপাশে ভেজা জায়গায় একটা থানকুনি পাতার ঝুপি হয়েছে, সেখান থেকে কয়েকটা ছিঁড়ে এনে মতিয়ারের জন্য হলুদ ছাড়া মলা মাছের ঝোল রান্না করে দিয়েছে। জন্ডিস হলে তেল-হলুদ খেতে হয় না। তখন তো এমনিতেই শরীরে হলুদের পরিমাণ বেড়ে যায়। গ্লুকোজের শরবতটা খেয়ে হাতের পাতায় মুখ মুছে মতিয়ার যখন সাত্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, সাত্তার ভাই, কেমুন জানি বমি বমি লাগতাছে। তখন মতিয়ারের চোখ দুটো হলুদ না হলেও কেমন যেন জ্বলজ্বল করছিলো। মনে হয় আর দু’একদিনের মধ্যেই হলুদ রঙ ধরবে।
তবে শেষ পর্যন্ত মতিয়ার আর বমি করেনি। কতক্ষণ কোঁ কোঁ করে কোঁকানো দিয়ে তারপর শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। এরপর বেরিয়ে এসছিলো সাত্তার। কলেজের চারপাশটা একবার চক্কর দিয়েছে। রাত একটায় ও তিনটায় দু’বার হুইসেল বাজিয়ে দিয়েছে। তারপর আজ একটু আগেই চিলেকোঠায় চলে এসেছিলো। যেহেতু মতিয়ার অসুস্থ। জন্ডিসের রোগী। এসে দেখে তখনও ঘুমাচ্ছে মতিয়ার। গায়ের জামাকাপড় বদলে একপাশে শুয়ে পড়ে সাত্তার। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে বুজে এসেছিলো দুচোখের পাতা। তাই মতিয়ারের উঠে যাওয়াটা টের পায়নি। হয়তো বাথরুম পেয়েছিলো মতিয়ারের। বাথরুমে যেতে হলে ওদের চিলে কোঠা থেকে এক তলা নিচে নেমে যেতে হয়। ছাদের ওপরে কোনো বাথরুম নেই। বাথরুম ছাড়া ছাদের কোনো কোনা টোনায় বসে অবশ্য রাতের পেচ্ছাপ টেচ্ছাপ সেরে ফেলা যায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে। তার পরেও একদিন মতিয়ার মাঝরাতে উঠে আলসেমি করে আর সাত তলায় না নেমে ছাদের একপাশে, যেখানে বৃষ্টির পানি বেরিয়ে যাওয়ার পাইপ আছে, সেখানে দাঁড়িয়ে পেশাপ করছিল, মাঝামাঝি পর্যায়ে তার চোখ পড়ে শাহসাব বাড়ির মসজিদের বিশাল উঁচু মিনারটির দিকে। মতিয়ার দেখতে পায় মিনারের মাথা থেকে একটা আগুনের গোলা সাঁ করে তার দিকে ছুটে আসছে। মতিয়ার ভয় পেয়ে আল্লার নাম নিতে নিতে মাঝপথে পেশাপ থামিয়ে ঝাড়া দৌড়। তখন তার খেয়াল হয় সে পশ্চিম দিকে মুখ করে পেচ্ছাপ করছিলো।
সেদিন ঘরে ফিরে এসে মতিয়ার লোহা পোড়া পানি খেয়েছিলো। লোহা মানে তাদের একটা ঠ্যাং ভাঙা বঁটি আছে। সেটারই আগাটা আগুনে লাল করে পুড়িয়ে লবণ গোলা পানিতে তিনবার কুলহু আল্লা পড়ে ছ্যাক দিয়ে খেয়ে নিয়েছিল। মতিয়ার ছোটবেলায় নাকি খুব ডরপুক ছিলো। রাত্তিরে গাছের পাতা ঝরে পড়লেও সে ভয় পেতো। ভয় পেলেই মতিয়ারের মা লোহার দা বঁটি খুন্তি যা-ই পেতো পুড়িয়ে নুনগোলা পানিতে ছ্যাক দিয়ে খাইয়ে দিতো।
সেই মতিয়ার এখন গাছ কাটার দা চাইছে বাইরে থেকে এসে! নিশ্চয়ই কিছু দেখে ভয় পেয়েছে। দা পুড়িয়ে পানি খাবে। কিন্তু দা কোথায় পাবে সাত্তার! তা-ও আবার গাছ কাটার ছ্যান দাও! ওদের গাছি বংশ নাকি? গাঁয়ে থাকতে শীতের কালে গাছিদের দেখা পাওয়া যেতো। কোমরে একটা ঘট আর একটা ছ্যান দা ঝুলিয়ে তরতর করে খেজুর গাছে উঠে যেতো। আগায় গিয়ে গাছের সাথে একটা লাঠি আড়াআড়ি দড়ি দিয়ে বেঁধে তার ওপর দাঁড়িয়ে ঘ্যাচঘ্যাচ করে খেজুর গাছের ছাল কাটতো গাছি। কয়েকটা পরত ছাল কাটা হলেই টুপটুপ করে রস পড়তে শুরু করতো। তারপর একটা মুলি বাঁশের ফাল গেঁথে তাতে মাটির ঘট ঝুলিয়ে দিয়ে কাঠবিড়ালীর মতো তুরতুর করে নেমে আসতো গাছি।
তো সেই কুট্টিকালে গাছির দা-খানা সাত্তারের বড় ভালো লাগতো। ঝকঝকে রুপার মতো লম্বা একখান দাও। গাছের ছালে ছোঁয়া দেবার সাথে সাথে ক্যাচ করে কেটে আসতো। সেই ছ্যান দা চাইছে এখন মতিয়ার! কিন্তু মতিয়ার তো জানেই তাদের ঘরে রান্নাবান্নার জন্য একটা ঠ্যাঙ ভাঙা বঁটি আর একটা কাগজ কাটার পাতলা ব্লেড ছাড়া কোনো দা-টা নেই।
সাত্তার হাল্কা অন্ধকারে চোখের মনি দুটো আরও তীক্ষè করে তাকায়। ও কি সত্যিই মতিয়ার?
