ড. ইউনূস, তার নব্য সমর্থকরা ও তালেবানী বাংলা by স্বদেশ রায়
দেশকে আমরা মা বলে ডাকছি অনেক দিন থেকে। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মুকুন্দ দাস সকলেই আমাদের গলায় নানান রঙে নানান ভাষায় এই মা ডাকটি তুলে দিয়েছে। আমরা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রাণভরে দেশকে মা বলে ডেকেছি। আবার প্রাণভরে মা ডাকতে শুরু করি ’৫২-এর পর থেকে।
’৭১-এ মুক্তিযোদ্ধারা নিজের জন্মদাতা মাকে পিছনে ফেলে দেশমাতাকে মুক্ত করতে গিয়েছিল।
বার বার আমরা প্রাণভরে দেশকে মা ডাকছি। কিন্তু আসলে কি আমরা উপলব্ধি করি এই মা আমাদের জীবনের কতটুকু। হয়ত একটি বড় অংশ উপলব্ধি করে, তা না হলে আমরা মুক্তিযুদ্ধে জিতলাম কিভাবে? কেন এত রক্ত, এত প্রাণ অকাতরে দিল মানুষ। শুধু তো আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীজুড়ে, পৃথিবীর ইতিহাসের পাতাজুড়ে রয়েছে দেশের জন্য এই ত্যাগ। নিজের দেশ অর্জন। কেন এই দেশ অর্জন? কেন এই দেশ? দেশ কী দেয় আমাদের? দেশ আমাদের কী দেয়, এটা ঠিক অনেকটা নিজের মা কী দেয় আমাদের জীবনে যেমন আমরা বুঝতে পারি না, তেমনি দেশ আমাদের কী দেয় সেটাও আমরা বুঝতে পারি না। জীবনে বড় হবার পরে ঠিক হিসাব করা হয় না, আসলে আজ আমি যে এ অবস্থানে এলাম এর জন্য দেশ আমাকে কী দিল? কিন্তু এই হিসাবটি কী আসলে জরুরী নয়।
আজ বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূস। আমেরিকা বা ইউরোপের অনেক প্রতিষ্ঠানে ডজন ডজন নোবেল বিজয়ী কাজ করছেন। এমনকি নোবেল পাবার পরে অপরাধ করার কারণে জেল খেটেছেন এমনও অনেক নোবেল বিজয়ী পৃথিবীতে আছেন। তবে আমাদের বাংলাদেশের হিসাবটি ভিন্ন। নানান উত্থান পতনের কারণে দেশটিতে অর্জন কম। যে কারণে আমাদের একজন মাত্র নোবেল বিজয়ী এটা আমাদের গর্ব। আর এই গর্ব কিন্তু সেখানে গিয়েই দাঁড়ায় যে, আমাদের একটি নিজস্ব দেশ আছে বলেই ড. ইউনূস এমন একটি কাজ করার সুযোগ পেলেন যাতে তিনি নোবেল পেলেন। বাস্তবে বাংলাদেশ যদি একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ না হতো তাহলে ড. ইউনূস কী কখনো গ্রামীণ ব্যাংক করার সুযোগ পেতেন? পাকিস্তানী প্রশাসন কী তাকে এই সুযোগ দিত? আর এ সুযোগ না পেলে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক গড়ে তুলতে পারতেন? শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ সালের ক্ষমতার সময়ে গ্রামীণ ব্যাংক দু’বার বিপর্যয়ের মুখে পড়ে তখন সরকার একবার গ্রামীণ ব্যাংককে ১শ কোটি টাকা আরেকবার তিন শ’ কোটি টাকা দিয়ে রক্ষা করে। এটা যদি বাংলাদেশ না হয়ে পাকিস্তান থাকত, করত কি এই কাজ পাকিস্তানী সরকার? কোন মতেই করত না। তাই দেশ আছে বলেই গ্রামীণ ব্যাংক হয়েছে। দেশ আছে বলেই গ্রামীণ ব্যাংক বড় হতে পেরেছে এবং গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস মিলে নোবেল পেয়েছে। যা আমাদের দেশের জন্য সম্মানের।
