সহস্রবর্ষের সখা সাধনার ধন by রেজোয়ান সিদ্দিকী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিদায় অভিশাপ কাব্যনাটক লিখেছে কচ ও দেবযানীকে নিয়ে। বৃহস্পতি পুত্র কচ স্বর্গ থেকে মৃত সঞ্জীবনী বিদ্যালাভের জন্য দেবযানীর পিতা দৈত্যদের গুরুর কাছে যায়। সে কাহিনীর চরিত্রদের মনোবিশ্লেষণ আমার লেখার উপজীব্য নয়। কচ যখন মর্ত্যে নেমে এল তখন দেখতে পেল ভেজা চুলে সাজি হাতে কুঞ্জ বনে আলোকিত আভরণে পূজার জন্য ফুল তুলছে দেবযানী।
কচ এসে বলল, ‘তোমার সাজে না শ্রম, দেহো অনুমতি/ফুল তুলে দেব দেবী।’ তারপর দীর্ঘ এক হাজার বছর কচ ও দেবযানী পরস্পরের সান্নিধ্যে আনন্দ বেদনায় শিহরণে সময় পার করেছে। কচের মূল লক্ষ্য ছিল মৃত সঞ্জিবনী বিদ্যা অর্জন। দেবযানীর হৃদয় ভরা ছিল ভালবাসা। কিন্তু বিদ্যা অর্জন যখন সম্পন্ন হয়েছে তখন দেবযানীর সঙ্গে তার এই দীর্ঘ দিনের সম্পর্ককে সে কোন মূল্য দিতে পারেনি। খুব সহজেই সে সিদ্ধান্ত নেয় যে, ফিরে যাবে স্বর্গ পুরীতে। কচ বলছে, ‘দেবসন্নিধানে, শুভে করেছিনু পণ/মহাসঞ্জিবনী বিদ্যা করি উপার্জন/দেবলোকে ফিরে যাব; এসেছিনু তাই/সেই পণ মনে মোর জেগেছে সদাই/পূর্ণ আজি প্রতিজ্ঞা আজি চরিতার্থ এতো কাল পরে এ জীবন কোনো স্বার্থ/করি না কামনা আজি।’
দেবযানী কচকে নানাভাব বোঝাবার চেষ্টা করছিল এই সহস্র বছরে তার সব সুখ-চিন্তামালার মুক্তাগাথা হয়েছিল কচকে ঘিরেই। কিন্তু কচের কাছেই তার কোনো মূল্য নেই। নারীর স্বপ্ন তার সহস্রবর্ষের সাধনা, আবেগ-অনুভূতি, আবদার কোনো কিছুকেই সে মূল্য দিতে পারেনি। এ পৃথিবীর ঘটনাবলীর মধ্যেও আমরা তাই দেখি। নারীর মন পেতে পদ চুম্বনের দ্বিধা নেই পুরুষের। কিন্তু সে নারীকে একবার কব্জায় পাওয়া গেলে তার প্রতি অবহেলারও শেষ থাকে না। জানি কর্মই পুরুষের কর্তব্য আর এর ফল নারীর প্রাপ্য। এ শুধু বেদবাক্যই। বেদবাক্য এখন আর আমরা সেভাবে মানতে রাজি নই। পুরুষেরা সমাজটাকে এভাবে সাজিয়েছে যে কেবল কায়িক শক্তির জোরে তারা নারীকে বশীভূত করতে চায়। বঞ্চিত করতে চায়। নারীকে ঠকিয়ে নিজেরা লাভবান হতে চায়। কিন্তু কখনই ভেবে দেখে না কার জন্য এই লাভ অলাভ? সে কি ভবিষ্যত্ বংশধরদের জন্য? সে কি সন্তানদের জন্য? তাই যদি করতে চাই সে সন্তান বাড়িয়ে তোলার দায়িত্ব নারীর উপরই বর্তায়। কী যত্নে, কী স্নেহে, কী আন্তরিকতায় তারা সে সন্তান বড় করে তোলে আমরা সেদিকটা কখনও খেয়াল করতে চাই না। নারীকে বঞ্চিত করে সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ অকল্পনীয় ব্যাপার। যদি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সন্তান চাই তাহলে অধিকতর উজ্জ্বল আনন্দ চাই নারীর জন্য।
কিন্তু তা সহজে ঘটে ওঠে না। নারীর শ্রমকে বলবান পুরুষের সমাজে ছোট করে দেখা হয়। তাই একই কাজে পুরুষের চেয়ে নারীর পারিশ্রমিক অনেক কম। এমনিভাবে সংসারের ভেতরেও নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার অতি সামান্যই। আসলে আধুনিক সমাজের ইতিহাস নারীদের বঞ্চনারও ইতিহাস। নগর, নগর সভ্যতা সেই বঞ্চনার মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এর বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদের ইতিহাসও অল্পদিনের নয়। মজুরি বৈষম্য দূরীকরণ, নির্দিষ্ট কর্ম শ্রমঘণ্টা ও কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। তারপর থেকে তারা অবিরাম আন্দোলন-সংগ্রাম করেই গেছে। ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কে সমঅধিকার ও ভোটাধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন ১৫ হাজারেরও বেশি নারী শ্রমিক। এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে যোগ দেন ১৭টি দেশের ১১০ জন নারী প্রতিনিধি। সেই সম্মেলনে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী ক্লারা জেতকিন ৮ মার্চকে নারীর সমঅধিকার দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেন। ১৯১৪ সাল থেকে পৃথিবীর অনেক দেশেই ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয়। প্রধানত এ দিবসটি পালনের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন সমাজতান্ত্রিক মতবাদে বিশ্বাসীরা। ১৯৭৫ সালে দিবসটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় এবং পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিশ্ব নারী দিবস পালিত হয়।
আমরা লিখেছি, এ দিবস পালনে সমাজতন্ত্রীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু ১৯৯১ সালে তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোতে ছিলাম নারী দিবসে। নারীদের এক সম্মেলনে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম। তখনও সেখানে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নারী নির্যাতনের অবসান ঘটেনি, নারীর ওপর পুরুষের খবরদারি ও নির্যাতন বহালই ছিল। মস্কোর নারী নেত্রীরা আমাদের কাছে তার একটি নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছিলেন।
কিন্তু নারীর প্রতি এ বৈষম্যের অবসান ঘটাতেই হবে নারী জাতির সুষ্ঠু বিকাশের স্বার্থে। ন্যায় বিচারের মাধ্যমে নারীর হৃদয় জয় করে সেখানে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেটা দেবযানী কচকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বলো যদি সরল সাহসে/‘বিদ্যায় নাহি কো সুখ, নাহি সুখ যশে, দেবযানী, তুমি সিদ্ধি মূর্তিমতী/তোমারেই করিনু বরণ’, নাহি ক্ষতি/নাহি কোন লজ্জা তাহে। রমণীর/মন/সহস্র বর্ষেই, সখা, সাধনার ধন।’
স্বপ্নে প্রাপ্ত ইতিহাস
এ নগর তো অবিরাম ইতিহাস রচনা করেই যাচ্ছে। যে নাগরিকের এখন ৭০ বছর বয়স তিনি এদেশের অর্ধশতাব্দীর চলমান ইতিহাস। তার সামনে কত কী ঘটে গেছে। আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, ’৬১-এর ছাত্র আন্দোলন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ, ’৭২-৭৫ এর অপশাসন, ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ, ’৭৫-এর পটপরিবর্তন, ’৮২ সালের সামরিক অভ্যুত্থান ও তত্কালীন রাজনীতি, ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানসহ এ পর্যন্ত সব ইতিহাসের সাক্ষী তারা। যে নাগরিকদের বয়স ৫০-এর মধ্যে তারাও এ ইতিহাসের ধারাবাহিকতা অবহিত আছেন। তাদের কাছে ইতিহাসের নামে বগি আওয়াজ তেমন কোনো কাজে আসে না। বরং হাস্যকর শোনায়।
ইতিহাস যেন এখন স্বপ্নে পাওয়া কবচের মতো হয়ে গেছে। ইতিহাসের নামে চারদিকে বগি আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ছয়কে নয় করার এক প্রাণান্ত প্রয়াস সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। নাগরিকরা স্তম্ভিত হয়ে হাসছেন। ইতিহাস যেন হয়ে উঠছে স্বপ্নে পাওয়া তাবিজের মত, সর্বরোগহর। ইতিহাসকে অসত্যে পরিণত করার জন্য কী যে মরিয়া উদ্যোগ।
এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কয়েকটি নজির দেখে হতভম্ব হয়ে গেছেন সচেতন নাগরিকরা। গত পহেলা ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর বইমেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষা আন্দোলনের এক অলীক ইতিহাস রচনা করে বসেছেন। তিনি বলেছেন, ১৯৪৮ সালে (২রা মার্চ) শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস বা সত্য হলো, সে সময় শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায়ই ছিলেন না। ছিলেন কলকাতায়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন।