মতিয়ার তো বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে!
ছাদের ওপর জ্বালিয়ে রাখা বাতির আলোয় সাত্তার দেখতে পায় একটা আস্ত মতিয়ার মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে ঘরের দেয়ালে দা খুঁজছে, আর একটা মতিয়ার দিব্যি কম্বলের তলায় ঘুম পাড়ছে। এমন কি ঘুমন্ত মতিয়ারের নাক ডাকার মৃদু শব্দও শোনা যাচ্ছে। সাত্তারের গা শিউরে ওঠে। বুকের ভেতর কলজেটা ধাম ধাম লাফ মারতে থাকে।
সাত্তার এখন কী করবে?
ঘর থেকে বের হয়ে দৌড় মারবে?
কোনদিকে? সিঁড়ি দিয়ে পটকন খেতে খেতে সোজা নিচতলায়, না যে দরজা দিয়ে বেরিয়ে ছাদে যাওয়া যায় সে দিকে!
কিন্তু ওর ভয় পাওয়া টের পেয়ে যদি ভূত-মতিয়ার পেছনে ধেয়ে আসে!
সাত্তার মনে মনে দ্রুত মন্ত্র পড়েÑ ভূত আমার পুত, পেতœী আমার ঝি, আল্লার নাম বুকে আছে ভয়টা আবার কী। সেই সঙ্গে কলেমা তৈয়ব। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ....।
ভূত মতিয়ার [না কি এটাই আসল মতিয়ার!] তখন উবু হয়ে ঘরের জিনিসপত্র এটা ওটা সরিয়ে দা খুঁজতে লেগেছে। জিনিসপত্র অবশ্য ঘরের ভেতর অনেক কিছুই আছে। সিমেন্টের বস্তা, রঙের বালতি, কৌটা, ব্রাশ, বস্তা হাবিজাবি!
একটা কাঠের টুকরো খুঁজে পায় মতিয়ার।
সেটা হাতে নিয়ে বলে, থাউক, লাঠিতেই চলবো। শালার চোরের ঘরের চোর! মাথা ফাটায়া আইজ যদি তর ঘিলু দিয়া আমি পাটিসাপটা পিঠা না বানায়া খাইছি তাইলে আমি বাপের ব্যাটাই না। তয় দাও হইলে ভালো হইতো, যেই না ছাদের কার্নিশে চান্দুর হাত দুইখান উইঠা আসতো, লগে লগে এক কোপে দশ আঙ্গুল টুকরা কইরা ফালাইতাম, তার বাদে আঙ্গুলগুলা ত্যালে ভাইজা মচমচা কইরা কাটলেট বানায়া খায়া ফালাইতাম।
এ কী কথা! মানুষের মগজ দিয়ে পিঠা খাবে, মানুষের আঙুলের কড়া ভাজা কাটলেট খাবে! এ তো আসলেই ভূত! পা দুটো কাঁপতে থাকে সাত্তারের। ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিতে চায় সাত্তার। কিন্তু কে যেন পায়ের পাতা ফ্লোরের সাথে সুপার গ্লু দিয়ে আটকে রেখেছে। আসল মতিয়ার কেন জেগে উঠছে না! সাত্তার গলা কাঁপিয়ে ভাঙাচোরা স্বরে জান দিয়ে চিৎকার করে, মতি ভাই, ঐ মতিয়ার ভাই!
ভূত মতিয়ার তার দিকে চেয়ে বলে, আরে, সাত্তার ভাই, কী হইল? তোমারে ভূতে পাইছে না কি? আমি তো সামেনই খাড়া। উঠ তো, শালার চোরের ব্যাটা চোররে পাকিস্তান দেহাইয়া দিয়া আসি। চাইর তলার ব্যালকনিতে পশ্চিম দিকের কার্নিশে উইঠা আসছে শালার চোর। ইলেকট্রিকের তার চুরি করার মতলব! আমারে দেখতে পায় নাই। লও, লও, যাই।
সাত্তার চৌকি থেকে নেমে দাঁড়ায়। কিন্তু এক পাও আগাতে পারে না। হতভম্বের মতো মতিয়ারের দিকে চেয়ে থাকে।
হ্যাঁ, মতিয়ারই তো! ও-ই তো কথায় কথায় বলে, ‘পাকিস্তান দেহাইয়া দিমু।’
ঘুমন্ত মতিয়ার এবার একটু নড়েচড়ে ওঠে। ঘুমের ঘোরে জড়ানো একটু শব্দ উঠেই আবার ছন্দে ছন্দে শ্বাস পড়তে শুরু করে। হঠাৎ কম্বলের তলা থেকে ঘুমন্ত মতিয়ারের একটা হাত বেরিয়ে আসে। হাতটা বেরিয়ে সাঁ করে চৌকির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাত্তারের পা চেপে ধরে। প্রায় ছ’ সাত হাত লম্বা একটা হাত। ঠা-া হিম! মনে হচ্ছে বরফের একটা চওড়া ফিতে দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তার পা বাঁধা হচ্ছে। সাত্তারের আর দিকদিশা জ্ঞান থাকে না। বাবা গো মাগো, ভূত ভূতÑ বলে সে অন্ধের মতো সিঁড়ি বেয়ে সাততলার দিকে দৌড়াতে শুরু করে। পেছন পেছন মনে হয় মতিয়ারও আসছে। আর এক জোড়া পায়ের দৌড়ানোর শব্দ। কোন মতিয়ার আসছে পেছনে কে জানে! অন্ধকার হাতড়ে ছ’ তলায় নেমে আসে সাত্তার। ছ’ তলায় কোনো আলো নেই। সব ফ্লোরে রাতে লাইট জ্বালিয়ে রাখার কথা আছে। সাত্তার জ্বালিয়েই রেখেছিলো। স্পষ্ট মনে আছে তার। নিশ্চয়ই চোরের কা-। না কি মতি ভূতের কা-!
