আলোয় ভুবন ভরাঃ যিশুর গায়ে রোদ লাগে না by কাজী জহিরুল ইসলাম
এসফল্টের রাস্তাটা পিছলাতে পিছলাতে পাহাড় থেকে নেমে এসে যেখানে সমতল ভূমিতে লেপ্টে গেছে ঠিক ওখানেই একটি নামফলক। লাল জমিনের ওপর সাদা লেখা, বনুয়া। ডানদিকে অনেকখানি সমতল, আনারসের মাঠ আবার উঠতে শুরু করেছে ওপরে। ওখানেই আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একশ’ ফুট উঁচু মেরিমূর্তি। কোলে শিশুপুত্র যিশু।
সাদা এ নারীমূর্তিকে ঘিরে এক পাকা বেদি, বেদির ওপর একদল কালো মানুষ ঈশ্বরের করুণা লাভের জন্য প্রার্থনায় নিমগ্ন। স্থাপত্যশিল্পের বৈচিত্র্য ছাড়া দৃশ্যটা একই, সর্বত্র। আইভরিকোস্টের এখানে-সেখানে এমন বহু ধর্মশালা পথের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কোনোটা ত্রিভুজ, কোনোটা পাখি, কোনোটা মেরি, কোনোটা নৌকা, আবার কোনোটা বর্তুল, গোলাকার গম্বুজ। রঙের বৈচিত্র্যও লক্ষ্য করার মতো। গাড় নীল, লাল, হলুদ, সবুজের সঙ্গে সাদার প্রাধান্য সর্বত্র। শ্বেতপাথরের প্রতি যতটা না প্রেম, আমার মনে হয় তার চেয়েও বেশি সাদার প্রতি প্রভুত্ব। এ দেশের মানুষ বেড়াল, কুকুর, খরগোশ তো বটেই, এমনকি ইঁদুর (বেশ বড়সড় এই ইঁদুরগুলোকে ওরা বলে আগুটি) এবং বাদুড়ও খায়। বাদুড়ের স্যুপ নাকি অসাধারণ সুস্বাদু খাবার। কিন্তু অতি আশ্চর্য এই যে, ওরা এখানে-সেখানে বসে থাকা ধবল বকগুলোকে খায় না। কারণ ওরা সাদা, ওরা আকাশ থেকে নেমে আসা দেবদূত।
দুপুর হেলে পড়লেও আকাশে জ্বলন্ত সূর্য। দাবদাহে পুড়ছে পাম আর কাকাওয়ের বন। আমরা আশ্বিনি বিচ থেকে ফিরছি। আবিদজান শহর থেকে একশ’ কিলোমিটার দূরের এই বিচে প্রতি রোববার ছুটে আসি সজীব হওয়ার জন্য। বুক ভরে আটলান্টিকের নোনা বাতাসে নিঃশ্বাস টেনে আমরা আরও একটি কর্মসপ্তাহ কাটানোর জন্য তৈরি হই। আশ্বিনি বিচে আসা-যাওয়ার পথে মেরিকে সব সময়ই দেখি পুত্র যিশুকে কোলে নিয়ে একাকী দাঁড়িয়ে দূরের পান্থজনদের বিলাসী গাড়িগুলো গুনছে। প্রায়ই ভাবি একদিন ওর কোলের কাছে যাব, জিজ্ঞেস করব, ঈশ্বরের পুত্রকে ধর্মের কোলে বন্দি করে রেখেছ কেন? ওকে ছেড়ে দাও মানুষের ভিড়ে, বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিক কালো মানুষের রক্তের ভেতর। মূল সড়ক থেকে মেরিমূর্তির পদতল অব্দি একটি প্রশস্ত মেঠোপথ। আমি গাড়ি নামিয়ে দিলাম মেঠোপথে। সঙ্গে আমার দুই পাকিস্তানি সহকর্মী, সাজ্জাদ মোহাম্মদ আর আজরা লোদী, ওরা পাকিস্তান পুলিশ বিভাগের দুই ডিএসপি। আজরা কিছুটা আপত্তি করলেও সাজ্জাদের আগ্রহ আমার মতোই। আনারসের মাঠ পেরিয়ে উন্মুক্ত গির্জার কাছাকাছি পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য, দূর