প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাদান কার্যক্রমঃ ‘জিয়া উচ্ছেদ প্রকল্প’ by আবদুল হাই শিকদার

এক.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে শিক্ষা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনার যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব তিনি আপন স্কন্ধে তুলে নিয়েছেন, সেই অবস্থান থেকে এ রকম একটি উদ্যোগ তো তিনি নিতেই পারেন। যুক্তি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শিষ্টাচারের ভাষা যাই হোক, প্রধানমন্ত্রী যে সে সব খুব একটা তোয়াক্কা করেন তা বলা যাবে না।

১৯৯৬-২০০১ এ তার প্রধানমন্ত্রিত্বের ১৮২৫ দিনের মধ্যে, ৬ লাখ ৫০ হাজার কিলোমিটার পথ আকাশে উড়ে, ৫০টি বিদেশ সফরে ২৪৮ দিন কাটিয়ে যে ১০টি অতি উন্নত জাতের ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি তিনি অর্জন করেছিলেন, তার ‘গরমে’ এখন তিনি যদি ‘ডক্টরেট’ বিহীন বিএনপিকে কিছু শিক্ষা দিতে চান, তাহলে তো আর তাকে দোষ দেয়া যায় না। বিদ্যা আর আগুন তো চেপে রাখার জিনিস নয়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে উত্তেজিত হয়ে তার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রিয় আমলা এবং ১৫ আগস্টের পর মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনাকারী এইচ টি ইমাম পর্যন্ত বলে বসেছেন, বিএনপিকে থেরাপি দেয়া হচ্ছে (মি. ইমাম যে থেরাপি বিশেষজ্ঞ এদ্দিন আমরা জানতাম না)।
প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে যে শিক্ষা দিচ্ছেন বা যে প্রকল্পের আওতায় কাজটি করছেন, সেই প্রকল্পের একটা নাম আমরা অনায়াসেই দিতে পারি। যদিও প্রধানমন্ত্রী তার শিক্ষাদান কর্মের কোনো শিরোনাম এখন পর্যন্ত দেননি। তো ‘এই মহত্ কর্মকাণ্ডের যে আলো’ আমাদের ওপর পতিত হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে হিংসা, প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, বিভেদ, জিঘাংসা, আক্রোশ, হানাহানি, অশান্তি, অসহিষ্ণুতা, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, সন্ত্রাস ও প্রতিশোধ। আবার এসব ‘মহাগুণাবলী’র আঘাত গোর্কি বা সিডরের মতো ভয়াবহতা নিয়ে যে মানুষটির ওপর হামলে পড়ছে তার নাম জিয়াউর রহমান। দেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা। তো পাঠ্যবই, বিমানবন্দর, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, স্টেডিয়াম, উদ্যান, শিল্প কারখানা—যেখানেই হোক না কেন, অন্ধ, উন্মত্ত, হৃদয়হীন, হিতাহিত বোধশূন্য ক্রুদ্ধ দানবের মতো জিয়াউর রহমানের নাম, কলম, হাতুড়ি, শাবল, গাইতি ও বুলডোজার দিয়ে উচ্ছেদ করে, ভেঙে গুঁড়িয়ে ধুলায় মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ওয়াদা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতিমুক্ত দেশ, ২০২১ ভিশন, ডিজিটাল বাংলাদেশ, দিনবদলের রাজনীতি, ১০ টাকা সের চাল, ঘরে ঘরে চাকরি, বিনামূল্যে সার, দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানা, বিদ্যুত্ সমস্যার সমাধান, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, দখলবাজ, সন্ত্রাস দমন, শিল্পায়ন, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূরীকরণ—সব শিকায় তুলে মহাজোট সরকারের এখন যেন একটাই কাজ—যেখানে, যেভাবে, যত তাড়াতাড়ি পার জিয়াউর রহমানের নাম উচ্ছেদ কর। মুছে দাও। ধ্বংস কর। নিশ্চিহ্ন কর। যেন বাংলাদেশের শাসক ক্ষমতায় এখন চেঙ্গিস খান, হালাকু খান কিংবা জর্জ বুশের মতো মানসিক বিকারগ্রস্ত কোনো রক্তপিপাসু। সম্প্রীতি, সমঝোতা, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা, ন্যায়নীতি, সভ্যতা, সামাজিক মূল্যবোধ—এগুলো যেন এদের কাছে বাদাম খোসার চাইতেও হাল্কা কিছু। এই ভয়ঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞে মহাজোট সরকারকে মহা উত্সাহে প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে তাদের অনুগ্রহ ভিখারি, খুঁদ-কুঁড়োভোগী একশ্রেণীর সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল এবং ‘সুশীল’ বুদ্ধিজীবী। আর এর মাধ্যমে বিরোধীদলকে উচ্ছেদ, দমন, পীড়নের মাধ্যমে, দৌড়ের ওপর রেখে রাষ্ট্রের আসল সমস্যা নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।
তো প্রধানমন্ত্রীর এই একরৈখিক এবং একমুখী শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার একটাই নাম হতে পারে, ‘জিয়া উচ্ছেদ প্রকল্প’। আর এই প্রকল্পের সাফল্যের পরই যেন নির্ভর করছে তার দিনবদল ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সাফল্য।
দুই.