সাত্তার বেদিশার মতো ছ’ তলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এদিক সেদিক তাকায়। তার হঠাৎ মনে হয় এখুনি একটা লম্বা ঠা-া হাত আবার তার দুই পা ঠেসে ধরবে। পায়ে পায়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে সাত্তারের।
একটা শি শি আওয়াজ উঠতে থাকে, মনে হচ্ছে মাঠের ভেতর থেকে। কলেজের মাঝখানে বহু পুরোনো একটা রেনট্রি গাছ ছিল। মাসখানেক আগে সেই গাছ কাটা হয়েছে। গাছ নেই হয়ে যাওয়াতে সে জায়গাটা যেন কেমন ধক ধক করে জ্বলছে। সেই ধকধকানির মধ্যে সাত্তার মিয়া আচমকা দেখতে পায় নীল ফতুয়া পরা ইয়া লম্বা এক মতিয়ার মাল্টিপারপাস ভবনের সাত তলার ব্যালকনিতে এক পা রেখে মাঠের উল্টো দিকের পাঁচ তলা বিজ্ঞান ভবনের ছাদে আর এক পা দিয়ে লাফ মেরে উঠে যাচ্ছে। তার ডান হাতে ধরা একটা লম্বা লাঠি। মাথার খোলা চুল লম্বা লম্বা সাপের মতো উড়াল দিতে দিতে ঝুলতে থাকে। সাপের শিশের মতো একটা হিস হিস হিহিহি হাসির হাল্কা রেশ বাতাসে মিলিয়ে যায়। আর সেই সঙ্গে উড়ে আসে দুরন্ত শীত.....!
সকালে মতিয়ারই সাত্তারকে আবিষ্কার করে। ছ’ তলার ব্যালকনিতে সিঁড়ির সামনে পড়ে আছে সাত্তার।
মতিয়ার নাকি পানি খাওয়ার জন্য সাত্তারকে ডাকতে গিয়ে দেখে ঘরের দরজা খোলা। সাত্তারের একটা স্যান্ডেল পড়ে আছে দরজার বাইরে। আর একটা নেই। তখন ধলপহরের আলো ফুটছে। মতিয়ার গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে সাত্তারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। সাততলার সিঁড়িতে নেমে মতিয়ার একটা গন্ধ পায়। তীব্র কর্পূরের গন্ধ। গন্ধের উৎস আবিষ্কার করতে পারে না মতিয়ার। হয়তা লোহা বা কাঠের রঙ বা অন্য কোনো কেমিক্যালের গন্ধ। একটু পরেই সেই গন্ধ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। হঠাৎ মতিয়ার দেখতে পায় সাত্তার হাতে একটা কাঠের টুকরা নিয়ে দুলতে দুলতে ছ’ তলার কার্নিশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তার গায়ে রাতপ্রহরীর খাকি ইউনিফর্ম।
মতিয়ার অবাক হয়ে বলে, সাত্তার ভাই, লাঠি লইয়া ঐখানে কী কর?
সাত্তার কোনো কথা না বলে লাফ দিয়ে ছতলার কার্নিশ থেকে পাঁচ তলায় তারপর চারতলায় নেমে কোথায় মিলিয়ে যায়। মতিয়ার কতক্ষণ বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকে। সাত্তার মিয়া কি প্রতিষ্ঠানের কোনো কিছু চুরি করে লুকিয়ে রাখতে যাচ্ছে? পুবের আকাশে তখন হাল্কা আলো ফুটছে। মতিয়ার সাত্তারের কা-কীর্তি ভালো করে বুঝবার জন্য ছ’তলার ব্যালকনিতে নেমে আসতেই দেখে ল্যান্ডিং-এ পড়ে আছে সাত্তার। মুখ দিয়ে গাঁজলা বেরুনো। চোখ উল্টে আছে। দম আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। মতিয়ার ঝুঁকে পড়ে ওর গায়ে হাত রাখতেই দেখে সাত্তারের শরীর সাপের মতো ঠা-া আর সারা গা দিয়ে যেন কর্পূরের ধোঁয়া বেরুচ্ছে। আর কী আশ্চর্য! সাত্তারের গায়ে রাত্তিরে ছেড়ে রাখা মতিয়ারের জ্বোরো গায়ের সেই নীল ফতুয়া! কিন্তু মতিয়ার স্পষ্ট দেখেছে ইউনিফর্ম পরা সাত্তার লাফিয়ে কার্নিশ পার হচ্ছে? আসল সাত্তার তবে কোনটা? ভয়ে কলিজা কাঁপানো চিৎকার দিয়ে ওঠে মতিয়ার।
সে বারবার আড় চোখে ঘরের ভেতরের একমাত্র আসবাবÑ কাঁঠাল কাঠের চৌকিটিতে পেতে রাখা বিছানাটা দেখে, যেখানে চাদর মুড়ি দিয়ে আর একজন মতিয়ার এতক্ষণ তার পাশে শুয়ে ঘুমিয়েছে এবং এখনও ঘুমোচ্ছে। দরজায় দাঁড়ানো মতিয়ারের চোখ কেমন জ্বলজ্বল করছে। বড় বড় মনি দুটো অস্বাভাবিকভাবে ঘুরছে। এ কে?