থেকে অতটা বোঝা যায়নি। যেখানে গাড়ি পার্ক করেছি ওখান থেকে মেরির পদতল অব্দি একান্নটি সিঁড়ি। সিঁড়ির দু’পাশে প্রতিটি সিঁড়িতে হাঁটু গেঁড়ে শত শত তরুণী দু’হাত জোড়া করে বাইবেলের শ্লোক পাঠ করছে আর চোখের পানি ফেলছে। আমি সিঁড়িতে পা রাখতেই সাজ্জাদ আমার জামা খামছে ধরল। ‘দাঁড়ান, ওদের সংস্কারগুলো জেনে নেয়া দরকার, জুতো পরে এ সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যাবে কিনা কে জানে?’ সাজ্জাদের কথায় আমি তেমন কর্ণপাত না করে তরতর করে ওপরে উঠতে লাগলাম। নানান দেশে এমন অনেক ধর্মশালায় গিয়েছি, বিদেশিদের জন্য এগুলো তো দর্শনীয় স্থানও, কেউ আপত্তি করেনি। দুবাইয়ের একটি দর্শনীয় মসজিদে দেখেছি বিদেশিরা জুতো পরে, শর্টস পরে, এমনকি মেয়েরাও দেদারসে ঢুকছে। শুধু এক জায়গায়, কাঠমান্ডুতে আমি বেশ আহত হয়েছি। পশুপতিনাথ মন্দিরের ছবি তুলতে গেলে এক নিরাপত্তাকর্মী ছুটে এসে আমার হাত থেকে ক্যামেরা কেড়ে নেয়। এছাড়া পৃথিবীর আর কোনো ধর্মশালা দর্শন করতে গিয়ে বিপদে পড়িনি। অবশ্য স্থানীয় জনগণের স্পর্শকাতরতার বিষয়টি সব সময় খেয়াল রেখে এগুনোই ভালো। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে যেন আঘাত না লাগে এটা লক্ষ্য রাখা একজন সচেতন পর্যটকের দায়িত্ব।
একান্নটি সিঁড়ি ভেঙে মেরির পদতলে নির্মিত গোলাকার সুবিশাল বেদির কাছে পৌঁছে গেছি, পেছনে সাজ্জাদ। আজরাতো গাড়ি থেকেই নামেনি। বেদির চতুর্দিকে গোল হয়ে হাঁটু গেঁড়ে, পাকা বেদির ওপর নতজানু মস্তক রেখে প্রার্থনায় নিবিষ্ট অসংখ্য মানুষ। অতি আশ্চর্যজনকভাবে এখানে কোনো রোদ নেই। এক সুশীতল ছায়া, তার ওপর দিয়ে বহু দূর থেকে ভেসে আসা মিষ্টি হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। ছেলেবেলায় রোদে খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে যখন ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে জিরোবার জন্য গাছতলায় বসে পড়তাম, তখন গাছের ছায়ায় শীতল বাতাসে যেমন প্রাণ জুড়াতো, ঠিক সেই রকম এক অনুভূতি হচ্ছে এখানে। অথচ দূরে, যতদূর চোখ যায়, আনারসের মাঠ, কাকাও বন, পাম বন কিংবা রাবার বন তীব্র রোদে পুড়ছে। এখানে রোদ নেই কেন? ওপরে তাকিয়ে দেখি একখণ্ড ভারী মেঘ ঠিক আমাদের মাথার ওপর স্থির দাঁড়িয়ে আছে, ছায়া দিচ্ছে প্রার্থনারত মানুষদের। কেমন একটা ধাক্কা লাগলো। আশপাশে কাউকে পাওয়া যায় কিনা জিজ্ঞেস করার মতো, খুঁজতে লাগলাম। খানিকটা দূরে একটি ছোট্ট ঘর, তার কার্নিশের নিচে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গেলাম। কুশল বিনিময় করে নাম জিজ্ঞেস করলাম। বললো, জোসেফ। ‘জোসেফ, বিষয়টা কি? শুধু এখানে ছায়া আর সর্বত্র রোদ?’ জোসেফ খুব ক্ষেপে গেল। ওর রাগ আমার মূর্খতার ওপর। যেন আমার জানা উচিত ছিল, এখানে রোদ না থাকারই কথা। কারণ মা মেরি তার শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন।
