দেশের উন্নয়নে প্রয়োজন রাজনৈতিক সমঝোতা by আলমগীর কবীর হৃদয়
আমাদের ছোট একটি দেশ বাংলাদেশ অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। লাখো শহীদের রক্তে গড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ ৩৯ বছর। তবু বহু প্রতীক্ষিত সোনার বাংলা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কেন হয়নি? না আমরা করতে পারিনি। আজ দুঃখ ভরে বলতে হয় ’৭১-এ যে স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীন বাংলার জন্য এ দেশের দামাল ছেলেরা প্রাণপণ যুদ্ধ করে দেশটা মুক্ত করেছিল হানাদার বাহিনীর হাত থেকে, সেই স্বপ্ন আজও স্বপ্নই রয়ে গেছে।
স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশ যাদের হাতে আমরা পরিচালনা করার দায়িত্ব দিয়েছি, তাদের বেশির ভাগ রাজনৈতিক সংগঠনই দলকে সংগঠিত করতে সন্ত্রাস ও দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে। কেউবা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে স্বৈরাচারী রূপ ধারণ করেছে, কেউবা অবৈধ টাকার পাহাড় গড়েছে। দেশ উন্নয়নের বিষয়টি সব সময় উপেক্ষিত থেকেছে। তাই আজও বিশ্বের বুকে আমাদের এ দেশটা বড় অবহেলিত, ক্ষুধা দারিদ্র্যপীড়িত। দেশে শিক্ষার মান নিম্নমুখী, জীবনযাত্রার মান যাচ্ছেতাই, আসলে কি স্বাধীনতার এত বছর পরও দেশের অবস্থা এমন হওয়ার কথা ছিল? আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দুটি রাজনৈতিক দলনির্ভর হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ আজ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতো দুটি বড় দলের দুই নেত্রীর আদর্শে আদর্শিত হয়ে পড়েছে—এ কথা বলার অবকাশ রাখে না। তাই বারবার ঘুরেফিরে এ দুটি দলই বাংলাদেশ শাসন করার সুযোগ পাচ্ছে; কিন্তু আশার আলো ছড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে বারবারই। তাই জনগণ আজ বিএনপিকে নির্বাচিত করছে তো আগামীতে আবার আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করছে এই ভেবে যে, রাজনৈতিক দলগুলো বুঝি তাদের ভুলগুলো সংশোধন করে দেশ উন্নয়নে দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে কাজ করবে। কিন্তু প্রত্যাশার বাস্তবায়ন কোনো সরকারের পক্ষ থেকেই দেশের জনগণ কাঙ্ক্ষিতভাবে পাচ্ছে না। কারণ যে দুই নেত্রীকে দেশের জনতা বারবার মূল্যায়ন করে, প্রধানমন্ত্রী করে—দেশ পরিচালনার জন্য তারা দুজনই তাদের রাজনৈতিক আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতেই ব্যস্ত সময় পার করে দেন ক্ষমতার বেশির ভাগ সময়। একটি দল মনে করে তারাই একমাত্র এ দেশের স্বাধীনতার ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল আর কেউ তাদের সমকক্ষ নয়। অন্য দল মনে করে এ দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তক ও স্বাধীনতার ঘোষকের দল। একদল জাতির জনকের আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে যাচ্ছে, অন্যদল স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এ নিয়েই জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থল জাতীয় সংসদের এক-তৃতীয়াংশ সময় কেটে যায়, যে সময়টুকু দেশের কল্যাণে উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ থাকলে দেশ অনেকটা উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে ধাবমান হতে পারত। কিন্তু তা যেন কোনো কিছুতেই সম্ভব হয়ে উঠছে না। এই তো কিছুদিন আগেও সংসদ অধিবেশনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে যে দুঃখজনক অশালীন বক্তব্য প্রদান নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সূত্রপাত হলো তা জাতির জন্য লজ্জাকর ব্যাপার। কারণ লাখো জনতার প্রতিনিধিরাই সংসদে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার বিষয়বস্তু তুলে ধরবেন, জাতীয় নেতাদের সম্মানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন—এটাই সবাই প্রত্যাশা করে। কিন্তু আজ স্বাধীনতার এত