সাত্তার মিয়া দিশাহারা হয়ে ঘুমন্ত মতিয়ারকে একটা ঠেলা দিয়ে ফিসফিস করে বলে, মতি ভাই, মতিয়ার ভাই, অ মতি ভাই...।
মতিয়ার কম্বলের তলা থেকে অস্পষ্ট একটা ঘুম জড়ানো গোঙানি দিয়ে আবার চুপ মেরে যায়।
দরজায় দাঁড়ানো মতিয়ার তখন আধখোলা পাল্লাটা দু’পাশে হাট করে ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়েছে। সাত্তার ভালো করে দেখে মতিয়ারের গায়ে গত রাতের সেই নীল ফতুয়া। গালে মুখে কদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কদিন ধরেই তো মতিয়ার অসুস্থ। দাড়ি কামাবে কী! সবই তো ঠিক আছে! তাহলে?
সাত্তার ভয়ার্ত চোখ ঘুরিয়ে দুই মতিয়ারকে দেখে। বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে অসুস্থ মতিয়ার আর সাত্তার মিয়ার পাঁচ বছরের সহকর্মী, তার প্রতিদিনের চেনা সঙ্গী সেই মতিয়ারই এখন ঘরের দেয়ালে বড় বড় ছায়া ফেলে গাছ কাটা দা খুঁজে বেড়াচ্ছে।
সাত্তার মিয়া কি স্বপ্ন দেখছে? চোখ ডলে ঘরের চারদিকে তাকায় সে।
হ্যাঁ, এই তো তাদের থাকার ঘর! দশ ফিট বাই দশ ফিটের দেয়াল ঘেরা একটা ছোট্ট কোঠা। দেয়ালে প্লাস্টার দেয়া হয়নি এখনও। পশ্চিম দিকে ছোট্ট একটা গ্রিলের জানালা বসানো। সেখান দিয়ে হাতির ঘাটের বড় মসজিদের উঁচু মিনারের চূড়াটা দেখা যাচ্ছে। মিনারের চারপাশে মিশমিশে কালো আকাশ ঝিম মেরে আছে। ছাদের দিকে বের হবার জন্য একটা দরজা। যে দরজাটা সাত্তার মিয়া আজ রাত চারটায় নিজের হাতে ভালো করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে তারপর শুতে এসেছে। সেই দরজার দুই পাল্লা এখন হাট করে খোলা। সেই খোলা দরজা দিয়ে দ্বিতীয় আর একজন মতিয়ার ঘরে ঢুকে দাও খুঁজছে। অবশ্য কোনটা যে প্রথম আর কোনটা দ্বিতীয় মতিয়ার তা সাত্তার মিয়া বুঝতে পারে না। তবু মনে হয় চৌকির ওপর এখনো নিঝুম শুয়ে আছে যে মতিয়ার, তাকেই রাতে শোবার আগে এক গেলাশ গ্লুকোজে গোলানো শরবত খাইয়ে দিয়েছিলো সাত্তার। কাজেই দাও-খুঁজন্তি মতিয়ারই দ্বিতীয়। কিন্তু নীল ফতুয়া? যে মতিয়ার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে তার গায়ে যদি অন্য কোনো জামা থাকে? যা কোনোদিন সাত্তার দেখেনি! তা হলে সে কি আসল মতিয়ার হবে না ভুয়া? সাত্তারের শীত লাগতে থাকে। ঘরটা যেন সাত্তারকেসহ দুই মতিয়ার দুদিক থেকে ধরে ঝাঁকাতে লেগেছে। কাঁপুনিও লাগে।
সাত্তারদের থাকার এই ঘরটা হলো সাত তলার ওপরের সিঁড়িঘর। দি ইউনিক ইন্টারন্যাশনাল কলেজের মাল্টিপারপাস ভবনের এই সিঁড়িটি অপরিসর। মূলত: ওঠানামার জন্য এ ভবনে থাকবে লিফট। ভবনটির নির্মাণকাজ সবেমাত্র শেষ হয়েছে। তবে ক্লাস ল্যাবরেটরি, কমনরুম টিচার্সরুম ইত্যাদি চালু হলেও লিফট এখনও লাগেনি। তাই আপাতত সিঁড়িই ভরসা।
মতিয়ার আর সাত্তার মিয়া এই কলেজের রাতপ্রহরী। মাল্টিপারপাস ভবনের অপরিসর চিলেকোঠায় তাদের দু’জনের সংসার। দু’জন পুরুষ মানুষের তো আর স্ত্রীপুত্রকন্যা মিলিয়ে যে সংসার তা হয় না! তবে তাদের দু’জনেরই পরিবারপরিজন থাকে গ্রামে। সাত্তার মিয়ার বাড়ি নোয়াখালীর ছাগলনাইয়াতে। সেখানে তার বউ আর দুটো ছেলে মেয়ে আছে। ছেলের বয়স বারো, স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়ে। থাকেও সেখানে। মেয়ের বয়স সাত। তাকে একটা এনজিও স্কুলে ভরতি করিয়ে দিয়েছে। সাত্তার মিয়ার মোবাইলে তার মেয়ে হাস্নাহেনার একটা হাসিমুখের ছবি আছে। মাথার চুলে একটা লাল প্রজাপতি ক্লিপ বসানো। সাত্তার সময় পেলেই