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত শিক্ষার মহিমা কীর্তনের আগে, জিয়া উচ্ছেদ প্রকল্পের রহস্য উদ্ঘাটন জরুরি বলে মনে হয়। কারণ অনেকেই প্রশ্ন করেন, হঠাত্ করে জিয়া উচ্ছেদের নামে এই বিভীষিকাময় তুঘলোকী কাণ্ড কেন? জিয়ার প্রতি তারা হঠাত্ এত মারমুখী হয়ে উঠল কেন? কেন এই বিদ্বেষ? জিয়ার নাম শুনলেই তারা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন কেন? গায়ে বিছুটির পাতা লাগার মতো জ্বালা ধরে কেন? সাধারণের এই জিজ্ঞাসাপূরণের জন্য শাসকরা যা বলছেন তা একেবারে নোংরা, কুতসিত্ ‘ইতরজনোচিত্’। সেগুলো দিয়ে গায়ের ঝাল মেটে, যৌক্তিক আলো পাওয়া যায় না।
অবাঞ্ছিত ও অনভিপ্রেত সেসব শ্লাং-এর স্রোতে গা ভাসানো আমাদের যোগ্যতায় কুলাবে না। আমরা পর্যায়ক্রমে এর যৌক্তিক কারণগুলো পরিষ্কারভাবে দেখাতে চাই। আসলে বর্তমান মহাজোট সরকার বা আওয়ামী লীগের জিয়া বিদ্বেষ হঠাত্ করে গজিয়ে ওঠা জিনিস নয়। অন্যবার সরাসরি আধিপত্যবাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না বলে বিষয়টি অতটা প্রকটভাবে চোখে পড়েনি। কিন্তু এবার পর্দার আড়াল বলে কিছু নেই। ফলে আঘাতগুলো হচ্ছে নির্বিচারে এবং উন্মত্ততার সঙ্গে। ঠিক যেভাবে লেন্দুপ দর্জির হাতে ঝলসানো হয়েছিল চোগিয়াল পরিবারকে, যেভাবে ম্যাসাকার চালানো হয়েছে পিলখানায়।
বিদ্বেষ-এক : দেশকে দেশের মানুষকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত, রক্তাক্ত, দিকনির্দেশনাহীন কিংকর্তব্যবিমূঢ় রেখে প্রধান নেতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান আত্মসমর্পণ করলেন পাকিস্তান বাহিনীর কাছে। বাকিরা পৈতৃক প্রাণ নিয়ে সীমান্ত টপকে পালালেন ইনডিয়াতে। সাধারণ নেতা-কর্মীদের কথা আলাদা। কিন্তু নেতৃত্বের বিরাট অংশ যে যুদ্ধ চায়নি, চেয়েছিল পাকিস্তানি ফ্রেমের মধ্যে সমাধান, তা বলাইবাহুল্য (৭ মার্চের ভাষণ ও ২৩ মার্চ বিবৃতি দ্রষ্টব্য)। এ জন্যই বর্তমান আওয়ামী মন্ত্রী, সাবেক এরশাদ সরকারের প্রিয় মন্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা একে খন্দকার বলতে বাধ্য হন, ২৩ মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কোনো ধরনের প্রস্তুতিই ছিল না (মুক্তিযুদ্ধ পূর্বাপর)।
সেই ঘোর সংকটে, প্রকৃতি প্রদত্তভাবেই যেন আলোকবর্তিকার মতো আবির্ভূত হন জিয়াউর রহমান। রাজনীতিবিদরা যখন ভূলুণ্ঠিত, সেই সময় জাতির স্বাধীনতার স্পৃহার নিশান উঁচু করার দায়িত্ব নিলেন জিয়া। তিনি ২৫ মার্চ রাতেই ঘোষণা করলেন বিদ্রোহ। ২৭ মার্চ ঘোষণা করলেন স্বাধীনতা। কবি বেলাল মোহাম্মদ ভাইর ভাষ্য অনুযায়ী আরও অনেকে হয়তো এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু সেগুলো জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রাহ্য হয়নি—কারণ তারা সবাই ছিলেন ‘মাইনর’। অতএব একজন ‘মেজর’-এর ঘোষণাই জাতিক বা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রাহ্য হয়। গৃহীত হয়। ড. মল্লিক কিংবা একে খানের মতো ব্যক্তিত্বদের অনুরোধেই যে জিয়া মরহুম মুজিবের নামে পরের ঘোষণাগুলো দিয়েছিলেন তাও সত্য। কারণ বলার অপেক্ষা রাখে না, শেখ মুজিব নিঃসন্দেহে তখন অবিসংবাদিত নেতা—জনগণের নির্বাচিত নেতা। তার নামে ঘোষণা না দিলে তা সেনা বিদ্রোহ হিসেবে দেখানোর সুযোগ নিত পাকিস্তান।