তাই যখন কাউকে দেশ অনেক বেশি সম্মানিত করে তখন কিন্তু দেশের প্রতি তার দায়িত্ব বেড়ে যায় অনেক। তখন দেশের সম্মানের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে যায়। কিন্তু সম্প্রতি ড. ইউনূসকে ঘিরে কিছু লোক এবং ড. ইউনূসের অনেক কাজ কিন্তু দেশকে অসম্মানিত করছে। হ্যাঁ, এটা সত্য ড. ইউনূসকে ঘিরে যা ঘটেছে তার সব কিছুর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমি একমত নই। যে কারণে এই কলামে সব সময়েই লিখেছি একটি সম্মানজনক সমঝোতার কথা। যেমন ড. ইউনূস যখন আর বয়সের কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থাকতে পারেন না তখন তাঁর ও সরকারের ভিতর একটি সমঝোতা হওয়া উচিত ছিল। আইন মেনে অন্য কীভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে থাকতে পারেন ড. ইউনূস। সে ধরনের সমঝোতা হতে পারত। এবং কোন কিছুতে কারো অনেক বেশি অবদান থাকলে সে সম্মান তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পান। যেমন নতুন সিঙ্গাপুরের রূপকারকে সেখানে বিশেষ সম্মানে সরকারের সঙ্গে রাখা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীরও তেমন একটি মনোভাব শুরুতে ছিল। কিন্তু ড. ইউনূস সে পথে না গিয়ে আদালতে যান। যাদের পরামর্শে তিনি আদালতে গিয়েছিলেন তারা কেন তাকে আদালতে নিয়েছিলেন সেটা তারা ভাল বলতে পারবেন। এবং দেখা গেল আদালতের রায়েই ড. ইউনূসের এমডি পদে থাকার অধিকার চলে গেল। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, ড. ইউনূস দেশে বা বিদেশে কোথাও কিন্তু বলছেন না আদালতের রায়ে তিনি এমডি পদ হারিয়েছেন। তিনি দোষারোপ করছেন সরকারকে। এবং এমনভাবে তিনি উপস্থাপন করছেন যে, তাকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বিতাড়ন করা হয়েছে ব্যাংকটিকে ধ্বংস করার জন্য।
পৃথিবীর অনেক নোবেল বিজয়ীর থেকে ড. ইউনূসের পৃথিবীজুড়ে ক্ষমতাবানদের সংযোগ অনেক বেশি। যে কারণে আমরা ড. ইউনূসের কাছ থেকে কোন মৌলিক বই আজ অবধি পায়নি। কারণ, তিনি হয়ত এই মৌলিক বই লেখার থেকে, মৌলিক বক্তব্য দেবার থেকে অনেক বেশি সময় ব্যয় করেন সারা পৃথিবীতে ক্ষমতাবানদের সঙ্গে নিজের একটি সংযোগ গড়ে তুলতে। মাঝে মাঝেই পৃথিবীর নানান দেশের পত্র-পত্রিকার বই সমালোচনা বিভাগ বা বইয়ের খবর বিভাগে চোখ রাখলেই দেখা যায় বাঙালী আরেক নোবেল বিজয়ী অর্মত্য সেনের কোন না কোন নতুন বই বের হয়েছে। যাতে একটি নতুন চিন্তা একটি নতুন দর্শন আছে। আছে অর্থনীতির নতুন কোন পথ আবিষ্কারের চেষ্টা। এ রকম কোন খবর আমরা ড. ইউনূস সম্পর্কে পাই না। বরং সংবাদ পত্রের লোক হিসেবে মাঝে মাঝে তার একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি আমরা ছাপি যে, কোন রানীর সঙ্গে বা কোন প্রধানমন্ত্রী বা কোন বাদশার সঙ্গে তার দেখা হলো। অনেক সময় নিজেরও মনে হয়েছে এ সব ছবি ছাপতে গিয়ে, কেন তিনি এ গুলো পত্রিকায় ছাপতে পাঠান। পরে নিজের মনেই হিসেব মিলিয়েছি, তিনিও তো বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মতো সামরিক কালচারের ভিতর বড় হয়েছেন। তাই অবচেতনভাবে তার ভিতরও এই সামরিক কালচার আছে। সামরিক সরকাররা যেমন ক্ষমতাবানের সঙ্গে নিজেকে প্রদর্শন করে নিজে যে ক্ষমতাবান অবচেতনভাবে এটা প্রচার করতে চান তিনিও সেটাই চান। এ জন্য কখন তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমেছে বলে মনে হয়নি। তবে এটুকু ভেবেছি তিনিও সামরিক কালচারের বাইরে নন। আর তিনি যে সামরিক কালচারের বাইরে নন তার প্রমাণও তিনি রাখেন আধা সামরিক শাসনের সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক দল গড়তে নেমে। তবে তিনি সামরিক শাসকের অন্য পোষ্য বা দাসস্য দাসদের থেকে যে অনেক উন্নত সে প্রমাণ রাখেন দল না করার ঘোষণা দিয়ে। সাধারণত বাঙালী থামতে ভুল করে। তিনি সে ভুল করেননি।
