নীল পাথরের বিষ by আব্দুল মান্নান সরকার
নীল পাথর বসানো সোনার আংটি! পাথরটি যেন সত্যই রহস্যময় আলো বিচ্ছুরিত করছে। সুন্দরী নারীর ওষ্ঠে ফুটে ওঠা একটুখানি হাসির আভা! সে হাসি কুটিল না প্রীতির বোঝা মুশকিল। আখতার আলম সাহেব আংটিটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেন, চোখ দুটো টেনে সরাতে পারেন না। চোখ সরে না রাহেলারও। ‘নাও আংটিটি পর’।
আচ্ছা আমিই পরিয়ে দেই। রাহেলার ডান হাত টেনে নেন আখতার সাহেব। আংটিসহ হাত খানা তুলে ধরেন চোখের সামনে। আলতো করে চুমু খান হাতে। অনেক আগেই সহজ হয়েছিল রাহেলা। এখন এসব তার ভালই লাগে। আখতার সাহেবের দিকে তাকিয়ে সে রহস্যময় হাসি হাসে। নীলার রহস্যময় হাসি। আখতার সাহেব মুগ্ধ হন, আর একটু কাছে টেনে নেন রাহেলাকে। দূর থেকে ছুটে আসা ক্লান্ত ঢেউ ভেঙে পড়ে সশব্দে, আর তা দীর্ঘশ্বাসের মতো শোনায়। জল আর বাতাসের ঝাপটা চোখে মুখে শীতল পরশ বুলিয়ে দেয়। পা ভিজিয়ে হাঁটে দু’জন, আর ভেজা বালুর সোহাগ নিতে নিতে বালিতে ডুবে থাকা রঙিন ঝিনুক খোঁজে। চারদিকে কত পদ ছাপ আর আঁকিবুঁকি। সমুদ্রের মতো বৃহতের সংস্পর্শে এসে মানুষ নিজের ক্ষুদ্রত্বকে অনুভব করতে পারে, আর হয়ত এ কারণে নিজের একটুখানি স্বাক্ষর এঁকে দিতে চায়; মুছে যাবে জেনেও করে তা। কিন্তু এই এক মুহূর্তের আকুতিই কি আর কম কিছু! দুটি কিশোরী ঝিনুকের মালা নিয়ে এগিয়ে আসে।
‘তুমি নেবে?’
রাহেলাকে জিজ্ঞেস করে আখতার সাহেব। রাহেলা এক-দুটো নেয়। কি মনে করে আখতার সাহেব সব কটাই কিনে ফেলে। রাহেলাকে রঙবেরঙের ঝিনুকের মালায় সাজালে এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের সৃষ্টি হবে। আদিম কালের কোন নারী। আফ্রিকান অনেক উপজাতির মধ্যে তিনি নারীদের এমন সজ্জায় দেখেছেন। রাহেলাকে নিয়ে কক্সবাজারে এই প্রথম এসেছেন আখতার সাহেব। তবে নিজে তিনি বহুবার এসেছেন, আর তা সস্ত্রীক। বিয়ের প্রথম দিকে জীবনের সেই উচ্ছল দিনগুলোতে দু’হাতে আনন্দ লুটে নিতে ইচ্ছে হতো। স্ত্রী হাসনা বানুকে নিয়ে কত জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, চাকরির সুবাদে বিদেশেও গেছেন, থেকেছেন তারকাখচিত সব হোটেলে আর রিসোর্টগুলোতে। সূর্যস্নান, জলকেলিÑ কত কিছু করেছেন বিদেশীদের মতো। শুধু ব্রা-বা বিকিনি পরে একপাল বিদেশীর চোখের সামনে সি বিচে চোখ বুজে শুয়ে থাকা, কি হোটেলের সুইমিং পুলে সাতার কাটতে হাসনা বানুর রুচিতে বাধতো। বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, তার সংস্কার কি আর সহজে যায়! সে যতই না উচ্চ শিক্ষিত হোক, তাদের আদর্শ তো সেই অশিক্ষিত মা-দাদিরাই। আখতার সাহেব অনুযোগ করেছেন, রাগ করেছেন, না-স্ত্রীর মনোভাব পাল্টানো যায়নি। পাপ! কিসের পাপ! আদম-হাওয়া বেহেশতে উদোম ছিলেন, উদোম! বুঝলে’Ñ এ সব কথা বলেও কোন কাজ হয়নি।
শেষে বিরক্ত হয়ে বলেছেন, ‘তোমাকে নিয়ে আর কোথাও আসব না।’ হাসনা বানু আসতেও চাননি আর, সংসার করেছেন, সন্তানের জনম দিয়েছেন, তাদের প্রতিপালন করেছেন, আর এ সবেই ছিল তার আনন্দ। আখতার সাহেবের স্বপ্নের জগত ফিকে আর বিবর্ণই থেকে গেছে। তাঁর চোখের তিয়াস মেটেনি, মেটেনি দেহ-মনের তৃষ্ণাও। আজ এই ষাটোর্র্ধ্ব বয়সে, রূপতৃষ্ণা আর দেহ-মনের অতৃপ্তি তাঁকে এতটাই বিক্ষুব্ধ আর বুভুক্ষু করে তুলেছে যে, এর বিনিময়ে আত্মা বিক্রি করতেও রাজি আছেন তিনি। আর তাই লুপ্ত যৌবন ফেরাবার তাগাদা থেকে, নানা উত্তেজক জিনিস সংগ্রহ করেন। না, তাঁকে কষ্ট করে এসব জিনিস সংগ্রহ করতে হয় না; এক সময়ের ডাকসাইটে আমলা তিনি, কতজন এসব নিজে থেকে দিয়ে যায়। আর রাজার কোন অপরাধ নেই এ কথা তিনি ভালই জানেন। ড্রেসিং টেবিলের সামনে অনেক সময় নিয়ে সাজে রাহেলা, নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখে, দেখে মুগ্ধ হয়। হাসনা বানু এতটা বয়সেও নানাভাবে সাজে দামি শাড়ি, জড়োয়া গহনা পরে, ভালই লাগে; কিন্তু প্রসাধন মেখে কি আর বয়স ঢাকা যায়! একরাশ বেলিফুল পড়ে আছে, আখতার সাহেব কোথা থেকে যেন এসেছেন। রাহেলা ফুলগুলো খোঁপায় জড়িয়ে নেয়। নীল রঙের শাড়ি ব্লাউজ, সায়া ম্যাচ করে পরে। ঠোঁটে, চোখের পাতায় আলতো করে লাগায় নীলরঙ! আবার আয়নায় নিজেকে দেখে। যেন সমুদ্র আছড়ে পড়েছে তার সর্বাঙ্গে। ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে, ‘আখতার খালু দেখে মুগ্ধ হবে।’ নিজের ভাবনায় চমকে ওঠে রাহেলা। এসব কি ভাবছে সে, কিন্তু আর কি সম্বোধন করা যেতে পারে বহু ভেবেও তা স্থির করতে পেরে না উঠলে, সর্বাঙ্গে বৃশ্চিকের জ্বালা কি উত্তাপ পেতে থাকে। কিন্তু পর মুহূর্তে নিজের ওপর ফুঁসে ওঠে, সে নারী, এক রূপমুগ্ধ পুরুষ তাকে আবিষ্কার করেছে; তাকে সে তৃপ্ত করবে। তাদের সম্পর্ক নারী-পুরুষের সম্পর্ক। সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে স্নিগ্ধ নীল আলো। রাহেলা দাঁড়িয়ে আছে, যেন সমুদ্রের নীল জল ঠেলে উঠে এসেছে ভেনাস! আখতার সাহেব অপলক চোখে তাকিয়ে থাকেন। দেখে বুঝি আশ মেটে না।
‘হ্যাঁ, তুমি আমার ভেনাস!’