মোবাইলে আলো জ্বালিয়ে মেয়ের ছবি দেখে। মতিয়ারের বাড়ি পটুয়াখালীর আমতলিতে। মতিয়ারের বউ বাক প্রতিবন্ধী। কথা বলতে পারে না। তবে মতিয়ার বউকে খুব ভালোবাসে। মতিয়ারের বাড়ির সমস্ত কাজ তার বউ করে। গাই পালে। খেত কোপায়। তরিতরকারি ফলায়। ঘরের বেড়া বাঁধে। মতিয়ারের মা নেই। তিনজন ছোট ছোট ভাই-বোন আছে। দেবর ননদদের মতিয়ারের বউই রেঁধেবেড়ে দেয়। তারও দুটি সন্তান। চার আর ছয় বছরের দুটি মেয়ে। মেয়েরা কেউ বোবা না। মাঝে মাঝে মতিয়ার মোবাইল করে ছোট মেয়ে প্রিয়ার সাথে কথা বলে। হিন্দি ফিল্ম দেখে মতিয়ার তার মেয়েদের নাম রেখেছে প্রীতি আর প্রিয়া। মতিয়ারের ইচ্ছা দু’ মেয়েকে সে লেখাপড়া শেখাবে। কিন্তু নিজের কাছে পরিবারকে এনে রাখতে না পারলে তো ছেলেমেয়ের লেখাপড়া হবে না।
দূরদূরান্তে নিজেদের পরিবার থাকাতে সাত্তার মিয়া আর মতিয়ার নিজেদের মধ্যে এক ধরনের সুখদুঃখের মিল খুঁজে পেয়েছে। কাজও তাদের একই। নাইট গার্ড। পাঁচতলা ছয়তলা সাততলা তিনদিকে তিনটি ভবন, মাঝখানে বিশাল এক মাঠ, পশ্চিমে একটা বাঁধানো ঝিল, তার পেছনে কলেজের অধ্যক্ষের কোয়ার্টারÑ এইসব মিলিয়ে কলেজটির বিশাল ক্যাম্পাস। তাতে দু’জন নাইট গার্ড তো বটেই তিনজন হলে আরও ভালো হয়। তবে মতিয়ার আর সাত্তার মনে করে আর কোনো নাইট গার্ড না আসাই ভালো। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। আর একজন এসে হয়তো তাদের দু’জনের মধ্যে সুঁই হয়ে ঢুকবে ফাল হয়ে বেরুবে। তাদের দোস্তি দেখে চোখ টাটাবে আর নানাভাবে ঝামেলা ঘটাতে চেষ্টা করবে। তার চেয়ে দু’জনই ভালো। ক্যাম্পাসটাকে দু’ভাগ করে তারা দু’জন পাহারা দেয়। মাঠের উত্তর দিকে পাঁচতলা আর ছয়তলা ভবন, দক্ষিণ দিকে সাততলা ভবন, গ্যারেজ, অধ্যক্ষের কোয়ার্টার, ঝিল ইত্যাদি। রাত একটা থেকে পাঁচটার মধ্যে ঘণ্টাখানেক পালা করে ঘুমিয়েও নেয় তারা। এক ধাপে মতিয়ার ঘুমায় সাত্তার জাগে আর এক ধাপে সাত্তার ঘুমায় মতিয়ার জাগে।
আজ অবশ্য মতিয়ার বারটার আগেই ঘুমিয়েছে। সাত্তার একলাই ডিউটি দিয়েছে।
কদিন ধরে মতিয়ারের গা ঘুষঘুষে জ্বর। মুখে রুচি নেই। সব কিছুতে গন্ধ লাগছে। গত রাতে ডালের সাথে একটুকরো এলাচি লেবু ডলে নিয়ে কয়েক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে আবার তা বমি করে ফেলে দিয়েছে। সাত্তারের ধারণা, মতিয়ারের জন্ডিস হয়েছে। সাত্তার মিয়া মতিয়ারের চোখের পাতা টেনে দেখেছে ভেতরে সাদা অংশ হলুদ হয়েছে কি না। হাতের পাতা মেলে নখগুলো পরীক্ষা করেছে, কোনো রঙ বদল হলো কি না। যদিও কিছুই বুঝতে পারেনি, তবুও মতিয়ারকে ডাক্তারের কাছে যেতে আর সাবধানে থাকতে পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু এখন মাসের শেষ। বেতন পাওয়ার আগে মতিয়ারের ডাক্তার দেখাবার উপায় নেই। গতকাল থেকে মতিয়ারের জ্বরও বাড়তির দিকে। জন্ডিসের একমাত্র ঔষধ বিশ্রাম Ñ সাত্তার তা জানে। তাই গত দু’ তিন রাত ধরে সাত্তার একাই ডিউটি দিচ্ছে। শুধু ডিউটিই না, মতিয়ারকে দেখাশোনাও সে-ই করেছে। প্যারাসিটামল কিনে দিয়েছে। পুরোনো পাঁচতলা বিল্ডিঙের ছাদে পানির ট্যাংকির চারপাশে ভেজা জায়গায় একটা থানকুনি পাতার ঝুপি হয়েছে, সেখান থেকে কয়েকটা ছিঁড়ে এনে মতিয়ারের জন্য হলুদ ছাড়া মলা মাছের ঝোল রান্না করে দিয়েছে। জন্ডিস হলে তেল-হলুদ খেতে হয় না। তখন তো এমনিতেই শরীরে হলুদের পরিমাণ বেড়ে যায়। গ্লুকোজের শরবতটা খেয়ে হাতের পাতায় মুখ মুছে মতিয়ার যখন সাত্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, সাত্তার ভাই, কেমুন জানি বমি বমি লাগতাছে। তখন মতিয়ারের চোখ দুটো হলুদ না হলেও কেমন যেন জ্বলজ্বল করছিলো। মনে হয় আর দু’একদিনের মধ্যেই হলুদ রঙ ধরবে।
