বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪৯৩ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবদুল মজিদ, বীর প্রতীক অনন্য সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের (ব্যাটালিয়ন) সুবেদার মেজর ছিলেন আবদুল মজিদ।


এর অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে এবং অধিনায়ক (কমান্ডিং অফিসার) ছিলেন বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিল। ১৯৭১ সালের শুরুতে এই রেজিমেন্টকে পাকিস্তানে (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) বদলি করা হয়েছিল। সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে মার্চ মাসে রেজিমেন্টের অর্ধেক সদস্য ছুটিতে এবং আবদুল মজিদসহ বাকিরা যশোরের জগদীশপুরে বার্ষিক ফিল্ড এক্সসারসাইজে ছিলেন।
তখন ওই এলাকা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। জনবসতি বা মানুষজন ছিল না। ফলে দেশের ঘটনাপ্রবাহ আবদুল মজিদেরা তেমন জানতেন না। ২৫ মার্চ রাত থেকে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে কী ঘটেছিল, তা তাঁদের অজানা ছিল। ২৯ মার্চ দুপুরে তলব পেয়ে রাত আনুমানিক ১২টায় তাঁরা সেনানিবাসে পৌঁছান। পরদিন সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১০৭ ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার দুররানী রেজিমেন্ট হেডকোয়ার্টারে আসেন এবং রেজিমেন্ট অধিনায়ককে জানান, তাঁদের নিরস্ত্র করা হলো। এরপর তিনি অস্ত্রাগারের চাবি নিয়ে চলে যান।
এই খবর মুহূর্তেই বাঙালি সেনাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বিদ্রোহ করেন এবং অস্ত্রাগার ভেঙে যাঁর যাঁর অস্ত্র নিজ হাতে নিয়ে চারদিকে পজিশন নেন। খবর পেয়ে যশোর সেনানিবাসে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৫ বালুচ রেজিমেন্ট ও ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স তাঁদের আক্রমণ করে।
আবদুল মজিদ ও তাঁর সহযোদ্ধারা অত্যন্ত দৃঢ়তা ও দক্ষতার সঙ্গে ওই আক্রমণ প্রতিহত করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সকাল আটটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত কয়েকবার আক্রমণ করে। প্রতিবারই তাঁরা সেই আক্রমণ প্রতিহত করেন। যুদ্ধ চলাবস্থায় তিনি এবং লেফটেন্যান্ট হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (বীর বিক্রম, পরে মেজর) কয়েকবার অধিনায়ক রেজাউল জলিলের কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন, তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়ে নেতৃত্ব দিতে। কিন্তু তিনি নেতৃত্ব দিতে অস্বীকার করেন। এ অবস্থায় তিনি হাফিজ উদ্দিনের ওপর যুদ্ধের নেতৃত দেন।
যশোর সেনানিবাসে তাঁদের তুলনায় পাকিস্তানি সেনা ছিল অনেক বেশি। হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আবদুল মজিদ ও তাঁর সহযোদ্ধারা বুঝতে পারেন, বেশিক্ষণ তাঁরা যুদ্ধ চালাতে পারবেন না। সে জন্য তাঁরা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এ সময় আবদুল মজিদ তাঁদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে আবার রেজাউল জলিলের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু তিনি পুনরায় অস্বীকৃতি জানান। বরং একপর্যায়ে তাঁকে কৌশলে তাঁর গাড়িতে তুলে অজানার উদ্দেশে রওনা হন। পথে আবদুল মজিদ বুঝতে পারেন, তাঁর অধিনায়ক আসলে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছেন। তাঁর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তিনি সঙ্গে সঙ্গে চলন্ত গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হন।
পাকিস্তানি সেনারা উত্তর-পূর্ব-দক্ষিণ, তিন দিক থেকে তাঁদের আক্রমণ করেছিল। পশ্চিম দিক দিয়ে আক্রমণ না করলেও সেদিকেও মাঝে মাঝে গুলি ছুটে আসছিল। তাঁরা শেষ পর্যন্ত ওই দিক দিয়েই সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে চৌগাছায় একত্র হন। এরপর তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
প্রতিরোধযুদ্ধে আবদুল মজিদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কারণ তখন তাঁদের দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একমাত্র হাফিজ উদ্দিন ছাড়া আর কোনো সেনা কর্মকর্তা ছিলেন না। ফলে তখন নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব তাঁর ওপরেও অনেক সময় পড়ে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যাওয়ার পর আবদুল মজিদ প্রথমে ১১ নম্বর সেক্টরে, পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আবদুল মজিদকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪৫। তাঁর প্রকৃত নাম আবদুল মজিদ মিয়া।
আবদুল মজিদ মিয়া স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেন। ২০০৫ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি গাজীপুর জেলার সদর উপজেলার দাখিনখান গ্রামে। অবসর নিয়ে বাস করতেন গাজীপুরের বোর্ডবাজারে (কলমেশ্বর)। বাবার নাম মো. জনাব আলী, মা আয়েশা বেগম আহল্লাদী। স্ত্রী জরিনা বেগম। তাঁদের চার ছেলে ও চার মেয়ে।
সূত্র: মেজর ইফতোর হোসেন (আবদুল মজিদ বীর প্রতীকের ছেলে), মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.