বত্তি চেলির নগ্ন ভেনাস! না, সে তো কেবল ছবি, কল্পনামাত্র। আমি ভেনাসকে জীবন্ত দেখতে চাই। এক এক করে সব কিছু খসে পড়ে রাহেলার শরীর থেকে; আখতার সাহেব তখন স্বর্গের সেই অনাস্বাদিত ফলের জন্য কাতর হয়ে উঠেছেন। স্বর্গ উদ্যানের সেই প্রথম সীমা লঙ্ঘনকারীর ব্যথা কি আনন্দ নিজ অন্তরে অনুভব করতে পারেন বিমুগ্ধতায়।
সন্ধ্যা উতরে গেছে অনেক আগেই। বাইরে অন্ধকার তখন জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছিল। অন্ধকারে চোখ মেলে দিয়ে বসে আছে রাহেলা, আর তখন তার আর একবার ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল ‘মাতৃজঠরে! ঝোপঝাড়গুলো দেখে মনে হয়, কালো লোমশ কোন জন্ত অদ্ভুত ঠা-া চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে; কিন্তু রাহেলা কাঁপে না। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যত! ভীতি আর উৎকণ্ঠায় কণ্ঠনালী শুকিয়ে আসতে চায়; বার বার ঢোক গেলে; অস্থির হাতে পানির বোতলের মুখ খুলে দীর্ঘ চুমুকে নিঃশেষ করে বোতলটি। একটুখানি সুস্থির হয়।
নাইট কোচটি শাঁ-শাঁ করে এগিয়ে চলেছে। পাছে যাত্রীদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে এ জন্য ড্রাইভার মাথার ওপরকার উজ্জ্বল আলোটি নিভিয়ে দেন। সাইডের ডিম লাইটটি জ্বালিয়ে দিলে গাড়ির ভেতর অপূর্ব স্নিগ্ধ নীল আলো ছড়িয়ে পড়ে। আর তখন কেঁপে ওঠে রাহেলা। তার রক্ত হিম হয়ে আসে। সমুদ্র গর্জন, শিশিরপাতের শব্দ-গন্ধ তাকে বুঝি পাগল করে দেয়।
পিঠে তপ্ত নিঃশ্বাস অনুভব করে, আর তা জ্বালাকর মনে হয়। রাহেলার কান্না পায় কিন্তু কাঁদতে পারে না।
স্বপ্নের এই শহর ছেড়ে আজ তাকে পালিয়ে যেতে হচ্ছে। অথচ এই শহরে একদিন সে এসেছিল কত না স্বপ্ন নিয়ে। আসা-যাওয়ার দিন দুটোর কতই না তফাত! এ শহরে যেদিন সে প্রথম আসে সেদিন তার হাতে ছিল মেহেদির রঙ। আর আজ যখন সে শহর ছেড়ে যাচ্ছে তখন তার সেই হাত দুটোই খুনের রক্তে রঞ্জিত।
রাহেলা চমকে উঠে হাতের দিকে তাকায়। হাত দুটো ধোয়া-মোছা, পরিষ্কার। সে আশ্বস্ত হয়। কিন্তু পরমুহূর্তে আর কিছু ভেবে বিচলিত হয়। কাল পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হবে; জোড়া খুনের আসামি-পুলিশ তাকে খুঁজবে; কে জানে আজকেই তারা খুঁজতে শুরু করেছে কিনা! বাড়ি যাওয়া নিরাপদ হবে না, গ্রামের বাড়িতেই প্রথম খোঁজ করবে পুলিশ। আর জানাজানি হলে গ্রামের লোকজন তাকে কোন চোখে দেখবে। বলবে, ‘ওই যে রহিম বখশের মাইয়া জোড়া খুন কইরা আইছে।’
যমুনার চরে দূর সম্পর্কের এক বোন আছে এখন তার বাড়িতেই আত্মগোপন করে থাকতে হবে। তবে দীর্ঘকাল আত্মগোপন করে কি আর থাকা যাবে? এ কি রুল করল সে। আর তখন দৈবের আশ্রয় নিয়ে আশ্বস্ত হতে চায়। পুলিশ তাকে সন্দেহ নাও করতে পারে। রক্ত মাখা মেঝে, জামা-কাপড় সব কিছু পরিষ্কার করে এসেছে, এমনকি খুনের জন্য ব্যবহার করা সেই বঁটিটি পর্যন্ত। খোদাকে স্মরণ করে, তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চায়।
বাসা থেকে বের হবার সময় বুড়ো দারোয়ান তাকে দেখেছে, তবে সে কোন সন্দেহ করে নাই, করলে তার হাতের পোটলা খুলে দেখত। একটু শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কই যাও।’
সে কথার উত্তরে রাহেলা হেসে জানিয়ে ছিল, ‘বুনের বাড়ি বেড়াইতে যাইতাছি।’
এখন মনে হচ্ছে এটা বলাটাও ভুল হয়ে গেছে। পুলিশের কাছে দারোয়ান কথাটা বলবে।
মাথা ঠিক রেখে এখন একটু ভাবার চেষ্টা করে রাহেলা। খুন দুটো না করলে তাকে পালাতে হতো না, আর তার নিরাপত্তা বিঘিœত হতো না। পালিয়ে যে শেষ রক্ষা হবে না তাও বুঝতে পারে না। কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছিল তার। মায়ের কথাই মনে পড়ছিল বার বার। ডেইজি, আহা! কী প্রাণবন্তুই না ছিল সে। হাসনা বানুর একমাত্র মেয়ে, মায়ের মতোই ছিল দেখতে, সুশ্রী আর মিষ্টি; চেহারার আর তার ভেতরটা? বড় লোকের মেয়ে, গরীব মানুষদের সে মানুষই মনে করত না। ছেলে বন্ধুদের নিয়ে বাড়িতে পার্টি দিত, নেশা করত, কত রকমের নেশার জিনিস তাকে খেতে দেখেছে। বিদেশী ব্যান্ডের তালে তালে নাচত আর এক সময় শরীর থেকে একে একে খসে পড়ত সব, দেখে মনে হতো বুঝি পাতা ঝরা শীতার্ত বৃক্ষ! ডেইজিকে এ দেশের মানুষ বলেই কখনও মনে হয়নি রাহেলার। আর শুধু ডেইজি একাই তো নয়, এমন অনেককে সে দেখছে এবং পরে এসব দোষের কিছুও বলে মনে হয়নি। চুলোয় যাক ডেইজির ভাবনা। নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে ওঠে রাহেলা। কেন সে খুন করতে গেল তাকে! আর খুন করা কি সত্যই আবশ্যক কিছু ছিল? হঠাৎ উত্তেজনা বশে সে খুনটা করে, যা সে না করলেও পারত; তবে এও ঠিক ডেইজির ওপর আক্রোশ ছিল তার; আক্রোশ ছিল হাসনা বানুরও ওপর; আর প্রকৃত খুনটা সে করতে চেয়েছিল তাকেই। দিনের পর দিন কি নির্মম অত্যাচারই না করেছে মা-মেয়ে তার ওপর! উঠতে বসতে শুনতে হয়েছে গঞ্জনা, আর এ জন্য অনেক সময় মাথা বিগড়ে যেত তার। হাসনা বানুকে খালা ডাকত রাহেলা, আর সে সম্বোধনও ঠিক করে দিয়েছিল হাসনা বানু নিজেই। খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল সে! কিন্তু দুটো খেয়ে পরে বাঁচাই যে সব নয়, এ কথা সে বুঝতে পেরেছিল, আর তা তাকে শিখিয়েছিল এই শহর। আলো ঝলমল এ শহর; চারদিকে এত আলো, সেই বা তবে কেন আঁধার পড়ে থাকবে।
কতটা কতটা অত্যাচার করা হয়েছিল তার ওপর। কতবার তাকে ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছিল; তবে দেহের সে ক্ষত মিলিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মনের ক্ষত শুকায়নি।
হাসনা বানু প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করত তাকে, যদিও তার বোঝা উচিত ছিল, একজন কাজের মেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষমতা রাখে না; আর যদি তাই হয় তবে সে সুযোগটাও করে দিয়েছিল সে নিজেই। নিজের স্বামীকে কোনদিন বোঝার চেষ্টা করেনি হাসনা বানু, একটি গ-ীর মধ্যেই বাস করে গেল সারা জীবন। অত্যন্ত ছক বাঁধা সে জীবন; কলেজে পড়িয়েছে, অবসরে সাজ-সজ্জা করেছে। হাসনা বানু সাজতে বড় ভালবাসত, নিমন্ত্রণ রক্ষা আর পার্টিতে যেত বেশ ঘটা করে সেজে। কিন্তু স্বামীর জন্য তাকে কখনো সাজতে দেখেনি রাহেলা। কত সময় তাকে করুণা করতে ইচ্ছে হয়েছে। এতটা সাহস সে পেয়েছিল কোথা থেকে, এখন সে কথা ভেবে অবাক হয় রাহেলা। কিন্তু সে তো ছিল একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত নারী! তাকে সবাই শুধু অপমান করেছে। আর তার নারিত্বের অপমান! রাহেলার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, তোমাদের মতো এই ভাল মানুষগুলোকে আমি চিনি; হ্যাঁ আমি চিনেছি। কিন্তু আমার কথা তো কেউ শুনবে না। সমাজ তাকে দোষী সাব্যস্ত করবে। তার দোষটাই চোখে পড়বে সবার।
বাসা থেকে এক কাপড়ে বের হতে চেয়েছিল, আর তখন মনে হয়েছিল ভবিষ্যতের চিন্তা। বাঁচতে হলে টাকা পয়সার দরকার হবে।
এতটা মনের জোর থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় বেরিয়ে মনে হয়েছিল, গোটা শহরের লোকজন বুঝি জেনে গেছে সে জোড়াখুন করে এসেছে। পুলিশের গাড়ি দেখলেই বুকে কাঁপন ধরে যেত, গলা শুকিয়ে আসত। মাত্র ঘণ্টা দুয়ের ব্যবধানে দুটো খুন। এতটা মনের জোর কিভাবে পেল সে। কেন রাগ সামাল দিতে পারে নাই?
নিজের ওপর রাগে, দুঃখে মাথা কুটতে ইচ্ছে করে রাহেলার। খুনের যৌক্তিকতা নিয়ে নানা কিছু ভাবে, হাসনা বানুকে খুন করতে হয়েছিল নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে। না হলে সে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিত। হাসনা বানু তখন কলেজ থেকে ফিরেছিল, প্রতিদিনের দুপুরের খাবার মা-মেয়ে এক সাথে খেত। হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং রুমের দিকে যেতে যেতে রাহেলাকে সে টেবিলে ভাত দিতে বলে। তারপর মেয়ের খোঁজ নেয়। মেয়ের সাড়া শব্দ না পেয়ে বেশ কয়েকবার নাম ধরে ডাকে। আর এ সময় তার নজর যায় মেঝের ওপর। কী দেখেছিল মেঝেতে কে জানে? চিৎকার করে উঠেছিল, রাক্ষুসী! তুই আমার ডেইজিকে খুন করেছিস?’