১৯৫২ সালের নবপর্যায়ে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বাংলা একাডেমীর ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এ সময় তাকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তিনি ‘১৪ই ফেব্রুয়ারি’ অনশন শুরু করলে ১৬ই ফেব্রুয়ারি তাকে আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিত্সার জন্য আনা হয়। সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধু ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের নির্দেশ দেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের ওই সময় শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে আটক ছিলেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) তাকে ফরিদপুর জেলা কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তিনি ১৫ই ফেব্রুয়ারি নিজের মুক্তির জন্য অনশন শুরু করেন। শেখ মুজিব ২৪শে ফেব্রুয়ারী কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে গোপালগঞ্জের নিজ বাড়িতে চলে যান এবং সেখানেই থেকে যান। এপ্রিলের শেষ দিকে তিনি ঢাকায় আসেন। তাহলে শেখ হাসিনা জেনেশুনে একথা বললেন কীভাবে? তিনি কি এই তথ্য তবে স্বপ্নের মধ্যে পেলেন? না কী ভাষা আন্দোলনের এক মনগড়া ইতিহাস রচনা করলেন? ভাবতে নাগরিকরা শঙ্কিত বোধ করছেন।
তেমনি গত ৭ মার্চ শেখ হাসিনা জানালেন আর এক তথ্য। সেটিও অতি চমকপ্রদ ও কৌতূহলোদ্দীপক। ওই দিনের ভাষণে শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালেই মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। তিনি বলেন, ১৯৬৯ সালের ২২ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনে যান। সে সময় তিনি স্বামীর কর্মস্থল ইটালিতে ছিলেন। ২৩ অক্টোবর ইটালি থেকে লন্ডনে পৌঁছেন। সেখানে শেখ মুজিব সভা করে ঠিক করেছিলেন ‘কখন মুক্তিযুদ্ধ হবে, কোথায় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং হবে এবং শরণার্থীরা কোথায় যাবে। সব প্রস্তুতি সেখানেই হয়। আমি চা-নাস্তা দেয়ার জন্য বেশ কয়েকবার ওই সভায় ঢুকতে পেরেছিলাম এবং তাদের কথা শুনেছিলাম।’ শেখ মুজিবের জন্য সম্ভবত এইটুকুই বাকি ছিল।
শেখ হাসিনা যদিও খুলে বলেননি যে, সে বৈঠকে কারা উপস্থিত ছিলেন। তবে খুব স্পষ্ট বোঝা গেল যে, শেখ মুজিব ’৬৯ সালের অক্টোবরেই জানতেন যে, ১৯৭০ সালে নির্বাচন হবে, সে নির্বাচনে তিনি বিপুলভাবে জয়ী হবেন, পাকিস্তানিরা তাকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেবে না, ২৫ মার্চ (১৯৭১) তারা নিরীহ বাংলাদেশীদের ওপর হামলা চালাবে এবং তারপর দিন, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন ও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। ‘কবে’ এসব হবে শেখ মুজিব সে তারিখও জানতেন। এটিও স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে নতুন সংযোজন।
নাগরিক মানুষেরা এ খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছেন। তবে কি শেখ মুজিব গণক ছিলেন? নাকি অতিমানব ছিলেন। তাদের বক্তব্য, শেখ মুজিবুর রহমান আর দশজন মানুষের মতো মানুষই ছিলেন। তার নেতৃত্বের গুণ ছিল, তাতে সম্মোহনী শক্তি ছিল, কিন্তু তিনি তো অতিমানব ছিলেন না। এসব উক্তি শেখ মুজিবকে কী বড় করবে না ছোট করবে, নাগরিকরা ভেবে আকুল হচ্ছেন।
এই নগরে মাঝে মাঝেই এখন এরকম স্বপ্নে প্রাপ্ত ইতিহাসের আবির্ভাব ঘটছে। নাগরিকরা হিসাব মেলাতে পারছেন না। তাদের চাক্ষুস যেসব ঘটনা এখন ইতিহাসের অঙ্গ, কিংবা যে ইতিহাস তারা বই পড়ে জানেন, ক্রমেই তা মিথ্যায় পরিণত হচ্ছে। নতুন নতুন চাটুকারেরা নতুন নতুন ইতিহাস রচনায় নেমেছে। তারা কল্পনার ভিত্তিতে নতুন ইতিহাস রচনা করতে চাইছে। এ সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমর নাগরিকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, “ক্ষমতায় বসে গায়ের জোরে ইতিহাস বিষয়ে বিভ্রান্তি বিস্তার করলে এবং সর্বোপরি আইনের হাতুড়ি মেরে যে সত্য ইতিহাস আড়াল করা যায় না, এটা এক ঐতিহাসিক সত্য। সত্যের ‘বদঅভ্যাসই’ হচ্ছে মিথ্যাকে পরাস্ত করা।”