বছর পরও দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে পারেনি। তবে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে রাজনৈতিক সমঝোতায় উপনীত হওয়া বিশেষ জরুরি হয়ে পড়েছে আজ। কারণ বড় দুটি দল যদি তাদের কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করতে না পারে তবে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন কখনও সম্ভব হবে না বলে দেশের সাধারণ মানুষ মনে করে। রাজনৈতিক সমঝোতা হলে প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ হবে। আমাদের দেশে প্রতিবার সরকার গঠনের পরই দেখা যায় প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু হয়ে যায়। বিরোধী দলকে হামলা, মামলা, দিয়ে কোণঠাসা করা চিরায়ত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ম বন্ধ করা উচিত। জাতীয় ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই একসঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে রাজনৈতিক সংঘাত কমে আসবে। গত বেশকিছু দিন ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিরোধী রাজনীতিকে হেয় প্রতিপন্ন করতে সরকারের মধ্যে থেকে বিভিন্ন স্থাপনার শহীদ জিয়ার ম্যুরাল ভেঙে ফেলা, নামকরণ মুছে ফেলা ও নতুন নামকরণ করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এতে করে রাজনৈতিক সহাবস্থান নষ্ট হচ্ছে। এখানে একটি কথা বলতে হয়, বিভিন্ন স্থাপনা থেকে জিয়ার নাম মুছে দিলেই কি এদেশের মানুষের মন থেকে জিয়াউর রহমান হারিয়ে যাবেন? না, ইতিহাস তা বলে না। স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা উঠলেই যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা ভেসে ওঠে, তা কোনো আইন দিয়ে বা জোর করে বন্ধ করা যাবে না; ঠিক তেমনি শহীদ জিয়ার নাম মুছে ফেলে জনতার মন থেকে জিয়াকে মোছা যাবে না চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে আসা সেই বজ্রকণ্ঠের অধিকারী হিসেবে, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে, শহীদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, যুদ্ধের সময়ে জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম উঠবেই। তাই আমাদের উচিত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চিন্তা থেকে সরে এসে দেশের উন্নয়নে মনোনিবেশ করা। একটি কথা বলতে চাই, আপনারা যদি জাতির প্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজনে রাজনীতি করে থাকেন তাহলে অবশ্যই দেশের প্রয়োজনে সবার আগে প্রধান দুটি দলকে ভাবতে হবে—আমরা এ দেশের সৈনিক, দেশের প্রয়োজনে কোনো সৈনিকের মধ্যে বিরোধ থাকতে পারে না। আর যে দেশের সৈনিকের মধ্যে নিজেদের আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠিত করার বা ভাবার অবকাশ থাকে সে দেশের মুক্তি, উন্নয়ন, অগ্রযাত্রা কোনোটাই আশা করা যায় না। আমাদের এই বাংলাদেশটাকে বিশ্বের বুকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সংকল্প নিয়ে কাজ করতে হবে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলকে। তাই সবার মতো আমারও চাওয়া—কোনো বিভক্তি নয়, রাজনৈতিক সমঝোতাই পারে সুখী-সমৃদ্ধ উন্নয়নে মুখর বাংলাদেশ গড়তে। এ দেশের মানুষ যেমন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবকে শ্রদ্ধাভাবে স্মরণ করে, তেমনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। জাতির প্রয়োজনে কোনো জাতীয় নেতাকে খাটো করে না দেখে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হোক সব জাতীয় ইস্যুতে। তবেই দেশের মানুষ সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ পাবে, কৃষক তার কৃষিতে, কুলি তার মজুরিতে, ব্যবসায়ী তার ব্যবসাতে, শিক্ষক তার শিক্ষা প্রদানে, লেখক তার লেখনীতে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করবে।
লেখক : সভাপতি, উত্তরণ সাহিত্য আসর, পাবনা
লেখক : সভাপতি, উত্তরণ সাহিত্য আসর, পাবনা
No comments