তেড়ে এসেছিল, তোকে আমি ছাড়বো না। খুন করব তোকে। পুলিশে দেব।’
উত্তেজিত হয়ে হাসনা বানু শোবার ঘরের দিকে ছুটে যাচ্ছিল তখন, রাহেলার বুঝতে বাকি থাকেনি, হাসনা খালা টেলিফোন করতে যাচ্ছে। আর এক মুহূর্তও নষ্ট করা যাবে না, রাহেলা কিচেন থেকে বঁটি-দা খানা নিয়ে এসেছিল, আর হাসনা বানু কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ঘাড়ের পেছনে কোপ বসিয়ে দিয়েছিল। হাসনা বানু ভয়ে, বিস্ময়ে অদ্ভুত চোখে তাকিয়েছিল, একবার প্রতিরোধের চেষ্টাও করেছিল। রাহেলা তুই!’ মাত্র এই একটি কথাই উচ্চারণ করতে পেরেছিল সে। হাসনা বানুকে এলোপাতাড়ি কুপিয়েছিল রাহেলা। দ্রুত কাজ শেষ করতে চেয়েছিল সে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। জবাই করা পশুর মতো হাসনা বানু গোঙাচ্ছিল তখন। কিছুটা বিচলিত হয়েছিল রাহেলা। পর মুহূর্তে সামলে নিয়েছিল নিজেকে। ঠা-া মাথায় করেছিল সব, মেঝে ধুয়ে-মুছে সাফ করেছিল, রক্তাক্ত জামা কাপড় পরিষ্কার করেছিল। লাশ দুটো খাটের নিচে লুকিয়ে ফেলেছিল। অনেক সময় নিয়ে গোসল করেছিল। তারপর নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিল। বাসায় সে ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউ নেই। আহসান ভাই ফিরবে অনেক রাত করে।
আহসান আখতার হাসনা বানুর একমাত্র ছেলে। মা-বোনকে দেখতে না পেয়ে অবাক হয়ে খোঁজাখুঁজি করবে। আর মা-বোনের লাশ দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়বে।
প্রথমে হয়ত চিটাগাংয়ে বাবার কাছে ফোন করবে। ছেলের ফোন পেয়ে, মেয়ে-বউয়ের মৃত্যুর সে সংবাদ শুনে কেমন অবস্থা হবে আখতার খালুর? শোকে-দুঃখে পাগল হয়ে যাবে? তাই তো হওয়া উচিত! অথচ রাহেলা তো জানে, স্বামী হিসেবে কতটা অবিশ্বাসী মানুষটা। কত সময় স্ত্রীর মৃত্যু কামনা করেছে।
এ কথা ঠিক, রাহেলার ওপর সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। পুলিশকে কি বলবে না, রাহেলা খারাপ চরিত্রের মেয়ে মানুষ। আর এমন একজন স্ত্রী লোকের পক্ষে খুন-ডাকাতি কত কিছু করা সম্ভব। আখতার খালু কি তাকে ঘৃণা করবে? তাও করবে নিশ্চয়! কথাটা ভেবে হাসি পায় রাহেলার। ঘৃণা করে কত কিছু শোনাবে লোকজনকে, সমাজকে।
একবারও কি তার কথা ভেবে বিচলিত হবে, দুঃখ করবে আখতার খালু? না, করবে না। সে তো কেবল তার শরীরটাই চেয়েছিল আর কিছু তো চায়নি। আর সেও তো শুধু শরীরই দিয়েছিল, তাও নিজের ইচ্ছায় নয়, একটুখানি স্বচ্ছলতার আশায়।
পাশের সিটের মহিলা ঘুমন্ত বাচ্চাকে খাবার জন্য পীড়াপীড়ি করছে। তখনও ঘুমের রেশ কাটেনি বলে শিশুটি বার বার ঢুলে ঢুলে পড়ছে। সারারাত না খেয়ে কষ্ট পাবে ছেলে, এ জন্যই মায়ের এত সাধাসাধি। শৈশবের কথা মনে পড়ে; হাট থেকে ফিরতে বাপের রাত হয়ে যেত, আর বাপের অপেক্ষায় থেকে তারা ভাই-বোন দুটি ঘুমিয়ে পড়ত। মা-তখন এভাবেই তাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে খাওয়াতো। মেয়ে খুন করে এসেছে এখন একথা শুনে তার বাপ-মায়ের অবস্থা কেমন হবে। তারাও কি ঘৃণা করবে তাকে। বাপ যে তাকে ঘৃণা করবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। মেয়ে এত বেশি টাকা কি করে পায়, কি ভাবে দেয় এ নিয়ে বাপ তাকে সন্দেহ করত। অনেক সময় প্রতিবাদ করে বলেছে, ‘এইডা তর পাপের কামাই! তর পাপের কামাই খাইয়া দোযখে যাবার কস!’
বাপের কথা শুনে দুঃখ পেয়েছে, নিজেকে হীন আর ছোট মনেও হয়েছে। কিন্তু পর মুহূর্তে মনে মনে জ্বলে উঠেছে। ‘পাপের কামাই! সারা জীবন পুণ্য করে তুমি কি পাইছো?’ না সে কথা বাপকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি। মা-ভাই তার অর্থ-কড়ি গ্রহণ করেছে অম্লান বদনে। লোভে দু’চোখ তাদের চকচক করে উঠতে দেখেছে। চিরকাল মানুষের অবহেলা আর ঘৃণা কুড়িয়ে বাঁচা, এই বাঁচা কি বাঁচা গো! মা-ভাইয়ের আর দোষ কি! কিন্তু এখন তাকে সেই মা-ভাই তাকে কোন চোখে দেখবে কে জানে! রাহেলার মনে হয়, এ মুহূর্তেই সে ছুটে গিয়ে তাদের মনোভাব জেনে আসে।
সারাদিন কিছু মুখে দেওয়া হয়নি, এখন বেশ ক্ষুধা পাচ্ছে। বাসে ওঠার আগে রুটি-কলা কিনেছিল, ব্যাগ থেকে রুটি কলা বের করে রাহেলা। একবার একটুখানি ছিঁড়ে মুখে দেয়, তারপর ছুড়ে ফেরে দিয়ে ঢকঢক করে পানি খায়।
বাবুকে দিয়ে তাকে খুন করাতে চেয়েছিল হাসনা বানু; আর সে চক্রান্তটি ছিল ডেইজির। বাবুকে সেই বলেছিল, ‘বাবু আমার অনুরোধ তোমাকে আমার একটি কাজ করে দিতে হবে। রাহেলা এই নষ্টা মেয়ে মানুষটাকে যে কোন উপায়ে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। আমাদের ফ্যামিলির প্রেস্টিজের কথা ভেবেই তা করতে হবে। ও-আমার ড্যাডকে নষ্ট করেছে।
আর এ জন্য যা চাও তা পাবে।
বলে বড় অর্থপূর্ণ হাসি হেসেছিল ডেইজি। কথাটা স্পষ্টই শুনতে পেরেছিল রাহেলা। সে তখন বাবুর জন্য চা নিয়ে ফিরছিল। বাবু ডেইজির গালে টোকা দিয়ে বলেছিল, ‘তোমাকে পেলে এ আর আমার জন্য কঠিন কাজ কি!’
ধনী শিল্পপতির সন্তান বাবু, তার ওপর রাজনীতি করে। সত্যই তো তার কাছে অসাধ্য বলে কি কিছু আছে। ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাহেলা। হাত থেকে কাপপিরিচ পড়ে ভেঙে যায়, আর তাতে আরও ক্ষিপ্ত হয় দু’জন। বাবু তাকে লাথি-গুঁতো মারে, বেদম প্রহার করে, আর সিগারেটের আগুন দিয়ে শরীরের নানা স্থানে ক্ষত সৃষ্টি করে। এতটা করেও সে শান্ত হয়নি, ডেইজির সামনে তাকে উলঙ্গ করে তার নিম্নাঙ্গেও ক্ষতি করে। আর উল্লাসে ফেটে পড়ে ডেইজি; হ্যাঁ ওটাই কর; ওটাই তো ওর নষ্টামির মূলধন।
আর সে মুহূর্তে দেহের যন্ত্রণার চাইতে মনের যন্ত্রণাই হয়েছিল বেশি। রাহেলা বুঝি পাগল হয়ে উঠেছিল। ‘নষ্টা, কুলটাÑশব্দগুলো বড় অস্থির করে তুলেছিল তাকে। বাবু বেরিয়ে যেতেই পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিল কিচেনে। বঁটি-দা খানাই নজরে এসেছিল প্রথমে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডেইজির ওপর চড়াও হয়েছিল সে। কোপ দিয়েছিল ঘাড়ে, পেটে। পেট চিড়ে নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে পড়ে। আর ফিনকি দিয়ে ছোটে রক্ত। একবার একটুখানি হাতও কাঁপেনি তার। এখন এ কথা ভেবে সে অবাক হয়, এতটা সাহস সে কিভাবে পেয়েছিল!