ফুটনোট
সুইচ অন করাই ছিল। বিদ্যুত্ চলে গেছে বহু আগেই। হঠাত্ করেই ফ্যান ঘুরে গেল। একজন চিত্কার করে উঠল, ‘কী আশ্চর্য! বিদ্যুত্ এসে গেছে।’
নগর পদ্য
একজন লোক আছে রাজধানী ঢাকাতে
সে ভারি ওস্তাদ ইতিহাস বানাতে,
ডিমকে ডাব বলে ফাল দেয়
গাধাকে ঘোড়া বলে চাল দেয়
এভাবে সে ব্যস্ত ইতিহাস গড়াতে।
দেবযানী কচকে নানাভাব বোঝাবার চেষ্টা করছিল এই সহস্র বছরে তার সব সুখ-চিন্তামালার মুক্তাগাথা হয়েছিল কচকে ঘিরেই। কিন্তু কচের কাছেই তার কোনো মূল্য নেই। নারীর স্বপ্ন তার সহস্রবর্ষের সাধনা, আবেগ-অনুভূতি, আবদার কোনো কিছুকেই সে মূল্য দিতে পারেনি। এ পৃথিবীর ঘটনাবলীর মধ্যেও আমরা তাই দেখি। নারীর মন পেতে পদ চুম্বনের দ্বিধা নেই পুরুষের। কিন্তু সে নারীকে একবার কব্জায় পাওয়া গেলে তার প্রতি অবহেলারও শেষ থাকে না। জানি কর্মই পুরুষের কর্তব্য আর এর ফল নারীর প্রাপ্য। এ শুধু বেদবাক্যই। বেদবাক্য এখন আর আমরা সেভাবে মানতে রাজি নই। পুরুষেরা সমাজটাকে এভাবে সাজিয়েছে যে কেবল কায়িক শক্তির জোরে তারা নারীকে বশীভূত করতে চায়। বঞ্চিত করতে চায়। নারীকে ঠকিয়ে নিজেরা লাভবান হতে চায়। কিন্তু কখনই ভেবে দেখে না কার জন্য এই লাভ অলাভ? সে কি ভবিষ্যত্ বংশধরদের জন্য? সে কি সন্তানদের জন্য? তাই যদি করতে চাই সে সন্তান বাড়িয়ে তোলার দায়িত্ব নারীর উপরই বর্তায়। কী যত্নে, কী স্নেহে, কী আন্তরিকতায় তারা সে সন্তান বড় করে তোলে আমরা সেদিকটা কখনও খেয়াল করতে চাই না। নারীকে বঞ্চিত করে সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ অকল্পনীয় ব্যাপার। যদি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সন্তান চাই তাহলে অধিকতর উজ্জ্বল আনন্দ চাই নারীর জন্য।
কিন্তু তা সহজে ঘটে ওঠে না। নারীর শ্রমকে বলবান পুরুষের সমাজে ছোট করে দেখা হয়। তাই একই কাজে পুরুষের চেয়ে নারীর পারিশ্রমিক অনেক কম। এমনিভাবে সংসারের ভেতরেও নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার অতি সামান্যই। আসলে আধুনিক সমাজের ইতিহাস নারীদের বঞ্চনারও ইতিহাস। নগর, নগর সভ্যতা সেই বঞ্চনার মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এর বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদের ইতিহাসও অল্পদিনের নয়। মজুরি বৈষম্য দূরীকরণ, নির্দিষ্ট কর্ম শ্রমঘণ্টা ও কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। তারপর থেকে তারা অবিরাম আন্দোলন-সংগ্রাম করেই গেছে। ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কে সমঅধিকার ও ভোটাধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন ১৫ হাজারেরও বেশি নারী শ্রমিক। এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে যোগ দেন ১৭টি দেশের ১১০ জন নারী প্রতিনিধি। সেই সম্মেলনে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী ক্লারা জেতকিন ৮ মার্চকে নারীর সমঅধিকার দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেন। ১৯১৪ সাল থেকে পৃথিবীর অনেক দেশেই ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয়। প্রধানত এ দিবসটি পালনের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন সমাজতান্ত্রিক মতবাদে বিশ্বাসীরা। ১৯৭৫ সালে দিবসটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় এবং পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিশ্ব নারী দিবস পালিত হয়।