কিন্তু তিনি তখন রাজনীতি সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছিলেন যেটা সামরিক কালচারের ব্যক্তিরাই করেন। আমাদের রাজনীতি অনেক নষ্ট হয়ে গেছে। এটাকে ঠি ক পথে আনতে হবে। তার মানে এই নয় যে, রাজনীতিকে অসম্মান করব। কারণ, মনে রাখা দরকার, এই যে ভাষা, এই যে দেশ সবই রাজনীতির ফসল। যে শহীদদের রক্তকে আমরা প্রতি মুহূর্তে শ্রদ্ধা করি ওই শহীদরা রাজনৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন। তাই রাজনীতিকে শ্রদ্ধা করতে হবে। হ্যাঁ, বাংলাদেশে রাজনীতি ক্রমান্বয়ে বিপাকে পড়ছে। রাজনীতির বিপরীতে রাজনীতির নাম নিয়ে গড়ে উঠছে সামরিক কালচারের রাজনীতি। সামরিক কালচারের এই রাজনীতি আর রাজনীতির ছদ্মাবরণে ধর্মীয় মৌলবাদ যা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের অঙ্গ। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেশের মানুষকে দেখতে হচ্ছে, ড. ইউনূস এ মুহুর্তে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে দেশ বিদেশে এমন কিছু কথা বলছেন, যা মূলত সরকারের কোন কর্মকা-ের দোষারোপ নয়, প্রকৃত বিচারে দেশের বিরোধিতা। এবং সেই বিরোধিতার দুর্ভাগ্যজনক ফল বাংলাদেশকে ভোগ করতে হচ্ছে। যা মূলত শেষ বিচারে দেশ বিরোধী প্রচার।
তবে তার থেকে আরও দুর্ভাগ্যজনক হলো, এ মূহুর্তে পত্র পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে ড. ইউনূসকে যারা সমর্থন যোগাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই জামায়াত-বিএনপি সমর্থক। এবং প্রকৃত অর্থে তারা দেশের স্বাধীনতাবিরোধী। ড. ইউনূসের পরিবারের একজন ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর কোলাবরেটর ছিলেন। স্বাধীনতার পরে চট্টগ্রামে তিনি কলাবরেটর হিসেবে গ্রেফতারও হয়েছিলেন। কিন্তু এটা তো সত্য ড. ইউনুস ১৯৭১ সালে আমেরিকাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়তে ভূমিকা রাখেন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। অথচ আজ তাকে যারা সমর্থন করছেন তারা সকলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীদের রক্ষক ও সন্ত্রাসবাদী বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক। ড. ইউনূসের সপক্ষে যারা বিবৃতি দিচ্ছেন তাদের অধিকাংশের অবস্থান এখানে।
মৌলবাদী এই সন্ত্রাসীরা ড. ইউনূসকে ঘিরে এই সুযোগ নেবার চেষ্টা করছেন। তাই বিষয়টি সম্পর্কে এ মুহূর্তেই ড. ইউনূসের সচেতন হওয়া উচিত। তার বিবৃতি দিয়ে জানানো উচিত তিনি আসলে এই জঙ্গী মৌলবাদীদের সমর্থন চান কিনা? দেশের মানুষ গত কয়েক মাস যাবত দেখতে পাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ড. ইউনূসের পক্ষে অনেকটা অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু এটা তো সত্য, বর্তমান বিশ্বে আমেরিকাই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাই ইতোমধ্যে যদি ড. ইউনূস বিবৃতি দিয়ে তাঁর অবস্থান পরিষ্কার না করেন তা হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও ভেবে দেখতে হবে, তারা যদি বাংলাদেশে ড. ইউনূসের সমর্থন করে তাহলে এ দেশটিতে মৌলবাদীদের অবস্থান কি দাঁড়াবে? মৌলবাদীরা যদি ড. ইউনূসকে ঘিরে আবার সংগঠিত হবার সুযোগ পায় তাহলে দেশটির অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এবং বিশ্ব রাজনীতির জন্য সেটা কতটা ক্ষতিকর হবে?