সাথে করে আনা কাপড়ের পোটলাটি কোলের ওপর থেকে নামিয়ে পায়ের কাছে রাখে, আবার কি মনে করে সেটা কোলের ওপর তুলে আনে। পোটলাটায় কম কিছু নাই, নগদ লক্ষাধিক টাকা ছাড়াও, হাসনা বানুর সব গহনা আর কয়েকটি দামি শাড়ি আছে। পোটলাটা কেউ হাতিয়ে দেখলেই সে ধরা পড়ে যাবে। এখন কে আর তা দেখতে আসছে। পাশের মহিলাটি অকাতরে ঘুমুচ্ছে, সে দিকে তাকিয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় রাহেলা। এসব সে এনেছে কার জন্য? ভাইকে দিবে! না, নিজের জন্যই লাগবে। ধরা না পড়লে, সে একটুখানি জমি কিনে বাড়ি করবে। ছোটখাটো একটা দোকানও দিবে। আবার নতুন করে তো সংসারও পেতে পারে সে। জমি-বাড়ি, দোকানÑএত কিছু পেলে কতজন তাকে বিয়ে করতে রাজি হবে। আর তার সেই স্বামী যে তাকে বিনা দোষ তালাক দিয়েছিল, সেও তাকে নিতে চাইবে এখন। ভবিষ্যতের একটুখানি সুখের ছবি আঁকতে চাইলেও, তা স্থায়ী হয় না। দূর সম্পর্কের যে বোনের বাড়িতে সে আশ্রয় নিতে যাচ্ছে সেখানে সে কতটা নিরাপদ? বোন-বোনের জামাই টাকা-আর অলংকারের লোভেই ধরিয়ে দিবে তাকে।
হাসনা বানুর সাড়ে তিন ভরি ওজনের সোনার হারটি গলায় শৃঙ্খলের মতো চেপে বসে রাহেলার। এক সময় ওটা পাবার জন্য কত না লোভ হতো তার! ক্ষুধার্ত ককুরের মতো তাকিয়ে থাকত, হাসনা বানু যখন ওটা পরে সাজতে বসত। হারটি বড় প্রিয় ছিল হাসনা খালার! নিজের অজান্তেই ছোট একটা শ্বাস ফেলে রাহেলা। তারপর সিদ্ধান্ত পাল্টায় আগে বাড়িতেই যাবে, মা-ভাইয়ের কাছে জিনিসগুলো রেখে তারপর অন্য কোথাও যাবে। রাতারাতি নিশ্চিয় পুলিশ তাকে খুঁজবে না।
পাশের মহিলাটি কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। সুখ আর পরিতৃপ্তির ছোঁয়া তার সর্ব অবয়বে। কেমন সাধারণ একখানা শাড়ি পরেছে, গলায় সরু একখানা চেন, কানের মটর দানা দুটোও ছোট। বোঝাই যায়, ধনী পরিবারের কেউ নয়। হয়ত স্বামী ছোটখাটো কোন ব্যবসা বা চাকরি করে তারপরও মেয়েটা যে সুখী তা বোঝা যায়। তার জীবনও কি আর অমন কিছু হতে পারত না! তার জন্মের জন্য কে দায়ী? তার বাপ! না-তার অদৃষ্ট! খোদাতালা! গরীব বাপের ঘরে দু-সন্ধ্যা পেট পুরে খেতে পারেনি, অর্থলোভী স্বামী যৌতুকের জন্য কত অত্যাচার করেছে তার ওপর। আর তার নারিত্বের চরম অবমাননা করেছে আখতার খালু, আর যে কিনা এ দেশের সমাজের সব থেকে সম্মানিত মানুষদের একজন। সরকারের বড় চাকুরে, ধনী, শহরের অভিজাত মানুষ। আর তো সেই শুধু নয়, তার ছেলে, হ্যাঁ একমাত্র ছেলে। উচ্চশিক্ষিত, ইঞ্জিনিয়ার বড় চাকুরে।
পিতা-পুত্র একই দেহে পরিতৃপ্ত হতে চেয়েছে। পিতা-পুত্রকে এক সাথে গ্রহণ করতে মনের সায় পায়নি রাহেলা, সে বাধা দিয়েছে, আর ক্ষেপে উঠেছে আহসান।
কী কারণ?
রাহেলা নিশ্চুপ থেকেছে; কী বলবে সে, যে কথা বলার মতো নয়।
‘পুতের মতো! না-কথাটা মুখ ফুটে বলা যায়নি, অথচ বুক ফেটে গেছে তার।
‘ও, বুঝেছি বাবা তোমার কাছে আসে এ জন্য! তুমি তো একটা বেশ্যা! তোমার আবার বাপ-ছেলে কি!’ লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছে তখন। কিন্তু পর মুহূর্তে জেদ চেপে বসেছে; হ্যাঁ, বেশ্যাই যখন তখন বাপ-ছেলে দু’জনকেই সে মজিয়ে ছাড়বে।
রাহেলার প্রতি স্বামী-পুত্রের এই অবৈধ আসক্তির কথা হাসনা বানুর অজানা ছিল না। অনেক সময় রিডিং রুমে রাত কাটাতেন আখতার সাহেব। আর গভীর রাতে সে রুমে রাহেলার উপস্থিতি দেখে হয়ত অবাক হতো, কষ্ট হতো, আর ঘৃণাও করত নিশ্চয়; কিন্তু তারপরেও স্বামীকে সে কিছু বলত না, একটুখানি তিরস্কারও নয়। অথচ এ জন্য রাহেলাকেই এককভাবে দায়ী করত সে। এবং অত্যাচারও। পুরুষের তৃষ্ণার্ত শরীর মন যে পড়তে জানে না, সে আবার কেমন মেয়ে মানুষ! হাসনা বানুকে মনে মনে বিদ্রƒপ করেছে রাহেলা। সে কেন ফিরিয়ে দিবে, একজন সক্ষম নারী হয়ে ফিরিয়ে দেওয়াই হতো তার ব্যর্থতা! লোভ আর স্বার্থপরতা তাকে এগিয়ে দিয়েছিল আরও বেশি করে। ভাইকে একটা দোকান করে দেওয়া, বাপ-মায়ের মাথা গোঁজার ভাল একটু ব্যবস্থা করা এই তো চেয়েছিল সে। না, এর থেকে বেশি কিছু সে চায়নি। হাসনা বানু তাকে হিংসে করতে শুরু করেছিল, তাহলে সে কি তাকে প্রতিপক্ষ বলে ভাবত। আখতার সাহেবের কাছে স্ত্রীর কোন প্রয়োজনীয়তা আর ছিল না, আর এই সুযোগটাই নিয়েছিল রাহেলা। মা-আর ভাইয়েকে সে মুঠো ভরেই দিতে পেরেছিল। কিন্তু খুন করে এসেছে শুনে যদি তারা আশ্রয় না দেয়! এখন সব কিছুই ভুল মনে হয় রাহেলার কার জন্য কি করেছে সে! আর কেনই বা করেছিল। যে গ্রামে যে সমাজে জন্ম তার, সেখানে মেয়েরা বড় হয় অবহেলায়; আর একটু বয়সে হলেই বাপ মা বিয়ে দিয়ে বিদেয় করে। তারপর একগাদা সন্তান-সন্তুতি প্রতি পালন করতে করতেই বুড়িয়ে যেতে হয়। কোন সুখ নেই, আহ্লাদ নেই, বড় বিবর্ণ, পানসে জীবন! আর কী এক বেপরোয়া জীনকেই না চিনেছিল শহরে এসে। এরা যে শুধু বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায়, তা নয়, নিজেরাও চলে ওভাবেই। একদিন ডেইজি তার জন্মদাগ দেখতে চেয়েছিল। লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারে রাহেলা, সে কথা শুনে। আর তাকে অবাক করে দিয়ে, তার সামনে উদোম হয়েছিল ডেইজি। ‘দেখো এই আমার জন্ম দাগ’।
তারপর রাহেলার মুখ তুলে ধরে বলেছিল, ‘এত কি লজ্জা তোর। মেয়ে মানুষের সামনে মেয়ে মানুষের কাপড় খুলতে আবার লজ্জা কিরে!’
তোর তো বিয়ে হয়েছিল, একজন পুরুষের সামনে তুই কাপড় খুলিস নাই?
সেদিন ডেইজিকে তার পাগল মনে হয়েছিল। বড় লোকের মেয়ের পাগলামি!
অল্প দিনেই বুঝতে পেরেছিল, ডেইজি মাদকাসক্ত, আর যৌন বিকারগ্রস্ত। কী সব ট্যাবলেট খেয়ে নেশা করত সে। পার্টির নামে বন্ধুদের নিয়ে মদ-মাংসের আড্ডা বসত, আর তা পরিণত হতো বেলেল্লাপনায়। প্রতিরাতে মাতাল হয়ে ফিরত আহসান ভাই। তাই মনে কী যেন এক কষ্ট ছিল। মা-বোনকে সে সহ্য করতে পারত না। ছেলের আচরণে ক্ষুব্ধ ছিল হাসনা বানু। ফলে আহসান ভাইয়ের জন্য ভাত-তরকারি বেড়ে বসে থাকতে হতো রাহেলার নিজেকেই। তার জন্য ভাত-তরকারি গরম করে দেওয়া, বালিশ-বিছানা ঠিক করে দেওয়া সব কিছু করতে হতো তাকে। কোন কোন রাতে বেশি করে বেসামাল হয়ে ফিরলে, তাকে সামলাতে হাতে। আর এভাবেই আহসানের সাথে জড়িয়ে যায় সে। বেহুঁস অবস্থায় কত সময় কাছে টানার চেষ্টা করেছে। আহসান; কিন্তু নিজেকে সঁপে দিতে মনের সায় পায়নি রাহেলা। কিন্তু যেদিন তাকে বেশ্যা বলে অধিকারে পেতে চেয়েছিল সেদিন আর বাধা দেয়নি। প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, সে শুধু একাই নষ্ট হবে কেন! আর সেদিন হতে আহসান সাহেবের যৌন সঙ্গী হতে যেমন কোন সংকোচ হয়নি, তেমনি তার পুত্রের বিকৃত কামলালসাও পূরণ করেছে কোন রকম দ্বিধা ছাড়াই। স্বামী-সন্তানের স্খলন নয়, মুন ভিলার মর্যাদা রক্ষার জন্য এক ভয়ঙ্কর পথ বেছে নিতে যাচ্ছিল হাসনা বানু। যে মুন ভিলা হয়ে উঠেছিল পাপের স্বর্গ! মা চলে গেলেই বাবুকে নিয়ে রুমে দরোজা দিত ডেউজি। বাইরে থেকে শোনা যেত তাদের ডিসকো নাচের শব্দ।
মুন ভিলা কি অপূর্বই না ছিল বাড়িটা। ওবাড়ি তার আগেই ছাড়া উচিত ছিল। এখন আর এ কথা ভেবে কোন লাভ নেই। বাড়ি পৌঁছুতে ভোর হবে।
এত সকালে তাকে দেখে বাড়ির সবাই নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যাবে। সে কিছু না বললেও, এই পুটলিটাই বলে দিবে সব। একবার মনে হয় পুটলিটা সে ফেলে দেয় জানালা গলিয়ে। আর পর মুহূর্তেই আঁকড়ে ধরে সেটা।
‘তুমি নেবে?’