আমরা লিখেছি, এ দিবস পালনে সমাজতন্ত্রীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু ১৯৯১ সালে তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোতে ছিলাম নারী দিবসে। নারীদের এক সম্মেলনে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম। তখনও সেখানে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নারী নির্যাতনের অবসান ঘটেনি, নারীর ওপর পুরুষের খবরদারি ও নির্যাতন বহালই ছিল। মস্কোর নারী নেত্রীরা আমাদের কাছে তার একটি নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছিলেন।
কিন্তু নারীর প্রতি এ বৈষম্যের অবসান ঘটাতেই হবে নারী জাতির সুষ্ঠু বিকাশের স্বার্থে। ন্যায় বিচারের মাধ্যমে নারীর হৃদয় জয় করে সেখানে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেটা দেবযানী কচকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বলো যদি সরল সাহসে/‘বিদ্যায় নাহি কো সুখ, নাহি সুখ যশে, দেবযানী, তুমি সিদ্ধি মূর্তিমতী/তোমারেই করিনু বরণ’, নাহি ক্ষতি/নাহি কোন লজ্জা তাহে। রমণীর/মন/সহস্র বর্ষেই, সখা, সাধনার ধন।’
স্বপ্নে প্রাপ্ত ইতিহাস
এ নগর তো অবিরাম ইতিহাস রচনা করেই যাচ্ছে। যে নাগরিকের এখন ৭০ বছর বয়স তিনি এদেশের অর্ধশতাব্দীর চলমান ইতিহাস। তার সামনে কত কী ঘটে গেছে। আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, ’৬১-এর ছাত্র আন্দোলন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ, ’৭২-৭৫ এর অপশাসন, ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ, ’৭৫-এর পটপরিবর্তন, ’৮২ সালের সামরিক অভ্যুত্থান ও তত্কালীন রাজনীতি, ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানসহ এ পর্যন্ত সব ইতিহাসের সাক্ষী তারা। যে নাগরিকদের বয়স ৫০-এর মধ্যে তারাও এ ইতিহাসের ধারাবাহিকতা অবহিত আছেন। তাদের কাছে ইতিহাসের নামে বগি আওয়াজ তেমন কোনো কাজে আসে না। বরং হাস্যকর শোনায়।
ইতিহাস যেন এখন স্বপ্নে পাওয়া কবচের মতো হয়ে গেছে। ইতিহাসের নামে চারদিকে বগি আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ছয়কে নয় করার এক প্রাণান্ত প্রয়াস সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। নাগরিকরা স্তম্ভিত হয়ে হাসছেন। ইতিহাস যেন হয়ে উঠছে স্বপ্নে পাওয়া তাবিজের মত, সর্বরোগহর। ইতিহাসকে অসত্যে পরিণত করার জন্য কী যে মরিয়া উদ্যোগ।
এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কয়েকটি নজির দেখে হতভম্ব হয়ে গেছেন সচেতন নাগরিকরা। গত পহেলা ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর বইমেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষা আন্দোলনের এক অলীক ইতিহাস রচনা করে বসেছেন। তিনি বলেছেন, ১৯৪৮ সালে (২রা মার্চ) শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস বা সত্য হলো, সে সময় শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায়ই ছিলেন না। ছিলেন কলকাতায়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন।
১৯৫২ সালের নবপর্যায়ে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বাংলা একাডেমীর ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এ সময় তাকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তিনি ‘১৪ই ফেব্রুয়ারি’ অনশন শুরু করলে ১৬ই ফেব্রুয়ারি তাকে আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিত্সার জন্য আনা হয়। সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধু ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের নির্দেশ দেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের ওই সময় শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে আটক ছিলেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) তাকে ফরিদপুর জেলা কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তিনি ১৫ই ফেব্রুয়ারি নিজের মুক্তির জন্য অনশন শুরু করেন। শেখ মুজিব ২৪শে ফেব্রুয়ারী কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে গোপালগঞ্জের নিজ বাড়িতে চলে যান এবং সেখানেই থেকে যান। এপ্রিলের শেষ দিকে তিনি ঢাকায় আসেন। তাহলে শেখ হাসিনা জেনেশুনে একথা বললেন কীভাবে? তিনি কি এই তথ্য তবে স্বপ্নের মধ্যে পেলেন? না কী ভাষা আন্দোলনের এক মনগড়া ইতিহাস রচনা করলেন? ভাবতে নাগরিকরা শঙ্কিত বোধ করছেন।
তেমনি গত ৭ মার্চ শেখ হাসিনা জানালেন আর এক তথ্য। সেটিও অতি চমকপ্রদ ও কৌতূহলোদ্দীপক। ওই দিনের ভাষণে শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালেই মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। তিনি বলেন, ১৯৬৯ সালের ২২ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনে যান। সে সময় তিনি স্বামীর কর্মস্থল ইটালিতে ছিলেন। ২৩ অক্টোবর ইটালি থেকে লন্ডনে পৌঁছেন। সেখানে শেখ মুজিব সভা করে ঠিক করেছিলেন ‘কখন মুক্তিযুদ্ধ হবে, কোথায় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং হবে এবং শরণার্থীরা কোথায় যাবে। সব প্রস্তুতি সেখানেই হয়। আমি চা-নাস্তা দেয়ার জন্য বেশ কয়েকবার ওই সভায় ঢুকতে পেরেছিলাম এবং তাদের কথা শুনেছিলাম।’ শেখ মুজিবের জন্য সম্ভবত এইটুকুই বাকি ছিল।
শেখ হাসিনা যদিও খুলে বলেননি যে, সে বৈঠকে কারা উপস্থিত ছিলেন। তবে খুব স্পষ্ট বোঝা গেল যে, শেখ মুজিব ’৬৯ সালের অক্টোবরেই জানতেন যে, ১৯৭০ সালে নির্বাচন হবে, সে নির্বাচনে তিনি বিপুলভাবে জয়ী হবেন, পাকিস্তানিরা তাকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেবে না, ২৫ মার্চ (১৯৭১) তারা নিরীহ বাংলাদেশীদের ওপর হামলা চালাবে এবং তারপর দিন, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন ও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। ‘কবে’ এসব হবে শেখ মুজিব সে তারিখও জানতেন। এটিও স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে নতুন সংযোজন।
নাগরিক মানুষেরা এ খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছেন। তবে কি শেখ মুজিব গণক ছিলেন? নাকি অতিমানব ছিলেন। তাদের বক্তব্য, শেখ মুজিবুর রহমান আর দশজন মানুষের মতো মানুষই ছিলেন। তার নেতৃত্বের গুণ ছিল, তাতে সম্মোহনী শক্তি ছিল, কিন্তু তিনি তো অতিমানব ছিলেন না। এসব উক্তি শেখ মুজিবকে কী বড় করবে না ছোট করবে, নাগরিকরা ভেবে আকুল হচ্ছেন।
এই নগরে মাঝে মাঝেই এখন এরকম স্বপ্নে প্রাপ্ত ইতিহাসের আবির্ভাব ঘটছে। নাগরিকরা হিসাব মেলাতে পারছেন না। তাদের চাক্ষুস যেসব ঘটনা এখন ইতিহাসের অঙ্গ, কিংবা যে ইতিহাস তারা বই পড়ে জানেন, ক্রমেই তা মিথ্যায় পরিণত হচ্ছে। নতুন নতুন চাটুকারেরা নতুন নতুন ইতিহাস রচনায় নেমেছে। তারা কল্পনার ভিত্তিতে নতুন ইতিহাস রচনা করতে চাইছে। এ সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমর নাগরিকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, “ক্ষমতায় বসে গায়ের জোরে ইতিহাস বিষয়ে বিভ্রান্তি বিস্তার করলে এবং সর্বোপরি আইনের হাতুড়ি মেরে যে সত্য ইতিহাস আড়াল করা যায় না, এটা এক ঐতিহাসিক সত্য। সত্যের ‘বদঅভ্যাসই’ হচ্ছে মিথ্যাকে পরাস্ত করা।”
ফুটনোট
সুইচ অন করাই ছিল। বিদ্যুত্ চলে গেছে বহু আগেই। হঠাত্ করেই ফ্যান ঘুরে গেল। একজন চিত্কার করে উঠল, ‘কী আশ্চর্য! বিদ্যুত্ এসে গেছে।’
নগর পদ্য
একজন লোক আছে রাজধানী ঢাকাতে
সে ভারি ওস্তাদ ইতিহাস বানাতে,
ডিমকে ডাব বলে ফাল দেয়
গাধাকে ঘোড়া বলে চাল দেয়
এভাবে সে ব্যস্ত ইতিহাস গড়াতে।
No comments