ওর সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে লাগলাম। এই বিশ্বাসী যুবক নিশ্চয়ই রোজ এখানে আসে না দেখার জন্য যে যিশু রোদে পুড়ছে কিনা? জোসেফ আসুক আর না আসুক আগামী রোববার আবার যখন আশ্বিনি বিচে যাব তখন আমি ঠিকই দেখতে আসব যিশুর গায়ে রোদ লাগছে কিনা।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পেশাজীবী
দুপুর হেলে পড়লেও আকাশে জ্বলন্ত সূর্য। দাবদাহে পুড়ছে পাম আর কাকাওয়ের বন। আমরা আশ্বিনি বিচ থেকে ফিরছি। আবিদজান শহর থেকে একশ’ কিলোমিটার দূরের এই বিচে প্রতি রোববার ছুটে আসি সজীব হওয়ার জন্য। বুক ভরে আটলান্টিকের নোনা বাতাসে নিঃশ্বাস টেনে আমরা আরও একটি কর্মসপ্তাহ কাটানোর জন্য তৈরি হই। আশ্বিনি বিচে আসা-যাওয়ার পথে মেরিকে সব সময়ই দেখি পুত্র যিশুকে কোলে নিয়ে একাকী দাঁড়িয়ে দূরের পান্থজনদের বিলাসী গাড়িগুলো গুনছে। প্রায়ই ভাবি একদিন ওর কোলের কাছে যাব, জিজ্ঞেস করব, ঈশ্বরের পুত্রকে ধর্মের কোলে বন্দি করে রেখেছ কেন? ওকে ছেড়ে দাও মানুষের ভিড়ে, বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিক কালো মানুষের রক্তের ভেতর। মূল সড়ক থেকে মেরিমূর্তির পদতল অব্দি একটি প্রশস্ত মেঠোপথ। আমি গাড়ি নামিয়ে দিলাম মেঠোপথে। সঙ্গে আমার দুই পাকিস্তানি সহকর্মী, সাজ্জাদ মোহাম্মদ আর আজরা লোদী, ওরা পাকিস্তান পুলিশ বিভাগের দুই ডিএসপি। আজরা কিছুটা আপত্তি করলেও সাজ্জাদের আগ্রহ আমার মতোই। আনারসের মাঠ পেরিয়ে উন্মুক্ত গির্জার কাছাকাছি পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য, দূর থেকে অতটা বোঝা যায়নি। যেখানে গাড়ি পার্ক করেছি ওখান থেকে মেরির পদতল অব্দি একান্নটি সিঁড়ি। সিঁড়ির দু’পাশে প্রতিটি সিঁড়িতে হাঁটু গেঁড়ে শত শত তরুণী দু’হাত জোড়া করে বাইবেলের শ্লোক পাঠ করছে আর চোখের পানি ফেলছে। আমি সিঁড়িতে পা রাখতেই সাজ্জাদ আমার জামা খামছে ধরল। ‘দাঁড়ান, ওদের সংস্কারগুলো জেনে নেয়া দরকার, জুতো পরে এ সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যাবে কিনা কে জানে?’ সাজ্জাদের কথায় আমি তেমন কর্ণপাত না করে তরতর করে ওপরে উঠতে লাগলাম। নানান দেশে এমন অনেক ধর্মশালায় গিয়েছি, বিদেশিদের জন্য এগুলো তো দর্শনীয় স্থানও, কেউ আপত্তি করেনি। দুবাইয়ের একটি দর্শনীয় মসজিদে দেখেছি বিদেশিরা জুতো পরে, শর্টস পরে, এমনকি মেয়েরাও দেদারসে ঢুকছে। শুধু এক জায়গায়, কাঠমান্ডুতে আমি বেশ আহত হয়েছি। পশুপতিনাথ মন্দিরের ছবি তুলতে গেলে এক নিরাপত্তাকর্মী ছুটে এসে আমার হাত থেকে ক্যামেরা কেড়ে নেয়। এছাড়া পৃথিবীর আর কোনো ধর্মশালা দর্শন করতে গিয়ে বিপদে পড়িনি। অবশ্য স্থানীয় জনগণের স্পর্শকাতরতার বিষয়টি সব সময় খেয়াল রেখে এগুনোই ভালো। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে যেন আঘাত না লাগে এটা লক্ষ্য রাখা একজন সচেতন পর্যটকের দায়িত্ব।
একান্নটি সিঁড়ি ভেঙে মেরির পদতলে নির্মিত গোলাকার সুবিশাল বেদির কাছে পৌঁছে গেছি, পেছনে সাজ্জাদ। আজরাতো গাড়ি থেকেই নামেনি। বেদির চতুর্দিকে গোল হয়ে হাঁটু গেঁড়ে, পাকা বেদির ওপর নতজানু মস্তক রেখে প্রার্থনায় নিবিষ্ট অসংখ্য মানুষ। অতি আশ্চর্যজনকভাবে এখানে কোনো রোদ নেই। এক সুশীতল ছায়া, তার ওপর দিয়ে বহু দূর থেকে ভেসে আসা মিষ্টি হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। ছেলেবেলায় রোদে খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে যখন ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে জিরোবার জন্য গাছতলায় বসে পড়তাম, তখন গাছের ছায়ায় শীতল বাতাসে যেমন প্রাণ জুড়াতো, ঠিক সেই রকম এক অনুভূতি হচ্ছে এখানে। অথচ দূরে, যতদূর চোখ যায়, আনারসের মাঠ, কাকাও বন, পাম বন কিংবা রাবার বন তীব্র রোদে পুড়ছে। এখানে রোদ নেই কেন? ওপরে তাকিয়ে দেখি একখণ্ড ভারী মেঘ ঠিক আমাদের মাথার ওপর স্থির দাঁড়িয়ে আছে, ছায়া দিচ্ছে প্রার্থনারত মানুষদের। কেমন একটা ধাক্কা লাগলো। আশপাশে কাউকে পাওয়া যায় কিনা জিজ্ঞেস করার মতো, খুঁজতে লাগলাম। খানিকটা দূরে একটি ছোট্ট ঘর, তার কার্নিশের নিচে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গেলাম। কুশল বিনিময় করে নাম জিজ্ঞেস করলাম। বললো, জোসেফ। ‘জোসেফ, বিষয়টা কি? শুধু এখানে ছায়া আর সর্বত্র রোদ?’ জোসেফ খুব ক্ষেপে গেল। ওর রাগ আমার মূর্খতার ওপর। যেন আমার জানা উচিত ছিল, এখানে রোদ না থাকারই কথা। কারণ মা মেরি তার শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন।
ওর সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে লাগলাম। এই বিশ্বাসী যুবক নিশ্চয়ই রোজ এখানে আসে না দেখার জন্য যে যিশু রোদে পুড়ছে কিনা? জোসেফ আসুক আর না আসুক আগামী রোববার আবার যখন আশ্বিনি বিচে যাব তখন আমি ঠিকই দেখতে আসব যিশুর গায়ে রোদ লাগছে কিনা।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পেশাজীবী
No comments