রাহেলাকে জিজ্ঞেস করে আখতার সাহেব। রাহেলা এক-দুটো নেয়। কি মনে করে আখতার সাহেব সব কটাই কিনে ফেলে। রাহেলাকে রঙবেরঙের ঝিনুকের মালায় সাজালে এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের সৃষ্টি হবে। আদিম কালের কোন নারী। আফ্রিকান অনেক উপজাতির মধ্যে তিনি নারীদের এমন সজ্জায় দেখেছেন। রাহেলাকে নিয়ে কক্সবাজারে এই প্রথম এসেছেন আখতার সাহেব। তবে নিজে তিনি বহুবার এসেছেন, আর তা সস্ত্রীক। বিয়ের প্রথম দিকে জীবনের সেই উচ্ছল দিনগুলোতে দু’হাতে আনন্দ লুটে নিতে ইচ্ছে হতো। স্ত্রী হাসনা বানুকে নিয়ে কত জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, চাকরির সুবাদে বিদেশেও গেছেন, থেকেছেন তারকাখচিত সব হোটেলে আর রিসোর্টগুলোতে। সূর্যস্নান, জলকেলিÑ কত কিছু করেছেন বিদেশীদের মতো। শুধু ব্রা-বা বিকিনি পরে একপাল বিদেশীর চোখের সামনে সি বিচে চোখ বুজে শুয়ে থাকা, কি হোটেলের সুইমিং পুলে সাতার কাটতে হাসনা বানুর রুচিতে বাধতো। বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, তার সংস্কার কি আর সহজে যায়! সে যতই না উচ্চ শিক্ষিত হোক, তাদের আদর্শ তো সেই অশিক্ষিত মা-দাদিরাই। আখতার সাহেব অনুযোগ করেছেন, রাগ করেছেন, না-স্ত্রীর মনোভাব পাল্টানো যায়নি। পাপ! কিসের পাপ! আদম-হাওয়া বেহেশতে উদোম ছিলেন, উদোম! বুঝলে’Ñ এ সব কথা বলেও কোন কাজ হয়নি।
শেষে বিরক্ত হয়ে বলেছেন, ‘তোমাকে নিয়ে আর কোথাও আসব না।’ হাসনা বানু আসতেও চাননি আর, সংসার করেছেন, সন্তানের জনম দিয়েছেন, তাদের প্রতিপালন করেছেন, আর এ সবেই ছিল তার আনন্দ। আখতার সাহেবের স্বপ্নের জগত ফিকে আর বিবর্ণই থেকে গেছে। তাঁর চোখের তিয়াস মেটেনি, মেটেনি দেহ-মনের তৃষ্ণাও। আজ এই ষাটোর্র্ধ্ব বয়সে, রূপতৃষ্ণা আর দেহ-মনের অতৃপ্তি তাঁকে এতটাই বিক্ষুব্ধ আর বুভুক্ষু করে তুলেছে যে, এর বিনিময়ে আত্মা বিক্রি করতেও রাজি আছেন তিনি। আর তাই লুপ্ত যৌবন ফেরাবার তাগাদা থেকে, নানা উত্তেজক জিনিস সংগ্রহ করেন। না, তাঁকে কষ্ট করে এসব জিনিস সংগ্রহ করতে হয় না; এক সময়ের ডাকসাইটে আমলা তিনি, কতজন এসব নিজে থেকে দিয়ে যায়। আর রাজার কোন অপরাধ নেই এ কথা তিনি ভালই জানেন। ড্রেসিং টেবিলের সামনে অনেক সময় নিয়ে সাজে রাহেলা, নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখে, দেখে মুগ্ধ হয়। হাসনা বানু এতটা বয়সেও নানাভাবে সাজে দামি শাড়ি, জড়োয়া গহনা পরে, ভালই লাগে; কিন্তু প্রসাধন মেখে কি আর বয়স ঢাকা যায়! একরাশ বেলিফুল পড়ে আছে, আখতার সাহেব কোথা থেকে যেন এসেছেন। রাহেলা ফুলগুলো খোঁপায় জড়িয়ে নেয়। নীল রঙের শাড়ি ব্লাউজ, সায়া ম্যাচ করে পরে। ঠোঁটে, চোখের পাতায় আলতো করে লাগায় নীলরঙ! আবার আয়নায় নিজেকে দেখে। যেন সমুদ্র আছড়ে পড়েছে তার সর্বাঙ্গে। ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে, ‘আখতার খালু দেখে মুগ্ধ হবে।’ নিজের ভাবনায় চমকে ওঠে রাহেলা। এসব কি ভাবছে সে, কিন্তু আর কি সম্বোধন করা যেতে পারে বহু ভেবেও তা স্থির করতে পেরে না উঠলে, সর্বাঙ্গে বৃশ্চিকের জ্বালা কি উত্তাপ পেতে থাকে। কিন্তু পর মুহূর্তে নিজের ওপর ফুঁসে ওঠে, সে নারী, এক রূপমুগ্ধ পুরুষ তাকে আবিষ্কার করেছে; তাকে সে তৃপ্ত করবে। তাদের সম্পর্ক নারী-পুরুষের সম্পর্ক। সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে স্নিগ্ধ নীল আলো। রাহেলা দাঁড়িয়ে আছে, যেন সমুদ্রের নীল জল ঠেলে উঠে এসেছে ভেনাস! আখতার সাহেব অপলক চোখে তাকিয়ে থাকেন। দেখে বুঝি আশ মেটে না।
‘হ্যাঁ, তুমি আমার ভেনাস!’
বত্তি চেলির নগ্ন ভেনাস! না, সে তো কেবল ছবি, কল্পনামাত্র। আমি ভেনাসকে জীবন্ত দেখতে চাই। এক এক করে সব কিছু খসে পড়ে রাহেলার শরীর থেকে; আখতার সাহেব তখন স্বর্গের সেই অনাস্বাদিত ফলের জন্য কাতর হয়ে উঠেছেন। স্বর্গ উদ্যানের সেই প্রথম সীমা লঙ্ঘনকারীর ব্যথা কি আনন্দ নিজ অন্তরে অনুভব করতে পারেন বিমুগ্ধতায়।
সন্ধ্যা উতরে গেছে অনেক আগেই। বাইরে অন্ধকার তখন জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছিল। অন্ধকারে চোখ মেলে দিয়ে বসে আছে রাহেলা, আর তখন তার আর একবার ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল ‘মাতৃজঠরে! ঝোপঝাড়গুলো দেখে মনে হয়, কালো লোমশ কোন জন্ত অদ্ভুত ঠা-া চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে; কিন্তু রাহেলা কাঁপে না। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যত! ভীতি আর উৎকণ্ঠায় কণ্ঠনালী শুকিয়ে আসতে চায়; বার বার ঢোক গেলে; অস্থির হাতে পানির বোতলের মুখ খুলে দীর্ঘ চুমুকে নিঃশেষ করে বোতলটি। একটুখানি সুস্থির হয়।
নাইট কোচটি শাঁ-শাঁ করে এগিয়ে চলেছে। পাছে যাত্রীদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে এ জন্য ড্রাইভার মাথার ওপরকার উজ্জ্বল আলোটি নিভিয়ে দেন। সাইডের ডিম লাইটটি জ্বালিয়ে দিলে গাড়ির ভেতর অপূর্ব স্নিগ্ধ নীল আলো ছড়িয়ে পড়ে। আর তখন কেঁপে ওঠে রাহেলা। তার রক্ত হিম হয়ে আসে। সমুদ্র গর্জন, শিশিরপাতের শব্দ-গন্ধ তাকে বুঝি পাগল করে দেয়।
পিঠে তপ্ত নিঃশ্বাস অনুভব করে, আর তা জ্বালাকর মনে হয়। রাহেলার কান্না পায় কিন্তু কাঁদতে পারে না।
স্বপ্নের এই শহর ছেড়ে আজ তাকে পালিয়ে যেতে হচ্ছে। অথচ এই শহরে একদিন সে এসেছিল কত না স্বপ্ন নিয়ে। আসা-যাওয়ার দিন দুটোর কতই না তফাত! এ শহরে যেদিন সে প্রথম আসে সেদিন তার হাতে ছিল মেহেদির রঙ। আর আজ যখন সে শহর ছেড়ে যাচ্ছে তখন তার সেই হাত দুটোই খুনের রক্তে রঞ্জিত।