তবে শেষ পর্যন্ত মতিয়ার আর বমি করেনি। কতক্ষণ কোঁ কোঁ করে কোঁকানো দিয়ে তারপর শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। এরপর বেরিয়ে এসছিলো সাত্তার। কলেজের চারপাশটা একবার চক্কর দিয়েছে। রাত একটায় ও তিনটায় দু’বার হুইসেল বাজিয়ে দিয়েছে। তারপর আজ একটু আগেই চিলেকোঠায় চলে এসেছিলো। যেহেতু মতিয়ার অসুস্থ। জন্ডিসের রোগী। এসে দেখে তখনও ঘুমাচ্ছে মতিয়ার। গায়ের জামাকাপড় বদলে একপাশে শুয়ে পড়ে সাত্তার। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে বুজে এসেছিলো দুচোখের পাতা। তাই মতিয়ারের উঠে যাওয়াটা টের পায়নি। হয়তো বাথরুম পেয়েছিলো মতিয়ারের। বাথরুমে যেতে হলে ওদের চিলে কোঠা থেকে এক তলা নিচে নেমে যেতে হয়। ছাদের ওপরে কোনো বাথরুম নেই। বাথরুম ছাড়া ছাদের কোনো কোনা টোনায় বসে অবশ্য রাতের পেচ্ছাপ টেচ্ছাপ সেরে ফেলা যায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে। তার পরেও একদিন মতিয়ার মাঝরাতে উঠে আলসেমি করে আর সাত তলায় না নেমে ছাদের একপাশে, যেখানে বৃষ্টির পানি বেরিয়ে যাওয়ার পাইপ আছে, সেখানে দাঁড়িয়ে পেশাপ করছিল, মাঝামাঝি পর্যায়ে তার চোখ পড়ে শাহসাব বাড়ির মসজিদের বিশাল উঁচু মিনারটির দিকে। মতিয়ার দেখতে পায় মিনারের মাথা থেকে একটা আগুনের গোলা সাঁ করে তার দিকে ছুটে আসছে। মতিয়ার ভয় পেয়ে আল্লার নাম নিতে নিতে মাঝপথে পেশাপ থামিয়ে ঝাড়া দৌড়। তখন তার খেয়াল হয় সে পশ্চিম দিকে মুখ করে পেচ্ছাপ করছিলো।
সেদিন ঘরে ফিরে এসে মতিয়ার লোহা পোড়া পানি খেয়েছিলো। লোহা মানে তাদের একটা ঠ্যাং ভাঙা বঁটি আছে। সেটারই আগাটা আগুনে লাল করে পুড়িয়ে লবণ গোলা পানিতে তিনবার কুলহু আল্লা পড়ে ছ্যাক দিয়ে খেয়ে নিয়েছিল। মতিয়ার ছোটবেলায় নাকি খুব ডরপুক ছিলো। রাত্তিরে গাছের পাতা ঝরে পড়লেও সে ভয় পেতো। ভয় পেলেই মতিয়ারের মা লোহার দা বঁটি খুন্তি যা-ই পেতো পুড়িয়ে নুনগোলা পানিতে ছ্যাক দিয়ে খাইয়ে দিতো।
সেই মতিয়ার এখন গাছ কাটার দা চাইছে বাইরে থেকে এসে! নিশ্চয়ই কিছু দেখে ভয় পেয়েছে। দা পুড়িয়ে পানি খাবে। কিন্তু দা কোথায় পাবে সাত্তার! তা-ও আবার গাছ কাটার ছ্যান দাও! ওদের গাছি বংশ নাকি? গাঁয়ে থাকতে শীতের কালে গাছিদের দেখা পাওয়া যেতো। কোমরে একটা ঘট আর একটা ছ্যান দা ঝুলিয়ে তরতর করে খেজুর গাছে উঠে যেতো। আগায় গিয়ে গাছের সাথে একটা লাঠি আড়াআড়ি দড়ি দিয়ে বেঁধে তার ওপর দাঁড়িয়ে ঘ্যাচঘ্যাচ করে খেজুর গাছের ছাল কাটতো গাছি। কয়েকটা পরত ছাল কাটা হলেই টুপটুপ করে রস পড়তে শুরু করতো। তারপর একটা মুলি বাঁশের ফাল গেঁথে তাতে মাটির ঘট ঝুলিয়ে দিয়ে কাঠবিড়ালীর মতো তুরতুর করে নেমে আসতো গাছি।
তো সেই কুট্টিকালে গাছির দা-খানা সাত্তারের বড় ভালো লাগতো। ঝকঝকে রুপার মতো লম্বা একখান দাও। গাছের ছালে ছোঁয়া দেবার সাথে সাথে ক্যাচ করে কেটে আসতো। সেই ছ্যান দা চাইছে এখন মতিয়ার! কিন্তু মতিয়ার তো জানেই তাদের ঘরে রান্নাবান্নার জন্য একটা ঠ্যাঙ ভাঙা বঁটি আর একটা কাগজ কাটার পাতলা ব্লেড ছাড়া কোনো দা-টা নেই।
সাত্তার হাল্কা অন্ধকারে চোখের মনি দুটো আরও তীক্ষè করে তাকায়। ও কি সত্যিই মতিয়ার?