বিএনপি-জামায়াত বলেছে তারা ক্ষমতায় গেলে ড. ইউনূসকে সম্মানিত করবে। কিন্তু তখন কোন বাংলাদেশে ড. ইউনূস সম্মানিত হবেন এ বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভেবে দেখতে হবে। বিএনপি জামায়াত যখন ক্ষমতায় ছিল তখন এখানে লাদেনের সেকেন্ড ইন কমান্ড অবস্থান করে গেছে। বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বাংলাদেশে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহায়তায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীদের জন্য অস্ত্র চোরাচালানের ব্যবস্থা হয়েছে। এছাড়া আইনের শাসন ও গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে তালেবানী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপি জামায়াতের প্রশাসনের সহায়তায় ১ ঘণ্টায় ৫২৭ স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয় বাংলাদেশে। পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসে কম সময়ে সব থেকে বেশি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা। এখানেই শেষ নয়, আধুনিক পশ্চিমা বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে তথাকথিত তালেবানী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপি-জামায়াত সরকারের সহায়তায় জঙ্গীরা আদালতে বোমা মেরে বিচারক হত্যা করেছে। এমনকি জঙ্গীরা ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরীর ওপরেও গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে তখন। এর থেকে নিশ্চয়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে স্পষ্ট হবে যে, বিএনপি-জামায়াত কোন বাংলাদেশে ড. ইউনূসকে সম্মানিত করবে? সেটা কি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ না তালেবানী বাংলা!
swadeshroy@gmail.com
বার বার আমরা প্রাণভরে দেশকে মা ডাকছি। কিন্তু আসলে কি আমরা উপলব্ধি করি এই মা আমাদের জীবনের কতটুকু। হয়ত একটি বড় অংশ উপলব্ধি করে, তা না হলে আমরা মুক্তিযুদ্ধে জিতলাম কিভাবে? কেন এত রক্ত, এত প্রাণ অকাতরে দিল মানুষ। শুধু তো আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীজুড়ে, পৃথিবীর ইতিহাসের পাতাজুড়ে রয়েছে দেশের জন্য এই ত্যাগ। নিজের দেশ অর্জন। কেন এই দেশ অর্জন? কেন এই দেশ? দেশ কী দেয় আমাদের? দেশ আমাদের কী দেয়, এটা ঠিক অনেকটা নিজের মা কী দেয় আমাদের জীবনে যেমন আমরা বুঝতে পারি না, তেমনি দেশ আমাদের কী দেয় সেটাও আমরা বুঝতে পারি না। জীবনে বড় হবার পরে ঠিক হিসাব করা হয় না, আসলে আজ আমি যে এ অবস্থানে এলাম এর জন্য দেশ আমাকে কী দিল? কিন্তু এই হিসাবটি কী আসলে জরুরী নয়।
আজ বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূস। আমেরিকা বা ইউরোপের অনেক প্রতিষ্ঠানে ডজন ডজন নোবেল বিজয়ী কাজ করছেন। এমনকি নোবেল পাবার পরে অপরাধ করার কারণে জেল খেটেছেন এমনও অনেক নোবেল বিজয়ী পৃথিবীতে আছেন। তবে আমাদের বাংলাদেশের হিসাবটি ভিন্ন। নানান উত্থান পতনের কারণে দেশটিতে অর্জন কম। যে কারণে আমাদের একজন মাত্র নোবেল বিজয়ী এটা আমাদের গর্ব। আর এই গর্ব কিন্তু সেখানে গিয়েই দাঁড়ায় যে, আমাদের একটি নিজস্ব দেশ আছে বলেই ড. ইউনূস এমন একটি কাজ করার সুযোগ পেলেন যাতে তিনি নোবেল পেলেন। বাস্তবে বাংলাদেশ যদি একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ না হতো তাহলে ড. ইউনূস কী কখনো গ্রামীণ ব্যাংক করার সুযোগ পেতেন? পাকিস্তানী প্রশাসন কী তাকে এই সুযোগ দিত? আর এ সুযোগ না পেলে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক গড়ে তুলতে পারতেন? শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ সালের ক্ষমতার সময়ে গ্রামীণ ব্যাংক দু’বার বিপর্যয়ের মুখে পড়ে তখন সরকার একবার গ্রামীণ ব্যাংককে ১শ কোটি টাকা আরেকবার তিন শ’ কোটি টাকা দিয়ে রক্ষা করে। এটা যদি বাংলাদেশ না হয়ে পাকিস্তান থাকত, করত কি এই কাজ পাকিস্তানী সরকার? কোন মতেই করত না। তাই দেশ আছে বলেই গ্রামীণ ব্যাংক হয়েছে। দেশ আছে বলেই গ্রামীণ ব্যাংক বড় হতে পেরেছে এবং গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস মিলে নোবেল পেয়েছে। যা আমাদের দেশের জন্য সম্মানের।
তাই যখন কাউকে দেশ অনেক বেশি সম্মানিত করে তখন কিন্তু দেশের প্রতি তার দায়িত্ব বেড়ে যায় অনেক। তখন দেশের সম্মানের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে যায়। কিন্তু সম্প্রতি ড. ইউনূসকে ঘিরে কিছু লোক এবং ড. ইউনূসের অনেক কাজ কিন্তু দেশকে অসম্মানিত করছে। হ্যাঁ, এটা সত্য ড. ইউনূসকে ঘিরে যা ঘটেছে তার সব কিছুর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমি একমত নই। যে কারণে এই কলামে সব সময়েই লিখেছি একটি সম্মানজনক সমঝোতার কথা। যেমন ড. ইউনূস যখন আর বয়সের কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থাকতে পারেন না তখন তাঁর ও সরকারের ভিতর একটি সমঝোতা হওয়া উচিত ছিল। আইন মেনে অন্য কীভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে থাকতে পারেন ড. ইউনূস। সে ধরনের সমঝোতা হতে পারত। এবং কোন কিছুতে কারো অনেক বেশি অবদান থাকলে সে সম্মান তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পান। যেমন নতুন সিঙ্গাপুরের রূপকারকে সেখানে বিশেষ সম্মানে সরকারের সঙ্গে রাখা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীরও তেমন একটি মনোভাব শুরুতে ছিল। কিন্তু ড. ইউনূস সে পথে না গিয়ে আদালতে যান। যাদের পরামর্শে তিনি আদালতে গিয়েছিলেন তারা কেন তাকে আদালতে নিয়েছিলেন সেটা তারা ভাল বলতে পারবেন। এবং দেখা গেল আদালতের রায়েই ড. ইউনূসের এমডি পদে থাকার অধিকার চলে গেল। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, ড. ইউনূস দেশে বা বিদেশে কোথাও কিন্তু বলছেন না আদালতের রায়ে তিনি এমডি পদ হারিয়েছেন। তিনি দোষারোপ করছেন সরকারকে। এবং এমনভাবে তিনি উপস্থাপন করছেন যে, তাকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বিতাড়ন করা হয়েছে ব্যাংকটিকে ধ্বংস করার জন্য।
পৃথিবীর অনেক নোবেল বিজয়ীর থেকে ড. ইউনূসের পৃথিবীজুড়ে ক্ষমতাবানদের সংযোগ অনেক বেশি। যে কারণে আমরা ড. ইউনূসের কাছ থেকে কোন মৌলিক বই আজ অবধি পায়নি। কারণ, তিনি হয়ত এই মৌলিক বই লেখার থেকে, মৌলিক বক্তব্য দেবার থেকে অনেক বেশি সময় ব্যয় করেন সারা পৃথিবীতে ক্ষমতাবানদের সঙ্গে নিজের একটি সংযোগ গড়ে তুলতে। মাঝে মাঝেই পৃথিবীর নানান দেশের পত্র-পত্রিকার বই সমালোচনা বিভাগ বা বইয়ের খবর বিভাগে চোখ রাখলেই দেখা যায় বাঙালী আরেক নোবেল বিজয়ী অর্মত্য সেনের কোন না কোন নতুন বই বের হয়েছে। যাতে