রাহেলা চমকে উঠে হাতের দিকে তাকায়। হাত দুটো ধোয়া-মোছা, পরিষ্কার। সে আশ্বস্ত হয়। কিন্তু পরমুহূর্তে আর কিছু ভেবে বিচলিত হয়। কাল পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হবে; জোড়া খুনের আসামি-পুলিশ তাকে খুঁজবে; কে জানে আজকেই তারা খুঁজতে শুরু করেছে কিনা! বাড়ি যাওয়া নিরাপদ হবে না, গ্রামের বাড়িতেই প্রথম খোঁজ করবে পুলিশ। আর জানাজানি হলে গ্রামের লোকজন তাকে কোন চোখে দেখবে। বলবে, ‘ওই যে রহিম বখশের মাইয়া জোড়া খুন কইরা আইছে।’
যমুনার চরে দূর সম্পর্কের এক বোন আছে এখন তার বাড়িতেই আত্মগোপন করে থাকতে হবে। তবে দীর্ঘকাল আত্মগোপন করে কি আর থাকা যাবে? এ কি রুল করল সে। আর তখন দৈবের আশ্রয় নিয়ে আশ্বস্ত হতে চায়। পুলিশ তাকে সন্দেহ নাও করতে পারে। রক্ত মাখা মেঝে, জামা-কাপড় সব কিছু পরিষ্কার করে এসেছে, এমনকি খুনের জন্য ব্যবহার করা সেই বঁটিটি পর্যন্ত। খোদাকে স্মরণ করে, তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চায়।
বাসা থেকে বের হবার সময় বুড়ো দারোয়ান তাকে দেখেছে, তবে সে কোন সন্দেহ করে নাই, করলে তার হাতের পোটলা খুলে দেখত। একটু শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কই যাও।’
সে কথার উত্তরে রাহেলা হেসে জানিয়ে ছিল, ‘বুনের বাড়ি বেড়াইতে যাইতাছি।’
এখন মনে হচ্ছে এটা বলাটাও ভুল হয়ে গেছে। পুলিশের কাছে দারোয়ান কথাটা বলবে।
মাথা ঠিক রেখে এখন একটু ভাবার চেষ্টা করে রাহেলা। খুন দুটো না করলে তাকে পালাতে হতো না, আর তার নিরাপত্তা বিঘিœত হতো না। পালিয়ে যে শেষ রক্ষা হবে না তাও বুঝতে পারে না। কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছিল তার। মায়ের কথাই মনে পড়ছিল বার বার। ডেইজি, আহা! কী প্রাণবন্তুই না ছিল সে। হাসনা বানুর একমাত্র মেয়ে, মায়ের মতোই ছিল দেখতে, সুশ্রী আর মিষ্টি; চেহারার আর তার ভেতরটা? বড় লোকের মেয়ে, গরীব মানুষদের সে মানুষই মনে করত না। ছেলে বন্ধুদের নিয়ে বাড়িতে পার্টি দিত, নেশা করত, কত রকমের নেশার জিনিস তাকে খেতে দেখেছে। বিদেশী ব্যান্ডের তালে তালে নাচত আর এক সময় শরীর থেকে একে একে খসে পড়ত সব, দেখে মনে হতো বুঝি পাতা ঝরা শীতার্ত বৃক্ষ! ডেইজিকে এ দেশের মানুষ বলেই কখনও মনে হয়নি রাহেলার। আর শুধু ডেইজি একাই তো নয়, এমন অনেককে সে দেখছে এবং পরে এসব দোষের কিছুও বলে মনে হয়নি। চুলোয় যাক ডেইজির ভাবনা। নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে ওঠে রাহেলা। কেন সে খুন করতে গেল তাকে! আর খুন করা কি সত্যই আবশ্যক কিছু ছিল? হঠাৎ উত্তেজনা বশে সে খুনটা করে, যা সে না করলেও পারত; তবে এও ঠিক ডেইজির ওপর আক্রোশ ছিল তার; আক্রোশ ছিল হাসনা বানুরও ওপর; আর প্রকৃত খুনটা সে করতে চেয়েছিল তাকেই। দিনের পর দিন কি নির্মম অত্যাচারই না করেছে মা-মেয়ে তার ওপর! উঠতে বসতে শুনতে হয়েছে গঞ্জনা, আর এ জন্য অনেক সময় মাথা বিগড়ে যেত তার। হাসনা বানুকে খালা ডাকত রাহেলা, আর সে সম্বোধনও ঠিক করে দিয়েছিল হাসনা বানু নিজেই। খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল সে! কিন্তু দুটো খেয়ে পরে বাঁচাই যে সব নয়, এ কথা সে বুঝতে পেরেছিল, আর তা তাকে শিখিয়েছিল এই শহর। আলো ঝলমল এ শহর; চারদিকে এত আলো, সেই বা তবে কেন আঁধার পড়ে থাকবে।
কতটা কতটা অত্যাচার করা হয়েছিল তার ওপর। কতবার তাকে ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছিল; তবে দেহের সে ক্ষত মিলিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মনের ক্ষত শুকায়নি।
হাসনা বানু প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করত তাকে, যদিও তার বোঝা উচিত ছিল, একজন কাজের মেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষমতা রাখে না; আর যদি তাই হয় তবে সে সুযোগটাও করে দিয়েছিল সে নিজেই। নিজের স্বামীকে কোনদিন বোঝার চেষ্টা করেনি হাসনা বানু, একটি গ-ীর মধ্যেই বাস করে গেল সারা জীবন। অত্যন্ত ছক বাঁধা সে জীবন; কলেজে পড়িয়েছে, অবসরে সাজ-সজ্জা করেছে। হাসনা বানু সাজতে বড় ভালবাসত, নিমন্ত্রণ রক্ষা আর পার্টিতে যেত বেশ ঘটা করে সেজে। কিন্তু স্বামীর জন্য তাকে কখনো সাজতে দেখেনি রাহেলা। কত সময় তাকে করুণা করতে ইচ্ছে হয়েছে। এতটা সাহস সে পেয়েছিল কোথা থেকে, এখন সে কথা ভেবে অবাক হয় রাহেলা। কিন্তু সে তো ছিল একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত নারী! তাকে সবাই শুধু অপমান করেছে। আর তার নারিত্বের অপমান! রাহেলার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, তোমাদের মতো এই ভাল মানুষগুলোকে আমি চিনি; হ্যাঁ আমি চিনেছি। কিন্তু আমার কথা তো কেউ শুনবে না। সমাজ তাকে দোষী সাব্যস্ত করবে। তার দোষটাই চোখে পড়বে সবার।
বাসা থেকে এক কাপড়ে বের হতে চেয়েছিল, আর তখন মনে হয়েছিল ভবিষ্যতের চিন্তা। বাঁচতে হলে টাকা পয়সার দরকার হবে।
এতটা মনের জোর থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় বেরিয়ে মনে হয়েছিল, গোটা শহরের লোকজন বুঝি জেনে গেছে সে জোড়াখুন করে এসেছে। পুলিশের গাড়ি দেখলেই বুকে কাঁপন ধরে যেত, গলা শুকিয়ে আসত। মাত্র ঘণ্টা দুয়ের ব্যবধানে দুটো খুন। এতটা মনের জোর কিভাবে পেল সে। কেন রাগ সামাল দিতে পারে নাই?
নিজের ওপর রাগে, দুঃখে মাথা কুটতে ইচ্ছে করে রাহেলার। খুনের যৌক্তিকতা নিয়ে নানা কিছু ভাবে, হাসনা বানুকে খুন করতে হয়েছিল নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে। না হলে সে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিত। হাসনা বানু তখন কলেজ থেকে ফিরেছিল, প্রতিদিনের দুপুরের খাবার মা-মেয়ে এক সাথে খেত। হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং রুমের দিকে যেতে যেতে রাহেলাকে সে টেবিলে ভাত দিতে বলে। তারপর মেয়ের খোঁজ নেয়। মেয়ের সাড়া শব্দ না পেয়ে বেশ কয়েকবার নাম ধরে ডাকে। আর এ সময় তার নজর যায় মেঝের ওপর। কী দেখেছিল মেঝেতে কে জানে? চিৎকার করে উঠেছিল, রাক্ষুসী! তুই আমার ডেইজিকে খুন করেছিস?’