মতিয়ার তো বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে!
ছাদের ওপর জ্বালিয়ে রাখা বাতির আলোয় সাত্তার দেখতে পায় একটা আস্ত মতিয়ার মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে ঘরের দেয়ালে দা খুঁজছে, আর একটা মতিয়ার দিব্যি কম্বলের তলায় ঘুম পাড়ছে। এমন কি ঘুমন্ত মতিয়ারের নাক ডাকার মৃদু শব্দও শোনা যাচ্ছে। সাত্তারের গা শিউরে ওঠে। বুকের ভেতর কলজেটা ধাম ধাম লাফ মারতে থাকে।
সাত্তার এখন কী করবে?
ঘর থেকে বের হয়ে দৌড় মারবে?
কোনদিকে? সিঁড়ি দিয়ে পটকন খেতে খেতে সোজা নিচতলায়, না যে দরজা দিয়ে বেরিয়ে ছাদে যাওয়া যায় সে দিকে!
কিন্তু ওর ভয় পাওয়া টের পেয়ে যদি ভূত-মতিয়ার পেছনে ধেয়ে আসে!
সাত্তার মনে মনে দ্রুত মন্ত্র পড়েÑ ভূত আমার পুত, পেতœী আমার ঝি, আল্লার নাম বুকে আছে ভয়টা আবার কী। সেই সঙ্গে কলেমা তৈয়ব। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ....।
ভূত মতিয়ার [না কি এটাই আসল মতিয়ার!] তখন উবু হয়ে ঘরের জিনিসপত্র এটা ওটা সরিয়ে দা খুঁজতে লেগেছে। জিনিসপত্র অবশ্য ঘরের ভেতর অনেক কিছুই আছে। সিমেন্টের বস্তা, রঙের বালতি, কৌটা, ব্রাশ, বস্তা হাবিজাবি!
একটা কাঠের টুকরো খুঁজে পায় মতিয়ার।
সেটা হাতে নিয়ে বলে, থাউক, লাঠিতেই চলবো। শালার চোরের ঘরের চোর! মাথা ফাটায়া আইজ যদি তর ঘিলু দিয়া আমি পাটিসাপটা পিঠা না বানায়া খাইছি তাইলে আমি বাপের ব্যাটাই না। তয় দাও হইলে ভালো হইতো, যেই না ছাদের কার্নিশে চান্দুর হাত দুইখান উইঠা আসতো, লগে লগে এক কোপে দশ আঙ্গুল টুকরা কইরা ফালাইতাম, তার বাদে আঙ্গুলগুলা ত্যালে ভাইজা মচমচা কইরা কাটলেট বানায়া খায়া ফালাইতাম।
এ কী কথা! মানুষের মগজ দিয়ে পিঠা খাবে, মানুষের আঙুলের কড়া ভাজা কাটলেট খাবে! এ তো আসলেই ভূত! পা দুটো কাঁপতে থাকে সাত্তারের। ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিতে চায় সাত্তার। কিন্তু কে যেন পায়ের পাতা ফ্লোরের সাথে সুপার গ্লু দিয়ে আটকে রেখেছে। আসল মতিয়ার কেন জেগে উঠছে না! সাত্তার গলা কাঁপিয়ে ভাঙাচোরা স্বরে জান দিয়ে চিৎকার করে, মতি ভাই, ঐ মতিয়ার ভাই!
ভূত মতিয়ার তার দিকে চেয়ে বলে, আরে, সাত্তার ভাই, কী হইল? তোমারে ভূতে পাইছে না কি? আমি তো সামেনই খাড়া। উঠ তো, শালার চোরের ব্যাটা চোররে পাকিস্তান দেহাইয়া দিয়া আসি। চাইর তলার ব্যালকনিতে পশ্চিম দিকের কার্নিশে উইঠা আসছে শালার চোর। ইলেকট্রিকের তার চুরি করার মতলব! আমারে দেখতে পায় নাই। লও, লও, যাই।
সাত্তার চৌকি থেকে নেমে দাঁড়ায়। কিন্তু এক পাও আগাতে পারে না। হতভম্বের মতো মতিয়ারের দিকে চেয়ে থাকে।
হ্যাঁ, মতিয়ারই তো! ও-ই তো কথায় কথায় বলে, ‘পাকিস্তান দেহাইয়া দিমু।’
ঘুমন্ত মতিয়ার এবার একটু নড়েচড়ে ওঠে। ঘুমের ঘোরে জড়ানো একটু শব্দ উঠেই আবার ছন্দে ছন্দে শ্বাস পড়তে শুরু করে। হঠাৎ কম্বলের তলা থেকে ঘুমন্ত মতিয়ারের একটা হাত বেরিয়ে আসে। হাতটা বেরিয়ে সাঁ করে চৌকির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাত্তারের পা চেপে ধরে। প্রায় ছ’ সাত হাত লম্বা একটা হাত। ঠা-া হিম! মনে হচ্ছে বরফের একটা চওড়া ফিতে দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তার পা বাঁধা হচ্ছে। সাত্তারের আর দিকদিশা জ্ঞান থাকে না। বাবা গো মাগো, ভূত ভূতÑ বলে সে অন্ধের মতো সিঁড়ি বেয়ে সাততলার দিকে দৌড়াতে শুরু করে। পেছন পেছন মনে হয় মতিয়ারও আসছে। আর এক জোড়া পায়ের দৌড়ানোর শব্দ। কোন মতিয়ার আসছে পেছনে কে জানে! অন্ধকার হাতড়ে ছ’ তলায় নেমে আসে সাত্তার। ছ’ তলায় কোনো আলো নেই। সব ফ্লোরে রাতে লাইট জ্বালিয়ে রাখার কথা আছে। সাত্তার জ্বালিয়েই রেখেছিলো। স্পষ্ট মনে আছে তার। নিশ্চয়ই চোরের কা-। না কি মতি ভূতের কা-!