একটি নতুন চিন্তা একটি নতুন দর্শন আছে। আছে অর্থনীতির নতুন কোন পথ আবিষ্কারের চেষ্টা। এ রকম কোন খবর আমরা ড. ইউনূস সম্পর্কে পাই না। বরং সংবাদ পত্রের লোক হিসেবে মাঝে মাঝে তার একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি আমরা ছাপি যে, কোন রানীর সঙ্গে বা কোন প্রধানমন্ত্রী বা কোন বাদশার সঙ্গে তার দেখা হলো। অনেক সময় নিজেরও মনে হয়েছে এ সব ছবি ছাপতে গিয়ে, কেন তিনি এ গুলো পত্রিকায় ছাপতে পাঠান। পরে নিজের মনেই হিসেব মিলিয়েছি, তিনিও তো বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মতো সামরিক কালচারের ভিতর বড় হয়েছেন। তাই অবচেতনভাবে তার ভিতরও এই সামরিক কালচার আছে। সামরিক সরকাররা যেমন ক্ষমতাবানের সঙ্গে নিজেকে প্রদর্শন করে নিজে যে ক্ষমতাবান অবচেতনভাবে এটা প্রচার করতে চান তিনিও সেটাই চান। এ জন্য কখন তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমেছে বলে মনে হয়নি। তবে এটুকু ভেবেছি তিনিও সামরিক কালচারের বাইরে নন। আর তিনি যে সামরিক কালচারের বাইরে নন তার প্রমাণও তিনি রাখেন আধা সামরিক শাসনের সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক দল গড়তে নেমে। তবে তিনি সামরিক শাসকের অন্য পোষ্য বা দাসস্য দাসদের থেকে যে অনেক উন্নত সে প্রমাণ রাখেন দল না করার ঘোষণা দিয়ে। সাধারণত বাঙালী থামতে ভুল করে। তিনি সে ভুল করেননি।
কিন্তু তিনি তখন রাজনীতি সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছিলেন যেটা সামরিক কালচারের ব্যক্তিরাই করেন। আমাদের রাজনীতি অনেক নষ্ট হয়ে গেছে। এটাকে ঠি ক পথে আনতে হবে। তার মানে এই নয় যে, রাজনীতিকে অসম্মান করব। কারণ, মনে রাখা দরকার, এই যে ভাষা, এই যে দেশ সবই রাজনীতির ফসল। যে শহীদদের রক্তকে আমরা প্রতি মুহূর্তে শ্রদ্ধা করি ওই শহীদরা রাজনৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন। তাই রাজনীতিকে শ্রদ্ধা করতে হবে। হ্যাঁ, বাংলাদেশে রাজনীতি ক্রমান্বয়ে বিপাকে পড়ছে। রাজনীতির বিপরীতে রাজনীতির নাম নিয়ে গড়ে উঠছে সামরিক কালচারের রাজনীতি। সামরিক কালচারের এই রাজনীতি আর রাজনীতির ছদ্মাবরণে ধর্মীয় মৌলবাদ যা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের অঙ্গ। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেশের মানুষকে দেখতে হচ্ছে, ড. ইউনূস এ মুহুর্তে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে দেশ বিদেশে এমন কিছু কথা বলছেন, যা মূলত সরকারের কোন কর্মকা-ের দোষারোপ নয়, প্রকৃত বিচারে দেশের বিরোধিতা। এবং সেই বিরোধিতার দুর্ভাগ্যজনক ফল বাংলাদেশকে ভোগ করতে হচ্ছে। যা মূলত শেষ বিচারে দেশ বিরোধী প্রচার।
তবে তার থেকে আরও দুর্ভাগ্যজনক হলো, এ মূহুর্তে পত্র পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে ড. ইউনূসকে যারা সমর্থন যোগাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই জামায়াত-বিএনপি সমর্থক। এবং প্রকৃত অর্থে তারা দেশের স্বাধীনতাবিরোধী। ড. ইউনূসের পরিবারের একজন ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর কোলাবরেটর ছিলেন। স্বাধীনতার পরে চট্টগ্রামে তিনি কলাবরেটর হিসেবে গ্রেফতারও হয়েছিলেন। কিন্তু এটা তো সত্য ড. ইউনুস ১৯৭১ সালে আমেরিকাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়তে ভূমিকা রাখেন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। অথচ আজ তাকে যারা সমর্থন করছেন তারা সকলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীদের রক্ষক ও সন্ত্রাসবাদী বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক। ড. ইউনূসের সপক্ষে যারা বিবৃতি দিচ্ছেন তাদের অধিকাংশের অবস্থান এখানে।