তেড়ে এসেছিল, তোকে আমি ছাড়বো না। খুন করব তোকে। পুলিশে দেব।’
উত্তেজিত হয়ে হাসনা বানু শোবার ঘরের দিকে ছুটে যাচ্ছিল তখন, রাহেলার বুঝতে বাকি থাকেনি, হাসনা খালা টেলিফোন করতে যাচ্ছে। আর এক মুহূর্তও নষ্ট করা যাবে না, রাহেলা কিচেন থেকে বঁটি-দা খানা নিয়ে এসেছিল, আর হাসনা বানু কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ঘাড়ের পেছনে কোপ বসিয়ে দিয়েছিল। হাসনা বানু ভয়ে, বিস্ময়ে অদ্ভুত চোখে তাকিয়েছিল, একবার প্রতিরোধের চেষ্টাও করেছিল। রাহেলা তুই!’ মাত্র এই একটি কথাই উচ্চারণ করতে পেরেছিল সে। হাসনা বানুকে এলোপাতাড়ি কুপিয়েছিল রাহেলা। দ্রুত কাজ শেষ করতে চেয়েছিল সে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। জবাই করা পশুর মতো হাসনা বানু গোঙাচ্ছিল তখন। কিছুটা বিচলিত হয়েছিল রাহেলা। পর মুহূর্তে সামলে নিয়েছিল নিজেকে। ঠা-া মাথায় করেছিল সব, মেঝে ধুয়ে-মুছে সাফ করেছিল, রক্তাক্ত জামা কাপড় পরিষ্কার করেছিল। লাশ দুটো খাটের নিচে লুকিয়ে ফেলেছিল। অনেক সময় নিয়ে গোসল করেছিল। তারপর নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিল। বাসায় সে ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউ নেই। আহসান ভাই ফিরবে অনেক রাত করে।
আহসান আখতার হাসনা বানুর একমাত্র ছেলে। মা-বোনকে দেখতে না পেয়ে অবাক হয়ে খোঁজাখুঁজি করবে। আর মা-বোনের লাশ দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়বে।
প্রথমে হয়ত চিটাগাংয়ে বাবার কাছে ফোন করবে। ছেলের ফোন পেয়ে, মেয়ে-বউয়ের মৃত্যুর সে সংবাদ শুনে কেমন অবস্থা হবে আখতার খালুর? শোকে-দুঃখে পাগল হয়ে যাবে? তাই তো হওয়া উচিত! অথচ রাহেলা তো জানে, স্বামী হিসেবে কতটা অবিশ্বাসী মানুষটা। কত সময় স্ত্রীর মৃত্যু কামনা করেছে।
এ কথা ঠিক, রাহেলার ওপর সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। পুলিশকে কি বলবে না, রাহেলা খারাপ চরিত্রের মেয়ে মানুষ। আর এমন একজন স্ত্রী লোকের পক্ষে খুন-ডাকাতি কত কিছু করা সম্ভব। আখতার খালু কি তাকে ঘৃণা করবে? তাও করবে নিশ্চয়! কথাটা ভেবে হাসি পায় রাহেলার। ঘৃণা করে কত কিছু শোনাবে লোকজনকে, সমাজকে।
একবারও কি তার কথা ভেবে বিচলিত হবে, দুঃখ করবে আখতার খালু? না, করবে না। সে তো কেবল তার শরীরটাই চেয়েছিল আর কিছু তো চায়নি। আর সেও তো শুধু শরীরই দিয়েছিল, তাও নিজের ইচ্ছায় নয়, একটুখানি স্বচ্ছলতার আশায়।
পাশের সিটের মহিলা ঘুমন্ত বাচ্চাকে খাবার জন্য পীড়াপীড়ি করছে। তখনও ঘুমের রেশ কাটেনি বলে শিশুটি বার বার ঢুলে ঢুলে পড়ছে। সারারাত না খেয়ে কষ্ট পাবে ছেলে, এ জন্যই মায়ের এত সাধাসাধি। শৈশবের কথা মনে পড়ে; হাট থেকে ফিরতে বাপের রাত হয়ে যেত, আর বাপের অপেক্ষায় থেকে তারা ভাই-বোন দুটি ঘুমিয়ে পড়ত। মা-তখন এভাবেই তাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে খাওয়াতো। মেয়ে খুন করে এসেছে এখন একথা শুনে তার বাপ-মায়ের অবস্থা কেমন হবে। তারাও কি ঘৃণা করবে তাকে। বাপ যে তাকে ঘৃণা করবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। মেয়ে এত বেশি টাকা কি করে পায়, কি ভাবে দেয় এ নিয়ে বাপ তাকে সন্দেহ করত। অনেক সময় প্রতিবাদ করে বলেছে, ‘এইডা তর পাপের কামাই! তর পাপের কামাই খাইয়া দোযখে যাবার কস!’
বাপের কথা শুনে দুঃখ পেয়েছে, নিজেকে হীন আর ছোট মনেও হয়েছে। কিন্তু পর মুহূর্তে মনে মনে জ্বলে উঠেছে। ‘পাপের কামাই! সারা জীবন পুণ্য করে তুমি কি পাইছো?’ না সে কথা বাপকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি। মা-ভাই তার অর্থ-কড়ি গ্রহণ করেছে অম্লান বদনে। লোভে দু’চোখ তাদের চকচক করে উঠতে দেখেছে। চিরকাল মানুষের অবহেলা আর ঘৃণা কুড়িয়ে বাঁচা, এই বাঁচা কি বাঁচা গো! মা-ভাইয়ের আর দোষ কি! কিন্তু এখন তাকে সেই মা-ভাই তাকে কোন চোখে দেখবে কে জানে! রাহেলার মনে হয়, এ মুহূর্তেই সে ছুটে গিয়ে তাদের মনোভাব জেনে আসে।
সারাদিন কিছু মুখে দেওয়া হয়নি, এখন বেশ ক্ষুধা পাচ্ছে। বাসে ওঠার আগে রুটি-কলা কিনেছিল, ব্যাগ থেকে রুটি কলা বের করে রাহেলা। একবার একটুখানি ছিঁড়ে মুখে দেয়, তারপর ছুড়ে ফেরে দিয়ে ঢকঢক করে পানি খায়।
বাবুকে দিয়ে তাকে খুন করাতে চেয়েছিল হাসনা বানু; আর সে চক্রান্তটি ছিল ডেইজির। বাবুকে সেই বলেছিল, ‘বাবু আমার অনুরোধ তোমাকে আমার একটি কাজ করে দিতে হবে। রাহেলা এই নষ্টা মেয়ে মানুষটাকে যে কোন উপায়ে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। আমাদের ফ্যামিলির প্রেস্টিজের কথা ভেবেই তা করতে হবে। ও-আমার ড্যাডকে নষ্ট করেছে।
আর এ জন্য যা চাও তা পাবে।
বলে বড় অর্থপূর্ণ হাসি হেসেছিল ডেইজি। কথাটা স্পষ্টই শুনতে পেরেছিল রাহেলা। সে তখন বাবুর জন্য চা নিয়ে ফিরছিল। বাবু ডেইজির গালে টোকা দিয়ে বলেছিল, ‘তোমাকে পেলে এ আর আমার জন্য কঠিন কাজ কি!’
ধনী শিল্পপতির সন্তান বাবু, তার ওপর রাজনীতি করে। সত্যই তো তার কাছে অসাধ্য বলে কি কিছু আছে। ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাহেলা। হাত থেকে কাপপিরিচ পড়ে ভেঙে যায়, আর তাতে আরও ক্ষিপ্ত হয় দু’জন। বাবু তাকে লাথি-গুঁতো মারে, বেদম প্রহার করে, আর সিগারেটের আগুন দিয়ে শরীরের নানা স্থানে ক্ষত সৃষ্টি করে। এতটা করেও সে শান্ত হয়নি, ডেইজির সামনে তাকে উলঙ্গ করে তার নিম্নাঙ্গেও ক্ষতি করে। আর উল্লাসে ফেটে পড়ে ডেইজি; হ্যাঁ ওটাই কর; ওটাই তো ওর নষ্টামির মূলধন।
আর সে মুহূর্তে দেহের যন্ত্রণার চাইতে মনের যন্ত্রণাই হয়েছিল বেশি। রাহেলা বুঝি পাগল হয়ে উঠেছিল। ‘নষ্টা, কুলটাÑশব্দগুলো বড় অস্থির করে তুলেছিল তাকে। বাবু বেরিয়ে যেতেই পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিল কিচেনে। বঁটি-দা খানাই নজরে এসেছিল প্রথমে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডেইজির ওপর চড়াও হয়েছিল সে। কোপ দিয়েছিল ঘাড়ে, পেটে। পেট চিড়ে নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে পড়ে। আর ফিনকি দিয়ে ছোটে রক্ত। একবার একটুখানি হাতও কাঁপেনি তার। এখন এ কথা ভেবে সে অবাক হয়, এতটা সাহস সে কিভাবে পেয়েছিল!