সাত্তার বেদিশার মতো ছ’ তলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এদিক সেদিক তাকায়। তার হঠাৎ মনে হয় এখুনি একটা লম্বা ঠা-া হাত আবার তার দুই পা ঠেসে ধরবে। পায়ে পায়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে সাত্তারের।
একটা শি শি আওয়াজ উঠতে থাকে, মনে হচ্ছে মাঠের ভেতর থেকে। কলেজের মাঝখানে বহু পুরোনো একটা রেনট্রি গাছ ছিল। মাসখানেক আগে সেই গাছ কাটা হয়েছে। গাছ নেই হয়ে যাওয়াতে সে জায়গাটা যেন কেমন ধক ধক করে জ্বলছে। সেই ধকধকানির মধ্যে সাত্তার মিয়া আচমকা দেখতে পায় নীল ফতুয়া পরা ইয়া লম্বা এক মতিয়ার মাল্টিপারপাস ভবনের সাত তলার ব্যালকনিতে এক পা রেখে মাঠের উল্টো দিকের পাঁচ তলা বিজ্ঞান ভবনের ছাদে আর এক পা দিয়ে লাফ মেরে উঠে যাচ্ছে। তার ডান হাতে ধরা একটা লম্বা লাঠি। মাথার খোলা চুল লম্বা লম্বা সাপের মতো উড়াল দিতে দিতে ঝুলতে থাকে। সাপের শিশের মতো একটা হিস হিস হিহিহি হাসির হাল্কা রেশ বাতাসে মিলিয়ে যায়। আর সেই সঙ্গে উড়ে আসে দুরন্ত শীত.....!
সকালে মতিয়ারই সাত্তারকে আবিষ্কার করে। ছ’ তলার ব্যালকনিতে সিঁড়ির সামনে পড়ে আছে সাত্তার।
মতিয়ার নাকি পানি খাওয়ার জন্য সাত্তারকে ডাকতে গিয়ে দেখে ঘরের দরজা খোলা। সাত্তারের একটা স্যান্ডেল পড়ে আছে দরজার বাইরে। আর একটা নেই। তখন ধলপহরের আলো ফুটছে। মতিয়ার গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে সাত্তারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। সাততলার সিঁড়িতে নেমে মতিয়ার একটা গন্ধ পায়। তীব্র কর্পূরের গন্ধ। গন্ধের উৎস আবিষ্কার করতে পারে না মতিয়ার। হয়তা লোহা বা কাঠের রঙ বা অন্য কোনো কেমিক্যালের গন্ধ। একটু পরেই সেই গন্ধ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। হঠাৎ মতিয়ার দেখতে পায় সাত্তার হাতে একটা কাঠের টুকরা নিয়ে দুলতে দুলতে ছ’ তলার কার্নিশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তার গায়ে রাতপ্রহরীর খাকি ইউনিফর্ম।
মতিয়ার অবাক হয়ে বলে, সাত্তার ভাই, লাঠি লইয়া ঐখানে কী কর?
সাত্তার কোনো কথা না বলে লাফ দিয়ে ছতলার কার্নিশ থেকে পাঁচ তলায় তারপর চারতলায় নেমে কোথায় মিলিয়ে যায়। মতিয়ার কতক্ষণ বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকে। সাত্তার মিয়া কি প্রতিষ্ঠানের কোনো কিছু চুরি করে লুকিয়ে রাখতে যাচ্ছে? পুবের আকাশে তখন হাল্কা আলো ফুটছে। মতিয়ার সাত্তারের কা-কীর্তি ভালো করে বুঝবার জন্য ছ’তলার ব্যালকনিতে নেমে আসতেই দেখে ল্যান্ডিং-এ পড়ে আছে সাত্তার। মুখ দিয়ে গাঁজলা বেরুনো। চোখ উল্টে আছে। দম আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। মতিয়ার ঝুঁকে পড়ে ওর গায়ে হাত রাখতেই দেখে সাত্তারের শরীর সাপের মতো ঠা-া আর সারা গা দিয়ে যেন কর্পূরের ধোঁয়া বেরুচ্ছে। আর কী আশ্চর্য! সাত্তারের গায়ে রাত্তিরে ছেড়ে রাখা মতিয়ারের জ্বোরো গায়ের সেই নীল ফতুয়া! কিন্তু মতিয়ার স্পষ্ট দেখেছে ইউনিফর্ম পরা সাত্তার লাফিয়ে কার্নিশ পার হচ্ছে? আসল সাত্তার তবে কোনটা? ভয়ে কলিজা কাঁপানো চিৎকার দিয়ে ওঠে মতিয়ার।
No comments