মৌলবাদী এই সন্ত্রাসীরা ড. ইউনূসকে ঘিরে এই সুযোগ নেবার চেষ্টা করছেন। তাই বিষয়টি সম্পর্কে এ মুহূর্তেই ড. ইউনূসের সচেতন হওয়া উচিত। তার বিবৃতি দিয়ে জানানো উচিত তিনি আসলে এই জঙ্গী মৌলবাদীদের সমর্থন চান কিনা? দেশের মানুষ গত কয়েক মাস যাবত দেখতে পাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ড. ইউনূসের পক্ষে অনেকটা অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু এটা তো সত্য, বর্তমান বিশ্বে আমেরিকাই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাই ইতোমধ্যে যদি ড. ইউনূস বিবৃতি দিয়ে তাঁর অবস্থান পরিষ্কার না করেন তা হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও ভেবে দেখতে হবে, তারা যদি বাংলাদেশে ড. ইউনূসের সমর্থন করে তাহলে এ দেশটিতে মৌলবাদীদের অবস্থান কি দাঁড়াবে? মৌলবাদীরা যদি ড. ইউনূসকে ঘিরে আবার সংগঠিত হবার সুযোগ পায় তাহলে দেশটির অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এবং বিশ্ব রাজনীতির জন্য সেটা কতটা ক্ষতিকর হবে?
বিএনপি-জামায়াত বলেছে তারা ক্ষমতায় গেলে ড. ইউনূসকে সম্মানিত করবে। কিন্তু তখন কোন বাংলাদেশে ড. ইউনূস সম্মানিত হবেন এ বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভেবে দেখতে হবে। বিএনপি জামায়াত যখন ক্ষমতায় ছিল তখন এখানে লাদেনের সেকেন্ড ইন কমান্ড অবস্থান করে গেছে। বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বাংলাদেশে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহায়তায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীদের জন্য অস্ত্র চোরাচালানের ব্যবস্থা হয়েছে। এছাড়া আইনের শাসন ও গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে তালেবানী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপি জামায়াতের প্রশাসনের সহায়তায় ১ ঘণ্টায় ৫২৭ স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয় বাংলাদেশে। পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসে কম সময়ে সব থেকে বেশি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা। এখানেই শেষ নয়, আধুনিক পশ্চিমা বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে তথাকথিত তালেবানী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপি-জামায়াত সরকারের সহায়তায় জঙ্গীরা আদালতে বোমা মেরে বিচারক হত্যা করেছে। এমনকি জঙ্গীরা ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরীর ওপরেও গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে তখন। এর থেকে নিশ্চয়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে স্পষ্ট হবে যে, বিএনপি-জামায়াত কোন বাংলাদেশে ড. ইউনূসকে সম্মানিত করবে? সেটা কি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ না তালেবানী বাংলা!
swadeshroy@gmail.com
No comments