এই একটি মাত্র ঘোষণা জাগিয়ে দিল জাতিকে। জাতি পেল পথ নির্দেশনা। ভেতরে যাই থাক, পলাতক আওয়ামী নেতৃত্বকে এগিয়ে আসতে হলো প্রবাসী সরকার গঠনে, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে। এই একটি মাত্র ঘোষণা পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল সেদিন। এই খানে জিয়ার কাছে চিরকালের জন্য ছোট হয়ে আছে আওয়ামী নেতৃত্ব। এটাকে উদার ও সহজভাবে তারা কোনো দিন মেনে নিতে পারেনি।
বিদ্বেষ-দুই : ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর আধিপত্যবাদের নীলনকশা ভণ্ডুল করে দেয় সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক সৈনিক ও বীর জনগণ। অভূতপূর্ব এক সিপাহি জনতার বিপ্লবের জন্ম দিয়ে তারা যেমন দেশকে রক্ষা করে, তেমনিই জাতীয় চেতনার আশা-আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হন জিয়াউর রহমান। ১৬ ডিসেম্বরের অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করে দেশ যেন সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হয়ে ওঠে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের আগের পর্যায়ে দেশকে পিছিয়ে নেয়ার আওয়ামী আয়োজন ব্যর্থ হলে, আওয়ামী লীগ এর জন্য জিয়াউর রহমানকে কোনো দিন ক্ষমা করেনি।
বিদ্বেষ-তিন : এ কথা সবাই জানে, অবিসম্বাদিত নেতা শেখ মুজিব শাসক হিসেবে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন। আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে, ক্ষমতা হাতে নিয়েই তিনি প্রথম আঘাত হানেন গণতন্ত্রের ওপর। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে গঠন করেন একদলীয় ‘বাকশালী’ স্বৈরতন্ত্র। সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি বাদে সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করেন। ১৯৭৫ সালে ২৭ জানুয়ারি লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ লিখল, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তার দেশে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের শেষ চিহ্নটুকু লাথি মেরে ফেলে দিয়েছেন। ... শেখ মুজিব এমপিদের বললেন, পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের অবদান। তিনি দেশের স্বাধীন আদালতকে ঔপনিবেশিক ও দ্রুত বিচার ব্যাহতকারী বলে অভিযুক্ত করেন।... নতুন প্রেসিডেন্টের যে আদৌ প্রশাসনিক জ্ঞান নেই তা গত তিন বছরে যথেষ্ট প্রমাণিত হয়েছে। তার স্টাইল হচ্ছে ডিকটেটরের স্টাইল।... একদলীয় শাসন সৃষ্টির ফলে দুর্নীতি দূর না হয়ে বরং বাড়তে থাকবে। কেননা, উদ্ধত আওয়ামী লীগারদের ‘চেক’ করতে পারবেন একমাত্র প্রেসিডেন্ট। কিন্তু তিনি থাকবেন অতিরিক্ত কাজের চাপে।’
আওয়ামী বাকশালী দুঃশাসনের ১৩৩৮ দিনের সীমাহীন অপকীর্তির সঠিক সংখ্যা, পরিমাণ ও ব্যাপকতা এক নজরে তুলে ধরা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারণ, সে সময় সব কীর্তি-কলাপ সংবাদপত্রে তুলে ধরা সম্ভব ছিল না। কারণ বাক-ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা না থাকায়, লাগামহীন লুণ্ঠন, ব্যাংক ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ, পাটের গুদামে আগুন, দখল, সন্ত্রাস ইত্যাদির কাছে সমাজের সবাই হয়ে পড়েছিল অসহায়। তারপরও সেই সময়কার দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সোর্সের তথ্য অনুযায়ী একটা সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান দেয়া যায় : দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করেন ১০ লাখ মানুষ। পুষ্টিহীনতায় মৃত্যুবরণ করেন ২ লাখ। বিনা চিকিত্সায় মৃত্যু হয় ১ লাখের। জেলখানায় মৃত্যু হয় ৯ হাজার। আওয়ামী বাকশালী গুণ্ডা ও রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনে মৃত্যু হয় ২৭ হাজার। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় ১৯ হাজার। গুম-খুন ১ লাখ। পিটিয়ে মারা হয় ৭ হাজার জনকে। নির্যাতনে পঙ্গুত্ব বরণ করেন ২ হাজার ৬০০। গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হন ২ লাখ। হাইজাক-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে ২২ হাজার। চুরি, ডাকাতি, লুটপাটের ঘটনা ঘটে ৬০ হাজার। আগুন লাগানো হয় ৭২টি পাটের গুদামে। আত্মসাত্ হয় ৫ হাজার কোটি টাকার মালামাল। কালোবাজারি হয় ২ হাজার কোটি টাকার মালামাল। পাচার হয়ে যায় ১০ হাজার কোটি টাকার মালামাল। জালিয়াতির ঘটনা ঘটে ৫ হাজার। ব্যাংক লুট হয় ১৫০টি। অস্ত্র লুট হয় ১৫ হাজার। ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ১৫ হাজার।
শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর দখল হয় ১৩ হাজার। জমি দখল হয় ৫০ হাজার একর। সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয় ৪ শতাধিক। (টাকার অংকগুলো সেই সময়ের, বর্তমানে এগুলো মান শত গুণ বাড়াতে হবে)।
এই রক্ত হিম করা লুণ্ঠনের খতিয়ানের সঙ্গে যুক্ত হয় ইনডিয়ান লুণ্ঠন। ১৩৩৮ দিনে ইনডিয়া ধান, গম, চাল লুট করে ৮০ লাখ টন, সে সময়কার বাজারমূল্য ২১৬০ কোটি টাকা। পাট লুট করে ৫০ লাখ বেল, মূল্য ৪০০ কোটি টাকা। ত্রাণসামগ্রী লুট করে নিয়ে যায় ১৫০০ কোটি টাকার। যুদ্ধাস্ত্র, আমদানিকৃত যন্ত্রাংশ, ওষুধ, মাছ, গবাদি পশু, স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা, কাঁসা, পিতল ইত্যাদি লুণ্ঠ করে ১,০০০ কোটি টাকার ওপরে। (মোট ৫০৬০ কোটি টাকা। সূত্র, জনতার মুখপত্র, নভেম্বর, ১৯৭৫)।
এই সীমাহীন অপশাসন, সন্ত্রাস ও লুণ্ঠনের ফলে দেশে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সদ্য মুক্তিযুদ্ধ ফেরত একটি গর্বিত জাতিকে পরিণত করা হয় ভিক্ষুকে। দেশের জন্য উপাধি জোটে তলাবিহীন ঝুড়ির।
এরকম অবস্থায় জিয়াউর রহমান দেশের শাসন ক্ষমতার দায়িত্ব পেলেন। তিনি অতি দ্রুততার সঙ্গে দেশে ফিরিয়ে আনলেন আইনের শাসন। গণতন্ত্রকে কবর থেকে উদ্ধার করে প্রবর্তন করলেন বহুদলীয় গণতন্ত্র। ভিক্ষুকের হাতকে পরিণত করলেন কর্মীর হাতিয়ারে। মাত্র দুই বছর আগে যে দেশে ১০ লাখ লোক না খেয়ে মরেছে, সেই দেশকে তিনি খাদ্যে স্বনির্ভর করলেন। তলাবিহীন ঝুড়ি পূর্ণ হলো প্রাচুর্যে। এবার শুরু হলো খাদ্য রফতানি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতির হারানো সম্মান ফিরে এল। উন্নয়ন ও উত্পাদনের পথে এগিয়ে চললো আধুনিক বাংলাদেশ। সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যায় শাসক শেখ মুজিব ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আর শাসক জিয়া সত্যিকার অর্থেই সফল। এই পরাজয়কেও আওয়ামী নেতৃত্ব কোনো দিন গ্রহণ করতে পারেনি।
বিদ্বেষ-চার : সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলা যায়, মরহুম শেখ মুজিব গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিলেন। একজন অনন্য সাধারণ জাতীয় নেতা হয়েও তিনি গণতন্ত্রকে কবরস্থ করতে সামান্য দ্বিধা করেননি। আর ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসে জিয়া সেই ‘নিহত গণতন্ত্রকে’ নতুন করে প্রাণ দেন। বিদ্বেষের কারণ এখানেও।