সাথে করে আনা কাপড়ের পোটলাটি কোলের ওপর থেকে নামিয়ে পায়ের কাছে রাখে, আবার কি মনে করে সেটা কোলের ওপর তুলে আনে। পোটলাটায় কম কিছু নাই, নগদ লক্ষাধিক টাকা ছাড়াও, হাসনা বানুর সব গহনা আর কয়েকটি দামি শাড়ি আছে। পোটলাটা কেউ হাতিয়ে দেখলেই সে ধরা পড়ে যাবে। এখন কে আর তা দেখতে আসছে। পাশের মহিলাটি অকাতরে ঘুমুচ্ছে, সে দিকে তাকিয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় রাহেলা। এসব সে এনেছে কার জন্য? ভাইকে দিবে! না, নিজের জন্যই লাগবে। ধরা না পড়লে, সে একটুখানি জমি কিনে বাড়ি করবে। ছোটখাটো একটা দোকানও দিবে। আবার নতুন করে তো সংসারও পেতে পারে সে। জমি-বাড়ি, দোকানÑএত কিছু পেলে কতজন তাকে বিয়ে করতে রাজি হবে। আর তার সেই স্বামী যে তাকে বিনা দোষ তালাক দিয়েছিল, সেও তাকে নিতে চাইবে এখন। ভবিষ্যতের একটুখানি সুখের ছবি আঁকতে চাইলেও, তা স্থায়ী হয় না। দূর সম্পর্কের যে বোনের বাড়িতে সে আশ্রয় নিতে যাচ্ছে সেখানে সে কতটা নিরাপদ? বোন-বোনের জামাই টাকা-আর অলংকারের লোভেই ধরিয়ে দিবে তাকে।
হাসনা বানুর সাড়ে তিন ভরি ওজনের সোনার হারটি গলায় শৃঙ্খলের মতো চেপে বসে রাহেলার। এক সময় ওটা পাবার জন্য কত না লোভ হতো তার! ক্ষুধার্ত ককুরের মতো তাকিয়ে থাকত, হাসনা বানু যখন ওটা পরে সাজতে বসত। হারটি বড় প্রিয় ছিল হাসনা খালার! নিজের অজান্তেই ছোট একটা শ্বাস ফেলে রাহেলা। তারপর সিদ্ধান্ত পাল্টায় আগে বাড়িতেই যাবে, মা-ভাইয়ের কাছে জিনিসগুলো রেখে তারপর অন্য কোথাও যাবে। রাতারাতি নিশ্চিয় পুলিশ তাকে খুঁজবে না।
পাশের মহিলাটি কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। সুখ আর পরিতৃপ্তির ছোঁয়া তার সর্ব অবয়বে। কেমন সাধারণ একখানা শাড়ি পরেছে, গলায় সরু একখানা চেন, কানের মটর দানা দুটোও ছোট। বোঝাই যায়, ধনী পরিবারের কেউ নয়। হয়ত স্বামী ছোটখাটো কোন ব্যবসা বা চাকরি করে তারপরও মেয়েটা যে সুখী তা বোঝা যায়। তার জীবনও কি আর অমন কিছু হতে পারত না! তার জন্মের জন্য কে দায়ী? তার বাপ! না-তার অদৃষ্ট! খোদাতালা! গরীব বাপের ঘরে দু-সন্ধ্যা পেট পুরে খেতে পারেনি, অর্থলোভী স্বামী যৌতুকের জন্য কত অত্যাচার করেছে তার ওপর। আর তার নারিত্বের চরম অবমাননা করেছে আখতার খালু, আর যে কিনা এ দেশের সমাজের সব থেকে সম্মানিত মানুষদের একজন। সরকারের বড় চাকুরে, ধনী, শহরের অভিজাত মানুষ। আর তো সেই শুধু নয়, তার ছেলে, হ্যাঁ একমাত্র ছেলে। উচ্চশিক্ষিত, ইঞ্জিনিয়ার বড় চাকুরে।
পিতা-পুত্র একই দেহে পরিতৃপ্ত হতে চেয়েছে। পিতা-পুত্রকে এক সাথে গ্রহণ করতে মনের সায় পায়নি রাহেলা, সে বাধা দিয়েছে, আর ক্ষেপে উঠেছে আহসান।
কী কারণ?
রাহেলা নিশ্চুপ থেকেছে; কী বলবে সে, যে কথা বলার মতো নয়।
‘পুতের মতো! না-কথাটা মুখ ফুটে বলা যায়নি, অথচ বুক ফেটে গেছে তার।
‘ও, বুঝেছি বাবা তোমার কাছে আসে এ জন্য! তুমি তো একটা বেশ্যা! তোমার আবার বাপ-ছেলে কি!’ লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছে তখন। কিন্তু পর মুহূর্তে জেদ চেপে বসেছে; হ্যাঁ, বেশ্যাই যখন তখন বাপ-ছেলে দু’জনকেই সে মজিয়ে ছাড়বে।
রাহেলার প্রতি স্বামী-পুত্রের এই অবৈধ আসক্তির কথা হাসনা বানুর অজানা ছিল না। অনেক সময় রিডিং রুমে রাত কাটাতেন আখতার সাহেব। আর গভীর রাতে সে রুমে রাহেলার উপস্থিতি দেখে হয়ত অবাক হতো, কষ্ট হতো, আর ঘৃণাও করত নিশ্চয়; কিন্তু তারপরেও স্বামীকে সে কিছু বলত না, একটুখানি তিরস্কারও নয়। অথচ এ জন্য রাহেলাকেই এককভাবে দায়ী করত সে। এবং অত্যাচারও। পুরুষের তৃষ্ণার্ত শরীর মন যে পড়তে জানে না, সে আবার কেমন মেয়ে মানুষ! হাসনা বানুকে মনে মনে বিদ্রƒপ করেছে রাহেলা। সে কেন ফিরিয়ে দিবে, একজন সক্ষম নারী হয়ে ফিরিয়ে দেওয়াই হতো তার ব্যর্থতা! লোভ আর স্বার্থপরতা তাকে এগিয়ে দিয়েছিল আরও বেশি করে। ভাইকে একটা দোকান করে দেওয়া, বাপ-মায়ের মাথা গোঁজার ভাল একটু ব্যবস্থা করা এই তো চেয়েছিল সে। না, এর থেকে বেশি কিছু সে চায়নি। হাসনা বানু তাকে হিংসে করতে শুরু করেছিল, তাহলে সে কি তাকে প্রতিপক্ষ বলে ভাবত। আখতার সাহেবের কাছে স্ত্রীর কোন প্রয়োজনীয়তা আর ছিল না, আর এই সুযোগটাই নিয়েছিল রাহেলা। মা-আর ভাইয়েকে সে মুঠো ভরেই দিতে পেরেছিল। কিন্তু খুন করে এসেছে শুনে যদি তারা আশ্রয় না দেয়! এখন সব কিছুই ভুল মনে হয় রাহেলার কার জন্য কি করেছে সে! আর কেনই বা করেছিল। যে গ্রামে যে সমাজে জন্ম তার, সেখানে মেয়েরা বড় হয় অবহেলায়; আর একটু বয়সে হলেই বাপ মা বিয়ে দিয়ে বিদেয় করে। তারপর একগাদা সন্তান-সন্তুতি প্রতি পালন করতে করতেই বুড়িয়ে যেতে হয়। কোন সুখ নেই, আহ্লাদ নেই, বড় বিবর্ণ, পানসে জীবন! আর কী এক বেপরোয়া জীনকেই না চিনেছিল শহরে এসে। এরা যে শুধু বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায়, তা নয়, নিজেরাও চলে ওভাবেই। একদিন ডেইজি তার জন্মদাগ দেখতে চেয়েছিল। লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারে রাহেলা, সে কথা শুনে। আর তাকে অবাক করে দিয়ে, তার সামনে উদোম হয়েছিল ডেইজি। ‘দেখো এই আমার জন্ম দাগ’।
তারপর রাহেলার মুখ তুলে ধরে বলেছিল, ‘এত কি লজ্জা তোর। মেয়ে মানুষের সামনে মেয়ে মানুষের কাপড় খুলতে আবার লজ্জা কিরে!’
তোর তো বিয়ে হয়েছিল, একজন পুরুষের সামনে তুই কাপড় খুলিস নাই?
সেদিন ডেইজিকে তার পাগল মনে হয়েছিল। বড় লোকের মেয়ের পাগলামি!
অল্প দিনেই বুঝতে পেরেছিল, ডেইজি মাদকাসক্ত, আর যৌন বিকারগ্রস্ত। কী সব ট্যাবলেট খেয়ে নেশা করত সে। পার্টির নামে বন্ধুদের নিয়ে মদ-মাংসের আড্ডা বসত, আর তা পরিণত হতো বেলেল্লাপনায়। প্রতিরাতে মাতাল হয়ে ফিরত আহসান ভাই। তাই মনে কী যেন এক কষ্ট ছিল। মা-বোনকে সে সহ্য করতে পারত না। ছেলের আচরণে ক্ষুব্ধ ছিল হাসনা বানু। ফলে আহসান ভাইয়ের জন্য ভাত-তরকারি বেড়ে বসে থাকতে হতো রাহেলার নিজেকেই। তার জন্য ভাত-তরকারি গরম করে দেওয়া, বালিশ-বিছানা ঠিক করে দেওয়া সব কিছু করতে হতো তাকে। কোন কোন রাতে বেশি করে বেসামাল হয়ে ফিরলে, তাকে সামলাতে হাতে। আর এভাবেই আহসানের সাথে জড়িয়ে যায় সে। বেহুঁস অবস্থায় কত সময় কাছে টানার চেষ্টা করেছে। আহসান; কিন্তু নিজেকে সঁপে দিতে মনের সায় পায়নি রাহেলা। কিন্তু যেদিন তাকে বেশ্যা বলে অধিকারে পেতে চেয়েছিল সেদিন আর বাধা দেয়নি। প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, সে শুধু একাই নষ্ট হবে কেন! আর সেদিন হতে আহসান সাহেবের যৌন সঙ্গী হতে যেমন কোন সংকোচ হয়নি, তেমনি তার পুত্রের বিকৃত কামলালসাও পূরণ করেছে কোন রকম দ্বিধা ছাড়াই। স্বামী-সন্তানের স্খলন নয়, মুন ভিলার মর্যাদা রক্ষার জন্য এক ভয়ঙ্কর পথ বেছে নিতে যাচ্ছিল হাসনা বানু। যে মুন ভিলা হয়ে উঠেছিল পাপের স্বর্গ! মা চলে গেলেই বাবুকে নিয়ে রুমে দরোজা দিত ডেউজি। বাইরে থেকে শোনা যেত তাদের ডিসকো নাচের শব্দ।
মুন ভিলা কি অপূর্বই না ছিল বাড়িটা। ওবাড়ি তার আগেই ছাড়া উচিত ছিল। এখন আর এ কথা ভেবে কোন লাভ নেই। বাড়ি পৌঁছুতে ভোর হবে।
এত সকালে তাকে দেখে বাড়ির সবাই নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যাবে। সে কিছু না বললেও, এই পুটলিটাই বলে দিবে সব। একবার মনে হয় পুটলিটা সে ফেলে দেয় জানালা গলিয়ে। আর পর মুহূর্তেই আঁকড়ে ধরে সেটা।
No comments