বিদ্বেষ-পাঁচ : বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে মরহুম মুজিব জাতিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে ফেলেছিলেন। এমনকি তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদেরও ‘বাঙালি হইয়া যাও’ বলে নছিহত করেছিলেন। যে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে ধারা তুলে মূল জাতিসত্তাকেও দুভাগে ভাগ করে ফেলেছিলেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির জন্য দরকার ছিল জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা। বিভেদ ও হানাহানির এই বিপর্যয় রুখতে জিয়া জাতিকে একটি আত্মপরিচয় দিতে পদক্ষেপ নেন। দেশের মধ্যে বাস করা ধর্ম সম্প্রদায় হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং বাঙালি, চাকমা, মারমা, মুরং, গারো, হাজং, সাঁওতাল, ওঁরাও, ত্রিপুরী, তঞ্চংইগ্যাসহ সব ছোট-বড় নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় জাতিসত্তার এক দৃঢ় পাটাতনে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড় করানোর জন্য উপহার দিলেন তার ঐতিহাসিক রাষ্ট্রদর্শন ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। যা আজ বাংলাদেশের প্রধানতম রক্ষাকবচ হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।
দেশের ঐক্য ও উন্নয়নের চাকাকে যথার্থভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই তিনি সংঘাত, হানাহানি, ঘৃণা ও বিভেদের ধ্বংসাত্মক পথ থেকে দেশ বাঁচানোর জন্য সমন্বয়ের রাজনীতি চালু করলেন। আর এই প্রক্রিয়াটি যে আধিপত্যবাদের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা—তা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এজন্য তারা বারবার আঘাত করছে এ সমন্বয় ও সম্প্রীতির পাটাতনকে নস্যাত্ করতে।
বিদ্বেষ-ছয় : শেখ মুজিব যখন সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে ‘বাকশাল’ কায়েম করেন, সেই সময় তিনি তার নিজের দল আওয়ামী লীগও ‘ব্যান্ড’ করে দেন। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তিনি প্রকাশ্য জনসভায় বলেন, সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি। আমি ভিক্ষা করে খাদ্য অর্থ আনি—আর চাটারদল সব খেয়ে ফেলে। এই পরিপ্রেক্ষিতে খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেন বিখ্যাত ছবি ‘আবার তোরা মানুষ হ’। মরহুম মুজিবের প্রত্যাশা অনুযায়ী আওয়ামী লীগের সেই সময়কার ক্ষমতাসীনরা ‘মানুষ’ না হলে, ব্যথিত মুজিব তার নিজ দলও নিষিদ্ধ করে দেন।
জিয়াউর রহমানের হাত দিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তিত হলে সব রাজনৈতিক দল এই সুযোগ গ্রহণ করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নামে সে সময় কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। জিয়াউর রহমান চাইলেন সব দল ও মতের মানুষের সম্মেলনে বহুদলীয় গণতন্ত্রে উত্তরণের সময়টা উজ্জ্বল হয়ে উঠুক। এ কারণে তিনি আওয়ামী লীগকেও পুনরুজ্জীবন দানের জন্য আগ্রহ দেখালেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের একটি অংশ স্বয়ং শেখ মুজিবের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ছিল জড়িত। তারা খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে গঠন করে নতুন দল। কেউ কেউ অন্যান্য দলে ভিড়ে। অবশিষ্ট যারা ছিল, তাদের তিনি ভয় না পেয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানালেন। বললেন, একটি মুক্ত অবাধ গণতান্ত্রিক পরিবেশের স্বার্থে আসুন অতীতের ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে, নতুনভাবে দেশ গড়ার জন্য নিজেদের সবটুকু সামর্থ্যকে

No comments

Powered by Blogger.